জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশঅথবা, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের জলবায়ুতে এর প্রভাব

ভূমিকা: জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপনীত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি— যার ফলে আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়েছে, সমুদ্রপষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে এবং বিশ্ব নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং এ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ গ্রিন হাউস ইফেক্ট। সূর্য থেকে আগত তাপশক্তি পৃথিবীপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে এবং এ বিকিরিত তাপশক্তির অধিকাংশই পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। কিন্তু মানবসৃষ্ট দূষণ এবং বনভূমি উজাড় করার ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে, যা কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের সমন্বয়ে গঠিত। এর ফলে বিকিরিত তাপশক্তি পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যাওয়ার পথে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এভাবেই বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। আধুনিক কালে ব্যাপক হারে জীবাশ্ম জ্বালানি দহন, বনাঞ্চল ধ্বংস, শিল্পায়নের ফলে গ্রিন হাউস ইফেক্টের মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এর ফলে ১৮৫০-১৯৬০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় পাচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বর্তমান বিশ্ব প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।



 

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ : পৃথিবী বেষ্টনকারী আবহাওয়ামণ্ডলের কারণে পথিবী প্রাণধারণ ও বসবাস উপযোগী হয়েছে। মহাশূন্যের আবহাওয়ামণ্ডলে ‘ওজোন স্তর’ নামে অদৃশ্য এক বেষ্টনী বিদ্যমান, যা পৃথিবীতে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি প্রবেশ রোধ করে এবং বিকিরণ প্রক্রিয়ায় সূর্য থেকে আসা তাপ মহাশূন্যে পুনরায় ফিরে যেতে সহায়তা করে। কিন্তু মানব সৃষ্ট দূষণ ও বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে প্রকৃতি প্রদত্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী, ওজোন স্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। গহন্তালি পণ্য যেমন ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার, বিভিন্ন ধরনের স্প্রে ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয় ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) গ্যাস, যা শিল্পকারখানাতেও ব্যবহৃত হয়। এ অবমুক্ত সিএফসি মহাশূন্যের ওজোন স্তর ক্ষয়ের অন্যতম কারণ। একদিকে ওজোন স্তরের ক্ষয়জনিত কারণে মাত্রাতিরিক্ত সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে পৌঁছাচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে প্রতিনিয়ত তাপ সঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে পৃথিবী হয়ে উঠছে উত্তপ্ত। সামগ্রিকভাবে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার ফলে পৃথিবী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বাংলাদেশে এর প্রভাব : পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে যেসব বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে সেগুলো মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই দেখা দিচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিই মূলত এ পরিবর্তিত জলবায়ুর জন্য দায়ী। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতিসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি : বিশ্ব উষ্ণায়নের একটি সম্ভাব্য পরিণতি হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে সমুদ্রের পানির উত্তাপ বৃদ্ধি পাবে এবং পানি সম্প্রসারিত হয়ে সমুদ্রের আয়তন ও পরিধিকে বাড়িয়ে তুলবে। উষ্ণায়নের ফলে হিমালয়সহ অন্যান্য পর্বতচূড়ায় জমে থাকা বরফ গলে যাবে এবং সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপ, যেখানে অসংখ্য নদ-নদী বয়ে চলেছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা ১০ সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের ১১ শতাংশ ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এর ফলে ৫৫ মিলিয়ন লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশে সমুদ্রপষ্ঠের উচ্চতা প্রতিবছর ৭ মিমি হারে বাড়ছে, যেখানে ভূ-পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ৫-৬ মিমি/বছর। এর ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ১-২ মিমি/বছর। Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC)-এর এক সমীক্ষায় বলা হয়, বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি দশকে ৩.৫ থেকে ১৫ মিমি বৃদ্ধি পেতে পারে। এমনকি ২১০০ সাল নাগাদ তা ৩০ সেমি থেকে ১০০ সেমি এ পৌছাতে পারে। তাই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

২. মরুভূমির বৈশিষ্ট্য : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন পৃথিবীর নিচু এলাকাসমূহ সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে মরুভূমির বৈশিষ্ট্য দেখা দেবে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ইতোমধ্যে মরুভূমির বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে, এর ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহতসহ তা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

