মুনাজাত অর্থ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা, কোনো কিছু চাওয়া বা আবেদন করা। ইসলামী শরীয়তে এর জন্য কোনো সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় নি। সরবে নীরবে যখনই প্রয়োজন হবে তখনই আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করা যেতে পারে। সুতরাং মুনাজাত একটি প্রয়োজন সাপেক্ষ ব্যাপার। ইহকাল ও পরকাল বিষয়ে মানুষের প্রয়োজনের কোনো শেষ নেই বলে মানুষের চাওয়া পাওয়ারও কোনো অন্ত নেই। উপরন্তু দু‘আ-প্রার্থনা ইবাদত-উপাসনার অন্যতম একটি অঙ্গ। হাদীসে দু‘আকে ইবাদতের সারবস্তু বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং আল্লাহর নিকট দু‘আ প্রার্থনা না করা হলে আল্লাহ তা‘আলা রাগান্বিত হন বলেও হাদীসে সতর্ক বার্তা এসেছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে নামাজের পরেও মুনাজাত করা যেতে পারে। এতে কোনো বিধি-নিষেধ নেই। বরং হাদীসে দু‘আ কবুলের আশাব্যাঞ্জক কিছু মুহূর্তের কথা বলা দেয়া হয়েছে। ফরজ নামাজের শেষের সময়টি সে মুহূর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম। সুতরাং ব্যক্তি পর্যায়ে নামাজের পরে মুনাজাত করা যেতে পারে; এব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। বরং এটি একটি কাঙ্ক্ষিত বিষয়। তবে ফরজ নামাজের পরে সম্মিলিতভাবে হাত উঠিয়ে মুনাজাতের ব্যাপারে উলামা মহলে কিছুটা দ্বিমত পরিলক্ষিত হয়। তবে যদি মুনাজাতের এ পদ্ধতিকে আবশ্যক মনে না করে এবং প্রথাগত রূপ না দিয়ে একান্ত স্বাভাবিক নিয়মে গ্রহণ করা হয় তবে এরও অবকাশ রয়েছে। তবে আজকের বাস্তবতা হলো, সাধারণ মানুষ এ বিষয়টিকে নামাজের আবশ্যকীয় অংশ এবং প্রথাগত আচার হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। ভাষায় না হলেও তাদের কার্যক্রমে এটিই প্রমাণিত হয়। মুনাজাত না হলে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, সবার সাথে হাত না উঠানোকে আড় চোখে দেখা, মুনাজাত শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কেউ মুনাজাতে রত থাকলে তাকে মুনাজাত শেষের বার্তা পৌঁছে দেয়াসহ সংঘটিত নানা আচরণ ফরজ নামাজের পরে সম্মিলিত মুনাজাতের আবশ্যকীয়তারই বার্তা বহন করে। এর সাথে যুক্ত হয় সশব্দে মুনাজাত করে মাসবুক মুসল্লীদের একাগ্রতায় বিঘœতা সৃষ্টির মত অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়। এতে করে দেখা যাচ্ছে, জনসাধারণের মাঝে সম্মিলিত মুনাজাতের এ পদ্ধতিটি নামাজে ইমামের ইকতেদা তথা অনুসরণের মত আবশ্যকীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুনাজাতের ক্ষেত্রে এসব অবাঞ্ছিত বাধ্যবাধকতা ও প্রথাসর্বস্বতা পরিহার করা উচিৎ। এবং মুনাজাতের এ বিষয়টিকে একান্ত ইমাম সাহেবের উপর ছেড়ে দেয়া উচিৎ। তার ইচ্ছা হলে কখনো করবেন। ইচ্ছা না হলে করবেন না। মুসল্লীদের ইচ্ছা হলে এক্ষেত্রে ইমামের অনুসরণ করবে। ইচ্ছা না হলে অন্যান্য আযকার পাঠে রত হবে। কিংবা ব্যক্তিগত বিশেষ প্রয়োজন হলে চলে যাবে। মুসল্লীদের এ নিয়ে কথা বলা কোনো ক্রমেই কাম্য নয়। তবে লক্ষণীয় হলো, মুনাজাতের সম্মিলিত এ পদ্ধটি সরাসরি সহীহ হাদীস, আসার এবং সাহাবী ও তাবিয়ীদের কর্মপদ্ধতিতে পাওয়া যায় না। তাই এ পদ্ধতিটিকে মাসনূন পদ্ধতি বলা যায় না। কারণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোনো নির্ধারিত নিয়ম বা রীতি ছিল না। তিনি সাধারণভাবে এ সময়ে বিভিন্ন যিকর ও মুনাজাত পাঠ করতেন। হাদীসের গ্রন্থগুলোতে প্রায় ত্রিশ রকমের যিকর এবং দু‘আর কথা উল্লেখিত হয়েছে। কখনো তিনি যিকর পাঠ শেষে ডানে বা বামে কিংবা মুসল্লী সাহাবীদের দিকে মুখ করে ঘুরে বসতেন। কখনো বা সালামের পর উঠে দাড়িয়ে নসীহত করতেন। ইত্যাদি। আল-আহাদীসুল মুখতারাহ, হাদীস তিনশত তিন। মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ১৭৩৪৫, মাআরিফুস সুনান ৩/৪০৯, আহসানুল ফাতাওয়া ৩/৬৭-৬৮, জাওয়াহিরুল ফিকহ ২/১৯৯-২০৬
