চালাক শব্দটি মূলত ফারসী ভাষার শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ একাধিক। যথা : বিচক্ষণ, চৌকস, মেধাবী, ধূর্ত, প্রতারক, কূটবুদ্ধিসম্পন্ন, চতুর। তবে চালাক শব্দটি বর্তমানে বাংলা ভাষায় বাংলা শব্দ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। বাংলা অভিধানগুলোতে চালাক শব্দের অর্থ করা হয়েছে, চতুর, বুদ্ধিমান, কূটবু্দ্ধিসম্পন্ন, ধূর্ত।
আর বুদ্ধিমান শব্দটি হলো, নিরেট বাংলা শব্দ। অভিধানগুলো এর অর্থ করেছে, বুদ্ধিযুক্ত, ধীমান, জ্ঞানী, চালাক।
সুতরাং আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বুদ্ধিমান আর চালাক শব্দ দুটি সমার্থবোধক শব্দ। প্রত্যেক বুদ্ধিমানই চালাক। এবং প্রত্যেক চালাকই বুদ্ধিমান।
পারিভাষিক পার্থক্য :
পরিভাষায় চালাক আর বুদ্ধিমান সমার্থবোধক নয়। পরিভাষায় এ দুটি শব্দের মাঝে বিস্তর ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়। যথা : ১। চালাক হলো, যে ব্যক্তি তার মেধা ও বোধ শক্তির অপব্যবহার করে। আর বুদ্ধিমান হলো, যে ব্যক্তি তার মেধা ও বোধ শক্তির সদ্ব্যবহার করে।
২। চালাক ব্যক্তি তার জ্ঞান বুদ্ধির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে। আর বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার জ্ঞান বুদ্ধির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে।
৩। চালাক ব্যক্তি তার আচার আচরণে স্বকীয়তা ও সততাকে চরমভাবে বিসর্জন দেয়। পক্ষান্তরে বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার আচার আচরণে স্বকীয়তা ও সততাকে সচতেনভাবে পরিশীলিত পন্থায় রক্ষা করে থাকে।
৪। চালাক ব্যক্তি মিথ্যাচার ও শঠতায় পারঙ্গম হয়ে থাকে। আর বুদ্ধিমান ব্যক্তি মিথ্যাচার ও শঠতা থেকে যত্নের সাথে দূরত্ব বজায় রাখে।
৫। চালাক মানুষগুলো মেধা ও বোধ শক্তি ব্যবহারে ত্বরাপ্রবণ হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে বুদ্ধিমান মানুষগুলো তাদের মেধা ও প্রজ্ঞা ব্যবহারে মন্থর, নির্চঞ্চল ও স্থির গতি সম্পন্ন হয়ে থাকে।
৬। চালাক মানুষগুলো তাদের মেধার উপস্থিত ব্যবহারে বেশ পারঙ্গম হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে বুদ্ধিমান মানুষগুলো উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন হলেও বোধ ও বুদ্ধির উপস্থিত বহিঃপ্রকাশ ঘটান না। বরং এ ক্ষেত্রে তারা সচেতনতার সাথে ধীর স্থিরতার পরিচয় দেন।
৭। বর্তমানে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে চালাক মানুষের কদর বেশি। পক্ষান্তরে এ ক্ষেত্রগুলোতে বুদ্ধিমানেরা হন অবহেলিত ও অবমূল্যায়িত।
৮। চালাক মানুষগুলো উপস্থিত স্বার্থ উদ্ধারে তুষ্ট থাকে। ভবিষ্যতের পরিণতি নিয়ে ভাবতে চায় না। পক্ষান্তরে বুদ্ধমান মানুষগুলো ভবিষ্যত পরিণতিকে সামনে রেখে দূরদর্শিতার সাথে বোধ ও বুদ্ধির স্বার্থক প্রয়োগ ঘটায়।
৯। চালাক মানুষগুলোর যাবতীয় কার্যক্রম নানা রকম স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। পক্ষান্তরে বুদ্ধিমান মানুষগুলোর যাবতীয় কার্যক্রম দেশ জাতি ও মানুষের কল্যাণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।
১০। সারকথা চালাক মানুষগুলো হয় ঘৃণিত পাপাচারী। পক্ষান্তরে বুদ্ধিমান মানুষগুলো হয় নন্দিত পুণ্যার্থী। যদিও প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় চালাক মানুষগুলোই হয় নন্দিত আর বুদ্ধিমান মানুষগুলো হয় অবহেলিত। কারণ বর্তমান সমাজে বুদ্ধি বিদ্যার মূল্য নেই। মূল্য আছে শঠতা ও অসত্যের।
খুব দ্রুত যে সমস্যার সমাধান করতে পারে, যেকোন বিষয়কে অন্য বিষয়ে লাগাতে পারে, তেমন কোন নিজ কর্ম ব্যতিত কৌশলে অন্যের উপর দিয়া কাজ হাসিল করে নিতে পারে তাকে চালাক বলে। এরা চালাক হলেও দূরদর্শী জ্ঞানসম্পর্ন নয়।
একজন চালক বর্তমান চিন্তা করে কাজ করে। আর একজন বুদ্ধিমান বর্তমান ও ভবিষৎ উভয়ের চিন্তা করে কাজ করে। কারণ হাদীসে শরীফে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: সেই ব্যক্তি চতুর ও বুদ্ধিমান, যে নিজের নাফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং মৃত্যুর পরবর্তী সময়ের জন্য কাজ করে। আর সেই ব্যক্তি নির্বোধ ও অক্ষম যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে আর আল্লাহ্ তা’আলার নিকট বৃথা আশা পোষণ করে।– সুনানে ইবনে মাজা: হা. ৪২৬০, সুনানে তিরমিযী: হা. ২৪৫৯।
শাদ্দাদ ইবনু আওস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ সেই ব্যক্তি চতুর ও বুদ্ধিমান, যে নিজের নাফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং মৃত্যুর পরবর্তী সময়ের জন্য কাজ করে। আর সেই ব্যক্তি নির্বোধ ও অক্ষম যে তার নাফসের দাবির অনুসরণ করে আর আল্লাহ্ তা’আলার নিকটে বৃথা আশা পোষণ করে। "ইবনু মাজাহ (৪২৬০), জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং (২৪৫৯)"