লকডাউনের আজ বিরানব্বই দিন হলো। বিগত বাইশ দিন ফ্ল্যাটের বাইরে পা রাখিনি। গতকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। শুধু বাচ্চাটার জন্য একটু ভাত বাঁচিয়ে রেখেছিলাম, নুন দিয়ে মেখে ওর মা খাইয়ে দিয়েছে। জানালা দিয়ে তাকালে বাইরে কবরস্থানের নিস্তব্ধতা। রাস্তায় স্তুপাকৃতি জঞ্জাল।

সাফাই করার লোক নেই। সপ্তাহে একদিন আসে। ওদের বস্তিতে অধিকাংশই করোনা আক্রান্ত। শুনছি অনেক জায়গায় রাস্তায় পড়ে আছে মৃতদেহ, কবর কে দিবে। সরকারি গাড়ি মাঝে মাঝে এসে তুলে নিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে আসছে

সরকারি হাসপাতাল গুলোতে পিলপিল করছে রুগী। টিভিতে আজকাল মাঝেমধ্যেই পুরোনো খবর দেখায়। সাংবাদিক খুব একটা বেচে নেই। খবর দেবে কে?

আমাদের সোসাইটির ছত্রিশটা পরিবারের মধ্যে আমাদের নিয়ে বারোটি পরিবার এখনো টিকে আছি। বাকিরা সরকারি হাসপাতালে বন্দী, অথবা কবরস্থানে, শ্মশানে ছাই হয়ে উড়ে গেছে।

সারাদিনে দু'ঘন্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছি। পাম্প চালানোর সিকিউরিটি নেই। নিজেদেরই গিয়ে চালাতে হচ্ছে। বস্তিগুলো খাঁ খাঁ করছে। ওরাই প্রথমদিকে সবচেয়ে বেশি রাস্তায় বেরোত। ওখান থেকেই করোনার আউটব্রেক শুরু হয়।

তারপর যা ভাবা হয়েছিল, তার চেয়েও বহুগুণ বেশী হারে ছড়িয়েছে covid-19। সারা দেশে এক চিত্র। দেশের জনসংখ্যার চল্লিশ শতাংশ আক্রান্ত। মৃত্যু কোটি ছাড়িয়েছে, সরকারি পরিসংখ্যান এই। সরকার যতদিন পেরেছে হাসপাতালে ভরেছে, এখন বলছে বাড়িতেই থাকতে, কোনও ওষুধ নেই। রোজকার ওষুধগুলোও আর পাচ্ছি না। করোনায় না মরলেও সুগার, প্রেশারে মরছে লোকজন। দেশে হাহাকার পরিস্থিতি।

সরকার হাল ছেড়ে দিয়েছে। বিদেশি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বলছে প্রচন্ড ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় লোকজন সাবধানতা অবলম্বন করলে এই আউটব্রেক হোত না। তারা নিয়মিত জমায়েত, আড্ডা সব কিছু করে গেছে সরকারি নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে। যার ফল এই মহামারী। জুন' মাসের এই অসহ্য গরমে দিনে দু'ঘন্টা বিদ্যুৎ। ইন্টারনেট পরিষেবা খুবই খারাপ। অত্যন্ত স্লো চলছে নেট।

সবচেয়ে মুশকিল হোল মানুষ এখন পেটের টানে মরিয়া হয়ে উঠে বাইরে বেরিয়ে পড়তে চাইছে। পেটের খিদায় বের হলাম কিন্তু অধিকাংশ দোকানদারই করোনা আক্রান্ত হওয়ায় দোকানও খুলছে না পণ্য নিয়ে বাড়ি চলে গেছে আবার অনেক দোকান ভেঙ্গে লুটপাট করে সব কিছু নিয়ে গেছে! দেখে মনে হয় খোলা গরুর ঘর।

কিছু কিছু মসজিদ থেকে মাইকে মোয়াজ্জেম আজান শেষ করেই কান্না শুরু করে দিয়েছে ইয়া আল্লাহ্ আমাদের তুমি বাঁচাও তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। প্রিয় মুছুল্লি কেরাম আপনারা সবাই ঘরে বসে নামাজ আদায় করুন , ক্ষমা প্রার্থনা করুন, আল্লাহ যেন আমাদের সবাই কে ক্ষমা করে দেয় এই বিপদ থেকে রক্ষা করে।

খুদার যন্ত্রণা ও শহরের এই পরিস্থিতি দেখে পুরাতন সাইকেলের পিছনে ছেলে ও তার মাকে বসিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। শক্তির অভাবে পায়ে যেন কেউ শিকল বেঁধে রেখেছে! যতদূর যাই শূন্য রাস্তা কাউকে দেখছি না, চার পাশে গাছ গুলো নিরব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর চার পাশ থেকে গন্ধে যেন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেই জমজমাট গ্রামের বাজার অতিরিক্ত করতে দেখি সব বন্ধ কিছু দোকানে খোলা কিন্তু ভিতরে কিছু নেই সব শূন্য অথচ এখানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর দিকে প্রশাসনের নির্দেশনা না মেনে সরকারি ছুটিতে আসা গ্রামের মানুষ গুলো অবাধে আড্ডা দিয়েছে। অবশেষে ৪০ মিনিটের রাস্তা ৩ ঘন্টা ৩৬ মিনিটে এসে পৌঁছেছি কিন্তু চাবি কাজ করছে না, দরজার তালায় মরিচা ধরছে। অনেক চেষ্টা করেছি তালা খোলার জন্য হঠাৎ পিছন থেকে পাশের ঘরের একজন এসে বললো আলহামদুলিল্লাহ তোরা এখনো জিন্দা আছোস, কবরস্থানের পাশে অনেকের পড়ে থাকা লাশ থেকে গন্ধ বের হচ্ছে মাটি চাপা দেওয়ার কাজে একটু সহযোগিতা করতে হবে চল। আমি ক্ষুধার্ত পেটে তার কঙ্কাল শরীর দেখে চেহারা চিনতে পারছিলাম না!

এই মূহুর্তে সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই, কিন্তু যে লোকগুলো কাজ করবে তারাও আক্রান্ত। কাদের নিয়ে লড়বে সরকার? সবই এখন অদৃষ্টের হাতে। লোকজন যদি প্রথমেই খেলার ছলে না নিয়ে গৃহবন্দিত্বকে গুরুত্ব দিতো তাহলে আজ দেশের এই হাল হোত না। পুরোপুরি ভাবে কাঠামো শেষ হয়ে গেছে। কবে যে দেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, কিংবা আদৌ পারবে কিনা সেটাই প্রশ্ন এখন।

বিঃ দ্রঃ উপরের সব ঘটনাই কাল্পনিক এবং বাংলাদেশের পেক্ষাপট বিবেচনায় লিখিত।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে