রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নাকি প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করতেন। এবং তিনি নিজেও নাকি প্ল্যানচেট করতেন। বস্তুবিজ্ঞান এর কি সমাধান করে, সেই বিষয়ে খালি ধোঁয়াশা তথ্যই পাইছি। বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পেতে চাই। প্ল্যানচেট কি কোন ধরনের বুজরুকি? বিজ্ঞান কি বলে?
শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
Call

অনেকে রবীন্দ্রনাথের প্রেতচর্চার প্রসঙ্গটির উল্লেখ করে তাঁকে অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাসী বলে প্রমাণ করতে চান৷ কিন্তু এঁরা ভুলে যান যে রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র বিষয়ে কৌতূহল ছিল৷ এই কৌতূহলবশেই এক সময় তিনি প্ল্যানচেট নিয়ে প্রেতচর্চার বিষয়টিও পরখ করে দেখতে চেয়েছিলেন৷ প্ল্যানচেটের মাধ্যমে পরলোকগত মানুষের আত্মাকে মর্ত্যলোকে ডেকে আনার এবং সে-আত্মার সঙ্গে মতবিনিময় করার হুজুগটি এক সময়ে খুবই জাঁকালো হয়ে উঠেছিল৷ রবীন্দ্র পরিমণ্ডলের কিছু মানুষের মধ্যেও সে-হুজুগটির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল৷ তাঁরা রবীন্দ্রনাথকেও সেই প্রেতচর্চার আসরে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ চির কৌতূহলী চিরকিশোর রবীন্দ্রনাথ প্রেতচর্চার সেই খেয়ালখেলার আসরে একজন আমুদে কিশোর খেলোয়াড়ের মতোই যোগ দিয়েছিলেন৷ এতে এমন কথা মোটেই প্রমাণিত হয় না যে তিনি প্রেততত্ত্ব তথা অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন৷ অনেক উচ্চ আধ্যাত্মিক ভাবের কথা রবীন্দ্র রচনায় আছে নিশ্চিয়ই, কিন্তু প্ল্যানচেট-বাহিত প্রেততত্ত্বে বিশ্বাসের পরিচয় রবীন্দ্রসাহিত্যের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কি?
মানুষের আত্মা মৃতু্যর পরে পরলোকে যায়, এবং সেখানে গিয়ে ইহলোকের কৃতকর্ম অনুযায়ী শাস্তি বা পুরস্কার লাভ করে_এ-রকম বিশ্বাস তো পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরই৷ কিন্তু পরলোক বা স্বর্গ নরক সম্পকর্ীয় সাধারণ বিশ্বাসের পাশাপাশি মৃতু্য-পরবতর্ী আত্মার অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে হিন্দুদের বিশ্বাসে অন্যতর একটি বৈশিষ্ট্য ও অভিনবত্ব আছে৷ হিন্দুরা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী৷ অর্থাত্ মৃতু্যর পর আত্মা আগেকার দেহ ছেড়ে অন্য দেহ আশ্রয় করে, দুষ্কৃতি বা সুকৃতির মাত্রা অনুযায়ী নীচকুলে বা উচ্চকুলে জন্মগ্রহণ করে, এমন কি মহাপাপী মানুষের আত্মা ইতরপ্রাণী রূপেও জন্ম নিতে পারে৷ জন্মান্তর গ্রহণকারী এই আত্মা নিশ্চয়ই প্ল্যানচেটে এসে ভর করতে পারে না, কোনো আত্মা এ-রকম করেছে বলে কোনো প্রেতচর্চাকারীর কাছে শোনা যায়নি৷ তবে, কিছু কিছু আত্মা নাকি নতুন জন্ম নেয়ার পরও পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করতে পারে৷ এদেরই বলা হয় 'জাতিস্মর'৷ কেউ কেউ আবার পুরোপুরি জাতিস্মর না হয়েও স্বপ্নযোগে পূর্বজন্মের কিছু প্রসঙ্গ জেনে যায়৷ রবীন্দ্রনাথ একবার এ-রকম একজন আধাজ্ঞাতিস্মর যুবকের পাল্লায় পড়েছিলেন৷ সেই যুবকটি দাবি করেছিল যে পূর্বজন্মে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী ছিলেন তার জননী৷ স্বপ্নযোগেই এ-খবর সে জানতে পেরেছে৷ যুবকটি বলেছিল যে সে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, অনেক চিকিত্সাতেও সেই ব্যাধি থেকে সে মুক্ত হতে পারেনি৷ অবশেষে স্বপ্নযোগেই জানতে পারে যে, সে যদি তার পূর্বজন্মের মায়ের (অর্থাত্ রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর) পাদোদক (অর্থাত্ পা ধোয়া জল) পান করে তবেই সে সুস্থ হতে পারবে৷ রবীন্দ্রনাথ ঘর থেকে সাধারণ জল এনেই তাকে পত্নীর 'পাদোদক' বলে চালিয়ে দিলেন, যুবকটি বেশ কিছুদিন কবির বৈঠকখানাতে অবস্থান করে সেই জলই পান করতে লাগলো, এবং বললো যে সে এতে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু সুস্থ হয়েও কবির বাড়ি থেকে চলে যাবার গরজ দেখালো না৷ পরে অনেক কষ্টে কবি তাঁর 'পূর্বজন্মের পুত্রে'র হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন৷ এই খবর প্রচার হয়ে যাবার পর আর একটি মেয়েও কবির পূর্বজন্মের কন্যা হওয়ার দাবি জানিয়েছিল, এবং সে-ও নাকি স্বপ্নেই তার পূর্বজন্মের খবর জানতে পেরেছিল৷ পূর্বজন্মের পুত্রকে নিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাবার পর পূর্বজন্মের কন্যাকে কবি যে আর প্রশ্রয় দেননি, একান্ত কৌতুকের সঙ্গেই তিনি তাঁর জীবনস্মৃতিতে সে-কথার উল্লেখ করেছেন৷ বোঝা যায় : প্ল্যানচেটে পরলোকগত মানুষের আত্মাকে ডেকে এনে প্রেতচর্চার প্রতি যেমন, তেমনই পূর্বজন্মের স্মৃতিবাহী 'জাতিস্মর'দের প্রতিও রবীন্দ্রনাথ নিতান্ত কৌতুকের দৃষ্টিতেই তাকিয়েছেন, এ-সব বুজরুকিকে নিজের বিশ্বাসের চৌহদ্দিতে ঠাঁই দেননি৷ লৌকিকেই তাঁর বিশ্বাস ছিল, অলৌকিকে নয়৷ আর এ-কথা কে না জানে যে লৌকিকে বিশ্বাসই বস্তুবাদের বৈশিষ্ট্য, এবং অলৌকিক বিশ্বাস ভাববাদের?
রবীন্দ্রনাথের যৌবনে এদেশে থিওসফির চর্চা ছিল খুবই ফ্যাশনদুরস্ত একটি বিষয়৷ রবীন্দ্রনাথ এই অলৌকিকতা-সর্বস্ব থিওসফির প্রতিও কৌতুকের দৃষ্টিতেই তাকিয়েছেন, 'ক্ষুধিত পাষাণ' গল্পটিতে থিওসফির 'অপূর্ব ম্যাগনেটিজম অথবা দৈবশক্তি, অথবা সূক্ষ্মশরীর, অথবা ঐ ভাবের একটা কিছু' নিয়ে বিদ্রুপাত্মক বক্রোক্তি করেছেন, একদিনের জন্যও এই ফ্যাশনের কাজে আত্মসমর্পণ করেননি৷ অথচ, সে-সময়ে অনেক অনেক পাশ্চাত্য শিক্ষিত মননশীল হিন্দুও থিওসফি নিয়ে কী মাতামাতিটাই-না করেছেন! মাদাম ব্লাভাটস্কি, কর্নেল অলকট ও এ্যানি বেসান্তের মতো বিদেশী বিদেশিনীরা ছিলেন থিওসফির প্রচারক৷ সমগ্র বিশ্বচরাচরের পেছনে একটি অলৌকিক সত্তা বা আত্মা আছে বলে তাঁরা প্রচার করতেন৷ তাঁরা বলতেন : 'এক শ্রেণীর সাধু' আছে যাঁরা অলৌকিক ক্ষমতা বলে সেই অদৃশ্য সত্তার পরিচয় লাভ করেছেন, এবং সেই সাধু মহাত্মারা আজও হিমালয় পর্বতে বাস করে তপস্যা করে যাচ্ছেন৷ মাদাম ব্লাভাটস্কি নাকি সেই মহাত্মাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে 'অনেক গূঢ়তত্ত্ব' জানতে পেরেছেন এবং নিজেও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারিণী হয়ে উঠেছেন৷ এ-সব কথা অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাসী হিন্দুদের খুব মনে ধরে, তাঁরা থিওসফির মধ্যে দিয়ে হিন্দুত্বের অভিমান চরিতার্থ করার সুযোগ পেয়ে যান৷ খ্রীস্টান ধর্মযাজক ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষরা হিন্দুর প্রতিমা পূজা, জাতিভেদ ও অন্যান্য অনেক কুসংস্কারের নিন্দা করতো৷ সেই নিন্দার জুত্সই জবাব দেবার মতো কোনো যুক্তি সনাতনী হিন্দুদের হাতে ছিল না৷ ঠিক সেই সময়েই থিওসফিস্টরা হিন্দুদের প্রায় সব যুক্তিহীন বিশ্বাস ও আচরণের সমর্থনে এগিয়ে আসে৷ আর তাতে হিন্দুরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে যায়৷ থিওসফিস্টদের সমর্থনই তাদের 'বৈজ্ঞানিক হিন্দুধর্ম' তথা হিন্দু রিভাইভ্যালিজম্কে আরও পোক্ত করে তোলে৷ ভাববাদী ভাবোন্মত্ততা তাদের নতুন করে পেয়ে বসে৷
হিন্দু কলেজের ছাত্ররা যে মুক্তবুদ্ধির চর্চার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন, বিদ্যাসাগর হিন্দুদের শাস্ত্রীয় মূঢ়তা থেকে মুক্ত করার যে প্রয়াস নিয়েছিলেন, অক্ষয় কুমার দত্ত 'বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার'-এর মধ্য দিয়ে যে বস্তুবাদী চিন্তার প্রসারে এগিয়ে এসেছিলেন_সে সবকিছুই যেন উনিশ শতকের আশির দশকে থিওসফিতে চোলাই-হওয়া হিন্দু রিভাইভ্যালিজমের ধাক্কায় ভাববাদী চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে বসলো৷ সে সময়ে সেই চোরাবালি সম্পর্কে সচেতনতা আর কারো মধ্যে তেমন দেখা গেল না৷ সচেতনতা দেখালেন, বলতে গেলে, একমাত্র রবীন্দ্রনাথই৷ ভাববাদী কবি হয়েও একজন নিষ্ঠাবান বস্তুবাদীর মতোই তিনি বৈজ্ঞানিক দায়িত্ব পালন করলেন৷

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