নামাজের পর মুনাজাত করা মুস্তাহাব। এটা না করলে নামাজ হবে না, এরূপ ধারণা করা বিদঅাত ও গোমরাহী। মুনাজাতের পক্ষে কিছু দলিল : (ক) সূরা ৯৪ বা অালাম নাশরাহ এর অায়াত -৭ এর অংশ ফা ইযা ফারাগতা অর্থাৎ যখনই অবসর পাও এর তাফসীরে প্রখ্যাত মুফাসসিরগণের বক্তব্য : (১) হযরত যাহহাক (রা.) সূরা ইনশিরাহ বা অালাম নাশরাহ এর উক্ত অায়াতের তাফসীরে বলেন, যখন তুমি ফরজ নামাজ থেকে ফারেগ হবে তখন অাল্লাহর দরবারে দুঅায় মশগুল হবে। (তাফসীরে দুররে মনসুর ৬/৩৬৫) (২) হযরত ইবনে অাব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি উক্ত অায়াতের তাফসীরে বলেন, যখন তুমি ফরজ নামাজ হতে ফারেগ হও, তখন অাল্লাহর দুঅায় মশগুল হয়ে যাবে। (তাফসীরে ইবনে অাব্বাস, পৃষ্ঠা নং. ৫১৪) (৩) হযরত কাতাদাহ, যাহহাক ও কালবী রা. হতে উক্ত অায়াতের তাফসীরে বর্ণিত অাছে, তাঁরা বলেন, ফরজ নামাজ সম্পাদন করার পর দুঅায় লিপ্ত হবে। (তাফসীরে মাযহারী ১০/৩৭৪ পৃষ্ঠা) (খ) নামাজের পর মুনাজাতের ওপর নবিজির (সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম) অামল : (১) হযরত মুগীরা ইবনে শুবা রা. বর্ণনা করেন যে, নবিজি (সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বীয় নামাজের শেষে দুঅা করতেন। (তারিখে কাবির, লেখক ইমাম বুখারি রহ. ৬/৮০) (২) হযরত অানাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, নবি করিম (সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন নামাজ থেকে ফারেগ হতেন তখন এ দুঅা করতেন। হে অাল্লাহ! অামার জীবনের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর কর অামার শেষ জীবনকে এবং অামার অামলের মধ্যে উত্তম কর শেষ অামলকে এবং অামার দিনসমূহের মধ্যে সবচেয়ে মনোরম কর তোমার সাথে সাক্ষাতের দিনকে। (অাল মুজামুল অাওসাত ১০/১৮৭ হাদিস নং ৯৪১১) (৩) হযরত যায়েদ বিন অাকরাম (রা.) বলেন যে, নবি করিম (সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম) কে প্রত্যেক নামাজের পর এ দুঅা করতে শুনতাম, হে অাল্লাহ! যিনি অামাদের প্রতিপালক এবং প্রত্যেক জিনিসের প্রতিপালক। (সুনানে অাবু দাউদ ১/২১১ হাদিস নং ১৫০৮) (গ) নামাজর পর মুনাজাত সম্পর্কে নবিজির (সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নির্দেশ : (১) হযরত অাবু উমামা বাহেলী (রহ.) বর্ণনা করেন যে, নবি (সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞাসা করা হল যে কোন দুঅা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি? এরশাদ হল, শেষ রাত্রে (তাহাজুদ্দের পর) এবং ফরজ নামাজ সমূহের পরে। (তিরমিজি হাদিস নং ৩৪৯৯) (২) অালী ইবনে অাবু তালিব (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভু অত্যন্ত লাজুক ও দয়ালু। কোন বান্দা তার দুটি হাত উঠিয়ে মুনাজাত করলে তার হাত খালি অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে তিনি লজ্জাবোধ করেন। (অাবু দাউদ ১৪৮৮) তাই অামরা নামাজের পর মুনাজাতকে মুস্তাহাব মনে করব। অাদব মেনে দুঅা করব।