মাহে রমযানে আমাদের করনীয় ও বর্জনীয় কাজসমূহ আরবী মাস সমূহের শ্রেষ্ঠ মাস হলো, পবিত্র রমযান মাস । এ মাস কল্যাণময় মাস, কুরআন নাযিলের মাস, রহমত বরকত ও মাগফিরাত এবং নাজাতের মাস । এ মাস তাকওয়া ও সংযম প্রশিক্ষণের মাস, সবর ও ধর্য্যের মাস। এ মাস জীবনকে সমস্ত পাপ পংকিলতা থেকে মুক্ত করে মহান আল্লার রেজামন্দি ও নৈকট্য লাভের মাস । ইরশাদ হয়েছেÑ “রমযান মাস – এ মাসে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন নাযিল হয়েছে । সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম তথা রোযা পালন করে ।” ( সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৫ ) রমযানের বৈশিষ্ট্য রমযানের বৈশিষ্ট্য অনেক । নি¤েœ কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে দেয়া হলো Ñ ১. আল্লাহ তা’আলা প্রত্যহ জান্নাতকে সুসজ্জিত করে বলেন, অনতিবিলম্বে আমার নেক বান্দারা দুনিয়াবী বিপদ- মুসিবত এড়িয়ে তোমার মাঝে এসে পৌঁছবে । ২. রমযান মাসে শয়তানকে সিকলে বেঁধে রাখা হয় । ৩. রমযান মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে রাখা হয় । ৪. রমযান মাসে একটি বরকতময় রাত আছে যা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । আর তা হলো- লাইলাতুল কদর । ৫. রমযানের শেষ রাতে সমস্ত রোযাদারদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয় । ৬. রমযানের প্রতি রাতে জাহান্নাম থেকে অনেক লোককে মুক্তি দেয়া হয় । ৭. রমযানে বান্দার নেকী দশ হতে সাতশতগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেয়া হয় । যাদের উপর রোযা রাখা ফরজ যাদের মাঝে নি ¤েœাক্ত শর্তাবলী পাওয়া যাবে , তার উপর রমযান মাসের রোযা যথা সময়ে আদায় করা এবং যথা সময়ে আদায় করতে না পারলে কাযা আদায় করা ফরয। ১. বালেগ হওয়া । সুতরাং নাবালেগের উপর রোযা ফরজ নয় । ২. মুসলমান হওয়া । সুতরাং কাফিরের উপর রোযা ফরজ নয় । ৩. জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া । সুতরাং পাগলের উপর রোযা ফরজ নয় । ৪. দারুল ইসলামের অধিবাসী হওয়া অথবা দারুল হরবে থাকলেও রোযা ফরজ হওয়ার ব্যাপারে জ্ঞাত থাকা । ৫. মুকীম হওয়া । সুতরাং মুসাফিরের জন্য রোযা রাখা ফরজ নয় । ৬. সুস্থ থাকা । সুতরাং অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রোযা রাখা ফরজ নয় । ৭. মহিলারা হায়েয নেফাস থেকে মুক্ত থাকা । রোযার নিয়ত নিয়ত ব্যতীত রোযা হয় না । নিয়তের স্থল হলো অন্তর । রাত থেকে শুরু করে (শরীয়তগ্রাহ্য) দিনের অর্ধেক অংশের পূর্ব পর্যন্ত ( অর্থাৎ সুবহে সাদেক ও সূর্যাস্তের ঠিক মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত , যা সূর্য মধ্যগগণে স্থির হওয়ার ৪০/৪৫ মিনিট পূর্বে হয় ) রোযার নিয়ত করা শুদ্ধ । রোযাদারের জন্য যেসব কাজ করা মাকরুহ নয় রোযাদারের জন্য নি ¤েœাক্ত কাজগুলো করা মাকরুহ নয় । ১. গোঁফে ও দাড়িতে তেল লাগানো । ২. সুরমা লাগানো । ৩. শীতলতা লাভের উদ্দেশ্যে গোসল করা । ৪. শীতলতা লাভের উদ্দেশ্যে ভেজা কাপড় গায়ে জড়ানো । ৫. রোযা রেখে দিনের শেষভাগে মিসওয়াক করা সুন্নত, যেমন প্রথমভাগে করা সুন্নত । মুস্তাহাব কাজসমূহ ১. সময়মত সাহরী খাওয়া । সাহরীর সময়ের শেষ ভাগে খাওয়া । ২. সূর্যাস্তের পর বিলম্ব না করে ইফতার করা । ৩. রাতে বড় নাপাকি হলে ফজরের পূর্বেই গোসল করে পাক হওয়া । ৪. গীবত, পরনিন্দা ও গালি-গালাজ থেকে জিহবাকে সংযত রাখা । ৫. রমযানের সূবর্ণ সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো, অর্থাৎ কুরআন তেলাওয়াত , যিকির, ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকা,উত্তেজিত না হওয়া । ৬. যথাসম্ভব এ মাসের রাতে ( বৈধ হলেও ) সহবাস হতে নিজেকে বিরত রাখা । ৭. ক্রোধান্বিত না হওয়া এবং তুচ্ছ কোন বিষয় নিয়ে উত্তেজিত না হওয়া । যেসব কারণে রোযা ভাঙ্গে না এবং মাকরুহ হয় না ১. মেসওয়াক করা । ২. শরীর, মাথা, দাড়ি এবং গোঁফে তেল লাগানো । ৩. চোখে সুরমা বা ঔষধ লাগানো । ৪. খুশবু লাগানো বা তার গ্রাণ নেয়া । ৫. ভুলে কিছু পান করা ,আহার করা এবং স্ত্রী সহবাস করা । ৬. গরম বা পিপাশার কারণে গোসল করা বা বারবার কুলি করা । ৭. অনিচ্ছাবশত: গলায়র মধ্যে ধোঁয়া, ধুলা-বালি-মাছি ইত্যাদি প্রবেশ করা । ৮. কানে পানি দেয়া বা অনিচ্ছাবশত চলে যাওয়ার কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না । তবে ইচ্ছাকৃতভাবে দিলে সতর্কতা হলো সে রোযাটি কাযা করে নেয়া । ৯. অনিচ্ছাকৃত বমি করা । ১০. স্বপ্নদোষ হওয়া । ১১. মুখে থুথু আসলে গিলে ফেলা । ১২. ইনজেকশন বা টিকা নেয়া । ১৩. দাঁত উঠালে এবং রক্ত পেটে না গেলে । ১৪. পাইরিয়া রোগের কারণে অল্প অল্প করে রক্ত বের হলে । ১৫. সাপ ইত্যাদি দংশন করলে । ১৬. পান খাওয়ার পর ভালভাবে কুলি করা সত্ত্বেও থুথুর সাথে লালভাব থাকলে । ১৭. উত্তেজনার সাথে শুধু দৃষ্টিপাত করতেই বীর্যপাত হলে । ১৮. ইনজেকশনের সাহায্যে শরীর থেকে রক্ত বের করলে । যেসব কারণে রোযা নষ্ট হয় ১. নাক বা কানে ঔষধ প্রবেশ করালে । ২. ইচ্ছাকৃত মুখ ভরে বমি করলে । ৩. কুলি করার নসয় গলায় পানি চলে গেলে । ৪. নারী স্পর্শ বা এসংক্রান্ত কোন কারণে বীর্যপাত হলে । ৫. খাদ্য বা খাদ্য হিসেবে গণ্য এমন কোন বস্তু গিলে ফেললে । ৬. আগরবাতি ইচ্ছা করে গলা বা নাকের মধ্যে প্রবেশ করালে । ৭. বিড়ি সিগারেট পান করলে । ৮. ভুলে খেয়ে ফেলার পর ইচ্ছা করে পুনরায় খাবার খেলে । ৯. সুবহে সাদেকের পর খাবার খেলে । ১০. বুঝে হোক বা না বুঝে সূর্য ডুবার আগে ইফতার করলে । ১১. ইচ্ছা করে স্ত্রী সহবাস করলে । যেসব কারণে রোযা মাকরূহ হয় ১. বিনা কারণে চিবিয়ে লবণ বা কোন বস্তুর ঘ্রাণ গ্রহণ করা , যেমন টুথপেষ্ট । ২. গোসল ফরজ অবস্থায় সরাসরি গোসল না করে থাকা । ৩. শরীরের কোথাও শিঙ্গা ব্যবহার করা বা রক্তপাত করানো । ৪. পরনিন্দা করা । ৫. ঝগড়া করা । ৬. রোযাদার নারী ঠোটে রঙ্গিন জাতীয় কোন বস্তু লাগালে যা মুখের ভেতর চলে যাওয়ার আশংকা রয়েছে । ৭. রোযা অবস্থায় দাঁত উঠানো বা দাঁতে ঔষধ ব্যবহার করা , তবে একান্ত প্রয়োজনে তা জায়েয । সাহরী প্রসঙ্গ রোযা রাখার নিয়তে শেষ রাতে খাদ্য গ্রহণ করাকে সাহরী বলা হয় । সাহরী খাওয়া সুন্নত । সুবহে সাদেকের একটু পূর্বে সাহরী খাওয়া মুস্তাহাব । রাসূল সা. বলেন- ﺗﺴﺤﺮﻭﺍ ﻓﺎﻥ ﻓﯽ ﺍﻟﺴﺤﻮﺭ ﺑﺮڪﺔ “ তোমরা সাহরী খাও, এতে অত্যন্ত বরকত নিহীত আছে ” ( মুসলিম শরীফ – ১/৩৫০ ) ইফতার প্রসঙ্গ সূর্যাস্তের পর পরই ইফতার করা উত্তম । রাসূল সা. বলেন- ﻻ ﻳﺰﺍﻝ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﺑﺨﻴﺮ ﻣﺎ ﻋﺠﻠﻮﺍ ﺍﻟﻔﻄﺮ “ মানব জাতি ততদিন পর্যন্ত কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতদিন পর্যন্ত তারা ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করে নেবে । (মুসলিম ) খেজুর দিয়ে ইফতার করা সর্বোত্তম । নতুবা অন্তত ইফতারের সূচনা পানি দিয়ে করা উচিত । ইফতারের দুআ ইফতারের বিভিন্ন পর্যায়ে চারটি দুআ রয়েছে - ১. ইফতারী সামনে এলে এই দুআ পড়া - ﺍﻟﻠﻬﻢ ﻟڪ ﺻﻤﺖ ﻭﻋﻠﯽ ﺭﺯﻗڪ ﺍﻓﻄﺮﺕ ﻭﻋﻠﻴڪ ﺗﻮڪﻠﺖ ﺳﺒﺤﺎﻧڪ ﻭ ﺑﺤﻤﺪڪ ﺗﻘﺒﻞ ﻣﻨﯽ ﺍﻧڪ ﺍﻧﺖ ﺍﻟﺴﻤﻴﻊ ﺍﻟﻌﻠﻴﻢ ২. ইফতরী সামনে রেখে এই দুআ পড়তে থাকা- ﻳﺎ ﻭﺍﺳﻊ ﺍﻟﻔﻀﻞ ﺍﻏﻔﺮﻟﯽ “হে বড় দাতা ! আমাকে ক্ষমা করুন ।- ৩. ইফতারের সময় এই দুআ পড়া - ﺍﻟﻠﻬﻢ ﻟڪ ﺻﻤﺖ ﻭﻋﻠﯽ ﺭﺯﻗڪ ﺍﻓﻄﺮﺕ ‘ হে আল্লাহ ! আমি তোমার জন্য রোযা রেখেছি এবং তোমারই দেয়া রিযিক দ্বারা ইফতার করছি ।’ (আবূ দাউদ ) ৪. ইফতার শেষে এই দুআ পড়া – ﺫﻫﺐ ﺍﻟﻈﻤﺎﺀ ﻭ ﺍﺑﺘﻠﺖ ﺍﻟﻌﺮﻭﻕ ﻭ ﺛﺒﺖ ﺍﻻﺟﺮ ﺍﻥ ﺷﺎﺀ ﺍﻟﻠﻪ “ পিপাসা নিবারণ হয়েছে, শিরা- উপশিরা সিক্ত হয়েছে, ইনশাআল্লাহ সওয়াবও নির্ধারিত হয়েছে । (আবূ দাউদ ) যেসব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং কাযা-কাফ্ফারা উভয় ওয়াজিব হয় ১. রোযা রেখে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে । ২. ইচ্ছাকৃত স্ত্রী সহবাস করলে । এতে স্বামী স্ত্রী উবয়ের উপর কাযা ও কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে । ৩. রোযা রেখে পাপ হওয়া সত্ত্বে যদি স্বামী তার স্ত্রীর পায়খানার রাস্তায় পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করায় এবং অগ্রভাগ ভেতরে প্রবেশ করে । তাহলে স্বামী স্ত্রী উভয়ের উপর কাযা কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে । ৪. রোযা অবস্থায় কোন বৈধ কাজ করলো, যেমন স্ত্রীকে চুম্বন করল কিংবা মাথায় তেল দিল, তা সত্ত্বেও সে মনে করলো যে, রোযা নষ্ট হয়ে গিয়াছে; আর তাই পরে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার ইত্যাদি করলো, তাহলে কাযা কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে ।