সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় মারা গেছে, এমন ঘটনা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। এটি খুবই অনাকাংখিত ও দু:খজনক ঘটনা। এমনটি কেন হয়, জানেন?

আজকে আমরা আলাপ করব, কেন গর্ভে সন্তান আসার পর মারা যায়, গর্ভে সন্তার মারা গেলে করনীয় কী, মৃত সন্তান কীভাবে প্রসব করা যায়, মৃত সন্তান কী নরমাল ডেলিভারী হয় নাকি সিজার করতে হয়, পরবর্তীতে সন্তান নিতে গেলে কী করণীয় এসব বিষয়ে।

অনেকগুলো কারণে মাতৃগর্ভে সন্তান মারা যেতে পারে। কেন গর্ভের সন্তান মারা যায়- এমন প্রশ্নে চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রথম যে কথাটি বলছে তা হলো ইডিওপ্যাথিক। অর্থাৎ কারণটি সম্পর্কে কারোরই কিছু জানা নেই।

এছাড়া আরও কিছু কারণ আছে যা আমরা ( ডাক্তার) রোগীদের কাছে জিজ্ঞেস করে আইডেনটিফাই করেছি। এরমধ্যে প্রথমেই আছে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। আমাদের দেশে অনেক মা জানেনই না যে, তার ডায়াবেটিস আছে।

দ্বিতীয়টি হলো, মায়ের হাই ব্লাড প্রেসার। খুব বেশী ব্লাড প্রেসার থাকা সত্ত্বেও মা হয়তো ওষুধ খাচ্ছেন না বা ওষুধ খেলেও তা মায়ের ব্লাড প্রেসারকে পর্যাপ্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।

মাতৃগর্ভে বাচ্চা মারা যাওয়ার 

তিন নম্বর কারণ হলো থাইরয়েড। মায়ের থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে পেটে বাচ্চা মারা যেতে পারে।

চতুর্থত, মায়ের ব্লাড গ্রুপ নেগেটিভ থাকলে, বাবার ব্লাড গ্রুপ পজেটিভ হলে এবং বাচ্চার ব্লাড গ্রুপ পজেটিভ হয়ে থাকলে বাচ্চা পেটে মারা যেতে পারে।

ভ্রূণ বৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ হলে সন্তান পেটেই মারা যায়। দুর্বলতার জন্য এবং সঠিক পুষ্টি না পেলে ভ্রূণ বৃদ্ধি পায় না এবং মারা যেতে পারে।

 গর্ভাবস্থায় নেশাজাত দ্রব্য যেমন অ্যালকোহল, নিকোটিন অথবা কোন বিরূপ ঔষধ গ্রহণ করলে সন্তানের উপর প্রভাব পড়বে এমনকি সন্তান গর্ভেই মারা যেতে পারে।

গর্ভধারণের ২৮ সপ্তাহ পর মা যদি চিৎ অথবা পেট নিচে হয়ে ঘুমায় তাহলে বাচ্চা পেটে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরের পেটের জায়গায় বা তার আশেপাশে কোন আঘাত লাগলে গর্ভে থাকা সন্তানের উপর প্রভাব পড়ে এবং গর্ভেই সন্তান মারা যেতে পারে।

এছাড়া গর্ভে বাচ্চার নাড়ি ছিড়ে গেলে, মায়ের ব্লাড গ্রুপ পজেটিভ কিন্তু বাবার নেগেটিভ হলে আবার গর্ভে থাকা সন্তানের পজেটিভ হলেও সন্তান অনেক সময় গর্ভেই মারা যেতে পারে।

এছাড়া মেডিক্যাল সায়েন্সের অন্যান্য ডিজিজের কারণেও মাতৃগর্ভে বাচ্চা মারা যেতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো মা কখন বুঝবেন, তার গর্ভস্থ শিশুটি মারা গেছে।

এজন্য আমরা বলি, গর্ভকালে সাত মাস হলেই গর্ভের শিশুটির নড়াচড়া গুণতে থাকবেন। বাচ্চাটা কিন্তু হঠাৎ করেই গর্ভে মারা যায় না। সে মারা যাওয়ার আগে গর্ভে নড়াচড়া কমে যায়। এটাও কিন্তু হুট করে কমে যায় না।

প্রথম দিনে হয়তো দশবারের পরিবর্তে ছয়বার নড়াচড়া করে। দ্বিতয় দিন তিন বার-চারবার নড়াচড়া করে। এক পর্যায়ে নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়।

তাই মা যখনই বুঝতে পারবেন তার গর্ভের সন্তান কম নড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের শরনাপন্ন হতে হবে। এই সময় দ্রুত চিকিৎসা নিতে পারলে সন্তান বেঁচে যেতে পারেন।

 মা যখন আমাদের কাছে এসে বলেন, গত তিনদিন ধরে গর্ভে আমার বাচ্চাটা নড়ছে না তখন আমরা তার ( রোগীর) পেটে স্টেথিস্কোপ বসিয়ে দেখি ও বাচ্চার হার্টবিট বাড়ছে কিনা।

যদি আমরা দেখি বাচ্চার হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে না তখন আমরা মাকে একটা আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে পাঠাই। যদি রিপোর্টে এমনটি পাই যে, বাচ্চার কোনো নড়াচড়া নেই। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, গর্ভের সন্তান মারা গেছে।

এক্ষেত্রে আমরা দু`ধরনের সিদ্ধান্ত নিই। যদি এমন হয় বাচ্চাটা আজকে বা কালকে মারা গেছে তাহলে আমরা মাকে বাসায় পাঠিয়ে দিই। অন্ত:স্বত্ত্বাকে বলি, আপনি বাসায় যান ও স্বাভাবিক ভাবে প্রসব ব্যথা উঠলে আসবেন।

তখন মাকে আমরা নরমাল ডেলিভারী করাতে পারি। তবে অভিজ্ঞতায় বলে, এমন ক্ষেত্রে কোন মা দু`সপ্তাহের বেশী অপেক্ষা করবেন না। কেননা, দু`সপ্তাহের বেশী অপেক্ষা করলে এই মৃত বাচ্চাটা মায়ের রক্তে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন আনে। যা মায়ের জন্য ক্ষতিকর।

আবার কোনো কোনো মা এমন ক্ষেত্রে ভয়ও পেয়ে যান। একটি মৃত সন্তানকে পেটে নিয়ে থাকতে তারা স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না।

তারা খুব দ্রুত বাচ্চাটাকে ডেলিভারী করাতে চান। সেক্ষেত্রে আমরা তাকে হসপিটালে ভর্তি করাই, ব্যথা উঠানোর ওষুধ দিই ও স্বাভাবিক প্রসব করাই।

আবার যদি এটা হয়, আগে মায়ের দু`টা বা তিনটা বাচ্চা সিজারে হয়েছে, এবারের বাচ্চাটা পেটে মারা গেছে, সেক্ষেত্রে সিজারের মাধ্যমে পেট থেকে মৃত বাচ্চাটা বের করতে হয়। এক্ষেত্রে নরমাল ডেলিভারীর কোন উপায় থাকে না।

পেটে যদি বাচ্চা মারা যায় ও ডেলিভারী হয় তখন মায়ের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এসময়টা খুবই বিপজ্জনক। তাই এ ধরনের মায়েদের ডেলিভারির ক্ষেত্রে আমরা প্রচুর রক্ত রেডি রাখতে হবে।

তাছাড়া মায়ের শারীরীক অবস্থার অবনতি হলে যেন যেকোনো পদক্ষেপ দ্রুত নেওয়া যায় তার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

কোনো মায়ের যদি গর্ভে সন্তান মারা যায়, সেটা যদি তার প্রথম সন্তান হয়, অর্থাৎ মৃত সন্তান প্রসবের পর মা যদি আবার গর্ভে সন্তান ধারণ করেন, তাহলে অবশ্যই তার আগে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ডাক্তার বের করবে কেনেআগে পেটে সন্তান মারা গিয়েছিল। সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।

আমরা (ডাক্তার) জোর দিয়ে যেটা বলি সেটি হচ্ছে- বাচ্চা কনসিভ করার তিন মাস আগে থেকে সে ওষুধ খাবে। তারপর সন্তান নেবে। যাতে পরবর্তীতে এমন ঘটনা আর না ঘটে।

মানুষের সংসার জীবনে পরিপূর্ণতা আসে সন্তান লাভের মাধ্যমে। মৃত সন্তান কোনো ভাবেই কাম্য নয়। আসুন, আমরা সচেতন হই। মন্তান গর্ভে ধারনের আগে থেকেই ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি এবং সব নিয়ম কানুন মেনে চলি।

লেখক: কনসালটেন্ট, ইমপালস হাসপাতাল। নারী রোগ ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ

collected 


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে