শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
Jobedali

Call

প্রাচীন বাংলার গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশ ও শাসন-ব্যবস্থা
মৌর্য ও গুপ্ত যুগে বাংলা
গুপ্ত যুগের পূর্বে প্রাচীন বাংলার ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করার তেমন কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি। কেননা তখনকার মানুষ আজকের মতো ইতিহাস লেখায় অভ্যস্ত ছিল না। ভারতীয় এবং বিদেশি সাহিত্যে এ সময়কার বাংলা সম্পর্কে ইতস্তত ও বিক্ষিপ্ত উক্তি হতে আমরা ইতিহাসের অল্পস্বল্প উপাদান পাই। এ সকল বিচ্ছিন্ন ঘটনা জোড়াতালি দিয়ে সন-তারিখ ও প্রকৃত ঘটনা সম্বলিত ধারাবাহিক কোনো ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। বস্তুত, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭-২৬ অব্দে গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় হতে প্রকৃত ইতিহাসের রূপ পরিগ্রহ করে। গ্রীক লেখকদের কথায় তখন বাংলাদেশে ‘গঙ্গারিডই’ নামে এক শক্তিশালী রাজ্য ছিল। গঙ্গা নদীর যে দুটি স্রোত এখন ভাগীরথী ও পদ্মা বলে পরিচিত-এ উভয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলই ‘গঙ্গারিডই’ জাতির বাসস্থান ছিল। গ্রীক গ্রন্থকারগণ গঙ্গারিডই ছাড়াও ‘প্রাসিঅয়’ নামে অপর এক জাতির উল্ল্যেখ করেছেন। তাদের রাজধানীর নাম ছিল পালিবোথরা (পাটলিপুত্র)। গ্রীক লেখকদের বর্ণনার উপর নির্ভর করে অনুমান করা যেতে পারে যে এ দু জাতি একই রাজবংশের নেতৃত্বে একসঙ্গে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল। এও অনুমান করা যেতে পারে, আলেকজান্ডারের আক্রমণের সময় বাংলার রাজা মগধাদি দেশ জয় করে পাঞ্জাব পর্যন্ত স্বীয় রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। তিনি ছিলেন পাটলিপুত্রের নন্দবংশীয় কোনো রাজা। এ সময় যে বাংলার রাজাই সমধিক শক্তিশালী ছিলেন প্রাচীন গ্রীক লেখকগণের উক্তি থেকে তা নি:সন্দেহে প্রমাণিত হয়। আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের মাত্র দুই বছর পর ৩২১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভারতের এক বিশাল অঞ্চলের উপর মৌর্য বংশের প্রভুত্ব স্থাপন করেন। উত্তর বাংলায় মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে (২৬৯-২৩২ খ্রিঃপূঃ)। অঞ্চলটি মৌর্যদের একটি প্রদেশে পরিণত হয়েছিল। প্রাচীন পুন্ড্রনগর ছিল এ প্রদেশের রাজধানী। উত্তর বঙ্গ ছাড়াও মৌর্য শাসন কর্ণসুবর্ণ (মুর্শিদাবাদ), তাম্রলিপ্ত, (হুগলী) ও সমতট (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর শুঙ্গ ও পরে কন্ব বংশের আবির্ভাব ঘটে। এ যুগের ইতিহাস জানার মতো যথেষ্ট উপাদান আমাদের কাছে নেই। ধারণা করা হয় তারা কিছু ছোট অঞ্চলের উপর শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এরপর বেশ কটি বিদেশি শক্তি ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। এদের মধ্যে গ্রীক, শক, পহ্লব, কুষাণ প্রভৃতি উলে-খযোগ্য। তবে এ আক্রমণকারীরা বাংলা পর্যন্ত এসেছিল কি-না তা বলা যায় না।
