কাদিয়ানী মতবাদের সাথে ইসলামের বিরোধকোথায় এবং কেন সচেতন মুসলিম সমাজকাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি করে-এপ্রশ্নের উত্তর পেতে হলে কয়েকটি বিষয়ে সুস্পষ্টধারণা নেওয়া প্রয়োজন।

ইসলামের মৌলিক আকীদা

আল্লাহ তাআলা মানব জাতির যোগ্যতা ওউপযোগিতা হিসাবে কালক্রমে তাদের বিভিন্নশরীয়ত দিয়েছেন। আর এর পূর্ণতা ওপরিসমাপ্তি বিধান করেছেন রাসূলে কারীমসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে।দ্বীনের পূর্ণাঙ্গতা লাভের পর যেহেতু এতেকোনোরূপ সংযোজন ও বিয়োজনের প্রয়োজনবা অবকাশ নেই তাই মানবজাতির জন্য নতুনশরীয়তেরও প্রয়োজন নেই। সুতরাং আল্লাহতাআলা নবী-রাসূল প্রেরণের ধারা চিরতরেরজন্য বন্ধ করে দিয়েছেন। এটা ইসলামেরঅন্যতম মৌলিক বিশ্বাস। আল্লাহ তাআলা পবিত্রকুরআনে বলেছেন, (অর্থ) ‘‘আজ আমি তোমাদেরদ্বীনকে পূর্ণতা দান করেছি, আর আমি তোমাদেরজন্য আমার নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছিএবং দ্বীন হিসেবে ইসলামকে তোমাদের জন্যমনোনীত করেছি।’’ (সূরা মায়েদা : ৩) পবিত্রকুরআনে অন্যত্র বলা হয়েছে, (অর্থ) ‘‘মুহাম্মদতোমাদের মধ্যকার কোনো বয়স্ক পুরুষের পিতানন, তবে তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষনবী।’’-সূরা আহযাব : ৪০

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবলেছেন, অন্যান্য নবীর মুকাবিলায় আমাকেছয়টি বিষয় দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করা হয়েছে, ১.আমাকে অল্প কথায় বেশি ভাবপ্রকাশেরযোগ্যতা দেওয়া হয়েছে, ২. আমাকেগাম্ভীর্যজনিত প্রতাপ-প্রতিপত্তি দ্বারা সাহায্য করাহয়েছে, ৩. আমার জন্য গণীমতের মাল হালালকরে দেওয়া হয়েছে, ৪. সমগ্র ভূপৃষ্ঠকে আমারজন্য নামায পড়ার উপযোগী জায়গা ও পবিত্রতাঅর্জনের উপকরণ হিসেবে স্থির করা হয়েছে, ৫.আমাকে সমগ্র সৃষ্টি জগতের রাসূলরূপে প্রেরণকরা হয়েছে, ৬. আমার দ্বারা নবীদের সিলসিলারপরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে।’’ (সহীহ মুসলিম,মাসাজিদ, হাদীস : ৫২৩)

অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আমার ও নবীদের উদাহরণএমন একটি প্রাসাদ, যা খুব সুন্দর করে নির্মাণকরা হয়েছে, তবে তাতে একটি ইটের জায়গাখালি রেখে দেওয়া হয়েছে। দর্শকবৃন্দ সে ঘরঘুরে ফিরে দেখে, আর ঘরটির সুন্দর নির্মাণসত্ত্বেও সেই একটি ইটের খালি জায়গা দেখেআশ্চর্য বোধ করে (যে, এতে একটি ইটেরজায়গা কেন খালি রইল!) আমি সেই একটিইটের খালি জায়গা পূর্ণ করেছি। আমার দ্বারাসেই প্রসাদের নির্মাণ পরিসমাপ্ত হয়েছে, আরআমার দ্বারা রাসূলদের সিলসিলা পরিসমাপ্ত করাহয়েছে।’’ অপর এক রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, ‘‘আমি হলাম সেই খালি জায়গার পরিপূরকইটখানি। আর আমি হলাম সর্বশেষ নবী।’’ (সহীহ বুখারী ১/৫০১; সহীহ মুসলিম, ২/২৪৮)অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে, ‘‘বনী ইসরাঈলেরনবীগণ তাঁদের কর্মকান্ডে নেতৃত্ব ও দিক-নির্দেশনা দান করতেন। যখন তাদের এক নবীদুনিয়া থেকে বিদায় নিতেন, তাঁর জায়গায় আরএকজন নবী অধিষ্ঠিত হতেন। কিন্তু আমার পরেকোনো নবী আসবেন না। তবে আমার পরেখলীফা হবে এবং তারা সংখ্যায় অনেক হবে।’’-সহীহ মুসলিম, ইমারা, হাদীস : ১৮৪২; মুসনাদেআহমদ, হাদীস : ১৫৮৭

এরূপ অগণিত কুরআনের আয়াত ও হাদীস দ্বারাপ্রমাণিত ইসলামের অন্যতম মৌলিক আকীদাএই যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম মানব জাতির হেদায়াতের জন্যপ্রেরিত সর্বশেষ নবী। তাঁর পর আর কোনো নবীপ্রেরিত হবেন না।

গোলাম আহমদ কেন নবী নয়?

এ প্রশ্নের সমাধান খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমতউল্লেখ্য যে, ইসলামের উপরিউক্ত মৌলিক ওঅকাট্য আকীদার উপস্থিতিতে কেউ যদি নবীহওয়ার দাবি করে তবে সেটা মুসলিম সমাজেরনিকট মিথ্যা বলে সাব্যস্ত হবে এবং তা

আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। শুধু তাই নয়, এরূপদাবি পোষণকারী ব্যক্তি ইসলামের সর্ববাদীবিশ্বাস মুতাবিক মুসলিমই নয়; বরংসন্দেহাতীতভাবে কাফের। সুতরাং গোলামআহমদ কাদিয়ানী এরূপ দাবি করার কারণেসম্পূর্ণ মিথ্যাবাদী ও কাফের-এটা স্বতঃসিদ্ধকথা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবলেছেন, ‘‘আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজনমিথ্যাবাদীর জন্ম হবে। তাদের প্রত্যেকেনিজেকে নবী বলে দাবি করবে। অথচ আমিহলাম সর্বশেষ নবী, আমার পরে কোনো নবীরআগমন হবে না।’’-আবু দাউদ, ফিতান, পৃ.৫৮৪; তিরিমিযী, খন্ড ২, পৃ.৪৫

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এ বিষয়টিসুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, হযরত মুহাম্মাদসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবীহিসেবে বিশ্বাস করা মুসলমানের ঈমানেরঅবিচ্ছেদ্য অংশ। যার এ বিশ্বাসে ত্রুটি রয়েছে,তার ঈমান বহাল থাকার কোনো অবকাশ নেই।

দ্বিতীয়ত ধরে নেওয়া যাক যে, যদি আল্লাহতাআলা মানব জাতির প্রতি নবী প্রেরণেরসিলসিলা বন্ধ না করে অব্যহত রাখতেন তবুকুরআন, হাদীস ও পূর্ববর্তী নবীগণেরজীবনেতিহাস পর্যালোচনা করলে যে শিক্ষাপাওয়া যায় তাতে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী বাতার মত স্বভাব-চরিত্রের কোনো লোক নবীহওয়ার জন্য অযোগ্য প্রমাণিত হয়। এ বিষয়টিসহজে বোধগম্য করার জন্য এখানে চারটিমৌলিক নীতিমালা পেশ করা হচ্ছে। এনীতিগুলো ‘‘দুয়ে দুয়ে চার’’-এর মত সতত সিদ্ধও স্বীকৃত সত্য।

প্রথম মৌলিক নীতিটি এই যে, প্রত্যেক সত্যবাদীনবী তাঁর পূর্ববর্তী সকল নবীর প্রতি শ্রদ্ধা বজায়রাখেন এবং অন্যদেরও সকল নবীর সম্মান ওমর্যাদার প্রতি যত্নশীল থাকতে শিক্ষা দেন।কেননা, প্রত্যেক নবী হলেন আল্লাহ তাআলারপ্রতিনিধি। তাই কোনো মুসলমান কোনো নবী-রাসূলের প্রতি এরূপ কোনো আচরণ করতেপারে না, যা নবীর জন্য অসম্মানজনক ওঅমর্যাদাকর। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে,গোলাম আহমদ কাদিয়ানী আল্লাহ তাআলারএকজন সত্যবাদী মহান নবী হযরই ঈসা আ.সম্পর্কে অত্যন্ত অশোভনীয় কটূক্তি করেছে।এখানে তার একটি উদাহরণ পেশ করা হচ্ছে।সে তার ‘দাফেউল বালা’ নামক বইতে বলেছে, ‘‘মাসীহের সততা তার সময়কার অন্যান্য সৎলোকের চেয়ে বেশি বলে প্রমাণিত হয় না; বরংতার চেয়ে ইয়াহইয়া নবীর মর্যাদা এক গুণবেশি। কেননা, সে মদপান করত না এবং কোনোব্যভিচারিণী নারী নিজের ব্যভিচার থেকেউপার্জিত অর্থ দ্বারা সুগন্ধি ক্রয় করে তার মাথায়মালিশ করেছে এমন কোনো কথা তার ব্যাপারেশোনা যায় নি। অথবা এমনও জানা যায়নি যে,এরূপ কোনো নারী নিজের হাত বা মাথার চুলদ্বারা তার শরীর স্পর্শ করেছিল অথবা কোনোআনাত্মীয় যুবতী নারী তার সেবা করত।

এ কারণে আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইয়াহইয়াকেহাসূর (নারী বিরাগী) বলেছেন। কিন্তু মাসীহের এনামকরণ করা হয়নি। কেননা, উক্তরূপ ঘটনাবলীএরূপ নামকরণের অন্তরায় ছিল।’’

উপরোক্ত উদ্ধৃতিটুকুতে গোলাম আহমদকায়িদানী হযরত মাসীহ ইবনে মরিয়ম আ.-এরপ্রতি কয়েকটি অপবাদ দিয়েছে। তারমধ্যেএকটি হল, তিনি মদ পান করতেন। দ্বিতীয় হল,তিনি ব্যভিচারিণী নারীদের অবৈধ পন্থায়উপার্জিত অর্থ দ্বারা ক্রয়কৃত সুগন্ধি তাদের দ্বারামাথায় লাগাতেন এবং তাদের হাত ও চুল দ্বারাতার নিজের শরীর স্পর্শ করাতেন। তৃতীয় হল,অনাত্মীয় যুবতী নারীদের সেবা নিতেন।

হযরত ঈসা আ.-এর মত একজন মহান নবীরপ্রতি এসব অশ্লীল ও কদর্য অপবাদ আরোপকরার পর সে এ রায়ও দিয়েছে যে, এসবঘটনার কারণেই আল্লাহ তাআলা তাকে পবিত্রকুরআনে ‘হাসূর’ (নারী বিরাগী) বিশেষণ দ্বারাবিশষায়িত করেননি।

যে কোনো নবীর মর্যাদা তো অনেক উর্দ্ধে,একজন সম্ভ্রান্ত ও ভদ্র মানুষের প্রতি এরূপঅপবাদ আরোপ করা নিশ্চয় তাঁর জন্য অতিঅপমানকর। যার মধ্যে অণুপরিমাণও ঈমানআছে, এমন কোনো ব্যক্তি কোনো নবী সম্পর্কেএরূপ অশ্লীল অপবাদ দিতে পারেন না।

কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের লোকেরা বলে থাকে যে,মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এসব কথানাকি খৃস্টান পাদ্রীদের জবাবে তাদের উপর চাপপ্রয়োগার্থে লিখেছে। এটা তাদের নিছক মিথ্যাপ্রলাপ ও প্রতারণা। কেননা, ‘দাফেউল বালা’নামক বইটি মুসলমান আলেমদের উদ্দেশ্যেরচিত। যার ইচ্ছা বইটি যাচাই করে দেখতেপারে। এছাড়াও সে ‘যমীমায়ে আঞ্জামে আথম’নামক বইতে লিখেছে, ‘‘তার (ঈসা আ.এর)খান্দানও ছিল অতি পূত পবিত্র (?)। তারতিনজন দাদী-নানী ছিল ব্যভিচারিণী ও পেশাদারপতিতা। তাদের রক্ত থেকে সে জন্ম লাভকরেছে। হয়ত এটাও খোদা হওয়ার একটিপূর্বশর্ত হবে! পতিতাদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ওদহরম-মহরম সম্ভবত তাঁর উত্তরাধিকারেররক্তের টানেই হয়ে থাকবে। অন্যথা কোনো সৎপুরুষ একজন যুবতী পতিতাকে এ সুযোগ দিতেপারে না যে, সে নিজের নাপাক হাত তার মাথায়লাগাবে এবং পতিতাবৃত্তি থেকে উপার্জিত অর্থদ্বারা ক্রয়কৃত অপবিত্র সুগন্ধি তার মাথায় মালিশকরবে, আর নিজের মাথার চুল তার পায়েঘষবে। সুধীজন বুঝে নিন, এরূপ লোক কোনচরিত্রের!’’ (যমীমায়ে আঞ্জামে আথম, পৃ. ৭)

উপরে উদ্ধৃত অংশটুকুতেও মির্জা গোলামআহমদ কাদিয়ানী সেই বক্তব্যই পেশ করেছে,যা সে তার ‘দাফেউল বালা’ নামক বইতেবলেছে। ‘যামীমায়ে আঞ্জামে আথম’ বইটি যদিওখ্রিস্টান পাদ্রীদের জবাবে লেখা বটে, তবে তারপূর্বোক্ত বক্তব্যের সাথে এটাকে সংযুক্ত করলেএটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, এসব বক্তব্য কেবলইকারও মুখ বন্ধ করার জন্য বলা হয়নি; বরং এটাতার মনের কথা। কেননা, সে ‘দাফেউল বালা’রএক জায়গায় বলেছে, ইবনে মরিয়মেরআলোচনা ছাড়, গোলাম আহমদ তার চেয়েউৎকৃষ্ট।’’ (পৃ. ২)

দ্বিতীয় মৌলিক নীতি এই যে, আল্লাহ তাআলারপ্রেরিত কোনো নবী নিজের দাবিকে প্রতিষ্ঠিতকরার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারেন না।তাঁরা সব সময় সত্যের উপর অটল-অবিচলথাকেন। কিন্তু মির্জা গোলম আহমদ কাদিয়ানীএক্ষেত্রে অবলীলাক্রমে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েথাকে। এর অগণিত উদাহরণ রয়েছে। এখানেপ্রবন্ধের কলেবরের প্রতি লক্ষ্য করে একটি মাত্রউদাহরণ পেশ করা হচ্ছে। মির্জা গোলাম আহমদতার ‘আরবাঈন-৩’ নামক বইতে লিখেছে, ‘‘মৌলবী গোলাম দস্তগীর কাসূরী ও মৌলবীইসমাঈল আলীগড়ী নিজ নিজ বইতে আমার(গোলাম আহমদের) ব্যাপারে চূড়ান্ত রায় ঘোষণাকরেছে যে, আমি যদি মিথ্যাবাদী হই, তবেতাদের আগে মারা যাব। তাদের দাবি মতে আমিযেহেতু মিথ্যাবাদী তাই আমি অবশ্যই আগেমারা যাব। তাদের এ বইগুলো প্রকাশিত হওয়ারপর অতি দ্রুত তারা মারা গেছে।’’ (আরবাঈন-৩,পৃ. ১১) উপরে উদ্ধৃত অংশে মরহুম মৌলবীগোলাম দস্তগীর কাসূরী ও মৌলবী ইসামঈলআলীগড়ী সম্পর্কে মির্জা গোলাম আহমকাদিয়ানী যে বক্তব্য পেশ করেছে তা সম্পূর্ণমিথ্যা। এতে সত্যের বিন্দু-বিসর্গও নেই। তারাএ ধরনের কোনো কথা তাদের বইতে বলেননি।মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর জীবদ্দশায়স্বয়ং তাকে এবং তার প্রয়াণের পর তারঅনুসারীদেরকে বহুবার এ চ্যালেঞ্জ পেশ করাহয়েছে যে, যদি উক্ত আলিমদ্বয় এরূপ কোনোকথা তাদের কোনো বইতে লিখেছেন বলেকোনো প্রমাণ তোমাদের কাছে থেকে থাকে তবেপেশ কর। কিন্ত তারা আজ পর্যন্ত কোনো প্রমাণদেখাতে পারেনি এবং কিয়ামত পর্যন্তও দেখাতেপারবে না। (কাযিবাতে মির্জা পৃ. ৭৩)

মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর এরূপমিথ্যাচার প্রচুর। পাঠক জেনে হয়ত আশ্চর্যবোধকরবেন যে, তার বিভিন্ন রচনাবলী থেকে তারমিথ্যাচারগুলো সংকলিত করা হলে বেশ বড়সড়একটি বই হতে পারে। এটা শুধু মুখের কথা নয়;বাস্তবেও যথাযথ উদ্ধৃতিসহ মির্জার মিথ্যাচারেরএকাধিক সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তারমধ্যেউর্দূ ভাষায় সংকলিত ‘কাযিবাতে মির্জা’ বইটিবেশ প্রসিদ্ধ। বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৭৯; সংকলকমাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াহিদ মাখদূম।

তৃতীয় মৌলিক নীতি এই যে, মির্জা গোলামআহমদ কাদিয়ানী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণভবিষ্যদ্বাণী করেছে এবং সে দাবি করেছে যে, সেসত্যবাদী নবী। এটা প্রমাণ করার জন্য তারভবিষ্যদ্বাণীগুলো অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হবে।আর তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো যদি সত্যে পরিণত নাহয় তবে সে মিথ্যবাদী বলে সাব্যস্ত হবে। আল্লাহতাআলার বিশেষ ফজল ও করম যে, তিনি তারভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে মিথ্যা প্রমাণিত করে তাকেমিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে দিয়েছেন।

উল্লেখ্য যে, যেখানে আল্লাহ তাআলা পবিত্রকুরআনে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবী হিসাবে ঘোষণাদিয়েছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম নিজেও অসংখ্য হাদীসে এ ঘোষণারপুনরাবৃত্তি করেছেন আর এ থেকে প্রমাণিতআকীদার উপর মুসলিম সমাজের ঈমানপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে যে-ই নবী হওয়ারদাবি করুক এবং তার হাতে যত অলৌকিকঘটনাই প্রকাশ পাক, তাকে কোনো মুসলিমসত্যবাদী নবীরূপে বিশ্বাস করতে পারে না, বরংসে এরূপ যে কোনো অলৌকিক কর্মকান্ডকেদাজ্জালের অলৌকিক কর্মকান্ডের মতই মনেকরবে। এ ছাড়া জাদুকরদের কাছেও এঅলৌকিক কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়, তাতে কেউতাদের নবী বলে স্বীকার করে না। তেমনি মির্জাগোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো যদি সত্যওহত তবু সে নবী বলে প্রমাণিত হত না। তবুআল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ যে, তিনি তারসত্য-অসত্যের মাপকাঠিরূপে উপস্থাপিতভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে অসত্য প্রমাণিত করে তাঁরদুর্বল ঈমানের অধিকারী বান্দাদেরকে এ পরীক্ষাথেকে রক্ষা করেছেন। এখানে আমি কেবল তারদুটি ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখ করব, যেগুলোর মাধ্যমেসে অকাট্যরূপে মিথ্যাবাদী সাবস্ত্য হয়েছে।একটি হল, ডেপুটি আবদুল্লাহ আথম নামকজনৈক খ্রিস্টানের মৃত্যু সংক্রান্ত। মির্জা গোলামআহমদ কাদিয়ানী বলেছে যে, ‘‘আথম ৫ জুন১৮৯৩ঈ. থেকে ৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ঈ. পর্যন্তঅর্থাৎ পনেরো মাস সময়ের মধ্যে মারা যাবে।’’তারপর পুনরায় ১৮৯৩ ঈ. সালের সেপ্টেম্বরে এঘোষণা দিয়েছে যে, ‘‘তার বেঁধে দেওয়া সময়সীমা অর্থাৎ ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অবশ্যই মারাযাবে।’’

উল্লেখ্য যে, তখন আথমের বয়স ছিল সত্তরেরকাছাকাছি। এসময় তার মারা যাওয়া বিচিত্র কিছুছিল না। সে ভরসা করেই হয়ত মির্জা গোলামআহমদ কাদিয়ানী এরূপ উক্তি করার সাহসপেয়েছিল কিন্তু আল্লাহ তাআলার মর্জি ছিল ভিন্নরকম, মির্জা গোলাম আহমদকে মিথ্যাবাদীসাব্যস্ত করা, তাই সে বয়ঃবৃদ্ধ আবদুল্লাহ আথমগোলাম আহমদের বেঁধে দেওয়া সময়সীমারমধ্যে মারা যায়নি; বরং তার পরও প্রায় দু’বছরবেঁচে থেকে ২৭ জুলাই ১৮৯৬ঈ. মারা যায়।মির্জা গোলাম আহমদ যেহেতু উক্তভবিষ্যদ্বাণীটিকে তার সত্য ও অসত্য হওয়ারমাপকাঠিরূপে পেশ করেছে, তাই তার বেঁধেদেওয়া সময়সীমার পরে আথম যতদিন জীবিতছিল, তার প্রতিটি মুহূর্ত গোলাম আহমদকেমিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার সাক্ষ্য বহন করেছিল।

আর তার একটি ভবিষ্যদ্বাণী হল মুহাম্মাদীবেগমের বিবাহ সংক্রান্ত। এটি তার সবচেয়প্রসিদ্ধ ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী। এটাকে সেতার বইপত্রে নিজের সত্যতার মাপকাঠি হিসেবেপেশ করেছে। মির্জা গোলাম আহমদের একআত্মীয় ছিল মির্জা আহমদ বেগ। ভারতেরহুশিয়ারপুরের অধিবাসী। অনিন্দ্য সুন্দরীমোহাম্মাদী বেগম তারই কন্যা। মির্জা গোলামআহমদের মনে তাকে বিয়ে করার আগ্রহ জাগে।একদিন সে কন্যার পিতার কাছে বিয়ের প্রস্তাবপাঠায়। কিন্তু আহমদ বেগ সম্মত হননি। মির্জাগোলাম আহমদ মির্জা আহমদ বেগকে প্রভাবিতকরার জন্য জোরে শোরে দুটি কথা ঘোষণাকরতে থাকে। একটি হল, মুহাম্মাদী বেগম তারবিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে, এটা সে আল্লাহর পক্ষথেকে ওহী ও ইলহাম দ্বারা জানতে পেরেছে।দ্বিতীয়টি হল, কন্যার পরিবার যদি এতে অমতপোষণ করে তবে তারা নানা রকম বিপদ-আপদে আক্রান্ত হবে। মুহাম্মাদী বেগমের উপরওবিপদ আসবে। মির্জা গোলাম আহমদ এসব কথাতার চিঠিপত্রে, বইপুস্তকে ও প্রচারপত্রে এতজোরে শোরে লিখতে শুরু করল যে, আহমদবেগ যদি কোনো কাঁচা মানুষ হতেন তবে ভয়েকন্যা দান করেই বসতেন। কিন্তু তিনি এসবেপ্রভাবিত হননি; বরং তিনি নিজের অমতের উপরঅবিচল থাকলেন। এভাবে বেশ কিছুদিনঅতিবাহিত হয়ে যায়, আর মির্জা গোলাম আহমদমুহাম্মাদী বেগমকে বিয়ে করার জন্য নানা রকমকৌশল অবলম্বন করতে থাকে। এক পর্যায়েলাহোরের অধিবাসী সুলতান মুহাম্মাদ নামক একলোকের সাথে মুহাম্মাদী বেগমের বিবাহ ঠিকহয়ে গেলে এতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্যমির্জা গোলাম আহমদ অনেক আশ্চর্য রকমেরচেষ্টা-তদবির শুরু করে। যখন তার সকল চেষ্টা-তদবির ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন সে তার পূর্বেরঅভ্যাস অনুযায়ী আল্লাহর ইলহামের বরাত দিয়েভবিষ্যদ্বাণী করতে শুরু করে। তাতে সে বলে যে,যদি সুলতান মুহাম্মাদের সাথে মুহাম্মাদীবেগমের বিয়ে হয় তবে বিয়ের পর আড়াইবছরের মধ্যে মুহাম্মাদী বেগমের পিতা মির্জাআহমদ বেগ মারা যাবে। আর মুহাম্মাদী বেগমবিধবা হয়ে তার বিবাহ বন্ধনে আসবে। আল্লাহরলীলা, সুলতান মুহাম্মাদের সাথে মুহাম্মাদীবেগমের বিবাহ হয়ে যাওয়ার পরও মির্জাগোলাম আহমদের পূর্ব ভবিষ্যদ্বাণী আরো জোরেচলতে থাকে। সে বলতে থাকে যে, এটা অদৃষ্টেরঅলঙ্ঘনীয় লেখা, কেউ এটাকে পরিবর্তন করতেপারবে না। সুলতান মুহাম্মাদ মারা যাওয়ার পরঅবশ্যই মুহাম্মাদী বেগম তার স্ত্রী হবে। যদি এটানা হয় তবে সে মিথ্যাবাদী ও নিকৃষ্টতম জীববলে সাব্যস্ত হবে। (আঞ্জামে আথম ও তারযমীমা) কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার এসবধোঁকাবাজিকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন এবং তারদম্ভ, অহঙ্কার ও দাবিকে ধুলোয় মিশিয়েদিয়েছেন। ফলে ১৯০৮ ঈ. সালে যখন মির্জাগোলাম আহমদ মারা যায় তখনও সুলতানমুহাম্মদ ও তার স্ত্রী মুহাম্মাদী বেগম জীবিতথেকে অতি সুখে জীবন যাপন করছিলেন।এমনকি তার প্রয়াণের পর সুলতান মুহাম্মাদ প্রায়৪০ বছর জীবিত ছিলেন।  যার পরবর্তী জীবনেরপ্রতিটি মুহূর্ত ও প্রতিটি দিন মির্জা গোলামআহমদকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার সাক্ষ্য বহনকরেছিল। সুলতান মুহাম্মাদ ১৯৪৯ সালেমৃত্যুবরণ করেন।

চতুর্থ মৌলিক নীতিটি হল এই যে, আল্লাহরকোনো নবী তার সমকালীন এমন কোনোধর্মদ্রোহী শাসকবর্গ বা ক্ষমতাধর লোকেরচাটুকারিতা, পদলেহন বা তল্পীবহন করতেপারেন না, যাদের প্রত্যক্ষ্য সহযোগিতায় ওপৃষ্ঠপোষকতায় কুফর ও ধর্মহীনতা বিস্তার লাভকরে।

উল্লেখ্য যে, ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী মানুষের মধ্যেধর্মহীনতা, ধর্মদ্রোহিতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ওনৈতিক অবক্ষয় বিস্তারে যে ভূমিকা রেখেছে,পৃথিবীর মানবেতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়াদুষ্কর। এমনি একটি দুষ্কর্মের পৃষ্ঠপোষকইংরেজ সরকারের চাটুকারিতা করতে গিয়েগোলাম আহমদ কোনোরূপ ত্রুটি করেনি। স্বয়ংগোলাম আহমদ তার ‘শাহাদাতুল কুরআন’ নামকবইয়ের পরিশিষ্টে ‘গভর্নমেণ্টের দৃষ্টি আকর্ষণ’শিরোনামের অধীনে এক জায়গায় বলেছেন, ‘‘এই (ইংরেজ) সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধআমার শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রীকে আবিষ্ট করেরেখেছে।’’ তারপর সে লেখে, ‘‘আমি মাননীয়(ইংরেজ) সরকারকে এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আমিএমনই আজ্ঞাবহ ও হিতাকাঙ্খী রয়েছি, যেমনআমার পূর্বসূরীরা ছিল।... আমি কামনা করি,আল্লাহ তাআলা এ সরকারকে ক্ষতি থেকে রক্ষাকরুন।’’ (পৃ. ৩)

উপরিউক্ত চারটি মূলনীতি নিয়ে একটু চিন্তা-ভাবনা করলেই এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে,আল্লাহ তাআলা যদি নবী প্রেরণের সিলসিলা বন্ধনা-ও করতেন তবু গোলাম আহমদের মতচরিত্রের ব্যক্তি নবী হওয়ার জন্য যোগ্য ওউপযুক্ত বলে বিবেচিত হত না। (কায়িদানিয়াতপর গাওর করনেকা সীধা রাস্তা, মাওলানামুহাম্মাদ মনযূর নোমানী রাহ.)

কাদিয়ানীরা অমুসলিম কেন?

কোনো কোনো সাধারণ মানুষ মনে করে যে,কাদিয়ানীদের সাথে মুসলিম সমাজের বিরোধটাহানাফী-শাফেয়ী বা হানাফী-আহলে হাদীসঅথবা কেয়ামী-বেকেয়ামীদের মতবিরোধেরমত। আসলে বিষয়টি তা নয়, বরং কাদিয়ানীদেরসাথে মুসলিম সমাজের বিরোধ এমন একটিমৌলিক আকীদা নিয়ে, যার বিশ্বাস করা-নাকরার উপর মানুষের ঈমান থাকা-না থাকা নির্ভরকরে। এ প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে যে,কুরআন পাকের অনেক আয়াত ও অগণিতহাদীস দ্বারা প্রমাণিত মুসলিম সমাজের অন্যতমমৌলিক আকীদা হল, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী এবং তাঁরপরে কোনো নবীর আগমন হবে না।মুসলমানদের এমন একটি অকাট্য আকীদারবিপরীতে অবস্থান নিয়ে মির্জা গোলাম আহমদকাদিয়ানী নিজেকে নবী বলে দাবি করল।সুতরাং সে মুসলমানদের সর্বসম্মত আকীদামুতাবিক কাফের তথা অমুসলিম। আর যে বাযারা তাকে নবী বলে বিশ্বাস করে সে বা তারাইসলামের সর্বজন স্বীকৃত আকীদা মুতাবিকমুসলমান থাকতে পারে না। তারা কাফের অর্থাৎঅমুসলিম। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টিসহজে বোধগম্য হতে পারে। দেখুন,বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলেরএকটির নাম আওয়ামী লীগ, আর অপরটির নামবিএনপি বা বাংলাদেশ জাতায়তাবাদী দল।প্রতিটি দলের ভিন্ন ভিন্ন ম্যানিফেস্টো বাসংবিধান আছে। যে যেই দল করে তাকে সেদলের ম্যানিফেস্টো মেনে চলতে হয়। যদি কেউদলের সংবিধান লঙ্ঘন করে বা তার কোনোগুরুত্বপূর্ণ ধারাকে অস্বীকার করে সে তার দলেরসদস্যপদ রক্ষার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। তখনতাকে হয় নিজের অপরাধ স্বীকার করেসংবিধানের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করে দলেথাকতে হয়, নতুবা বহিস্কারের শাস্তি মাথা পেতেনিয়ে দল থেকে বের হয়ে যেতে হয়। ধরুন,কেউ আওয়ামীলীগ করে, কিন্তু সে শেখ মুজিবুররহমানকে জাতির পিতা স্বীকার করে না, এরূপব্যক্তি আর যা-ই হোক, আওয়ামী লীগের সদস্যহতে পারে না। কোনো আওয়ামীলীগার তাকেআওয়ামী লীগের সদস্য মেনে নেবে না। এরূপইকেউ যদি বিএনপি করে, কিন্তু জিয়াউররহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকার করে না,এমন কাউকে বিএনপি’র লোকজন নিজেদেরলোক বলে গ্রহণ করবে না। এ সহজ-সরল মোটাকথাটি যদি বোধগম্য হয়, যে ব্যক্তি ইসলামেরঅন্যতম মৌলিক আকীদায় বিশ্বাসী নয়; বরংতার বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে নিজেকে ‘নবী’বলে দাবি করে, আর যারা তার এ দাবিকেবিশ্বাস করে তারাও মুসলমান নামের পরিচয়বহন করতে পারে না। তাদেরকেও হয় নিজেদেরঅপরাধ স্বীকার করে এবং তওবা করে মুহাম্মাদসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবীমেনে নিয়ে এবং ইসলামের অন্য সকল মৌলিকআকীদাকে মেনে নিয়ে মুসলমান হতে হবে,অথবা মুসলমানের পরিচয় বাদ দিয়ে নিজেদেরভিন্ন ধর্মের নামে পরিচিত হতে হবে। এ কথাটিআমাদের দেশের সাধারণ লোকজন থেকে শুরুকরে শাসকগোষ্ঠী পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষ যততাড়াতাড়ি বুঝে নিতে সক্ষম হবে ততই তাদেরদুনিয়ার জীবনে হেদায়াত ও পরকালের শান্তি ওমুক্তির পথ বেছে নিতে সহায়ক হবে।

