শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
Call

আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব আর সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে বাংলাদেশে আশংকাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। আর আইনের সঠিক প্রয়োগ না হবার কারণে পার যেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। ফলে প্রতিনিয়ত এ ধরণের লোমহর্ষক ঘটনার শিকার হচ্ছে কোন না কোন নারী। আর পাষণ্ডদের বিকৃত লালসা থেকে বাদ যাচ্ছে না নিষ্পাপ শিশুরাও। গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দশ মাসে শুধু চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসাপাতালেই ধর্ষণের শিকার ২৪১ জন নারী ও শিশু চিকিৎসা নিয়েছেন। তিন বছরের ছোট অবুঝ শিশুও দুবৃত্তদের বিকৃত এ লালসা থেকে মুক্তি পায়নি। ধর্ষণের শিকার হয়ে চলতি মাসের ৮ তারিখ চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে রুমি নামের তিন বছরের একটি শিশুটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে আসা ধর্ষণের শিকার ৭৪ জনের মধ্যে ১০ জন ছিল শিশু ও কিশোরী। বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সীরা ধর্ষণের শিকার হয় বেশি। এছাড়া ২৫ থেকে ৩৫ বছরের নারীরাও রেহাই পায়নি পাশবিক এ নির্যাতন থেকে। নারী বা শিশু ধর্ষণের ঘটনা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এ সংখ্যা ছিল ১৮ জন। পরবর্তী মাসে তা কমলেও মার্চ এবং এপ্রিলে চিকিৎসা নেয় ১৯ জন ধর্ষিতা। সর্বোচ্চ বেশি সংখ্যক ধর্ষিতা চিকিৎসা নিতে আসে জুলাই এবং আগস্ট মাসে। এ সময় যথাক্রমে ৪৩ এবং ৩৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়ে এখানে চিকিৎসার জন্য আসে। এছাড়া সেপ্টেম্বরে ২৪ জন এ ঘটনার শিকার হন। চলতি মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছে ১৫ জন নারী ও শিশু। খোদ বাবার হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে মেয়ে। গত ৯ সেপ্টেম্বর মিরসরাইয়ে মোহাম্মদ মোস্তফা নামে এক পাষণ্ড পিতা ধর্ষণ করে নিজের মেয়েকে। এছাড়া ৫সেপ্টেম্বর নগরীর এনায়েত বাজার এলাকায় গৃহকর্তা কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়ে অবৈধ গর্ভপাত করাতে গিয়ে মারা যায় শাহানুর আকতার শানু নামে এক গৃহপরিচারিকা। এছাড়া একই মাসের ২৪ তারিখ কর্নেলহাট এলাকার চুমকি গার্মেন্টসে কর্মরত ২২ বছর বয়সী তরুণী কাজ শেষে টেম্পুতে করে বাড়ি ফেরার পথে টেম্পু চালক ও তার ৭ জন সহযোগীদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়। অনেক সময় মামলা করেও অপরধীদের হুমকির মুখে থাকতে হয় নির্যাতিতাসহ তার পরিবারকে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর হালিশহর বেপারিপাড়া এলাকার নবম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করায় বশির আহমেদ ও তার সহযেগীদের প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে থাকতে হচ্ছে তাদেরকে। শুধু নগরীতে নয় ঈদের দিন সিনেমা দেখে ফেরার পথে কক্সবাজারে ধর্ষণের শিকার হয় দুই কিশোরী। তাছাড়া চলতি মাসের ১৫ তারিখ বান্দরবানে বাবা-মার সামনে দুবৃত্তরা ধর্ষণ করে মেয়েকে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ডক্টর ইফতেখার সুপ্রভাত বাংলাদেশকে বলেন, আকাশ সংস্কৃতির কারণে সমাজে যে পরিবর্তন এসেছে তা সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। সামাজিকীকরণের যে প্রক্রিয়া তাতে মিডিয়ার ভূমিকা অনেক বলে তিনি মনে করেন। আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক কিছু প্রভাবের কারণে আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ নষ্ট হচ্ছে। ফলে খারাপ যা কিছু মানুষ দেখছে তা নিজের ভিতর গ্রহণ করার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। পারিবারিক রীতি নীতি বদলে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আধুনিক যুগের ছেলে-মেয়েরা নিজেদের খেয়াল খুশিমত চলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ফলে পরিবার থেকে আগে যে শিক্ষা তারা পেতো সেখান থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। তাছাড়া ব্যক্তিবাদী যুগ হওয়াতে ভোগই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে বলে তিনি মনে করেন। তাই এভাবে নৈতিকতার স্খলন ঘটছে। তাছাড়া মাদকের অতিমাত্রার ব্যবহার এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ না হবার কারণে ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ বাড়ছে বলে তিনি জানান। অপরাধীদের যদি কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তির ব্যবস্থা করে তা কার্যকরের বিধান করা হয় তবে এ ধরনের কাজ করতে তারা আর সাহস পাবে না। ধর্ষকদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে ধর্ষণের প্রবণতা অনেক কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের এগিয়ে আসতে হবে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার তথা ব্যক্তিত্বজনিত সমস্যায় যারা আক্রান্ত তারা এ ধরনের অপরাধে বেশি জড়িত থাকে। ধর্ষণ যে একটা অপরাধ এ বোধই তাদের মধ্যে কাজ করে না। তাছাড়া জৈবিক কিছু সামাজিক কারণ তথা দাম্পত্য কলহ ও যৌন অতৃপ্তি থেকেও মানুষ এ ধরনের কাজে প্ররোচিত হয় বেশি। অনেকসময় ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যাবার কারণেও অপরাধীরা পার পেয়ে যায় বলে জানান চমেক ফরেনসিক বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক। বিবাহিতদের ক্ষেত্রে আলামত পেতে কিছুটা সমস্যা হলেও অবিবাহিতদের বেলায় তা হয় না। তরে সামাজিক কারণে আর লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই এ ব্যাপারে নীরব থাকে। মামলা সংক্রান্ত জটিলতাসহ অপরধীদের হুমকির কারণেও অনেকেই আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে চায় না। আর এতে ধর্ষকরা পার পেয়ে যাচ্ছে আর এ ধরনের ঘটনা আরো বাড়ছে। সাধারণত গার্মেন্টসকর্মীসহ গ্রাম এলাকার নারী ও শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয় বেশি। সামাজিক অবস্থানের কারণে উচ্চ ও মধ্যবিত্তরা এ বিষয়টি নানা ভাবে এড়িয়ে যায়। উল্লেখ্য, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারদন্ড ও মৃত্যুদন্ড বিধান থাকলেও উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে ও আলামত নষ্ট হয়ে যাবার কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবসহ নীল ছবির অবাধ বিক্রি এবং মাদক গ্রহণের হার বাড়াকেই ধর্ষণের প্রবণতা বেড়ে যাবার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই সামাজিক ও আইনগতভাবে এ অপরাধ প্রতিহত করা অতি জরুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তারা।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