৪. জীববৈচিত্র্য ধ্বংস : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার প্রভাবে বনাঞ্চলসমূহ ধ্বংস হওয়ার আশংকা দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্তির পথে, কারণ এ পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে তারা খাপ খাওয়াতে পারছে না। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেলে তা বিশ্বের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ ফলাফল বয়ে আনবে। পরিবেশ তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাস্তুসংস্থানের বিপর্যয় ঘটলে তা মানব সভ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হবে।

৬. পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি : পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি দেশের কৃষি ও অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। বর্তমানে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ও দূরবর্তী দ্বীপসমূহের প্রায় ১.৪ মিলিয়ন হেক্টর এলাকায় লোনা পানি প্রবেশ করায় উন্মুক্ত জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে এ লবণাক্ততার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে। বিশেষত নদ-নদীর মোহনায় অবস্থিত দ্বীপ ও তৎসংলগ্ন এলাকার অধিক লোনা পানি প্রবেশ করবে। ভূগর্ভস্থ পানি ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি উপকূলীয় পরিবেশকে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

৭. আকস্মিক বন্যা : পাহাড়ি ঢলের কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিশেষত মেঘনা অববাহিকায় প্রতিবছর আকস্মিক বন্যা দেখা যায়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার এ এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ১ হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা আকস্মিক বন্যার শিকার। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত পাহাড়ি ঢলের পরিমাণ আরো বেড়ে যাচ্ছে।ফলে আকস্মিক বন্যার পৌনঃপুনিকতা, ক্ষতির পরিমাণ ও তীব্রতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।

৮. নদী ভাঙন: বাংলাদেশে মোট সমদ্র তটরেখার পরিমাণ ৬৫০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সুন্দরবন উপকূল ঘিরে রয়েছে ১২৫ লোমিটার এবং কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এছাড়া সমদ উপকূল বরাবর রয়েছে গঙ্গা ও মেঘনা অববাহিকায় অহত অসংখ্য প্রশস্ত জোয়ার ভাটা সমভমি এবং নদী মোহনায় রয়েছে ব-দ্বীপ। নদীসঙ্গমে অবস্থিত এসব বদ্বীপ ও সমুদ্র তটরেখা বরাবর ভূখণ্ড প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। কিন্তু এ পরিবর্তনশীল বৈশিষ্টের মাঝে এক বিশেষ ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে এ ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে।

৯. খরা: মাটিতে আর্দ্রতার অভাব অর্থাৎ বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবনের মাত্রা বেশি হলে খরা দেখা দেয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে যার প্রভাব বাংলাদেশেও দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষাকালে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত ও পানির অভাবে কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং ফসল উৎপাদনও ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে।



 

১০. সামুদ্রিক ঝড় জলোস : সাধারণত সামদিক ঝড় সষ্টি হয় উত্তপ্ত বায় ও ঘূর্ণিবায় থেকে। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পেছনে অন্যান্য প্রক্রিয়া সাক্রয় থাকলেও পানির উত্তাপ বদ্ধিই মূল কারণ। বাংলাদেশে প্রতিবছর মে-জুন মাসে যে সামুদ্রিক ঝড় হয় তাতে উপকূলীয় জেলাসমূহে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রাও ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছাসের তীব্রতাও বেড়ে যাবে। ২০০৭ সালে আঘাত হানা সিডর’ বাংলাদেশে যে ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন রেখে গেছে তা বর্ণনাতীত। সিডরে হাজার হাজার মানুষের সলিল সমাধির সাথে সাথে সম্পদেরও ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। মানবসৃষ্ট দূষণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের যে ধারা সৃষ্টি হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য তা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। দূষণের জন্য বিশ্বের শিল্পায়িত দেশগুলোর দায়ভার সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনেক ধনী রাষ্ট্রই কিয়োটো প্রটোকল, ১৯৯৭’ কার্যকর করেনি।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বাংলাদেশে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাবে সম্ভাব্য ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ও তার প্রতিবেশী দেশসমূহে ক্ষয়-ক্ষতির মাত্রা অত্যন্ত ব্যাপক হবে বলে পরিবেশ ও ভূ-বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বাংলাদেশের উচ্চতা কম থাকার কারণে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও ভয়াবহ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে যা জলবায়ু পরিবর্তনেরই ফলাফল।

