চোখ ও দাঁতের সমস্যা, অতিরিক্ত প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার এবং ঘুমের অনিয়মের কারণের মধ্যে যেকোনোটির জন্যই চোখ ব্যথা করতে পারে।
সর্বাধিক উত্তম উপায় হলো একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে সঠিক কারণ উদ্ঘাটন এবং সে মোতাবেক চিকিৎসা নেয়া।
দেখে নিতে পারেন দৈনিক কালের কন্ঠে প্রকাশিত চোখের ব্যথার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন(লিখেছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আনিসুর রহমান আন্জুম)ঃ
চোখ ও এর আশপাশে বহু কারণে ব্যথা হতে পারে। এ কারণগুলো বুঝতে চোখ ও এর আশপাশে যা যা আছে তা চেনা দরকার।
চোখের একেবারে সামনে থাকে কর্নিয়া। এটি স্বচ্ছ কাচের মতো। এটি বাইরে থেকে আসা আলোকরশ্মিকে ফোকাস করে। চোখের মণির আবরণ হিসাবেই কর্নিয়া থাকে। চোখের সাদা অংশটি স্ক্লেরা নামে পরিচিত। সাদা ও কালো উভয় অংশ খুব পাতলা একটি আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে- যার নাম কনজাংটিভা। চোখের কালো মণির নাম আইরিস। চোখ যে অক্ষিকোটরে থাকে তার নাম অরবিট। নড়াচড়ার জন্য চোখে অনেক মাংসপেশি থাকে।চোখে নার্ভ বা স্নায়ু থাকে। আর পুরো চোখ ঢেকে রাখে চোখের পাতা।
চোখ ব্যথার কারণ
অনেক রোগের কারণেই চোখ ব্যথা হতে পারে। যেমন- চোখ উঠা, চোখের মণির কোনো রোগ, আঘাতজনিত কোনো রোগ, চোখের ভেতরের রোগ ইত্যাদি। শরীরের রোগের মধ্যে মাইগ্রেন, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি কারণে চোখ ব্যথা হতে পারে। চোখ ব্যথার সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে আছে-
কনজাংটিভাইটিস বা চোখ উঠা : চোখ লালচে, গোলাপি বর্ণের হয়। জ্বালাপোড়া করে। সাধারণত অ্যালার্জি থেকে চোখের আবরণীর এই প্রদাহ দেখা দেয়। তবে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে কনজাংটিভাইটিস হতে পারে। চোখ খুব চুলকায়, চোখে ময়লা জমে।
চোখের পাতায় প্রদাহ বা ব্লিফারটিস : চোখের পাতায় অঞ্জন বা কোনো কারণে প্রদাহ হলেও চোখ ব্যথা করতে পারে।
কর্নিয়ায় আঘাত : সাধারণত চোখে বালুর মতো দানাদার কিছু ঢুকলে এবং অতঃপর চোখ ডলাডলি করলে কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া হঠাৎ গাছের পাতার আঘাত বা চোখে কোনো কিছুর আঘাত থেকেও এটি হতে পারে। এতে তীব্র ব্যথা হয়।
কর্নিয়া ইনফেকশন : সাধারণত হার্পিস জোস্টার ভাইরাস দিয়ে এ ধরনের ইনফেকশন হয়। যাঁরা কনটাক্ট লেন্স ব্যবহার করেন, তাঁদেরও এ ইনফেকশন হতে পারে। এতে ব্যথা হয়, চোখে অস্বস্তি বোধ হয়।
চোখে কিছু ঢুকলে : যত ছোটই হোক কিছু চোখে ঢুকলে অস্বস্বি হবেই। তবে দানাদার, রাসায়নিক, ধোঁয়া ইত্যাদিতে চোখ ব্যথা হতে পারে। সাধারণত ভালো করে পানি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করে ফেললে সমস্যাটি চলে যায়। যদি ভেতরে ঢোকা পদার্থটি বের করা না যায়, তবে তীব্র ব্যথাও হতে পারে।
গ্লুকোমা : চোখের একটি রোগ, যাতে প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না। চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ বেড়ে গিয়ে রোগটি হয়। লক্ষণ হিসেবে থাকতে পারে তীব্র চোখ ব্যথা, বমি ও বমিবমি ভাব, মাথাব্যথা, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া ইত্যাদি। অ্যাকিউট অ্যাঙ্গল ক্লোজার নামে এক ধরনের গ্লুকোমা আছে, যা হঠাৎ করেই হতে পারে। দ্রুত ও সঠিক চিকিৎসা না করলে এ থেকে অন্ধত্বও হতে পারে।
চোখের মণির প্রদাহ : চোখের মণির প্রদাহ হতে পারে, তবে তা খুব বেশি ক্ষেত্রে দেখা যায় না। সাধারণত আঘাত, ইনফেকশন, অটোইমিউন বা রোগপ্রতিরোধ শক্তি কমে যাওয়াজনিত অসুখ থেকে এটি হতে পারে। এতে চোখ ব্যথা হয়, লাল হয়ে যায় এবং দৃষ্টিশক্তি কমে যায়।
চোখের নার্ভের প্রদাহ : চোখের ঠিক পেছনেই থাকে অপটিক নার্ভ বা চোখের স্নায়ু, যা সরাসরি মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত। এই নার্ভে প্রদাহ হলেও চোখে তীব্র ব্যথা হয়। সাধারণত স্ক্লেরোসিস, ইনফেকশন থেকে এ রোগ হয়। এতে দৃষ্টিশক্তিও কমে যায়।
*সাইনোসাইটিস : মুখমণ্ডলের হাড়ের মধ্যে বেশ কিছু বায়ুপূর্ণ ফাঁকা স্থান থাকে, যা সাইনাস নামে পরিচিত। এগুলোয় ইনফেকশন হতে পারে। চোখের চারদিকে এসব সাইনাসের অবস্থান বলে ইনফেকশন হলে চোখেও ব্যথা হতে পারে।
*চোখের অঞ্জন : চোখের পাতার ঠিক প্রান্তে হয়। খুব ব্যথা হয়। কয়েক দিন ব্যথা থেকে চলে যায়।
চোখ ব্যথার উপসর্গ
সাধারণত চোখ ব্যথার সঙ্গে নিচের উপসর্গগুলো দেখা যায়।
*দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া
*চোখ দিয়ে পানি বা পিঁচুটি পড়া
*চোখের ভেতর কিছু আটকে আছে এমন অনুভূতি হওয়া
*মাথাব্যথা
*আলোর দিকে তাকাতে অস্বস্তিবোধ, চোখে ব্যথা বা চাপ অনুভব করা
*বমি ও বমিবমি ভাব
*চোখের মণি লালচে বা গোলাপি হয়ে যাওয়া
* অনবরত পানি ঝরা
*ঘুম থেকে উঠার পর পিঁচুটি জমে চোখ বন্ধ হয়ে থাকা।
চিকিৎসা
চোখ ব্যথার পাশাপাশি যদি হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি কমে যায়, চোখে অসহনীয় ব্যথা হয়, কান, মাথা ঘোরানো- এ ধরনের কোনো অসুবিধা হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
তবে কোনো রোগ ছাড়াও ব্যথা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে যদি চশমার প্রয়োজন হয়, তা হলে চোখ পরীক্ষা করে প্রয়োজনমতো চশমা ব্যবহার করা উচিত। কোনো মানসিক চাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ বা চিকিৎসা করাতে হবে।
সাধারণ যে কারণগুলোর জন্য চোখ ব্যথা হয়, সেগুলোর যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে। যেমন- কনজাংটিভাইটিস বা চোখ উঠা রোগে অ্যান্টিহিস্টামিন আই ড্রপ ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়। কর্নিয়াতে আঘাত পেলে অ্যান্টিবায়োটিক অয়েন্টমেন্ট প্রয়োগ করতে হয় ও নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। গ্লুকোমাজনিত ব্যথায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়মিত নিতে হয়, তার পরামর্শে আই ড্রপ ও ওষুধ সেবন করতে হয় চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ কম রাখার জন্য, কখনো কখনো গ্লুকোমায় সার্জারিও লাগতে পারে। কর্নিয়ার ইনফেকশনে অ্যান্টিভাইরাল বা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল আই ড্রপ ব্যবহার করতে হয়। মণির প্রদাহে স্টেরয়েড, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল ড্রপ লাগতে পারে। নার্ভের প্রদাহ বা নিউরাইটিসে কর্টিকোস্টেরয়েড প্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে। অঞ্জনির জন্য তেমন ওষুধ প্রয়োজন নেই, হালকা গরম সেক ও পরিষ্কার রাখলেই কয়েক দিনে তা ভালো হয়ে যায়।
কখন চোখ পরীক্ষা করতে হবে
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ছয় বছর বয়সের আগে কোনো সমস্যা থাক বা না থাক অবশ্যই একবার চক্ষু পরীক্ষা করাতে হবে। এ ছাড়া যাদের কখনো চোখের কোনো সমস্যা হয়নি কিন্তু বয়স ৩৫-এর ওপরে, যাদের ডায়াবেটিস বা হাইপারটেনশন আছে অথবা কোনো ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে সেবন করতে হয়, তাদের অবশ্যই নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা করাতে হবে, বয়স যদিও কম বা বেশি হোক না কেন। আবার যাঁদের বয়স ৪০-এর ঊর্ধ্বে, তাঁদের চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ (ইন্ট্রা অকুলার প্রেশার) আছে, তাঁদের পাওয়ার পরীক্ষা করাতে হবে এবং এসব ক্ষেত্রে সমস্যা না থাকলেও কমপক্ষে দুই বছর পর পর চক্ষু পরীক্ষা করাতে হবে। কিন্তু যাঁদের অন্য কোনো অসুখ যেমন- ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন ইত্যাদি আছে তাঁদের বছরে কমপক্ষে একবার চক্ষু পরীক্ষা করানো উচিত।