যৌক্তিক বিচারে কাদিয়ানীদের অমুসলিমঘোষণার দাবি

এদেশীয় মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানসম্প্রদায়ের লোকেরা যেমন বাংলাদেশেরনাগরিক, তেমনি কাদিয়ানী সম্প্রদায়েরলোকেরাও এ দেশের নাগরিক। দেশের প্রচলিতআইন অনুসারে সকল ধর্মের অনুসারী লোকেরাযতটুকু নাগরিক অধিকার ও সুবিধা ভোগ করে,কাদিয়ানীরাও ততটুকু পাক, এতে কারও দ্বিমতথাকার কথা নয়, তবে সেটা তাদের নিতে হবেনিজের স্বতন্ত্র ধর্মীয় পরিচয়ে-মুসলমান পরিচয়েনয়। তারা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে ভিন্ননামে সমাজে বেঁচে থাকুক, আর্থ-সামাজিককার্যক্রমে তারা তাদের স^তন্ত্র পরিচয় নিয়েঅংশগ্রহণ করুক, তাতেও কোনো মুসলমানেরমাথাব্যাথা নেই। তবে মুসলমানের মৌলিকআকীদায় বিশ্বাসী না হয়ে (উল্টো কুঠারাঘাতকরে) তারা মুসলমান পরিচয় ধারণ করবে, এঅধিকার তাদের নেই। সুতরাং কাদিয়ানীদেরঅমুসলিম ঘোষণার দাবি মুসলিম সম্প্রদায়েরআকীদা রক্ষার আন্দোলন তো অবশ্যই, ধর্মীয়অধিকারের বিষয়ও বটে।

এখন দেখা যাক, কাদিয়ানীরা অমুসলিম রূপেঘোষিত ও চিহ্নিত না হলে তাতে মুসলমানদেরধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে কি কি সমস্যার সৃষ্টিহয়। এ বিষয়টি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে,এমন একটি সম্প্রদায় যারা ইসলামী শরীয়তেরদৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে অমুসলিম, তারা যদিসরকারীভাবে অমুসলিম ঘোষিত হয়ে পৃথকএকটি ধর্মাবলম্বী দল হিসাবে চিহ্নিত না হয়তাতে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রেবহুবিধ সমস্যা সৃষ্টি হয় এবং হতে থাকবে।যেমন :

১. তাদের রচিত ও প্রকাশিত বইপত্রকেমুসলমানদের লেখা বই-পুস্তকের মত মনে করেপাঠ করে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং ঈমানহারিয়ে বসে।

২. তাদের উপাসনালয়কে মসজিদ মনে করেসেখানে গিয়ে নামায পড়ে। এতে মুসলমানদেরকাছে ঈমানের পরে সর্বোচ্চ যে ইবাদত নামায,তা নষ্ট হয়।

৩. কাদিয়ানী ধর্মমতের অনুসারী কোনো ব্যক্তিমুসলমানের ইমাম সেজে তাদের ঈমান-আমলনষ্ট করতে পারে।

৪. তারা মুসলমান পরিচয়ে নিজেদের মতবাদ-মতাদর্শ প্রচার করলে তাতে সাধারণ মুসলমানতাদেরকে মুসলমানেরই একটি দল মনে করেতাদের মতবাদ গ্রহণ করে নিজেদের সবচেয়েবড় সম্পদ ঈমান হারিয়ে ফেলে।

৫. তারা মুসলমান নামে পরিচিত হওয়ার কারণেতাদের সাথে মুসলনামানের মত আচার-আচরণও চলাফেরা করে। অথচ তাদের সাথেমুসলমানের সম্পর্ক হওয়া উচিত এমনই, যেমনকোনো অমুসলিমের সাথে হয়ে থাকে।

৬. অনেক সাধারণ মুসলমান তাদেরকেমুসলমান মনে করে নিজেদের বিবাহের উপযুক্তামেয়েদের তাদের সঙ্গে বিবাহ দিয়েঅমুসলিমদের হাতে নিজেদের কন্যা তুলে দেয়এবং মুসলিম পাত্রের জন্য কাদিয়ানী ধর্মাবলম্বীলোকের মেয়েকে মুসলমান না করে বধু হিসেবেবরণ করে। ফলে এরূপ দম্পতি আজীবনব্যভিচারের গুনাহে লিপ্ত থাকে।

৭. কোনো সম্পদশালী মুসলমান কোনোকাদিয়ানী ধর্মাবলম্বী গরীবকে যাকাত দিলে তারফরয যাকাত আদায় হবে না।

৮. যে কোনো কাফের তথা অমুসলিমের জন্যহারাম শরীফে ঢোকা নিষেধ। অথচ কাদিয়ানীসম্প্রদায়ের লোকেরা মুসলিম পরিচয় দিয়ে হজ্বও চাকরি-বাকরির নামে সৌদি আরবে গিয়েহারাম শরীফে প্রবেশ করে তার পবিত্রতা নষ্টকরার সুযোগ পায়।

সুতরাং কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে মুসলমান থেকেপৃথক একটি ধর্মের অনুসারী দল ঘোষণা করেভিন্ন নামে চিহ্নিত না করা হলে এরূপ বহু সমস্যাসৃষ্টি হয়, হতে পারে এবং ভবিষ্যতে হতেথাকবে। এতে মুসলমান সমাজের ধর্মীয়অনুভূতিতে আঘাত লাগার কারণে তারা যদিউত্তেজিত হয়ে উঠে তবে এতে দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে এবং মানুষেরজানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, যাকারও কাম্য নয়। কাজেই তাদেরকে অবিলম্বেপৃথক একটি ধর্মাবলম্বী দল ঘোষণা করে পৃথকনামে তাদেরকে একটি সংখ্যালঘু দল হিসাবেমর্যাদা দিলে এবং তাদের জন্য ইসলামীপরিভাষাসমূহ যেমন : নামায, রোযা, মসজিদ,হজ্ব ইত্যাদির ব্যবহার নিষিদ্ধ করলে তা দেশেরআইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে সহায়ক হবে বলেআমরা মনে করি। এটাই সচেতন মুসলিমসমাজের প্রাণের দাবি।

কাদিয়ানী সম্প্রদায় সম্পর্কে সর্বোচ্চ আদালতেররায়

কাদিয়ানী সম্প্রদায় যেহেতু ইসলামের মৌলিকআকীদার পরিপন্থী আকীদা পোষণ করে, হযরতমুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেসর্বশেষ নবী স্বীকার করে না; বরং তারা মির্জাগোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী মনে করেএবং তার মতবাদ অনুসরণ করে তাই কোনোআদালত বা পার্লামেন্ট তাদেরকে অমুসলিমঘোষণা করুক, আর নাই করুক, তারা সুস্পষ্টকাফের অর্থাৎ অমুসলমান। এটা ইসলামেরফয়সালা। তবু ইসলামের দুশমন ও ইসলামেরজন্য ক্ষতিকর এমন একটি সম্প্রদায়কেমুসলমানের মুখোশ পরে চলার প্রশ্রয় দেওয়াসচেতন মুসলিম সমাজের পক্ষে সম্ভব নয়, তাইতাদেরকে সরকারীভাবে ‘অমুসলিম’ ঘোষণা করেপৃথক একটি ধর্মাবলম্বী দল হিসাবে চিহ্নিত করাএবং ইসলামের পরিভাষাসমূহকে তাদের ধর্মীয়কর্মকান্ডের জন্য ব্যবহার করাকে আইনগতভাবেনিষিদ্ধ করা আবশ্যক। এটাই সচেতন মুসলিমসমাজের ঈমানী চেতনার দাবি। বহু ত্যাগ ওকুরবানীর বিনিময়ে বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধিকরে বহু তর্ক-বহসের পর ১৯৭৪ঈ. সালে ভুট্টোসরকারের আমলে পাকিস্তান ন্যাশনাল এসেম্বলীকাদিয়ানীদের ‘অমুসলিম সংখ্যালঘু’ ঘোষণা করেএবং তাদের জন্য ইসলামী পরিভাষাসমূহব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তারপর লাহোর হাইকোর্ট১৯৮১, ১৯৮২, ১৯৮৭, ১৯৯১, ১৯৯২ ইংসালে, সম্মিলিত শরয়ী আদলত ১৯৮৪,১৯৯১ঈ. সালে, কোয়েটা হাইকোর্ট ১৯৮৭ঈ.সালে,

সুপ্রিম কোর্ট শরয়ী এপিলেট বেঞ্চ পাকিস্তান১৯৮৮ঈ. সালে এবং

পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্ট ১৯৯৩ঈ. সালে কাদিয়ানীসম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করে। এছাড়াসৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত,আফগানিস্তান, মুসলিম লীগ, আর্গানাইজেশন অবইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) কাদিয়ানীদেরঅমুসলিম ঘোষণা করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশওআইসির অন্যতম সদস্য দেশ।

বাংলাদেশ কোর্টের রায়

কাদিয়ানীরা ‘ইসলামেই নবুওয়াত’ নামক একটিবই রচনা করে তাতে কুরআন ও হাদীসের বিকৃতও মনগড়া অর্থ করে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লামের পর নতুন নবীরআগমনের পথ তৈরি করার চেষ্টা করে। বইটিমুসলিম সমাজের আকীদা-বিশ্বাসের মূলে আঘাতহানার কারণে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৫ঈ.সালের আগস্ট মাসে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।কাদিয়ানীরা সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেহাইকোর্টে মামলা দায়ের করে। হাইকোর্টডিভিশনের বিচারপতি জনাব সুলতান আহমদখান ও বিচারপতি জনাব এম. মাহমুদুর রহমানসমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে যথোপযুক্ত শুনানির পরকাদিয়ানীদের আবেদন নামঞ্জুর করেন। মাননীয়বিচারপতিগণ তাদের রায়ে হযরত মুহাম্মাদসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের পরে নবীআবির্ভূত হওয়ার আকীদাকে কুফরী বিশ্বাস বলেঘোষণা করেন। বিশ্বের বিভিন্ন আদালতের রায়েকাদিয়ানীরা যে অমুসলিম ঘোষিত হয়েছে, এশুনানির মাধ্যমে বাংলাদেশ হাইকোর্ট সে কথাইপুনঃব্যক্ত করেছেন। সংবাদটি বাংলাদেশেরএকটি জাতীয় দৈনিকে ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬ঈ.তারিখে প্রকাশিত হয়।

১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে অন্য একটি মামলায়হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মাদ আব্দুলজলিল ও বিচারপতি মোহাম্মাদ ফজলুল করিমেরসমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে আইনের দৃষ্টিতেকাদিয়ানীদের অমুসলিম বলে রায় প্রদান করেন।এর দ্বারা বাংলাদেশে হাইকোর্টের মতেওকাদিয়ানীরা অমুসলিম ঘোষিত হয়েছে। সরকারকর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটিও কাদিয়ানীদেরকেরাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করার সুপারিশকরেছেন। (তথ্য সূত্র : মো : আব্দুল কাসেমভূঞা, কাদিয়ানী ধর্মমত বনাম ইসলামী দুনিয়ারঅবস্থান)

সুতরাং মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালতসমূহেররায় এবং আন্তর্জাতিক সর্বোচ্চ ইসলামী সংস্থাওআইসি’র সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ওআইসি’রসদস্যদেশ হিসাবে বাংলাদেশ সরকারের উচিত কাদিয়ানীদেরকে সরকারীভাবে ‘অমুসলিমসংখ্যালঘু’ ঘোষণা করা এবং তাদের জন্যইসলামী পরিভাষাসমূহের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে