নভেল করোনা ভাইরাস আপডেট, ০২/০৩/২০২০।

ভাইরাসের নামঃ SARS-CoV-2
রোগের নামঃ COVID-19

হঠাৎ করে আমরা কেন যেন করোনা ভাইরাস নিয়ে একটু চুপচাপ হয়ে গেছি। এই ভাইরাস আমাদের উপর কখনও আক্রমন করবেনা, এমন একটি ধারনা হয়তো আমাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে অথবা আক্রমন করলেও এটিকে মোকাবিলা করতে আমাদের সক্ষমতা সীমিত জেনে হয়তো আমরা থম মেরে গেছি।

সত্য কথা বলতে কি, ভাইরাসটি ভয়াবহ ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। গত দশদিনে নতুন ৩৪ টি দেশ যোগ হয়ে আক্রান্ত দেশের সংখ্যা ৭০ তে দাঁড়িয়েছে। উৎপত্তিস্থল চীনের সার্বিক অবস্থার উন্নতি হলেও দক্ষিন কোরিয়া, ইরান ও ইটালীতে এই রোগটির অবস্থা সত্যিই ভয়াবহ। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইটালীর পরে জার্মানীতে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের স্থানের পরিবর্তন ও বিস্তৃত হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা ভীষনভাবে উদ্বিগ্ন। WHO ইতোমধ্যে সারাবিশ্বে প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান। নভেল করোনাভাইরাসের আক্রমন দেশটিতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের মিছিল। আজ অবধি আক্রান্তের সংখ্যা ১৫০১ জন। উদ্বেগের বিষয় গত একদিনে ৫২৩ জন আক্রান্ত হয়েছে, অথচ চায়নাতে বেড়েছে ২০২ জন। আর এ পর্যন্ত মারা গেছে ৬৬ জন । যদিও বিবিসি সহ অন্যান্য বিশ্বস্ত সূত্র মতে এ সংখ্যা ২০০ এর ও বেশি। মৃতের হারও বেশী ইরানে, ৫.৬%। মৃতের হার কেন এত বেশী? প্রথমত বহু কেইস সনাক্ত হয়নি। চীনে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রোগটির বিস্তৃতি ঘটায় রোগ সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে সহজে। কিন্তু ইরানে রোগীরা বিভিন্ন সোর্স থেকে ভাইরাসটি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাই শুধুমাত্র যারা সনাক্ত হয়েছে তাদের সংস্পর্শে আসা এবং মুমুর্ষূ রোগীদের সাথে যারা ছিল তাদেরই মুলত ডায়াগনোসিস হয়েছে। দ্বিতীয়ত, চীন যেভাবে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে নিখুঁতভাবে রোগটি নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করেছে, আইসিইউর যথেষ্ট সাপোর্ট দিতে পেরেছে, ইরান তাতে ব্যর্থ হয়েছে। ইরানের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমন ছড়িয়ে পড়েছে। এসব দেশের আক্রান্ত রোগীর ইরান ভ্রমনের ইতিহাস আছে। বাংলাদেশের বহু লোক মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকুরীরত থাকায় তারা করোনা ঝুঁকিতে আছেন পূর্ণমাত্রায়।

নভেল করোনা ভাইরাস সম্বন্ধে অনেকেই বলছেন, যেসব দেশের তাপমাত্রা বেশী, সেসব দেশে এর সংক্রমন হবেনা। বাংলাদেশে যেহেতু গরম পড়ে গেছে, বাংলাদেশ ঝুঁকিমুক্ত। সারাবিশ্বের বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখন পর্যন্ত ভাইরাসটির প্রকৃতি অজানা। সকলের অবগতির জন্যে বলছি, সিঙ্গাপুরে তাপমাত্রা ৩৩ ℃ এবং এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১০৬ জন।

সাধারণত কোন ভাইরাস দিয়ে সংক্রমন হলে, রোগী ওই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রাপ্ত হন। অর্থাৎ একই ভাইরাস দ্বিতীয়বার আক্রমন করলেও তা প্রতিহত হয়। কিন্তু নভেল করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে ভিন্নরকম ঘটনা ঘটছে৷ চীনের ১৪% মানুষ দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছে। এটি প্রমান করে ভাইরাসটির মিউটেশনের হার অনেক বেশী। ফলে খুব দ্রুত এটি চেহারা পরিবর্তন করে নিজ এন্টিবডির কাছেই অজানা হয়ে যায়। ফলে নভেল করোনা ভাইরাস থেকে সুস্থ রোগীর রক্তরস পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে আক্রান্ত রোগীর যে চিকিৎসাপদ্ধতি চীন আবিষ্কার করে তা ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়।

আমরা কি করছি?
রাস্তায় বের হলেই দেখি বহু লোক N95 বা সার্জিক্যাল মাস্ক পড়ে ঘুরে বেরাচ্ছে। N95 মাস্ক ৯৫% পর্যন্ত বায়ুবাহিত জীবানুকে ফিল্টার করতে পারে। খুব আঁটোসাঁটোভাবে মুখ ও নাককে ঢেকে রাখে বলে এটি একেবারেই আরামদায়ক নয়। তাছাড়া এটি পরার আগে ফিট টেস্ট করে নিতে হয়। মানুষদের দেখি সাইজের চেয়ে বড় মাস্ক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা পরা আর না পরা একই কথা। আর এই মাস্ক ৮ ঘন্টার বেশী ব্যবহার করাও যায়না৷ নভেল করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে অনেকেই মাস্কের এত গুরুত্ব দেয়ায় দামও আকাশ চুম্বী হয়ে গেছে। মাস্কের যেহেতু জীবানু ধ্বংসে কোন ভূমিকা নেই, মুখ নাক থেকে নিঃসৃত ভাইরাস এর গায়ে আটকে থাকে ও সেখানে ভাইরাসটি কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারে। মোটকথা, মাস্ক নভেল করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মাস্ক মূলত যাদের হাঁচি কাশি আছে তারা পরবেন অন্যকে বাঁচানোর জন্য

আরেকটা কথা, করোনা ভাইরাস respiratory droplet এর মাধ্যমে ছড়ায়, যার সাইজ ৫ মাইক্রনের বেশী হওয়ায় বাতাসে ভাসতে পারেনা। টেবিল, চেয়ার, দরজার হাতল, লিফটের ভেতরের হাতল, সিঁড়ির হাতল , ল্যাপটপ, মোবাইল, যে বস্তু আমরা প্রতিনিয়ত স্পর্শ করি তাতে এই ভাইরাস থাকার আশংকা রয়েছে।

তাই WHO মাস্ক পরার চেয়েও হাত ধোয়ার উপর গুরুত্ব দিয়েছে বেশী।

আসুন,
১. নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধুই।
২.ব্যাগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখি। 
৩. নিজেদের মধ্যে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখি ( respiratory droplet ৩ ফুটের ভেতরে ছড়ায়)
৪. করমর্দন বা কোলাকুলি পরিহার করি
৫. কাশি শিষ্ঠাচার নিজে মেনে চলি ও সন্তানকে শেখাই।
৬. আপনি যদি ডাক্তার হন, কিছু সার্জিকাল মাস্ক সাথে রাখুন। রোগীর কাশি থাকলে তাকে মাস্ক পড়তে বলুন।যেকোন রোগী দেখার পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন।

সিঙ্গাপুরে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত যে রোগী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে আছেন, তার অবস্থার উন্নতি হয়নি। আল্লাহ তাকে দ্রুত সুস্থ করে দিন।

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে রক্ষা করুন, আমীন।।

লিখেছেন,,
ডা. নুসরাত সুলতানা।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে