শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
Sanjoyrand1

Call

এক. বিজ্ঞানের এ পর্যন্ত গবেষণায় মস্তিষ্ককে পুষ্টি ও অক্সিজেন প্রবাহের ধারক ও শরীরের একটি স্বতন্ত্র অঙ্গরূপে বিবেচনা করা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিকতম গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে খাবার গ্রহণের কয়েক মিনিটের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট পুষ্টির কার্যকারিতার ফলাফল অনুভব করতে পারে মস্তিষ্কে। তোমার মস্তিষক (বুদ্ধিমত্তা) কিভাবে কাজ করে বা করে না এখন আপনি যে শব্দগুলো পড়ছেন মগজের প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে সেই মস্তিষ্কটি জন্মলগ্ন থেকেই এমনটি ছিলো না। তার মানে এই নয় যে, আপনি দৌড়ে আয়নার সামনে গেলেন আর কপালের দুপাশে পরিবর্তনের ক্ষত চিহ্ন দেখতে পেলেন। আপনার জীবনের শুরুতে যে মগজের কোষগুলো পেয়েছেন সেগুলোই বা অধিকাংশই এখনো হুবহু বর্তমান আছে। অথচ আপনার মনের পরিবর্তন হয়ে চলেছে প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায়। আমরা জানি বা না জানি আমাদের খাওয়া, ঘুম, জীবন চর্চার প্রতিটি মুহর্তে মন পেয়ে চলেছে নতুন নতুন আকৃতি, এমন না যে শুধু চিন্তাশীলতার মাধ্যমে আমরা এর পরিবর্তন ঘটাচ্ছি। ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সমস্ত ফলাফলই ঘটে মস্তিষ্কের রাসায়নিক ও আকৃতি বা গঠনগত বিন্যাসে। এই কিছুক্ষণ আগে খাবার খেতে খেতেই আপনার মন কিছু পরিবর্তনের প্রক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গেছে বা কিছুক্ষণ আগে আপনি যা পড়ছিলেন এখন হয়তো সেই অনুসারেই আপনার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ঘটে চলেছে। দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ এক. বিজ্ঞানের এ পর্যন্ত গবেষণায় মস্তিষ্ককে পুষ্টি ও অক্সিজেন প্রবাহের ধারক ও শরীরের একটি স্বতন্ত্র অঙ্গরূপে বিবেচনা করা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিকতম গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে খাবার গ্রহণের কয়েক মিনিটের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট পুষ্টির কার্যকারিতার ফলাফল অনুভব করতে পারে মস্তিষক। দ্বিতীয়ত. বলা হয়েছে জন্মের পরে প্রথম বছরটিতে মগজের কোষের দ্রুত বিকাশ ঘটে, আর বিশেষ পরে তা ঘটে অতি ধীরগতিতে। কিন্তু্তু বয়স সংক্রান্ত গবেষণা এ সমস্ত দৃশ্যপটের বিপরীতে ঘটিয়েছে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন। দেখা গেছে চুলের ধসরতা আসার আগেই অনেকে বৃদ্ধ হয়ে যায়; কৈশোর- যৌবন পেরিয়ে এমন কি চল্লিশ-আশিতে এসেও অনেকের মনের পরিপক্বতা আসে না। ল্যাবরেটরিতে জীব জন্তুর গবেষণায় জানা গেছে যে প্রকৃতি পরিবেশের প্রতিকূল চ্যালেঞ্জ এবং উদ্দীপনা মানুষের মস্তিষ্ককে প্রতিনিয়ত বিকশিত হতে সাহায্য করে। মস্তিষ্ক এমনই এক নমনীয় অঙ্গ যে স্নায়ুবিদরা গড়ে পিটে সহজেই একে এমন আকার দিতে পারে (ক্ষমতা বিস্তৃতির ক্ষেত্রে) যে প্রয়োজন মত সমস্যা মোকাবেলা করা এর (মস্তিষ্কের) পক্ষে সহজ হয়ে ওঠে। বক্স নিউরো (স্নায়ু সম্বন্ধীয়) শব্দটি এই বইয়ে প্রায়ই ব্যবহার করা হয়েছে। স্নায়বীয় প্রক্রিয়াতেই এর ভূমিকা। নিউরন হলো মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ। নিউরোবায়োলজি (স্নায়ু জীববিদ্যা) অর্থাৎ মস্তিষ্ক বিষয়ক পড়াশোনার দুটি শাখা আছেঃ নিউরো এ্যানাটমি (মস্তিষ্কের গঠন প্রক্রিয়া বিষয়ক পড়াশোনা) এবং নিউরোফিজিওলজি (মস্তিষ্কের কার্য বিষয়ক পড়াশোনা) নিউরোট্রান্সমিটার হলো মস্তিষ্কের স্বতঃস্ফূর্ত রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যার ফল স্বরূপ স্নায়ুকোষ সমহের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিক সংকেত প্রবাহের ওঠা-নামা ঘটে। নিশ্চিতভাবেই এই নতুন আবিষকারের দুটি দিক রয়েছে। অর্থাৎ আমরা যা পেতে পারি, আবার তা হারাতেও পারি। অসচেতন, নিসপৃহ মনোভাব মানসিক শক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে যা পরিণতিতে রূপলাভ করতে পারে অনিষ্টতা, একঘেয়েমি, ক্লান্তি অথবা আত্মবিশ্বাসের কমতিতে। আমেরিকান জেরিয়াটিক্স সোসাইটির প্রেসিডেন্ট এবং প্রবীণ বিষয়ক আমেরিকান মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন কমিটির কো চেয়ারম্যান ওয়াল্টার বোর্টজ এম.ডি’র মন্ত্রব্য ‘শরীরের অন্যান্য অংশের মতোই মস্তিষেকর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য যে, হয় একে ব্যবহার কর, নতুন এর কার্যকারিতা হ্রাস পাবে। আমরা সহজেই অনেক বৃদ্ধ মানুষের মস্তিষেকর অসাড়তা বা জরাগ্রস্ততা থেকে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারি। এই ঘটনা থেকে মস্তিষ্কের স্ব পরিচালক হিসেবে আপনার অনেক দায়-দায়িত্বের ব্যাপার চলে আসে। মনের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে এই বইটি হয়ে উঠবে আপনার ব্যবহারিক গাইড। গতানুগতিকভাবে আত্ম উন্নয়নমূলক বইগুলোতে সেই পুরনো আদি নীতি ‘আমি জানি’ আমি পারবো, আমি জানি আমি পারবো’-এই জাতীয় অটোসাজেশনের মাধ্যমেই কাজ চালানোর চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু আজ মনের গবেষণায় যে ব্যাপক উন্নতি সাধন ঘটেছে তাতে আপনি মস্তিষ্কের নতুন আবিষকৃত সামর্থ্যের সুষ্ঠু চর্চার মাধ্যমে নিজের পরিবর্তন এবং বিকাশ সাধন করতে পারবেন। মানুষ জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয় আসলে তার অপরিপক্ব মানসিক সামর্থ্যের কারণেই। আবার মানসিক শক্তি কখনো কখনো যথার্থভাবে প্রয়োগ করা হয় না। তুষার ঢাকা পথে যেমন গাড়ির চাকা আটকে যায় এবং ঘুরতে থাকে, তেমনি আপনার মনের চাকাও ঘুরতে থাকে, কোনো নির্দিষ্ট একটা বিষয়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রাখতে পারে না, তার দুশ্চিন্তাগ্রস্ততা, ধারাবাহিক ঘুমের ঘাটতি, পর্যাপ্ত মানসিক শারীরিক চর্চার অভাব, অপরিপুষ্টতা এসকল কিছুই মানসিক শক্তিকে নিংড়ে নেয়। কিছু পাঠক এই বইটি খুলে পড়তে বসবে তার স্মৃতি শক্তিকে প্রখর করার উদ্দেশ্যে, কারো উদ্দেশ্য সৃজনী শক্তি বাড়ানো। আসলে বইটি সকলের উদ্দেশ্যকেই পূরণ করবে এবং তা করবে আপনার খাদ্যাভ্যাস, মানসিক শারীরিক চর্চা, ঘুমের পরিমাণগত ও গুণগত মান, আবেগ, কোলাহল, দষণ, মাদকতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দিক নির্দেশনা স্বরূপ আপনার মানসিক প্রণোদনা সৃষ্টির মাধ্যমে। শরীর ও মনের পারসপরিক সংযোগ সৃষ্টির উৎকৃষ্ট কৌশল সম্বন্ধে আপনি জানতে পারবেন, জানবেন বায়োফিডব্যাক, শিথিলায়ন, মেডিটেশন এবং এ্যারোবিক প্রক্রিয়া সম্বন্ধে। উপরোল্লিখিত ফ্যাক্টরগুলোর যে কোনোটি বা সবগুলোই আপনার মানসিক সম্পর্ককে সম্প্রসারিত করবে, যে সম্পদ আপনি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছেন এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এটা সেই একই মস্তিষ্ক (ধী শক্তি) যা আপনি লাভ করেছেন প্রাগৈতিহাসিক প্রক্রিয়ায়, পুরুষানুক্রমে। তাদের সঙ্গে আপনার পার্থক্য মানসিক শক্তিতে নয়, পার্থক্য হলো পরিবেশগত বিষয়ে, যেখানে আপনার মস্তিষ্ক বিকশিত হয়; আর এই পরিবেশ তো সৃষ্টি করতে হবে আপনার নিজেকেই। বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা অনেক বছর আগে, ৬৫ বছরের এক ব্যক্তি ২৬ মাইলেরও বেশি ম্যারাথন দৌড় ২ ঘন্টা ৫০ মিনিটে দৌড়ে ১৯০৮ সালের অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিতেছিল। তার এই প্রচেষ্টা ছিলো অসাধারণ। কিন্তু্তু বর্তমানের আলোয় এ যোগ্যতা অনেক বৃদ্ধি পেয়ে জন্ম দিয়েছে অনেক নাম জানা না জানা নায়কের। আমরা এখন অনেক কিছুর সঙ্গেই সহজেই মানিয়ে নিতে পারি এক সময়ের মানুষের জন্য অচিন্তনীয় ছিলো। জীবন-চর্চা এবং দৃষ্টি ভঙ্গির ক্ষেত্রে পরিবর্তিত নতুন দৃষ্টি ভঙ্গিই এই পার্থক্যের কারণ। কিন্তু অনেক সময়েই আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার কোনো নতুন অভ্যাসকে মেনে নিতে দেরি করে ফেলি। অনেক বৃদ্ধলোকই ঘরে বসে ব্যায়ামের গেঞ্জি, জুতা পরে দৌড়ানোর কথা ভাবে, যারা এখনো স্কুল ফেরত বালকের মতো উদ্দীপ্ত থাকতে পছন্দ করে, এমনকি পেশা পরিবর্তনের বিষয়ে বিবেচনা করে, কিংবা হাতে তুলে নেয় কোনো বাদ্যযন্ত। আর আমরা হয়তো তখন সেই বৃদ্ধ মানুষটির মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষের পরিমাণের হ্রাস প্রাপ্তির কথা ভাবতে বসে যাই। কিন্তু্তু সৌভাগ্যক্রমে এখানে কোষ সমহের সংখ্যাই মুখ্য বিবেচ্য নয়, আসল কথা হলো বৈদ্যুতিক প্রবাহ বা রাসায়নিক প্রক্রিয়া যা বিলিয়ন বিলিয়ন স্নায়ুকোষ সমূহকে পরসপর সংযুক্ত রাখে। এই সুইচ বোর্ডটির জটিল বুনোন সত্যিই বিস্ময়ে অভিভূত করার। গড় স্নায়ুকোষগুলো অন্যান্য প্রায় ১০ হাজার স্নায়ুকোষের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত; আবার কিছু নিউরন যা প্রায় ২ লাখ নিউরনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এই বইটির মাধ্যমে আপনি জানতে পারবেন যে কিভাবে আপনার কার্যক্ষমতা এবং চিন্তাশক্তি এই নেটওয়ার্কটিকে স্ফুলিঙ্গময় রাখতে পারে। মস্তিষ্কের অবস্থিতি দেহের সর্বোচ্চ স্থানে। তা গ্রীবা দ্বারা সংযুক্ত; আর গ্রীবা বা কণ্ঠ মস্তিষ্ককে স্নায়ুতন্তী এবং রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে শরীর মনের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। স্নায়ুতন্ত বিভিন্ন আবেগ বা উদ্দীপনা সচক বৈদ্যুতিক তাড়নাকে বহন করে মস্তিষ্কে নিয়ে আসে বা সেখান থেকে অন্যত্র পৌঁছে দেয়। কিন্তু্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দ্বিতীয় যোগাযোগ পদ্ধতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, আর তা হলো রক্তের মধ্য দিয়ে পরিভ্রমণরত রাসায়নিক সংকেতসমূহ, আর তা হলো ‘হরমোন’ যা মস্তিষ্কের সমস্ত নির্দেশ শরীরের সর্বত্র পৌঁছে দেয়, আবার প্রয়োজনমত সমস্ত জায়গা থেকে (শরীরের) তথ্যপ্রবাহ ফিরিয়ে আনে মস্তিষ্কে। মনে হয় যেন প্রকৃতি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই শরীর ও মনকে এই প্রক্রিয়ায় একসূত্রে গেঁথেছে। রিচার্ড জে উটম্যান, এম. ডি (নিউরো এন্ডোক্রিনোলজি এর অধ্যাপক, এম আই টি)-র পরামর্শ মতে রক্তপ্রবাহ মস্তিষ্কের সপর্শকাতরতাই আমাদের দৈনন্দিন খাওয়া-ঘুম এবং যৌন বিষয়ে নিয়ন্তণ সাধন করে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের একটি উপূজাত রয়েছে, আর তা হলো শরীর যেদিকে যায় মনও সেদিকে অনুসরণ করে। আপনার শরীর যদি সুন্দরভাবে চলতে থাকে তবে মনও ভালো অবস্থায় থাকবে। তবে এখানেই রয়েছে বিপদ; শরীরের দাবী মেটাতে আপনি যদি মনকে প্রলুবদ্ধ করেন-যেমন কফি খেয়ে শরীরকে চাঙ্গা রাখা, কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রকল্প শেষ করার জন্য ঘুমকে থামিয়ে রাখা, কিংবা নতুন নতুন ভাবের আবেশ সৃষ্টির জন্য মদ্যপানের ওপর নির্ভরতা। এই সমস্ত সাময়িক কৌশলসমূহ পরিণামে আপনার শরীর ও মনের জন্য অন্তর্ঘাত স্বরূপ হয়ে উঠবে। শরীরকে বিশ্রাম ও পুনর্গঠনের জন্য যথেষ্ট সময় প্রদান ছাড়া কখনোই কৃত্রিমভাবে মনের কার্যকারিতার উন্নতি সাধন সম্ভব নয়। আপনার দৈনন্দিন কার্যধারা আপনার মানসিক শক্তিকে নিংড়ে নেয় না আরো বেশি কিছু যুক্ত করে, তা বুঝতে স্নায়ুকোষ সমহের পারসপরিক বিনিময় ব্যবস্থাকে বুঝতে হবে, যা চিন্তাশক্তিকে সাধন করে। প্রথমেই বলে নেয়া যাক, মস্তিষেকর স্নায়ুকোষের সংখ্যা সুপ্রচুর-সম্ভবত একশত বিলিয়ন। এতে বোঝা যায় যেন মাথার ভেতরটা একটা জমাটবদ্ধ অবস্থা, অথচ যার ওজন মাত্র ৩ পাউন্ড-এর মতো। কিন্তু এগুলোর অবস্থান পাশাপাশি নয়, বৈদ্যুতিক তন্তু দ্বারা এরা সংযুক্ত। ডেনড্রাইটর্স নামক তন্তুগুলো স্নায়ুকোষের মধ্যে বৈদ্যুতিক তাড়না সৃষ্টি করে, আর অ্যাক্সন নামক তন্তুগুলো সংকেতকে বহন করে নিয়ে যায় এক স্নায়ুকোষ থেকে অন্য স্নায়ুকোষে। এক সঙ্গে জড়ো করলে আপনার স্নায়ু কোষ সমহের সমিমলিত বৈদ্যুতিক শক্তি হলো ২০ ওয়াট-খুবই অল্প পাওয়ারের একটা ডিম লাইট বাল্বের সমান। মস্তিষ্কের রাসায়নিক যৌগ এই গল্পের মুদ্রার এপিঠ হলো বৈদ্যুতিক প্রবাহ। বিষয়টি এমন নয় যে নিউরনগুলো খ্রীষ্টমাস ট্রী-র লাইটের মতো তারে বাঁধাভাবে শোভিত। প্রতিটি স্নায়ুকোষের বৈদ্যুতিক গতিপথে এক মিনিটের শূন্যতা বা ফাঁক দ্বারা একটা বিরতি আছে, যাকে বলে ‘সিন্যাপস’ এবং ধারণা করা হয় যে এগুলোর সংখ্যা ১০০ ট্রিলিয়ন। এই ফাঁক বা শূন্যতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সংকেত সমূহ নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা, এর মধ্যে ৩০ টিকে চিহ্নিত করা গেছে। সংকেত বা তথ্যপ্রবাহের আদান প্রদানের ক্ষেত্রে এই রাসায়নিক প্রেরকের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই সিন্যাপস গুলোকে তরলে পস্নাবিত করে আমাদের চিন্তাধারা, আবেগ এবং আচরণকে সংযত ও সহনীয় করে। এতক্ষণ যা বলা হলো তা সবই নিছক নিউরোবায়োলজির নিষকরুণতায় পর্যবসিত হবে যদি না জানতে পারি যে এইসব রাসায়নিক প্রেরকের কোনো নির্দিষ্টটিকে আমরা ইচ্ছা করলেই প্রভাবিত করতে পারি। রক্তে তৈরি পুষ্টিস্তরের ওঠা-নামার হিসেব অনুযায়ী বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের (স্নায়ু প্রেরক) স্তরের তারতম্য ঘটে। কঠিন শ্বেতসারযুক্ত খাবার খাওয়ার পরে আমরা তন্দ্রাচ্ছন্ন অনুভব করি, পেস্নটভর্তি সেদ্ধ আলু খেলেও নিদ্রার আবহ সৃষ্টি হয়, কেননা কার্বোহাইড্রেড সম্পর্কে খাবার বেশি মাত্রায় সেরোটনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার উৎপন্ন করে যা স্নায়ু কোষের উত্তেজনাকে প্রশমিত করে প্রশান্তিময় শিথিলায়ন ঘটায়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিভিন্ন খাদ্য সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে যেগুলো ট্রান্সমিটারের জন্য কাঁচামাল স্বরূপ তা এমনি এক ব্যবহারিক পন্থ্থা যে সুবিধা গ্রহণ করলে শরীর মনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন সহজতর হয়। বিষণ্নতা এবং পারকিনসন্স রোগ ‘সিন্যাপসেস’-এর ট্রান্সমিটারের সঙ্গে সম্পর্কিত সেক্ষেত্রে নিউরোট্রান্সমিটারকে নিয়ন্তিত করার জন্য ডাক্তাররা তাই ওষুধ লিখে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ ট্রাইসাইক্লিক্স নামক এক ধরনের বিষণ্নতা বিরোধী ওষুধ একটি নির্দিষ্ট নিউরোট্রান্সমিটারকে দীর্ঘকালব্যাপী সক্রিয় রাখে, যতদিন না তা প্রাকৃতিকভাবে নিষিক্রয় হয়ে যায়। কিন্তু্তু যদি তা অতিরিক্ত মাত্রায় অপব্যবহৃত হয়, তবে মস্তিষ্কের রাসায়নিক মিথস্তিক্রয়ায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা হতে পারে তন্দ্রাচ্ছন্নতা বা মুখ শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। প্রাকৃতিকভাবে ঘটমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া মস্তিষ্কের নিয়ন্তণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আগেই বলা হয়েছে হরমোন হলো এক ধরনের রাসায়নিক বার্তাবাহক যা রক্তের মধ্য দিয়ে পরিবাহিত হয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং কোষ সমষ্টি (কলা) কে নিয়ন্তণ করে। মস্তিষক পিটুইটারি গস্ন্যান্ডের মধ্য দিয়ে তার কার্যক্রম সাধন করে, যেটি শরীরের সবচে গুরুত্বপূর্ণ হরমোন উৎপন্নকারী গ্রন্থ্থিরূপে চিহ্নিত। রাসায়নিক পদার্থকে রক্ত প্রবাহে ছেড়ে দেয়ার মাধ্যমে এটি অঞ্চলীভূত স্নায়ুতন্তের নেটওয়ার্কের বাইরের স্থানে পৌঁছে যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ মস্তিষ্কের মাধ্যমে মুক্ত হরমোনসমূহ রক্তের লিম্ফোসাইটিস কোষগুলোকে প্রভাবিত করে, ফলে তা আমাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায়। মস্তিষ্ক নিজেই মুক্ত হরমোন দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে; কিছু কিছু মস্তিষ্কে ঢুকে নিউরোট্রান্সমিটাররূপে দ্বৈত ভূমিকা পালন করে। এর একটি হলো এ্যাড্রেনালিন। এটা শুধু শরীরকে কার্যোপযোগী করে তুলতেই সাহায্য করে না (হৃৎক্রিয়ার দ্রুত হার; রক্ত প্রবাহের পথকে মসৃণ করা এবং যকৃত থেকে ব্লাড সুগারের ত্বরিত মুক্তির মাধ্যমে) মানসিক শক্তিকেও উজ্জীবিত করে এবং মনোযোগকে নিবদ্ধ ও একাগ্র করতেও সাহায্য করে। মস্তিষ্কের আরেকটি রাসায়নিক উপাদান হলো নিউরোপেপটাইডস। এগুলো মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষের উত্তেজনাকে প্রশমিত করে, তৃষ্ণা, স্মৃতি এবং যৌনাচরণে এগুলো প্রভাবক ভূমিকা পালন করে। কিছু পেপটাইডস (এন্ড্রেফিসস নামে পরিচিত) ব্যথা ও আনন্দের অনুভূতিকে প্রভাবিত করে, মরফিনের মতো ড্রাগ দেহের আফিম বা মাদক রূপে পরিচিত। শারীরিক বা মানসিক অনুশীলনের মাধ্যমে নিঃসৃত পেপটাইডস এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। সমেমাহন বিদ্যা (হিপনোসিস) এবং আকুপাংচার প্রক্রিয়ায়ও এই ধরনের ব্যথা নিরাময়ক প্রাকৃতিক রস নিঃসৃত হয়। শরীর ও মনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিউরোট্রান্সমিটাররূপে নিউরোপেপটাইডসের ভূমিকার পাশাপাশি তা হজম প্রক্রিয়ায়ও ভূমিকা পালন করে। সংশেস্নষণ পদ্ধতিতে উৎপন্ন নিউরোপেপটাইডস এক ধরনের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় যা মনোযোগ ক্ষমতাকে প্রসারিত করে, স্মৃতিশক্তির বিস্তার ঘটায় এবং চোখ দ্বারা যা দেখি তা তথ্য আকারে সর্বোচ্চ ধারায় মস্তিষেক সন্নিবেশিত রাখতে পারে। মন এবং শরীর অথবা মন/শরীর? শরীর ও মনের সম্বন্ধে বা বন্ধন সংক্রান্ত আবিষ্কারটি পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের প্রাচ্যের চিন্তাশীলদের সঙ্গে একমত হওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে যে, মন এবং শরীর এক ও একান্ত, শরীর ও মনের মাঝের দেয়াল বা ব্যবধানের কল্পনা শুধু কৃত্রিম নয়, তা আমাদের আত্মপরিচয় এবং স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি স্বরূপ। এখন তাই স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধানকারী পেশাজীবীরা নতুন ও উদ্যমশীল শৃখলার মাধ্যমে শরীর ও মনের ব্যবধান ঘুচিয়ে ব্যক্তির আত্মপরিচয়কে সমুন্নত করতে বিশেষ যত্নশীল। এক্ষেত্রে তারা সাহায্য নিয়ে থাকে আচরণগত ওষুধ, সাইকোসোমাটিক মেডিসিন, বলিস্টিক মেডিসিন এবং সোমাটিক সাইকোথেরাপি প্রভৃতির অথবা সাইকোটেকনোলজি যা বার্তা হিসেবে শরীরের মধ্য দিয়ে কাজ করে মনকে সাহায্য দিয়ে থাকে। এ সকল কিছুই একটি সুসপষ্ট সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে যে শরীর ও মন অচ্ছেদ্যভাবে (এবং বিস্ময়করভাবে) পরসপর সম্পর্কযুক্ত। পরসপরের সুস্বাস্থ্যই পরসপরকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কর্মক্ষম রাখে। অধ্যাপক মরটন এফ রেইজার, এম. ডি. তার মন, মস্তিষ্ক, শরীর নামক বইতে মন ও শরীরের পার্থক্যের বিষয়টিকে অর্থহীন সেকেলে মরণারূপে উদ্বৃত করেছেন। রোগ বর্ণনায় সাইকোসোমাটিক বিশেষণটিকে তিনি পছন্দ করেন না, কেননা তা মন ও শরীরের স্বতন্ত অস্তিত্বকে নির্দেশ করে। তিনি শারীরিক ও মানসিক অসুখের উভয়টির কারণই মন ও শরীর এমনকি সামাজিক সীমায় নিহিত বলে মনে করেন। চিত্রে দেখানো হয়েছে মন, শরীর এবং পরিবেশ কিভাবে পরসপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। লক্ষ্য করুন যে তীর চিহ্নগুলো বৃত্তাকারে ঘুরছে এবং এই প্রক্রিয়াতেই শরীরের (বাইরের পৃথিবী সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য) মধ্য দিয়ে পরিচালিত নির্দেশনার প্রভাবে মস্তিষক তার যোগান (প্রত্যাশিত ফল) পেয়ে যায়। শরীর ও মনের পারস্পারিক সহযোগিতার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুইটি উপায়ে এটা ঘটে-একটা খুব কষ্টসাধ্য উপায়, শরীরে গভীরভাবে উদ্দীপনা সৃষ্টির পরেও দেখা যায় মন সারাক্ষণ শরীরে একটা চাপদায়ক অনুভূতি বজায় রাখে। নিচে দেখানো হলো কিভাবে তা ঘটে- (১) মন যখন কোনো হুমকির আশঙ্কা করে তখন সে শরীরকে উদ্দীপিত সেই পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে, রাসায়নিক পদার্থের (বার্তাবাহক) নিঃসরণের মাধ্যমে। (২) এই রাসায়নিক উপাদানসমহের রয়েছে মস্তিষ্ককেও উদ্দীপ্ত করার ক্ষমতা। (৩) তখন সেই উদ্দীপ্ত মস্তিষ্ক সারাক্ষণই সতর্ক সংকেত বাজাতে থাকে, এমনকি সত্যিকার বিপদ কেটে যাবার পরেও। (৪) যদি এই যোগান চক্র কোনোভাবেই ব্যাহত না হয় (যেমন শিথিলায়ন প্রক্রিয়া বা হাঁটার মাধ্যমে) তবে এই স্ব-সৃষ্ট মানসিক চাপের অব্যাহত প্রতিক্রিয়ায় শরীর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং মনের মধ্যে এক জট লাগানো পরিস্থিতিরও উদ্ভব হতে পারে। কিন্তু এর বিপরীতে যোগান প্রক্রিয়ার রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এটা পৃথিবীর সঙ্গে মনের নিবিড় সংযোগ ঘটায়, শরীরের ভেতরে বাইরে, সর্বতভাবে। চিত্রে ‘যোগান চক্রের’ মাধ্যমে দেখানো হয়েছে মস্তিষ্ক কিভাবে তার কার্যক্রমকে রক্ষণাবেক্ষণ ও আত্ম সংশোধন করে। মস্তিষ্ক শরীরের মধ্য দিয়ে আসা অনেক সক্ষ্ম সংকেতকে অনুভব করার ক্ষমতা রাখলেও অনেক সময়েই তা অসাবধানতায় অলক্ষিত থেকে যায়। এটা রক্তের রাসায়নিক উপাদান, অক্সিজেন স্তর, তাপমাত্রা এবং অন্যান্য বিষয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। আমরা কখনো কখনো বায়োফিডব্যাক টেকনোলজির মাধ্যমে নিয়ন্তণ আনার চেষ্টা করি। চিত্রে শরীর ও মস্তিষেকর মধ্যে সংযোগ সাধক বায়োফিডব্যাক চক্রটি দেখানো হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত যন্ত্রটি মস্তিষ্কে সক্ষ্ম তরঙ্গ সৃষ্টি করে। তবে এই যন্ত্রটির প্রয়োজনীয়তা খুবই সাময়িক, কারণ পর্যায়ক্রমে আপনি যখন নিজেই ভেতরের অবস্থাকে নিয়ন্তণের কৌশল বা পদ্ধতি শিখে বায়োফিডব্যাক সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে পঞ্চম অধ্যায় দেখুন। চিত্রটি থেকে আবেগ ও আচরণের গতি প্রকৃতির ব্যাখ্যা সম্বন্ধে অনেক কৌতূহলের নিবৃত্তি ঘটতে পারে। এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি শরীরের রোগ প্রতিরোধে আবেগের প্রভাব সম্বন্ধে। উদাহরণস্বরূপ আত্মবিশ্বাসী মেজাজ, দৈহিক আত্মরক্ষায় সাহায্য করে। ব্যাপারটি বুঝতে পারা যাবে যদি একই ব্যক্তি হঠাৎ তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে তবে তার প্রতিরোধ ব্যবস্থাও সেই পথটিই অনুসরণ করবে। ক্যান্সার, এলার্জি এবং হাঁপানির নিরাময়ে আবেগের প্রভাবের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। সানফ্রান্সিসকোর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার মনস্তত্ত্ববিদ লিডিয়া টেমোশক (পি, এইচ, ডি) জার্নাল অব সাইকোসোমাটিক রিসার্চ এর এক সংখ্যায় লিখেছেন ‘ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে যারা আবেগকে অবদমিত রাখার পরিবর্তে তাদের ক্ষোভ হতাশা ও দুর্দশাকে মন খুলে প্রকাশ করে তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের হার অপেক্ষাকৃত বেশি। মন যে শরীরকে প্রভাবিত করে এটা প্রমাণের জন্য কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। মানুষের চিন্তা আবেগ সহজেই তাদের চোখে, মুখে, শরীরের ভাষায় প্রতিফলিত হয়। একথাটি ইতোমধ্যে উদ্ধৃত হয়েছে যে মন যেদিকে যায় শরীরও সেই পথ অনুসরণ করে। এটা জীবনব্যাপী একটা খেলা, আপনার কাজ হলো এ দুটিকে (শরীর ও মন) সার্বক্ষণিকভাবে এক সূত্রে গেঁথে রাখার চ্যালেঞ্জটিকে গ্রহণ করা। তাই চিন্তা শক্তিকে উন্নত করতে এ বইটি মস্তিষ্কের গঠন জটিলতা আর স্মৃতি কৌশল নিয়ে গৎবাঁধা আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, কারণ আপনার সর্বোচ্চ চিন্তাশক্তির উদ্ভব আসলে গ্রীবা বা কণ্ঠোর নিচ থেকে সুস্বাস্থ্যের (শরীরের) মধ্যেই মল সূত্র নিহিত, পরিপুষ্ট, নিয়মিত পরিচর্চিত এবং শিথিল দেহ, যেখান থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত এবং উদ্দীপনা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক কার্যক্রমের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছায়।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