আল্লাহ নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন । আল্লাহ গফফার । যাদের বিষয়ে গিবত করেছেন, তাদের কাছে ক্ষমা চাইবেন। যদি এমন ব্যক্তির গীবত করেন যে যাদের কাছ থেকে ক্ষমা নিতে পারবেন না তাহলে শুধু তওবা করলেই যথেষ্ট ।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আল্লাহ অবশ্যই তাদের উপর দয়া করে, যারা অজ্ঞাতবশত পাপ কাজ করল অতঃপর অন্যায় বুঝতে পেরে তওবা করল এবং সে অনুযায়ী নিজেদের সংশোধনও করে নিল। হে নবি, আপনার প্রভু অবশ্যয়ই এরপর তাদের জন্য হবেন ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। ( সুরা আন-নাহল, ১১৯)
আর যাদের ব্যাপারে গীবত করেছেনতাদের কাছে ক্ষমা চান ।
বিস্তারিত দেখুন-
গীবত একটি জঘন্য গুনাহ
ইমাম নববী রহ. জবান থেকে নিঃসৃত গুনাহর আলোচনা শুরু করেছেন। প্রথমেই তিনি
এমন একটি গুনাহের কথা আনলেন যা আমাদের মাঝে ব্যাপক। গুনাহটির নাম গীবত। এটি
জঘন্যতম একটি মহামারি। যার অসভ্য গ্রাস থেকে আমাদের সমাজ মুক্ত নয়।
আমাদের কোনো আলোচনা, কোনো মজলিস এই জঘন্য পাপ থেকে মুক্ত নয়। মহানবী ﷺ
এব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। কোরআন মজিদে গীবত সম্পর্কে
কঠোর শব্দ এসেছে। সম্ভবত এরূপ কোনো শব্দ অন্য কোনো গুনাহ সম্পর্কে উচ্চারিত
হয় নি। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে,
وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ
‘তোমরা একে অপরের গীবত বা পরনিন্দা করো
না। (কারণ একটি জঘন্য পাপ। আপন ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতোই জঘন্য গুনাহ।)
তোমাদের কেউ কি আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করে? (নিশ্চয় তা পছন্দ
করেনা; বরং ভাববে এত বিকৃত কথা!) সুতরাং তোমরা গীবতকেও ঘৃণা করো।’
আয়াতটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নিয়ে ভাবুন। কত কুৎসিত কাজ এই গীবত। একে তো
মানুষের গোশত খাওয়া, তার উপর আপন ভাইয়ের গোশত, তাও আবার মৃত–কতবড় জঘন্য ও
ঘৃণ্য কাজ! অবর্ণনীয় মন্দ কাজ। অনুরূপভাবে গীবতও একটি ঘৃণ্য ও জঘন্য
গুনাহের নাম।
গীবত কাকে বলে?
গীবত অর্থ পরনিন্দা। কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি আলোচনা করা। হতে
পারে দোষটি তার মধ্যে আছে। কিন্তু এই আলোচিত দোষটির কথা শুনলে সে নির্ঘাত
মনে ব্যথা পাবে। তাহলে এটাই গীবত। হাদীস শরীফে এক সাহাবীর কথা এসেছে, যিনি
নবীজী ﷺ-কে প্রশ্ন করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! গীবত কাকে বলে?
নবীজি ﷺ
উত্তরে বলেছিলেন, আপন ভাইয়ের আলোচনা তার পেছনে এমনভাবে করা যা তার নিকট
পছন্দনীয় নয়। অর্থাৎ সে পরবর্তীতে যদি জানতে পারে তার সম্পর্কে অমুক
মজলিসে এ আলোচনা হয়েছে তাহলে মনে কষ্ট পাবে। এটাই গীবত।
সাহাবী পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, আমি যে দোষ নিয়ে আলোচনা করেছি তা যদি সত্যি সত্যি আমার ভাইয়ের মাঝে থাকে?
নবীজি ﷺ উত্তর দিলেন, আসলেই যদি দোষ থাকে তাহলেই গীবত হবে। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার হবে। (আবু দাউদ, বাবলু গীবাত ৪৮৭৪)
লক্ষ্য করুন, আমাদের আলোচনা এবং সভা-সমিতির প্রতি একটু চোখ বুলিয়ে দেখুন।
কত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই মহামারি! আমরা দিবানিশি এই জঘন্য পাপে
আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকি। আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়েত করুন। অনেকে গীবতকে বৈধতার
পোশাক পরাতে চায়। বলে থাকে, আমি গীবত করছি না; বরং আমি কথাটি তার মুখের
উপরও বলে দিতে পারব। সুতরাং এটা তার পেছনেও বলতে পারব। জেনে রাখুন, গীবত
গীবতই। মুখের উপর বলতে পারা আর না পারার বিষয় এখানে বিবেচ্য নয়। কারো
দোষ-ত্রুটি তার অনুপস্থিতিতে আলোচনা করলেই তার গীবত হবে। যা একটি কবিরা
গুনাহ; মহাপাপ।
গীবত করাও কবীরা গুনাহ
মদ পান, ডাকাতি এবং ব্যভিচার যেমনিভাবে কবিরা গুনাহ, অনুরূপভাবে গীবতও
কবীরা গুনাহ। কবিরা গুনা হওয়ার দিক থেকে কোনো পার্থক্য এগুলোর মাঝে নেই।
অন্যান্য কবিরা গুনাহর মতোই গীবতও নিঃসন্দেহে একটি হারাম কাজ। যেহেতু এটি
হুকুকুল ইবাদ বা বান্দার হকের সাথে সম্পর্কযুক্ত। হুকুকুল ইবাদ একটি
স্পর্শকাতর বিষয়। যার সম্পর্কে ইসলামের বিধান হল, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মাফ
না করা পর্যন্ত মাফ হবে না। অন্যান্য গুনাহ তাওবার মাধ্যমে মাফ হয়ে যায়।
কিন্তু গীবতের বেলায় শুধু তাওবা যথেষ্ট নয়। বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিও ক্ষমা
করে দিতে হবে। এবার অনুধাবন করুন, গীবত করা কত বড় গুনাহ। আল্লাহর
ওয়াস্তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন যে, কারো গীবত করবো না, কারো গীবত শুনবো না।
কোনো মজলিসে গীবত শুরু হলে আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। অন্য
প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করে দেব। আলোচনার মোড় পাল্টাতে না পারলে মজলিস ছেড়ে
চলে যাব। যেহেতু গীবত করাও হারাম এবং শোনাও হারাম।
গীবতকারী নিজের মুখমণ্ডল খামচাবে
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَمَّا عُرِجَ بِي مَرَرْتُ
بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمِشُونَ وُجُوهَهُمْ
وَصُدُورَهُمْ فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلاَءِ يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَؤُلاَءِ
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ وَيَقَعُونَ فِي أَعْرَاضِهِمْ
সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালিক রাযি. নবীজি ﷺ-এর বিশিষ্ট খাদেম। সুদীর্ঘ দশ বছর নবীজির খেদমত করেছেন। তিনি বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ
বলেছেন, মিরাজ-রজনীতে যখন আমাকে ঊর্ধ্বজগতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন
(জাহান্নাম দেখানোর সময়) আমাকে এমন কিছু লোক দেখানো হয়েছিল, যারা নিজেদের
নখরাঘাতে মুখমণ্ডল ও বক্ষদেশ থেকে রক্ত ঝরাচ্ছিল। আমি জিবরাইল আ.-কে
জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? জিবরাইল আ. বললেন, এরা ঐসব লোক যারা মানুষের গোশত
খেতো অর্থাৎ গীবত করতো। আর মানুষের ইজ্জত-সম্ভ্রমে আঘাত হানত। (আবু দাউদ
৪৮৭৮)
ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য
নবীজি ﷺ
গীবত নামক এ জঘন্যতম গুনাহর কথা সাহাবায়েকেরামের সন্মুখে বিভিন্নভাবে
প্রকাশ করেছেন। এজন্য এই সুবাদে আলোচনা করতে গিয়ে একটি হাদিস সামনে রাখা
প্রয়োজন, যেন এর ভয়াবহতা ও কদর্যতা আমাদের হৃদয়ে বসে যায়। আল্লাহ তাআলা
আপন রহমতে গুনাহটির ভয়াবহতা আমাদের অন্তরে বসিয়ে দিন এবং জঘন্য গুনাহটি
থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দিন। আমিন।
উল্লেখিত হাদীসের মাধ্যমে গীবতের ভয়াবহতা আপনারা নিশ্চয় অনুধাবন করেছেন যে, গীবতকারী আখেরাতে নিজের মুখমণ্ডল খামচাবে।
অপর এক হাদীসে এসেছে, হাদীসটি সনদের দিক থেকে তেমন মজবুত না হলেও অর্থের দিক থেকে বিশুদ্ধ। রসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, গীবতের গুনাহ জিনা-ব্যভিচারের গুনাহর চেয়েও মারাত্মক।
প্রশ্ন হল, এর কারণ কী?
