ইংরেজ শাসনামলে বাংলার রাজনৈতিক পরিবর্তনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা হলো:



সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল স্বাধীন রাজা-বাদশাহদের শাসনাধীন। ইংরেজ শাসন শুরুর পূর্বে ভারতভূমি কখনও পরাধীন ছিল না। দ্রাবিড়, আর্য,আরব, ইরানী, পাঠান, মুঘল, তুর্কি-অর্থাৎ বহিরাগত যারাই এই ভূমিতে রাজনৈতিক কারণে পা রেখেছে, তারাই একে আপন করে নিয়েছে, ভারতের আলাে মেখে এর বাতাসে মিশে গেছে। এমনকি দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণে আসেন, তখন তার কয়েকজন সেনানায়ক এ দেশের জলবায়ু ও ধনসম্পদে মুগ্ধ হয়ে এখানেই বসতি স্থাপন করেন। এর ব্যতিক্রম হয় অর্থনৈতিক কারণে আগত ইউরােপের বিভিন্ন অঞ্চলের বণিকদের বেলায়।



ভাস্কো ডা গামার ভারত প্রবেশের জলপথ আবিষ্কারের পর পর্তুগিজ বণিকরা এদেশে একচেটিয়া বাণিজ্য শুরু করে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তাদের পথ ধরে আসে ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজরা। উঁচ হয়ে ঢােকা এই ইংরেজরা একসময় ফাল হয়ে বেরিয়ে এসে ইতিহাস গড়ে। এককালের আশ্রিত এই বিদেশিরাই একসময় হয়ে ওঠে গােটা ভারতবর্ষের প্রভু। ১৬১৮ সালে বার্ষিক এককালীন তিন হাজার টাকার বিনিময়ে

ইংরেজদের বিনা শুল্কে এদেশে বাণিজ্যের অনুমতি দানের মধ্যেই এই ট্রাজেডির বীজ নিহিত ছিল। সম্রাট শাহজাহানের সাথে ইংরেজ দূত টমাস রাে'র করা এই চুক্তিই গঙ্গা অববাহিকায় ইংরেজদের লােলুপ দৃষ্টি হাজার ভারতীয় রুপির চেয়েও কম ছিল। এর পরের বছর রানী এলিজাবেথের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ভারতের সাথে তারা বাণিজ্য শুরু করে। ১৬১২ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের অনুমতিতে তৎকালীন ভারতের প্রধান সমুদ্র বন্দর সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে তারা। সুরাটে তখন আরও অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী ছিলেন, যাদের একেকজনের মূলধন পুরাে ইংরেজ

কোম্পানীর চেয়ে কয়েকশত গুণ বেশি ছিল। ইংরেজদের দৈন্যদশা দেখে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের করুণার দৃষ্টিতে দেখতেন এবং তাদের মােটেও

গুরুত্ববহ মনে করতেন না। এই গুরুত্বহীন, করুণার পাত্র, নামমাত্র মূলধন নিয়ে ব্যবসা করতে আসা ইংরেজগণ একদা পুরাে উপমহাদেশের শাসনক্ষমতা দখল করে নিল। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে পুরাে ভারতবর্ষে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে ইংরেজরা। তারা প্রলুব্ধ হয়েছিল শুধুমাত্র এদেশের সম্পদ দ্বারা। আর তাই সুদীর্ঘকালের শাসনামলে ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে পঙ্গু

করে দিয়ে যায় তারা।




পলাশীর যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদে রাজকোষ ও রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠিত হয়, সরকার দেউলিয়া হয়ে পড়ে। হিন্দু জমিদার ও চাকলাদারদের অর্থে তখন সরকার পরিচালিত হতাে। গদি লাভের জন্য ইংরেজদের দাবি অনুযায়ী ঘুষ সংগ্রহ করার জন্য মীর জাফর ও মীর কাসিম রাজস্ব বাড়িয়ে দেন। নবাবের এসব রাজস্ব বৃদ্ধির অজুহাতে জমিদাররা প্রান্তিক মুসলিম প্রজা ও রায়তদের উপর বহুগুণে খাজনা বাড়িয়ে দেয়। দেশব্যাপী শুরু হয় অরাজকতা। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে দেখা দেয় অস্থিতিশীল অবস্থা। একইসাথে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য বিদেশি বণিকদের বাংলা ছাড়া করে ইংরেজরা রেশম, মসলিন, সুতি কাপড়, চিনি, চাল,আফিম, সল্টপিটার প্রভৃতি পণ্য রপ্তানীর ক্ষেত্রে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। বাজার কুক্ষিগত করে এরা এসব পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক রকম নামিয়ে দেয়।

ব্যবসায় ইংরেজদের সবচেয়ে বড় চারণক্ষেত্র ছিল আমাদের বঙ্গভূমি। সে সময় বাংলা থেকে কৃষিজ ও প্রাণিজ পণ্য বাদে শুধু মসলিন, মােটা সুতি বস্ত্র, রেশম ও রেশমী বস্ত্র ইউরােপের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানী করেই বছরে দশ-বারাে হাজার কোটি টাকা আয় হতাে। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, কিশাের মিলিয়ে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হতাে এই বস্ত্রখাতে। এছাড়া ইউরােপে সন্টপিটার, ইস্ট ইন্ডিজে চাল, চীন ও জাপানে আফিম,

আরব, ইরাক ও ইরানে লাল চিনি, মধ্যপ্রাচ্য ও স্বাভাবিক উৎপাদন হার কমে এলে ইংরেজরা হিন্দু জমিদার ও প্রশাসনিক কর্মচারীদের উৎপীড়ন ও প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু গােমস্তা, দালাল ও ফড়িয়াদের দ্বারা গ্রামে-গঞ্জে আড়ৎ-গদি প্রতিষ্ঠা করায়। ও অত্যাচারের-নিপীড়নের মাধ্যমে উৎপাদন চালাতে বাধ্য করে। এরা থানার দারােগা, পরগণার শিকদার ও পাইক নামিয়ে বলপূর্বক দাদন দিতে বাধ্য করতাে এবং চাবুক মেরে কম মূল্যে কাপড়, লবণ ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি করতে বাধ্য করতাে। অত্যাচারের মাত্রাতিরিক্ততায় তাঁতীরা তাদের হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে ফেলে। মধ্যাঞ্চলের চাষীরা আসামের অরণ্যের দিকে পালিয়ে যায়। এভাবে বিশ্বঅর্থনীতির অবাধ ও প্রতিযােগিতামুখর একটি উৎপাদন ক্ষেত্রকে ইংরেজরা এক দাসত্বপ্রথামূলক নারকীয় যজ্ঞে পরিণত করে।





বিকল্প সমাধান :



বাংলায় ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটে পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ থেকে। ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করে । ১৮৫৭ খ্রীস্টাব্দের সিপাহী বিপ্লবের পর কোম্পানির হাত থেকে বাংলার শাসনভার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আসে।


ব্রিটিশ রাজার নিয়ন্ত্রণাধীন একজন ভাইসরয় প্রশাসন পরিচালনা করতেন। ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে অনেকবার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এর মধ্যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত ১৭৭০ খ্রীস্টাব্দের দুর্ভিক্ষে আনুমানিক ৩০ লাখ লোক মারা যায়।


১৯০৫ হতে ১৯১১ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের ফলশ্রুতিতে পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হয়েছিল, যার রাজধানী ছিল ঢাকায়। তবে কলকাতা-কেন্দ্রিক রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের চরম বিরোধিতার ফলে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায় ১৯১১ সালে।


ভারতীয় উপমহাদেশের দেশভাগের সময় ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে আবার বাংলা প্রদেশটিকে ভাগ করা হয়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অংশ হয়, আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের নাম পাল্‌টে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়।


ইংরেজ শাসন আমলে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন

বাঙালিরা কখনই বিদেশি ইংরেজ শাসকদের মেনে নেয়নি। ফলে পলাশী যুদ্ধের পর পরই এদেশের কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। পরাধীনতার একশ বছর পর স্বাধীনতা ঘোষণা করে এদেশের সৈনিকরা ও দেশীয় রাজরাজারা। পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ সমাজ। বাঙালি তরুণ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দলে দলে আত্মাহুতি দিয়ে কাঁপিয়ে তোলে ইংরেজ শাসনের ভিত। উপমহাদেশের স্বাধিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে সবচেয়ে গৌরবময় ভূমিকা ছিল বাঙালিদের। এই অধ্যায়ে ১৮৫৭ খ্রিঃ প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামসহ পরবর্তী আন্দোলনসমূহে বাঙালি তথা তৎকালীন ভারতবাসীর গৌরবের ও আত্মত্যাগের ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।


রাজনৈতিক :

পলাশী যুদ্ধের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজ্য বিস্তার, একের পর এক দেশীয় রাজ্যগুলো নানা অজুহাতে দখল, দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে ভীতি, অসন্তোষ ও তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে সাতারা, ঝাঁসি, নাগপুর, সম্বলপুর, ভগৎ, উদয়পুর, করাউলী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। স্বত্ববিলোপ নীতি অনুযায়ী দত্তক পুত্র সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে পারত না। এই নীতি প্রয়োগ করে কর্নাটের নবাব ও তাঞ্জোরের রাজার দত্তক পুত্র এবং পেশওয়া দ্বিতীয় রাজা বাজিরাওয়ের দত্তক পুত্র নানা সাহেবের ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্রিটিশের অনুগত মিত্র অযোধ্যার নবাবও এই আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাননি। অপশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়। এসব ঘটনায় দেশীয় রাজন্যবর্গ অতন্ত ক্ষুব্ধ হন। তাছাড়া ডালহৌসি কর্তৃক দিল্লিসম্রাট পদ বিলুপ্ত করায় সম্রাট পদ থেকে বঞ্চিত দ্বিতীয় বাহাদুর শাহও ক্ষুব্ধ হন।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