চাঁদের গায়ে কলঙ্ক অবশ্যই আছে এবং তার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে লুনার মেয়ার(lunar mare)। এই নামটি এসেছিল লাতিন শব্দ থেকে যেখানে এই mare মানে হচ্ছে সমুদ্র। এরকম নাম দেওয়ার কারণ, আগে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন যে ওটা চাঁদের ওপর সমুদ্র, যা পরে ভুল প্রমাণিত হয়।
তারপর একসময় ভাবা হল যে ওটা সমুদ্র নয়, কোনো গ্রহানু(asteroid) চাঁদের গায়ে আঘাত করায় সেই গর্ত সৃষ্টি হয়েছে এবং তাই এই কালো দাগ। কিন্তু সেটাও ভুল ছিল।
তাহলে আসলে কলঙ্ক জিনিষটা কী?
এবারে বিজ্ঞানীদের কাছে যা নতুন তথ্য প্রমাণ রয়েছে তাতে দেখা গেল যে সেটা আগ্নেয়গিরির জন্য হয়েছে। অনেক বছর আগে, আগ্নেয়গিরির লাভা বয়ে গিয়েছিল চাঁদের গা দিয়ে। তারপর সেই লাভা একসময় শুকিয়ে গিয়ে কালো পাথরের আকার নেয়। এইটাই আমরা কালো দাগ হিসেবে দেখি পৃথিবী থেকে আর তাকে বলি চাঁদের কলঙ্ক।
যখন আপনি যে চাঁদকে দেখেন আপনার কাছে চাঁদকে সব সময় একই রকম দেখায়। যখন চাঁদটি পুরো হয় আপনি তখন চাঁদটিকে বৃত্ত আকৃতির দেখেন। আমরা কেবল চাঁদের একটা সাইডই দেখতে পারি, যেখানে চাঁদের উপরে একটা কালো দাগ দেখা যায়। কিন্তু এই গোল চাঁদটিতো ঘুরছে। তাহলে আমাদের চাঁদের আরেক পাশে কি আছে তা দেখতে পাওয়ার কথা। কিন্তু কেন আমরা আরেক পাশ দেখতে পারি না। কিন্তু কেন হয় এমন?
আসলে এর কারণ হচ্ছে- চাঁদ তার নিজের এক্সেসে যে মাত্রায় ঘুরছে ঠিক একই মাত্রায় চাঁদ পৃথিবীর সঙ্গে ঘুরছে। যাকে সিঙ্ক্রনাস রটেশন এবং টাইডেল লক বলা হয়ে থাকে। ঠিক আমরা যেমনটা জানি পৃথিবি ঘুরে আর তার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদও ঘুরে। কিন্তু চাঁদ সিঙ্ক্রনাস রটেশনে ঘুরছে যার জন্য পৃথিবি থেকে আমরা শুধু চাঁদের এক পাশই দেখতে পারি। ১৯৫৯ সালে সোভিয়েত স্পেস ক্রাফট অ লুনা-৩ চাঁদের না দেখা ৫টি ছবি প্রকাশ করে। যা ছিল মানুষের দেখা প্রথম চাদের আরেকটা পাশ। যা কখনো পৃথিবী থেকে দেখা যায়নি। কিন্তু আপনি যদি খেয়াল করেন চাঁদের যে পাশটিকে আমরা দেখতে পাই ওই পাশটিতে কিছু কালো দাগ দেখা যায়। আমাদের অনেকেরই মনে এই প্রশ্নটা আসে যে এইগুলো কি আর কথায় থেকে আসলো এই কালো দাগ।
ছোটবেলায় বলা হত যে ওই কাল দাগের মধ্যে চাঁদের বুড়িকে দেখা যায়। আবার কেউ কেউ বলতো যে, চাঁদের ওই কালো দাগগুলো হল চাঁদের কলঙ্ক। আসল ঘটনা আমি আজ আপনাদের জানাবো। চাঁদের আমরা যে পাশটি দেখি তার ৩১ ভাগ এ কালো দাগে ভরা। কালো এই দাগকে বলা হয় লুনার মারিয়া। কিন্তু এই কালো দাগ কিভাবে হলো আর পৃথিবী থেকে কেনইবা আমরা এই কালো দাগগুলো দেখতে পাই। এই ঘটনা জানার জন্য আমাদের যেতে হবে চার দশমিক এক বিলিয়ন বছর আগে। এই সময় সোলার সিস্টেমের ত্রেডিস্ট্রিয়াল প্লানেটস যেমন মারকিউরি, ভেনাস, আর মার্সের উপরে এস্ট্রয়েড আর কমিক্স এর বর্ষণ হয়।
যাকে বিজ্ঞানীদের ভাষায়- ল্যাট হ্যাভি বম্বারডমেন্ট বলা হয়ে থাকে। আর মানা হয়ে থাকে যে, এই ল্যাট হ্যাভি বম্বারডমেন্ট এর কারণেই পৃথিবীতে পানি এসেছিল। এই এস্ট্রয়েড আর কমিক্স ট্রেডিস্ট্রিয়াল প্লানেটস এর উপরতো পরছেই এর সঙ্গে সঙ্গে এটি আমাদের চাঁদের উপরেও পরছে। বিশেষ করে চাঁদের ওই ভাগটিতে বেশি পরেছে যে ভাগটি আমরা পৃথিবী থেকে দেখতে পাই। ঐসময় চাঁদের নতুন নতুন ফরমেশন হচ্ছিল। যার জন্য চাঁদটি খুব বেশি গরম ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাঁদের উপরের ভাগটি ঠান্ডা হয়ে যায়। যে কারণে চাঁদের উপরের অংশটুকু কিছুটা শক্ত হয়ে যায়।
ল্যাট হ্যাভি বম্বারডমেন্ট থেকে যে এস্ট্রয়েড আর কমিক্স চাঁদের ওপর পরছিল তা ক্রমাগত চাঁদের গায়ে দাগ ফলে যাচ্ছিল। আর এর ফলে চাঁদের যে গর্তগুলো হয় তা লাভায় ভরে যায়। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই লাভাও ঠান্ডা হয়ে যায়। ঠাণ্ডা লাভাতে আয়রনের মাত্রা খুবই বেশি ছিল। যার জন্য এই জায়গাগুলো সূর্যের আলোকে খুব কম রিফ্লেক্ট করে। চাঁদের ওপরে পরে থাকা ঠাণ্ডা এই লাভাগুলোকে বলা হয়ে থাকে ব্যাসাল্ট। আমরা যেটা জানি যে চাঁদ সূর্যের আলোকে রিফেক্ট করে থাকে। মানে আকাশে যে উজ্জ্বল চাঁদটি আমরা দেখি এর আসল কারণ হলো সূর্য। চাঁদের জায়গাটি আমরা বেশি উজ্জ্বল দেখি এই জায়গাটা সূর্যের আলোকে কয়েক গুন বেশি রিফ্লেক্ট করে থাকে। আর এই জায়গাটি যেখানে আছে লুনার মারিয়া এখানে আয়রনের মাত্রা বেশি হওয়ার কারণা সূর্যের আলো এই জায়গাতে অনেক কম রিফ্লেক্ট হয়ে থাকে।
এজন্য চাঁদের যে পাশটি আমাদের পৃথিবী থেকে দেখা যায় ওখান থেকে যে অংশটুকু লুনার মারিয়া হয়ে রয়েছে ওখানেই আমরা কালো দেখি। তো সব মিলিয়ে আমরা বুঝতেই পারছি এখন চাঁদের যে পাশটি আমরা দেখতে পারি ওখানে হ্যাভি বম্বারডমেন্টের কারণে লুনার মারিয়া হওয়ার ফলে আমাদের এই কালো কালো দাগগুলো চোখে পড়ে। লুনার শব্দটি ল্যাটিন শব্দ লুনা থেকে এসেছে। যার মানে হচ্ছে চাঁদ। আর ল্যাটিন শব্দ মারিয়ার মানে হচ্ছে সমুদ্র। ১৭০০ শতাব্দীর এস্ট্রোনাট চাঁদের কালো দাগগুলো কে ভাবেছিল চাঁদের মাঝে সমুদ্র। এর জন্য উনারা এর নাম রেখেছিল লুনার মারিয়া।
চাঁদে কলঙ্ক আছে এটি শুধুমাত্র সাহিত্যের কথামালা আর উপমা। কলঙ্ক শুধু মানুষেরই হয় কেননা মানুষের কাছেই সম্মান বা মর্যাদা সম্পদ যা অর্জন বা হারানো দুটোই তার মনমানসিকতা, কর্ম, অস্তিত্ব, বেচে থাকার অবলম্বন।
অন্য প্রাণীতে সম্মানবোধ নাই বললেই চলে। তাদের সম্মানের সময় আর কলঙ্ক জীবনে প্রভাব করেনা। আর জড় বস্তুর তো এসবের প্রশ্নই ওঠেনা।
চাঁদে কলঙ্ক বলতে আমরা সুন্দর চাদোয়া বা আভার মধ্যে কালো দাগকে বুঝি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে চাঁদের আলো বা আভা কিছুই নাই। আমরা যে আলো দেখি তা সুর্যের আলো চাদের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের কাছে আসছে। চাদে গেলে মাটি ছাড়া চাদের আলো পাবেন না। আর চাদের গায়ে কালো দাগ মূলত গর্ত, পাথর, মাটির বর্ন, অসমতা ইত্যাদির জন্য আলো প্রতিফলিত হতে না পারলে আধার বা ছায়াময় অবস্থা।
এটি বিশ্বের সবকিছুরই আছে। সূর্যেও আছে। গাছের গায়ে আছে। তাই বাস্তবিক এগুলো কলঙ্ক বলাটা আমাদের কথামালা ছাড়া কিছু না।
ধরুন আপনি ফর্সা মানুষ, সুসম্মানের অধিকারী। কিন্তু আপনার গায়ে তিল আছে। মেয়েদের মুখে তিল তো সুন্দর্য আরো বাড়িয়ে দেয়। তখন ঐ কালোকে কলঙ্ক বলিনা কেন? কারন ওটা দেখতে ভাল লাগে বলে। ঠিক এমনি আমরা আমাদের নিজেদের সুবিধার জন্য এক এক অবস্থা বৈশিষ্ঠকে সময় স্থানভেদে সাহিত্যের কথামালা আর উপমা সাজাতে তকমা লাগিয়ে দেই।