শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

গ্যাসের সমস্যা আসলে কী আর এসিডিটিই বা কী?এসবের লক্ষণ ও চিকিৎসায় পার্থক্য কী? গ্যাস হওয়া আমেরিকান রিসার্চ সেন্টার অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি র মতে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক- চতুর্থাংশই গ্যাসের সমস্যায় ভুগছে। মনে রাখতে হবে, খাবার পর অন্ত্রে (ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদান্ত্র) গ্যাস তৈরি হওয়া স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। ২৪ ঘণ্টায় অন্তত এক থেকে চার পাইন্ট গ্যাস অন্ত্রে তৈরি হয়। এই গ্যাস ২৪ ঘণ্টায় সাধারণত ১৪ বারে ঢেঁকুর হিসেবে বা পায়ুপথে বের হয়। আমরা যেসব খাবার খাই তা হজম হয়। এই হজম হওয়ার প্রক্রিয়াতেই উপজাত বা বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে গ্যাস উৎপন্ন হয়। আবার বৃহদন্ত্রে (যেখানে হজম হওয়া খাবার মল হিসেবে জমা থাকে) থাকে অনেক ব্যাকটেরিয়া। এগুলোও গ্যাস তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যে গ্যাসগুলো অন্ত্রে তৈরি হয় তার মধ্যে আছে কার্বন ডাই- অক্সাইড, হাইড্রোজেন ও মিথেন গ্যাস। কখনো কখনো সালফাইড জাতীয় গ্যাসও তৈরি হয়। কোনো কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে গ্যাস তৈরি হলে গ্যাস সমস্যা তৈরি হয়। গ্যাস তৈরি হওয়ার সমস্যা সাধারণত তিন ধরনের। * বেলচিং বা ঢেঁকুর ওঠা * ব্লটিং বা পেট ফুলে যাওয়া * ফাস্টিং বা পায়ুপথে গ্যাস বের হওয়া বেলচিং বা ঢেঁকুর ওঠা ঢেঁকুর ওঠা স্বাভাবিক, তবে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ওঠা অস্বস্তিকর ও কষ্টকর। সাধারণত নিচের কারণগুলোর জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঢেঁকুর ওঠে। * খাবার গ্রহণের সময় অপ্রয়োজনে বেশি বেশি ঢোক গিললে, কথা বেশি বললে, বারবার পানি পান করলে পাকস্থলীতে বাড়তি বাতাস পরিবেশ থেকে প্রবেশ করে। এগুলো পরে বের হয়। * ধূমপান, হুঁকো বা পাইপ খেলে। * কোল্ডড্রিংকস বা সোডা-জাতীয় পানীয় বেশি বেশি পান করলে। * জুস বা কোনো ড্রিংকস পানের সময় স্ট্র ব্যবহার করলে। * চুইংগাম বা চিবিয়ে খেতে হয় এমন খাবার বেশি খেলে। * ঠিকমতো ফিট হয়নি এমন নকল দাঁত ব্যবহার করলে। এ ক্ষেত্রে ঢোক গেলার হার বেশি হয় ও আটকে পড়া বাতাস পাকস্থলীতে ঢুকে যায়। * অভ্যাসের কারণেও অনেকের বেশি ঢেঁকুর ওঠে। * কিছু অসুখের কারণে বেশি বেশি ঢেঁকুর উঠতে পারে। যেমন_ জিইআরডি বা গ্যাস্ট্রো ইসোফেজাল রিফ্লাক্স ডিজিজ (বুকজ্বলা), হায়াটাস হার্নিয়া, ফ্রুক্টোজ ম্যাল অ্যাবজর্বশন বা চিনি-জাতীয় খাদ্য শোষণজনিত সমস্যা, ইউরেমিয়া, ক্রনিক রেনাল ফেইলিওর ও ডায়াফ্রামের ইরিটেশন। ব্লটিং বা পেট ফুলে যাওয়া এই রোগে পেট ফুলে যায়, বুকে অস্বস্তি বোধ হয়, সব সময় পেট ভরা ভরা অনুভূত হয়, অনেক সময় বুকে চাপ ধরা ব্যথার মতো মনে হয়। কোনো কোনো সময় বুকের ব্যথা বা অস্বস্তিকে রোগী ও চিকিৎসক উভয়ই হার্টের অসুখ বা এনজাইনা বলে বিভ্রান্ত হন, আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। নিচের কারণগুলোর জন্য ব্লটিং হয়_ * কিছু খাবারের কারণে, যেমন_ শিমের বীজ, মটরশুঁটি, ডালজাতীয় খাবার, চর্বিজাতীয় বা তৈলাক্ত খাবার, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার_ঘি, পনির, দই ইত্যাদি। কিছু সবজি যেমন_ওল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি। কিছু ফল যেমন_আপেল, কলা ইত্যাদি। সিরিয়াল (যেমন কর্নফ্লেক্স), কেক, পেস্ট্রি, চকোলেট, কোল্ডড্রিংকস ইত্যাদি। * কিছু কিছু অসুখের কারণে, যেমন_ জিইআরডি বা গ্যাস্ট্রো ইসোফেজিয়ার রিফ্লাক্স ডিজিজ (বুকজ্বলা) পিইউডি বা পেপটিক আলসার ডিজিজ। পিত্তথলির পাথর বা গলস্টোন। আইবিএস বা ইরিটেবল বাওল সিনড্রোম। কী করণীয় এ ধরনের সমস্যায় পড়লে ডাক্তার দেখাতে হবে। তিনি পরীক্ষা করে যদি বলেন, আপনার পেটের অস্বস্তি কোনো অসুখের কারণে নয়, সে ক্ষেত্রে আপনি কয়েকটি নিয়ম মেনে চললে ভালো থাকবেন। ১. পরীক্ষা করে নিজেই নিশ্চিত হোন কোন খাবারের কারণে আপনার সমস্যা হচ্ছে। এটি দুটি পদ্ধতিতে নিশ্চিত করা যায়_ ক. আপনার যদি মনে হয় বিশেষ ধরনের খাবারের জন্য সমস্যা হচ্ছে, তার একটি তালিকা তৈরি করুন। ধরা যাক, আপনার দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারে সমস্যা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে যেকোনো এক ধরনের (ধরুন দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার) খাবার অন্তত সাত দিন বন্ধ রাখুন। যদি দেখেন এতে আপনার সমস্যা কমে গেছে, তাহলে বুঝবেন এটিই আপনার অস্বস্তির কারণ। কিন্তু যদি আপনার সমস্যা একই রকম থাকে, তবে এটি খাওয়া আবার শুরু করে তালিকার অন্য ধরনের খাবার অন্তত সাত দিন বন্ধ রাখতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত হোন নির্দিষ্ট কোনো খাবারে আপনার সমস্যা হচ্ছে কি না। খ. দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো সন্দেহজনক সব খাবার সাত দিন বন্ধ রাখা। এরপর প্রতিদিন ওই সন্দেহভাজন খাদ্য এক এক করে যোগ করুন এবং লক্ষ করুন তাতে সমস্যা হচ্ছে কি না। যেমন_সবজি যোগ করুন এবং খেয়াল করুন কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। সমস্যা হলে তো বুঝেই গেলেন, না হলে এর সঙ্গে আবার অন্য খাবার যোগ করুন। এভাবে বন্ধ করে দেওয়া খাবারগুলো আবার এক এক করে যোগ করে দেখুন নির্দিষ্ট কোন খাবারে সমস্যা হচ্ছে। ২ . অনিয়ম ও টেনশন করলে পেটে গ্যাস হওয়া বেড়ে যায়। তাই কিছু নিয়ম মেনে চলুন_ * চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করুন। * ধূমপান করবেন না। * দুগ্ধজাত খাবার কম খাবেন। * খুব দ্রুত খাবার খাবেন না। খাবার ধীরে ধীরে সময় নিয়ে ও অল্প অল্প করে খান। * খাবারের মাঝখানে কখনো পানি খাবেন না। এমনকি খাবারের পর এক থেকে দুুুই ঘণ্টার মধ্যেও পানি না খাওয়াই ভালো। কারণ এতে ডাইজেসটিভ জুস পাতলা হয়ে যায়, খাবার হজম হতে দেরি হয় বা বদহজম হয়। * হাঁটা অবস্থায় অথবা কোনো কাজ করা অবস্থায় খাবেন না। এমনকি টিভি দেখতে দেখতেও খাবেন না। শান্তভাবে বসে খাবার খান। * খাবার দুই ঘণ্টার মধ্যে ঘুমাতে যাবেন না। * কখনো একবারে খুব বেশি খাবেন না। পেট যেন অল্প একটু খালি থাকে, সেটা খেয়াল রাখুন। * অল্প অল্প করে বারবার খান। * আদা চা, লবণ ইত্যাদি খান। এতে গ্যাস তৈরি হওয়া কমে যায়। * রাত জাগবেন না। * কখনো হঠাৎ বুকে ব্যথা হলে, চাপ চাপ ব্যথা হলে অবহেলা করবেন না। হার্টের ব্যথা কি না তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হোন। ফাস্টিং বা পায়ুপথে গ্যাস বের হওয়া এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কিন্তু কখনো বেশি হলে অস্বস্তি ও বিরক্তির কারণ হয়ে থাকে। এটি সাধারণত কোনো অসুখের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। * গ্যাসের সমস্যার সঙ্গে আলসার না থাকলে কখনোই রেনিটিডিন বা ওমিপ্রাজল খাওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং সিমেথিওন বা মোটিলিটি স্টিমুল্যান্ট-জাতীয় ওষুধ দিন। এসিডিটি বা বুকজ্বলা পাকস্থলীতে খাদ্য হজমের জন্য সহায়ক হাউড্রোক্লোরিক এসিড তৈরি হয়। এই এসিড যাতে পাকস্থলীর ভেতরের গাত্রকে হজম বা ক্ষয় (আলসার) করে না ফেলে সে জন্য পাকস্থলীর ভেতরের দিকে একটি পিচ্ছিল আবরণ থাকে। এ আবরণটিতে থাকে মিউকাস লেয়ার বা মিউকাসের আস্তর। কোনো কারণে এসিড নিঃসরণ বেড়ে গেলে বা পাকস্থলী রক্ষাকারী গাত্রটি ক্ষয়প্রাপ্ত (আলসার) হলে পেটের উপরিভাগ জ্বলে। পাকস্থলী ওপরের দিকে ইসোফেগাসের (খাদ্যনালীর অংশ) সঙ্গে যুক্ত থাকে। কোনো কারণে এই এসিড যদি ইসোভেগাসে আসে, তবে বুকজ্বলা সমস্যাটি দেখা দেয়। বুকজ্বলা সমস্যাটি হার্টবার্ন নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে এসিডিটিতে আক্রান্ত ৯০ শতাংশ লোকেরই পাকস্থলীর মিউকাস স্তর ক্ষয়ের বড় কারণ হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি নামের ব্যাকটেরিয়া। সাধারণত খালি পেটেই এই জ্বলাভাব বেশি হয়। এর সঙ্গে মুখ টক টক হয়, কখনো কখনো বমি-বমি ভাবও হয়। যাদের আলসার আছে তাদের রক্তবমি, কালো রঙের পায়খানা হতে পারে। এ ছাড়া অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রোগী শক বা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এসিডিটি বা বুকজ্বলার চিকিৎসা এসিডিটি বা বুকজ্বলা সমস্যায় অ্যান্টাসিড, রেনিটিডিন, ওমিপ্রাজল, ইসোমিপ্রাজল, প্যানটোপ্রাজল, ল্যান্সোপ্রাজল, র্যাবেপ্রাজল-জাতীয় ওষুধ সেবন করতে হয়। যাদের আলসার হেলিকোব্যকটার পাইলোরির জন্য হয়, তাদের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপির সঙ্গে অ্যান্টি আলসারেন্ট দেওয়া হয়। অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে ইরাথ্রোমাইসিন, নিটাজক্সামাইড ইত্যাদি দেওয়া হয়। এসিডিটি- সংক্রান্ত ভুল ধারণা অনেকেই ভাবেন রাতে ঠাণ্ডা দুধ খেলে বুকজ্বলা কমে। তাই রাতে ঘুমানোর আগে এক গ্লাস দুধ খান। কিন্তু দুধ কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও চর্বিসংবলিত একটি ভারী খাবার। এতে পাকস্থলীতে এসিড নিঃসরণের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর সে কারণে পাকস্থলীতে ক্ষয় বেশি হয়। অনেকে মনে করেন, এসিডিটি থাকলে ফল খাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু পেঁপে, আনারস, আম ইত্যাদি ফলে ডাইজেস্টিভ এনজাইম থাকে, যা হজমে সাহায্য করে ও এসিডিটি কমায়। যে কারণে এসিডিটি বেশি হয় * ঝাল খাবার * টক খাবার, যেমন_ তেঁতুল, আমড়া * ভাজাপোড়া খাবার * অ্যালকোহল * কফি, চা, চকোলেট- জাতীয় উত্তেজক পানীয় * সিগারেট, বিড়ি ইত্যাদি তামাকজাত দ্রব্য এ ছাড়া টেনশনে থাকলে, ব্যথানাশক ওষুধ খেলে বুক জ্বলতে পারে। I

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