উত্তর হল, আল্লাহ না করুন, যদি কেউ ব্যভিচারের গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায়
তাহলে পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে নিলে আল্লাহ চাহে তো গুনাহটি মাফ
হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে গীবত এমন মারাত্মক গুনাহ যে, গুনাহটির ক্ষমা ততক্ষণ
পর্যন্ত পাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না যার গীবত করেছে সে ক্ষমা করে দেয়।
(মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, বাবুল গীবাত খন্ড ৮ পৃষ্ঠা ৯২)
গীবতকারীকে জান্নাতে প্রবেশে বাধা দেওয়া হবে
নবীজি ﷺ
অন্যত্র বলেছেন, গীবতের গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি দুনিয়ায় বাহ্যিক দৃষ্টিতে
নেককার হবে। নামাজ পড়বে, রোজা রাখবে, অন্যান্য ইবাদতও করবে। কিন্তু
পুলসিরাত পার হওয়ার সময় তারা বাধাগ্রস্থ হবে।
পুলসিরাতের কথা আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন। জাহান্নামের উপর অবস্থিত পুলের নাম
পুলসিরাত। আখেরাতে সকলকেই ওই পুল পাড়ি দিতে হবে। জান্নাতি হলে পুলসিরাত
সহজেই জয় করে নিবে। আর জাহান্নামী হলে তাকে টেনে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া
হবে। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন। গীবতকারীও এরূপ পরিস্থিতির শিকার হবে।
তাদেরকে পুলসিরাত পাড়ি দেয়া থেকে বাধা প্রদান করা হবে। বলা হবে, তোমরা
পুলসিরাত পাড়ি দিতে পারবে না। পাড়ি দিতে হলে গীবতের কাফফারা আদায় করে
যাও। তারপর পাড়ি দাও। গীবতের কাফফারা মানে যাদের গীবত করা হয়েছে, তাদের
থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। তারা ক্ষমা করলে পুলসিরাত পার হতে পারবে,
অন্যথায় নয়।
জঘন্যতম সুদ
এমনকি এক হাদীসে নবী ﷺ
বলেছেন, সুদ একটি মহাপাপ। অসংখ্য গুনাহের সমষ্টি এটি। আল্লাহ আমাদের রক্ষা
করুন। সুদের সবচেয়ে ছোট অপরাধ আপন মায়ের সাথে ব্যভিচার করার মত। লক্ষ্য
করুন, সুদ সম্পর্কে এরূপ কঠোর বাণী উচ্চারিত হয়েছে, অন্য কোন গুনাহের কথা
এত কঠোরভাবে বলা হয় নি। নবীজী ﷺ
বলেন, সেই সুদের মত থেকে সবচাইতে জঘন্য শুধু হলো, অপর মুসলিম ভাইয়ের
মানসন্মানকে আহত করা। অর্থাৎ গীবত করা। (আবু দাউদ, বাবুল গীবাত ৪৮৭৬)
মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া
নবীযুগের দু’জন মহিলার কথা হাদীস শরীফে এসেছে। তারা রোজা রেখেছিল। রোজা
অবস্থায় পরস্পরে গল্পগুজবে লিপ্ত হলো। এক পর্যায়ে অন্যের গীবতও শুরু করে
দিল। ইত্যবসরে এক ব্যক্তি নবীজির দরবারে এসে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল!
দুইজন মহিলা রোজা রেখেছিল। তাদের অবস্থা এখন নিতান্ত নাজুক। পিপাসায় তাদের
কলজে ফেটে যাচ্ছে। হয়তো তারা মারাই যাবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ
সম্ভবত ওহীর মাধ্যমে আগেই জেনেছিলেন যে, মহিলা দু’জন এতক্ষণ পর্যন্ত গীবতে
লিপ্ত ছিল। তিনি বললেন, তাদেরকে আমার নিকট নিয়ে আসো। কথামতো তাদেরকে
নবীজির খেদমতে হাজির করা হলো। নবীজি লক্ষ্য করে দেখলেন, সত্যি সত্যি তারা
মৃতপ্রায়।
নবীজী ﷺ বললেন, একটি বড় পাত্র নিয়ে আসো। পাত্র আনা হলো। নবীজি ﷺ
দু’জন মহিলা থেকে একজনকে নির্দেশ দিলেন, পাত্রটিতে বমি করো। মহিলা যখন বমি
করা শুরু করল, দেখা গেল, এক অবাক কান্ড! বমির সঙ্গে রক্ত-পুঁজ ও গোশত উগলে
পড়ছিল। তারপর দ্বিতীয় মহিলাকেও তিনি একই আদেশ করলেন। দেখা গেল, সেও
রক্ত-পুঁজ ও দুর্গন্ধযুক্ত গোশত বমি করছে। এক পর্যায়ে সম্পূর্ণ পাত্র ভরে
গেল। নবীজি উভয় মহিলাকে লক্ষ্য করে বললেন, এগুলো তোমাদের ভাই,-বোনের
রক্ত-পুঁজ ও গোশত। রোজা অবস্থায় তোমরা এগুলো খেয়েছিলে। অর্থাৎ তাদের গীবত
করেছিলে। রোজা রাখার কারণে তো তোমরা বৈধ খাবারও পরিহার করেছিলে। অথচ হারাম
খাবার তথা গীবতের মাধ্যমে অপর ভাইয়ের রক্ত, পু্ঁজ ও গোশত ভক্ষণ তোমরা
পরিহার করতে পারো নি। এগুলো খেয়ে তোমাদের পেট ভরে গিয়েছিল। ফলে তোমরা আজ এ
দুরাবস্থার শিকার হয়েছিলে। যাও, ভবিষ্যতে কখনো আর গীবত করো না।
উক্ত ঘটনা আমাদের জন্য নিশ্চয়ই শিক্ষাপ্রদ। গীবতের রূপক নমুনাও আল্লাহ মানুষকে দেখালেন। গীবতের পরিণাম কত বীভৎস! কত ভয়াবহ!
একটি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন
বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত রাবঈ রহ. নিজের ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এক
মজলিসে গিয়ে দেখতে পেলাম, লোকজন খোশগল্প করছে। আমিও তাদের সাথে বসে
পড়লাম। গল্প জমে উঠলো। গীবতও শুরু হল। বিষয়টা আমার কাছে ভাল লাগে নি। তাই
আমি উঠে গেলাম। কারণ ইসলামের বিধান হল, মজলিসে গীবত চললে পারলে বাধা দিবে।
না পারলে মজলিস ত্যাগ করে উঠে চলে যাবে। আমি উঠে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর
ভাবলাম, এতক্ষণে হয়তো গীবত শেষ হয়ে গিয়েছে। কারো দোষচর্চা আর চলছে না।
সুতরাং আলোচনায় পুনরায় শরিক হওয়া যায়। এই ভেবে আমি পুনরায় মজলিসে
গিয়ে বসলাম। কিছু সময় এটা সেটা আলোচনা চলল। তারপরেই শুরু হলো গীবত। আমিও
মজা পেয়ে গেলাম। আগ্রহের সঙ্গে তাদের গীবত শুনতে লাগলাম। একপর্যায়ে
নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। দু’চারটে গীবত নিজেও করে ফেললাম। মজলিস শেষে
বাড়িতে ফিরে আসলাম। রাতে ঘুমের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখলাম। এক বীভৎস
কালো লোক আমার জন্য পাত্রে করে গোশত নিয়ে এসেছে। লক্ষ্য করে দেখলাম,
শূকরের গোশত।। লোকটি বলল, এটা শূকরের গোশত, খাও। আমি বললাম, কিভাবে খাবো,
আমি তো মুসলমান? লোকটি বলল, না, ওসব আমি শুনবো না। তোমাকে খেতেই হবে। এই
বলে লোকটা জোর করে আমার মুখে গোশত পুরে দেওয়া শুরু করলো। আমি তার কবল থেকে
নিজেকে বাঁচানোর শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। বমি করতে চাইলাম তবুও রক্ষা
পেলাম না। সে আমার উপর এক নির্মম অত্যাচার করেই যাচ্ছিল। সে কি কষ্ট! এরই
মধ্যে আমার চোখ খুলে গেল। তারপর থেকে আমি যখনই আহার করার জন্য বসতাম,
ঘটনাটি মনে পড়ে যেত। কেমন যেন স্বপ্নের সেই শূকরের গোশতের দুর্গন্ধ আমার
নাকে লাগতো। কি অবস্থা ত্রিশ দিন পর্যন্ত ছিল। খাবার গ্রহণে আমার খুব কষ্ট
হতো।
এই ঘটনা দ্বারা আল্লাহ আমাকে সতর্ক করলেন। কেবল একটি মজলিসের দু-চারটি গীবত
এত ভয়ঙ্কর। দীর্ঘ ত্রিশ দিন পর্যন্ত আমি এই ভয়াবহতার গন্ধ পেয়েছি।
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেককে গীবত করা ও শোনা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
হারাম খাদ্যের কলুষতা
আসলে পরিবেশ দূষিত হয়ে গেছে, ফলে আমাদের বোধশক্তিও নষ্ট হয়ে গেছে। তাই পাপকে এখন আর পাপ মনে হয় না।
হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী রহ. বলেন, একবার একটি দাওয়াতের সন্দেহযুক্ত
কিছু খাবার খেয়ে ফেলেছিলাম। সুদীর্ঘ কয়েক মাস পর্যন্ত এর কলুষতা আমার
অন্তরে অনুভূত হয়েছে। ক্যানন চা খেয়েছিলাম তা হালাল কিনা; সন্দেহ ছিল।
তারপর থেকে বারবার অন্তরে খারাপ চিন্তা আসতো। গুনাহ করার ইচ্ছা জাগতো।
গুনাহের প্রতি আকর্ষণ অনুভব হত।
গুনাহের ফলে এটি। গুনাহ গুনাহকে টানে। প্রতিটি গুনাহ অন্তরকে কদর্য ও
তমসাচ্ছন্ন করে তোলে। ফলে গুনাহর প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। পাপ কাজে ব্রতী
হয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের অনুভূতিকে সুস্থ করে দিন। আমিন।
মোটকথা গীবত খুবই মারাত্মক গুনাহ। আল্লাহ যাকে সুস্থ বিবেক দিয়েছেন, সেই অনুধাবন করতে পারে যে, কত বড় গুনাহতে আমি লিপ্ত।
যেসব ক্ষেত্রে গীবত জায়েজ
গীবত-এর সংজ্ঞা তো আপনাদের অজানা নয়। কারো অনুপস্থিতিতে দোষচর্চা করা।
বাস্তবে দোষ থাকুক বা না থাকুক সে শুনলে মনে কষ্ট পাবে। এটাই তো গীবত-এর
সংজ্ঞা। এই সুবাদে আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে যে, ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম।
প্রতিটি জিনিসের স্বভাব বা প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য রেখেই ইসলাম বিধান
প্রণয়ন করেছে। মানুষের স্বভাব ও চাহিদার প্রতিও ইসলাম লক্ষ রেখেছে।
তদনুযায়ী বিধান প্রদান করেছে। এরই নিমিত্তে ইসলাম কয়েকটি বিষয়কে গীবতের
আওতামুক্ত রেখেছে। বিষয়গুলো বাহ্যিক দৃষ্টিতে গীবত মনে হবে। অথচ ইসলামের
দৃষ্টিতে এগুলো গীবত নয়।
কারো অনিষ্টতা থেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে গীবত করা যাবে
যেমন কেউ এমন কাজ করছে, যার দ্বারা অন্য লোকের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে,
তাহলে এটা ষড়যন্ত্র। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এ সম্পর্কে অবহিত না করলে সে
ষড়যন্ত্রের শিকার হবে। তাই তাকে এটা বলে দেওয়া জায়েজ হবে যে, তুমি সতর্ক
থেকো, তোমার বিরুদ্ধে অমুক এই ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে। এটাই নবীজি ﷺ-র শিক্ষা। তিনি আমাদেরকে সবকিছু শিক্ষা দিয়ে তারপর বিদায় নিয়েছেন।
হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, একদিনের
ঘটনা। আমি নবীজির খেদমতে বসা ছিলাম। ইত্যবসরে দেখলাম, সামনের দিক থেকে এক
লোক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। রাস্তায় থাকাকালীন নবীজি ﷺ তার দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বললেন, লোকটি তার গোত্রের নিকৃষ্ট ব্যক্তি। হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, একথা শুনে আমি একটু সতর্ক হয়ে বসলাম। কারণ দুষ্ট লোকের থেকে সতর্ক থাকা উচিত। তারপর লোকটি যখন মজলিসে এসে বসল, নবীজি ﷺ তার সাথে স্বভাব অনুযায়ী সদাচরণ করলেন। লোকটি চলে যাওয়ার পর হযরত আয়েশা রাযি.
নবীজিকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার ভাষ্যমতে লোকটি গোত্রের
নিকৃষ্ট ব্যক্তি। অথচ সে আপনার মজলিসে বসল আর আপনি তার সঙ্গে এত সুন্দর
ব্যবহার করলেন; এর কারণ কী? নবীজি ﷺ
উত্তর দিলেন, দেখো, লোকটি আসলেই ভয়ঙ্কর। সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা
তার স্বভাব। মানুষ তার থেকে পালিয়ে বাঁচে। তার সঙ্গে যদি সুন্দর ব্যবহার
করা না হয়, তাহলে এসে ত্রাস ও অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই আমি তার
সঙ্গে অভ্যাসমাফিক সুন্দর ব্যবহার করলাম। (তিরমিজি শরিফ ১৯৯৬)
হাদীসটির ব্যাখ্যায় ওলামায়েকেরাম লিখেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ
আয়েশাকে যে বললেন, ‘লোকটি গোত্রের নিকৃষ্ট ব্যক্তি।’ সাধারণ দৃষ্টিতে এটা
গীবত হয়েছে। যেহেতু মন্তব্যটি তার অনুপস্থিতিতে হয়েছে। তবু এটা জায়েজ।
কারণ এর দ্বারা নবীজির উদ্দেশ্য ছিল, লোকটির অনিষ্টতা থেকে আয়েশা রাযি.-কে সতর্ক করা। যেন আয়েশা রাযি.
লোকটির কোনো ফ্যাসাদের শিকার না হন। সুতরাং হাদীসটি থেকে আমরা বুঝতে
পারলাম, কাউকে অন্যের ষড়যন্ত্র অত্যাচার থেকে বাঁচানোর জন্য গীবত করা
যাবে। এটা জায়েজ। বরং এজাতীয় গীবত গীবতের অন্তর্ভুক্ত নয়।
যদি কারো প্রাণনাশের আশঙ্কা হয়
অবস্থাবিশেষে অপরের দোষ বর্ণনা করার প্রয়োজন পড়তে পারে। যেমন আপনি
দেখলেন, একজন আরেকজনকে খুন বা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই অবস্থায়
আপনি চোখ বুজে থাকতে পারবেন না। বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বলে দিতে হবে যে,
তোমার জীবন হুমকির সম্মুখীন। এতে সে নিজেকে বাঁচানোর সুযোগ পাবে। এই বিশেষ
ক্ষেত্রে গীবত করা আপনার জন্য বৈধ হবে।
প্রকাশ্যে গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির গীবত
এক হাদীসে আছে, যার সঠিক অর্থ অনেকে উদ্ধার করতে পারেনা। হাদীসটি হল, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
لَا غِيبَةَ لِفَاسِقِ ولا مجاهر
অর্থাৎ, ফাসিক ও প্রকাশ্যে গুনাহকারী ব্যক্তির গীবত করলে তা গীবত হিসাবে বিবেচিত হবে না। (জামেউল উসূল, খন্ড ০৮ পৃষ্ঠা ৪৫০)
হাদীসটির অর্থ অনেকে উল্টোভাবে করে। তাদের ধারণা, কবীরা গুনাহে লিপ্ত
ব্যক্তির অথবা বেদআতে অভ্যস্ত ব্যক্তির গীবত যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে করা যাবে।
এতে কোন গোনাহ নেই। এটা জায়েজ। মূলত হাদীসটির অর্থ এটা নয়। বরং হাদীসটির
মর্মার্থ হল, প্রকাশ্যে গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির গীবত করা যাবে। যেমন মদ্যপ।
প্রকাশ্যে মদপান যার জন্য নিতান্ত মামুলী ব্যাপার। এরকম ব্যক্তির পেছনে
কেউ যদি বলে, অমুক মদপান করে; তাহলে এটা গীবত হবে না। কারণ সে তো প্রকাশ্যে
মদ পান করে। এর মাধ্যমে কেমন যেন সে ঘোষণা করে বেড়াচ্ছে যে, আমি মদ পান
করি। সুতরাং তার অনুপস্থিতিতে কথাটি আলোচনা করলে তার মনে কষ্ট যাওয়াটা
বিবেচ্য বিষয় নয়। বিধায় এটা গীবত হবে না।
এটাও গীবত
কিন্তু যে সব দোষ উক্ত ব্যক্তি গোপন রাখতে চায় সে সব দোষ নিয়ে যদি আপনি
তার অনুপস্থিতিতেই ঘাটাঘাটি করেন তাহলে তা গীবত হবে। যেমন সে প্রকাশ্যে মদ
খায় ঠিক তবে তার এমন আরও একটি গুনাহও আছে, যা সে প্রকাশ্যে করে না। গোপনে
করে। সে মানুষের সামনে তার এই গুনাহটি প্রকাশ করতে রাজি নয়। গুনাহটিও এমন
যে, এর কারণে অন্যদের ক্ষতি হয় না। এরূপ ক্ষেত্রে তার উক্ত গুনাহের কথা
আলোচনা করা জায়েজ হবে না; বরং এটা তখন গীবত হবে ।
বোঝা গেল, প্রকাশ্যে যে গুনাহটি মানুষ করে তার আলোচনা করা গীবত নয়।
পক্ষান্তরে যে সব গুনাহ মানুষ গোপনে করে সেগুলোর আলোচনায় অপরের সামনে করা
গীবতের শামিল। উপরোক্ত হাদীসের মর্মার্থও এটা।
ফাসেক ও গুনাহগারের গীবতও নাজায়েজ
হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেছেন, এক মজলিসে হযরত ওমর রাযি.-এর পুত্র আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. উপস্থিত ছিলেন। ইতোমধ্যে মজলিসের এক লোক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সমালোচনা শুরু করে দিল। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি.
তাকে বাধা দিয়ে বললেন, দেখো তোমার এই সমালোচনা গীবতের অন্তর্ভুক্ত। তুমি
মনে করো না, হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ শত শত লোকের হত্যাকারী তাই তার গীবত হালাল
হয়ে গিয়েছে। ভালোভাবে জেনে নাও, তার গীবত করা হালাল হয়নি। বরং আল্লাহ
তাআলা হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ থেকে শত শত মানুষের রক্তের হিসাব যেমনিভাবে নিবেন,
অনুরূপভাবে তুমি যে তার পেছনে গীবত করেছ তার হিসাবও নিবেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাজত করুন। আমিন।
সুতরাং ফাসেক, পাপী অথবা বেদআতী হলেই তার গীবত করা চলবে না। এই চিন্তা
নিতান্তই ভ্রান্ত। এজাতীয় লোকের গীবত করা থেকেও বেঁচে থাকা ওয়াজিব।
জালিমের জুলুমের আলোচনা গীবত নয়
আরেকটি ক্ষেত্রে ইসলাম গীবতের অনুমতি দিয়েছে। তা হল, এক ব্যক্তি তোমার
উপরে জুলুম করেছে। এই জুলুমের কথা তুমি অপরকে শোনাতে পারবে। বলতে পারবে
আমার সাথে এ অন্যায় করা হয়েছে, এ জুলুম করা হয়েছে। এটা গীবতের
অন্তর্ভুক্ত হবে না। গুনাহও হবে না। যাকে তুমি জুলুমের কাহিনী শুনিয়েছে সে
এর প্রতিকার করতে সক্ষম হোক বা না হোক; শোনাতে পারবে । যথা কোন ব্যক্তি
তোমার মাল চুরি করেছে। থানায় গিয়ে তুমি তার বিরুদ্ধে চুরির মামলা দায়ের
করলে তাহলে যদিও এটা তার অনুপস্থিতিতে তার দোষ চর্চা হয়েছে কিন্তু এটা
গীবত হবে না। কারন সে তোমার ক্ষতি করেছে তারপর তুমি থানায় গিয়ে
বিচারপ্রার্থী হয়েছ। থানা কর্তৃপক্ষ এর বিচার করবেন। সুতরাং এটা গীবতের
অন্তর্ভুক্ত নয়।
অনুরূপভাবে চুরির ঘটনা যদি এমন লোকের নিকট বলা হয়, যে এর প্রতিকার করতে
সক্ষম নয়। যেমন চুরির খবর শুনে কিছু লোক তোমার বাড়ি চলে আসলো। তুমি জানো
যে, তোমার বাড়িতে কে চুরি করেছে। তাই তুমি তাদের নিকট বলে দিলে যে, আজ রাত
অমুক আমার বাড়িতে চুরি করেছে। কিংবা বললে, অমুক আমার ক্ষতি করেছে। কিংবা
বললে, অমুক আমার উপর এ জুলুম করেছে। তাহলে এটা গুনাহ হবে না। যেহেতু এটা
গীবত নয়।
লক্ষ্য করুন, ইসলাম মানবপ্রকৃতিকে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছে। মানুষের
স্বভাবপ্রকৃতি হল, দুর্দশাগ্রস্ত হলে সে অন্যের নিকট প্রকাশ করতে চায়।
নিজের দুঃখের কথা অন্যকে বলে মনের বোঝা কিছুটা হালকা করতে চায়। তখন সেই
খেয়াল করে না যে, অপর কেউ তার দুঃখ লাঘব করতে পারবে কিনা! ইসলাম এই
মানবীয় মেজাজের প্রতি লক্ষ্য রেখেছে । অন্যের নিকট দুঃখ ব্যক্ত করার
অনুমতি দিয়েছে। কোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে,
لَّا يُحِبُّ اللَّهُ الْجَهْرَ بِالسُّوءِ مِنَ الْقَوْلِ إِلَّا مَن ظُلِمَ ۚ
আল্লাহ তাআলা মন্দবিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। অবশ্য যার উপর জুলুম করা হয়েছে, তার কথা আলাদা।
অর্থাৎ, তার উপর যে অত্যাচার করা হয়েছে সেটা সে অপরের নিকট বলতে পারবে। এটা গীবত নয়; বরং জায়েজ।
মোটকথা উল্লেখিত কয়েকটি বিষয় আল্লাহ তাআলা গীবতের আওতামুক্ত রেখেছেন।
এগুলো গীবতের শামিল হবে না। এগুলো ব্যতীত আমরা যে মজলিসে বসলেই সমালোচনার
ঝুলি খুলে দেই, সে সবই গীবত। সুতরাং গীবতের মহামারি থেকে বেঁচে থাকুন।
আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের উপর দয়া করুন। জবানকে হেফাজত করুন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেককে জবান সংযত রাখার তৌফিক দিন। আমিন।
গীবত থেকে বাঁচার শপথ
গীবতের বিস্তৃত আলোচনা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হল। আপনারা এতক্ষণ তা
শুনেছেন। কিন্তু এক কান দিয়ে শুনে অপর কান দিয়ে বের করে দিলে চলবে না।
প্রতিজ্ঞা নিতে হবে যে, ইনশাআল্লাহ, আর কোনদিনও কারো গীবত বা পরনিন্দাসুচক
একটি শব্দও বলব না। তবুও কখনো ভুল হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে নিতে
হবে। গীবতের সঠিক প্রতিকার বা চিকিৎসা হলো, যার গীবত করা হয়েছে তার নিকট
সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনা করা। একথা বলা যে, ‘ভাই, আমি তোমার গীবত করেছি,
আমাকে মাফ করে দাও।’ আল্লাহ তাআলার কিছু বিশেষ বান্দা আছেন তারা এমনই করে
থাকেন।
বাঁচার উপায়
হযরত থানবী রহ. বলেছেন, মাঝে মাঝে দু’এক ব্যক্তি আমার কাছে এসে বলেন যে, হুজুর, আমি আপনার গীবত করেছি। আমাকে মাফ করে দিন।
তখন আমি তাদেরকে বলি, এক শর্তে মাফ করে দিব। প্রথমে বলতে হবে, আমার কী গীবত
করেছ? এর দ্বারা আমার উদ্দেশ্য হলো, যাতে আমি জানতে পারি, মানুষ আমার
সম্পর্কে কী বলে! যদি আমার সামনে বলতে পারো তাহলে মাফ পেয়ে যাবে।
হযরত থানবী বলেন, আমার এরূপ করার পেছনে একটা কারণ আছে। তা হল, হতে পারে, যে
দোষ আলোচনা করা হয়েছে, তা আমার মধ্যে বাস্তবেই আছে। সুতরাং দোষটা আমার
জানা হয়ে যাবে এবং এর মাধ্যমে হয়তো আল্লাহ তাআলা এ থেকে বেঁচে থাকার
তৌফিক আমাকে দিয়ে দিবেন।
তাই গীবতের প্রকৃত চিকিৎসা এটাই। এ চিকিৎসা গ্রহণ করা যদিও কষ্টকর, যদিও
মনের উপর করাত চালিয়ে তারপর অন্যকে বলতে হবে,’আমাকে মাফ করে দাও, আমি
তোমার গীবত করেছি।’ তবুও এটাই আসল চিকিৎসা। দু’চার বার এই তদবির মত কাজ
করলে ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হয়ে যাবে।
বুযুর্গানে দ্বীন অবশ্য গীবত থেকে বাঁচার জন্য অন্যান্য ব্যবস্থাপত্রও
দিয়েছেন। যেমন হযরত হাসান বসরী রহ. বলেছেন, যখন অন্যের দোষচর্চার কথা মনে
পড়বে তখনই নিজের দোষগুলোর কথা চিন্তা করবে। ভাববে, কোনো মানুষই তো
দোষমুক্ত নয়। আমার মধ্যেও তো এই দোষ আছে, ওই দোষ আছে… । সুতরাং অন্যের
দোষচর্চা আমি কিভাবে করি! পাশাপাশি গীবতের শাস্তির কথা ও ভাববে। আল্লাহর
নিকট দো’আ করবে যে, হে আল্লাহ! আমাকে এই ভয়াবহ শাস্তি থেকে রক্ষা করুন ।
মজলিসে দোষ চর্চা হতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কথা স্মরণ করবে। দোয়া
করবি, হে আল্লাহ! এই মজলিসে গীবত শুরু হয়ে গিয়েছে; আমাকে হেফাজত করুন। এই
জঘন্য পাপ থেকে আমাকে রক্ষা করুন ।
গীবতের কাফফারা
এক হাদীসে এসেছে। হাদীসটি সনদের দিক থেকে দুর্বল হলেও অর্থের দিক থেকে
বিশুদ্ধ। যদি ঘটনাচক্রে কারো গীবত হয়েই যায় তাহলে তার কাফফারা দিতে হবে।
কাফফারা হলো, যার গীবত করা হয়েছে তার জন্য বেশি বেশি করে দোয়া করা,
ইস্তেগফার করা। যেমন কেউ আজীবন গীবত করেছিল। এখন তার হুঁশ হলো। ভাবল, আমি
তো আজীবন এগুনাহ করে এসেছি। কার কার গীবত করেছি তাও পুরোপুরি জানা নেই।
কোথায় তাদেরকে খুঁজে বেড়াবো, তবে ভবিষ্যতে আর গীবত করবো না। এখন উপায়?
উপায় একটাই। যাদের গীবত করা হয়েছে তাদের জন্য দোয়া করতে থাকা, ইস্তেগফার
অব্যাহত রাখা। এভাবে হয়তো গুনাহটি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। (মিশকাত,
কিতাবুল আদাব ৪৮৭৭)