গুপ্ত যুগ সম্পর্কে জানার মতো বেশ কিছু উপাদান ইতিহাসবিদদের হাতে রয়েছে। এ থেকে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের শেষভাগ ও চতুর্  শতকের প্রথম ভাগের ইতিহাস রচনা সহজ হয়েছে। ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় ৩২০ খ্রিস্টাব্দে। তখন বাংলায় বেশ কিছু স্বাধীন রাজ্যের উত্থান ঘটে। এগুলোর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সমতট রাজ্য ও পশ্চিম বাংলার পুষ্করণ রাজ্য উলে-খযোগ্য। গুপ্ত সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালেই উত্তর বঙ্গের কিছু অংশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধিকারে আসে। সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে সমগ্র বাংলা জয় করা হলেও সমতট একটি করদ রাজ্য ছিল। সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকাল হতে ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত উত্তরবঙ্গ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনস্থ একটি ‘প্রদেশ’ বা ‘ভুক্তি’ হিসেবে পরিগণিত হতো। মৌর্যদের মত এদেশে গুপ্তদের রাজধানী ছিল মহাস্থানগড়ের পুন্ড্রনগর।
গুপ্ত পরবর্তী বাংলা
পাঁচ শতকে দুর্ধর্ষ পাহাড়ি জাতি হুন ও ষষ্ঠ শতকে মালবের যশোবর্মণের আক্রমণের ফলে ষষ্ঠ শতকের প্রমার্ধেই গুপ্ত শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর সারা উত্তর ভারতে ক্ষুদ্রক্ষুদ্র স্বাধীন রাজবংশের উদ্ভব হয়। এভাবে গুপ্তদের পর সমগ্র উত্তর ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। সে সুযোগে বাংলাদেশে দুটি স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি হয়। এর একটি হলো বঙ্গ। এর অবস্থান দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম-বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে। দ্বিতীয় রাজ্যের নাম গৌড়। এর অবস্থান ছিল বাংলার পশ্চিম ও উত্তর বাংলা নিয়ে।
স্বাধীন বঙ্গ রাজ্য
গুপ্ত সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে বঙ্গ জনপদে একটি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। তাম্র শাসন (তামার পাতে খোদাই করা রাজার বিভিনড়ব ঘোষণা বা নির্দেশ) থেকে জানা যায় যে, গোচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব নামে তিনজন রাজা স্বাধীন বঙ্গরাজ্য শাসন করতেন। এঁরা সবাই ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের রাজত্বকাল ছিল ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। কোন্ সময়ে এবং কীভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী বঙ্গ রাজ্যের পতন হয়েছিল তা বলা যায় না। ধারণা করা হয়, দাক্ষিণাত্যের চালুক্য বংশের রাজা কীর্তিবর্মনের হাতে স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যের পতন ঘটেছিল। ভিন্ন মত যাঁরা পোষণ করেন তাঁরা বলেন, স্বাধীন গৌড় রাজ্যের উত্থান ঘটলে বঙ্গ রাজ্যের পতন ঘটে। আবার স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যের পতনের পেছনে কিছু সামন্ত রাজার উত্থানকেও দায়ী করা হয়। কারণ, সাত শতকের পূর্বেই দক্ষিণ বাংলার সমতট রাজ্যে ভদ্র, খড়গ,রাঢ় প্রভৃতি বংশের স্বাধীন ও সামন্ত রাজাদের উত্থান ঘটেছিল।
স্বাধীন গৌড় রাজ্য
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ছয় শতকে ‘পরবর্তী গুপ্ত বংশ’ বলে পরিচিত গুপ্ত উপাধিধারী রাজাগণ উত্তর বাংলা, পশ্চিম বাংলার উত্তরাংশ ও মগধে ক্ষমতা বিস্তার করেছিলেন। ছয় শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ অঞ্চলই গৌড় জনপদ নামে পরিচিতি লাভ করে। মৌখরী ও পরবর্তী গুপ্তবংশীয় রাজাদের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ বছর পুরুষানুক্রমিক সংঘর্ষ এবং উত্তর থেকে তিব্বতীয় ও দাক্ষিণাত্য থেকে চালুক্যরাজগণের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে বাংলায় গুপ্তবংশীয় রাজাগণ দুর্বল হয়ে পড়েন। এ অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে শশাংক নামে জনৈক সামন্ত সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে গৌড় অঞ্চলে ক্ষমতা দখন করেন এবং স্বাধীন গৌড় রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
শশাংক :
শশাংকের পরিচয়, তাঁর উত্থান ও জীবন-কাহিনী আজও পণ্ডিতদের নিকট পরিষ্কার নয়। কেননা তাঁর আমলের ইতিহাসের যে সমস্ত উপাদান পাওয়া গেছে তাতে বহু বিপরীতমুখী বর্ণনা রয়েছে। গুপ্ত রাজাদের অধীনে বড় কোনো অঞ্চলের শাসককে বলা হতো ‘মহাসামন্ত’। ধারণা করা হয় শশাংক ছিলেন গুপ্ত রাজা মহাসেনগুপ্তের একজন ‘মহাসামন্ত’ এবং তাঁর পুত্র অথবা ভ্রাতুষ্পুত্র। শশাংক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। তিনি গৌড়ে তাঁর অধিকার স্থাপন করে প্রতিবেশী অঞ্চলে রাজ্য বিস্তার শুরু করেন। তিনি দণ্ডভুক্তি (মেদিনীপুর) রাজ্য, উড়িষ্যার উৎকল (উত্তর উড়িষ্যা) ও কঙ্গোদ (দক্ষিণ উড়িষ্যা) রাজ্য এবং বিহারের মগধ রাজ্য জয় করে তাঁর রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেন। পশ্চিমে তাঁর রাজ্য বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কামরুপের (আসাম) রাজাও শশাংকের হাতে পরাজিত হন। এরপর তিনি পশ্চিম সীমান্তের দিকে মনোযোগ দেন। উত্তর ভারতে এ সময় দুজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন। একটি পুষ্যভূতি রাজবংশের অধীনে থানেশ্বর এবং অন্যটি মৌখরী রাজবংশের অধীনে কান্যকুব্জ। পশ্চিম দিক থেকে কনৌজের মৌখরী শক্তি বাংলা অধিকারের জন্য বার বার চেষ্টা করছিল। তদুপরি সমসাময়িক সময়ে থানেশ্বরের রাজা প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীর সঙ্গে কনৌজের মৌখরী রাজা গ্রহবর্মণের বিয়ে হলে কনৌজ-থানেশ্বর জোট গড়ে উঠে। এ জোটের ফলে বাংলার নিরাপত্তা বিশেষভাবে বিপনড়ব হয়ে পড়ে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে শশাংকও কূটনৈতিক সূত্রে মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে স্বীয় শক্তি বৃদ্ধি করেন।
পরাক্রান্ত থানেশ্বররাজ প্রভাকরবর্ধনের অকস্মাৎ মৃত্যু হলে তাঁর জামাতা কনৌজের গ্রহবর্মণ সিংহাসনে বসেন। মালবরাজ দেবগুপ্ত মৌখরিরাজ গ্রহবর্মণকে পরাজিত করেন। তাঁর মহিষী রাজ্যশ্রীকে বন্দী করা হয়। দেবগুপ্ত এরপর থানেশ্বরের দিকে অগ্রসর হন। থানেশ্বরের রাজা তখন রাজ্যবর্ধন। পথিমধ্যে দেবগুপ্ত রাজ্যবর্ধনের হস্তে পরাজিত ও নিহত হন। কিন্তু কনৌজের উপর নিজ প্রভুত্ব বিস্তার ও ভগড়বী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করার আগেই তিনি শশাংকর হাতে মৃত্যুবরণ করেন। রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু হলে হর্ষবর্ধন কনৌজ ও থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি কাল বিলম্ব না করে রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার ও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য শশাংকের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। এ সময় কামরূপের ভাস্করবর্মা তাঁর সঙ্গে মিত্রতাবদ্ধ হন। কিন্তু এ সংঘর্ষের ফলাফল বা আদৌ কোনো সংঘর্ষ হয়েছিল কি-না সে বিষয়ে সঠিকভাবে জানা যায় না। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে শশাংক মৃত্যুবরণ করেন।
শশাংক শৈব ধর্মের উপাসক ছিলেন। হিউয়েন-সাং তাঁকে বৌদ্ধ ধর্ম বিদ্বেষী বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে এ ব্যাপারে তেমন কোনো জোরালো প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। সাত শতকে বাংলার ইতিহাসে শশাংক একটি বিশিষ্ট নাম। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে তিনিই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সার্বভৌম শাসক।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