১. বিপন্ন জনগোষ্ঠী : বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কোনো মাঝারি ধরনের প্লাবনে দেশের ৬৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে এবং প্লাবন এলাকার পরিধি ক্রমেই বাড়তে থাকবে। ফলে বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়বে।

২. অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্লাবনের তীব্রতা বাড়বে এবং অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে। IPCC-এর সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্লাবনজনিত কারণে বস্তুগত সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ২৪২ মিলিয়ন টাকা।

৩. বিপন্ন কৃষি : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের কৃষি খাত মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কৃষিখাতের ওপর এ বিপর্যয় দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। IPCC-এর সমীক্ষা অনুযায়ী প্লাবনের কারণে দেশে আমন ধানের উৎপাদন ১৩.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন হ্রাস পাবে। এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দেশের কৃষি উৎপাদন বর্তমানের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শীত মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৩৬০০ বর্গ কিমি এলাকা খরার কবলে পড়ে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে খরার ব্যাপ্তি আরো বেড়ে তা ২২০০ কিমি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। এছাড়া প্রয়োজনীয় সেচের অভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে চাষাবাদ ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।।

৪. লোনা পানির অনুপ্রবেশ : দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে। IPCC-এর সমীক্ষা অনুযায়ী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০০ সেমি বৃদ্ধি পেলে ২৫,০০০ বর্গ কিমি এলাকায় লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটবে। ফলে দেশের প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ লোকের জীবন ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া লোনা পানি প্রবেশের ফলে দেশের চিংড়ি শিল্প ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। দেশের নদ-নদীতে লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটলে স্বাদু পানির মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হবে এবং জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন বিপন্ন হবে।

৫. পরিবেশ বিপর্যয় : বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পদ অত্যন্ত অপ্রতুল। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে জলবায়ুতে যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে তা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনবে। ইতোমধ্যে দেশের বৃহৎ বনভূমি সুন্দরবন ও হাওর অঞ্চলের পরিবেশ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে আমাদের করণীয় : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় বরং সমগ্র বিশ্ব ও মানবজাতির জন্য চমকিস্বরূপ। ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূ-প্রাকৃতিক অবকাঠামো বাংলাদেশকে যতটা কুফলভোগী করেছে, এ সংকট সৃষ্টিতে আমাদের দেশের ভূমিকা শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় খুবই নগণ্য। এখনই সময় এ সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসার। বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে আমাদের সবচেয়ে যেসব বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে সেগুলো হলো :

১. ব্যাপকভাবে বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ও নদী তীরবর্তী এলাকাসমূহে বনায়ন কর্মসূচি শুরু করতে হবে। ফলে নদী ভাঙন ও সামুদ্রিক ঝড়ের তীব্রতা কমে যাবে।

২. বৃক্ষনিধন রোধ করতে হবে। কারণ বৃক্ষই প্রকৃতি থেকে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস শোষণ করে এবং অক্সিজেন নির্গমন করে।

৩. বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ বাড়ায়-এমন ক্ষতিকর গ্যাসের নির্গমন কমাতে হবে।

৪. পরিবেশ সহায়ক জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

৫. শিল্পকারখানার জ্বালানি সাশ্রয় করতে হবে এবং উৎপন্ন বর্জ্য বিশুদ্ধকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।




 

উপসংহার : একবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে মানবজাতি যখন সভ্যতার চরম শিখরে, ঠিক তখনই এ মানবজাতি তার পরিবেশকে ঠেলে। দিচ্ছে চরম বিপর্যয়ের দিকে। মানুষ তার প্রয়োজনে একদিকে যেমন পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করছে অপরদিকে পরিবেশকে করে তুলছে বিষাক্ত। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং পরিবেশের ভারসাম্য দ্রুত বিনষ্ট হচ্ছে। এ বিশ্ব আমাদেরই। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। এখন থেকেই সবাই সচেতন হলে। সম্ভাব্য বিপর্যয় মোকাবিলা অনেক সহজ হয়ে যাবে এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমে আসবে। আমাদের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই কৌশলগতভাবে অগ্রসর হতে হবে। যাতে দীর্ঘকালীন প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করা যায়


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে