(সংকেত: ভূমিকা; ধান চাষের উৎপত্তি; জন্মস্থান; ধান গাছের বর্ণনা; ধান চাষের জন্য বীজতলা; ধান চাষের জন্য উপযোগী অঞ্চল; শ্রেণিভেদ; বাংলাদেশে ধানের মৌসুম; ফসল সংগ্রহ; ধানের প্রক্রিয়াজাতকরণ; ধানের পুষ্টিগুণ; ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; উন্নত জাতের ধান সমূহ; ধানের উৎপাদন; উপসংহার।)

ভূমিকা:

ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। আমরা ধান থেকে তৈরি ভাত খেয়ে জীবন ধারণ করি। পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক অন্নভোজী। বাংলাদেশে ধানের চাহিদা প্রচুর। বিভিন্ন উপায়ে এই ক্রমবর্ধমান চাহিদার পূরণ করা হচ্ছে। ভারতীয় উপমহাদেশে হাজার হাজার বছর ধরে চলেছে এই ধান চাষ। ধানের সঙ্গে আর কোনো কৃষিজাত দ্রব্যেরই তুলনা করা যায় না।

ধান চাষের উৎপত্তি:

ধান (বৈজ্ঞানিক নাম oryza sative) Graminae / poaceae গোত্রের দানাশস্য উদ্ভিদ। ধান উষ্ণ জলবায়ুতে, বিশেষত পূর্ব-এশিয়ায় ব্যাপক চাষ হয়। ধানবীজ বা চাল সুপ্রাচীন কাল থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রধান খাদ্য। চীন ও জাপানের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় ১০,০০০ বছর আগে ধান চাষ হয়েছিল বলে জানা যায়।

ধান গাছের বর্ণনা:

ধান গাছ সাধারণত ১-১.৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এর পাতা সরু, লম্বা আকৃতির হয়। পাতা ৫০-১০০ সে.মি (২০-৩৯ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা ও ২-২.৫ সে.মি. (০.৭৯-০.৯৮ ইঞ্চি) প্রশস্ত হয়ে থাকে। সাধারণত বায়ুর সাহায্যে এর পরাগায়ন হয়ে থাকে। পুষ্পমঞ্জরীতে ফুলগুলোর শাখান্বিত অবস্থান উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সাজানো থাকে। এক একটি পুষ্পমঞ্জরী ৩০-৫০ সে. মি. (১০-২০ ইঞ্চি) লম্বা হয়ে থাকে। এর বীজকে খাবার হিসাবে খাওয়া হয়, একে শস্য বলা হয়। প্রথমে ধান সজুব বর্ণের থাকে। ধান পাকলে সোনালি বর্ণ ধারণ করে।

জন্ম স্থান:

বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন, জাপান, শ্রীলংকায় প্রচুর ধান জন্মে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কম বেশি ধান জন্মে। বাংলাদেশের সর্বত্র ধান জন্মে। তবে বাংলাদেশের বরিশাল, ঢাকা, কুমিল্লা, দিনাজপুর, সিলেট, জামালপুর ও ময়মনসিংহে অনেক বেশি ধান জন্মে।

ধান চাষের জন্য বীজতলা:

ধান চাষ করতে হলে প্রথমে বীজতলা তৈরি করতে হয়। সেখানে বীজ ছিটিয়ে রেখে কয়েক দিন সেচ দিতে হয়। তারপর ছোট চারাগুলোকে তুলে মূল জমিতে রোপন করা হয়। তাছাড়া সরাসরি বীজ জমিতে ছিটিয়েও চাষ করা হয়।

শ্রেণিভেদ:

বাংলাদেশে রয়েছে হরেক রকমের ধানের জাত। এর মধ্যে ফসলভেদে ধানকে আউশ, আমন ও বোরো এই তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। প্রত্যেক প্রকারের আবার নানা রকম নামও হয়ে থাকে। যেমন- লক্ষ্মীবিলাস, কালাজিরা, মানিদীঘি ইত্যাদি। বর্তমানে ইরি জাতের ধানের ব্যাপক চাষ হচ্ছে।

বাংলাদেশে ধানের মৌসুম:

চাষের সময়ের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের ধানকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এই প্রধান তিনটি ভাগ হলো আউশ, আমন ও বোরো।

আউশ ধান:

দ্রুত (আশু) ফসল উৎপন্ন হওয়ার বিচারে এই ধানের নামকরণ করা হয়েছে আউশ। এই ধান সাধারণত আষাঢ় মাসে জন্মে। এই কারণে এর অপর নাম আষাঢ়ী ধান। তবে এই ধান বৎসরের যেকোনো সময়েই চাষ করা যায়। বাংলাদেশে তৈরি আউশ ধানের বিভিন্ন জাতগুলো হলো- হাসিকলমি, সূর্যমুখ, শনি, ষাইটা, আটলাই, কটকতারা, কুমারি, চারণক, দুলার, ধলাষাইট, ধালাইল, পটুয়াখালি, পানবিড়া, কালামানিক, কালা বকরি, ভইরা, ভাতুরি ইত্যাদি।

আমন ধান:

আমন হেমন্ত ঋতুর ধান। আমন ধান তিন প্রকারের। যথা:-

রোপা আমন:

চারা প্রস্তুত করে, সেই চারা রোপন করে এই ধান উৎপন্ন হয় বলে এর নাম রোপা আমন। রোপা আমন জৈষ্ঠ্য-আষাঢ় মাসে বীজ তলায় বীজ বোনা হয়। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে মূল জমিতে রোপণ করা হয় এবং অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে ধান কাটা হয়।

বোনা আমন:

এই আমন ছিটিয়ে বোনা হয়। বোনা আমন চৈত্র-বৈশাখ মাসে মাঠে বীজ বপণ করা হয় এবং অগ্রহায়ণ মাসে পাকা ধান কাটা হয়। একে আছড়া আমনও বলে।

বাওয়া আমন:

বিল অঞ্চলে এই আমন উৎপন্ন করা হয়। এই কারণে একে গভীর পানির বিলের আমনও বলা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির আমন ধান চাষ হয়ে থাকে এবং প্রতিটি প্রজাতির ধানের স্থানীয় নাম রয়েছে। যেমন- চিংড়ি খুশি, চিটবাজ, ইন্দ্রশাইল, কাতিবাগদার, ক্ষীরাইজালি, নাজিরশাইল, বাঁশফুল, ঢেপি, বাদশাভোগ, ভাসা মানিক, বাইশ বিশ, দুধলাকি, ধলা আমন, ঝিঙ্গাশাইল, রাজাশাইল, রূপশাইল, লাটশাইল, হাতিশাইল, গদালাকি, গাবুরা, জেশোবালাম ইত্যাদি।

বোরো ধান:

বোরো ধান প্রধানত সেচ নির্ভর। কার্তিক মাস থেকে বীজ তলায় বীজ বপণ শুরু হয়। ধান কাটা চলে বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য পর্যন্ত। উচ্চ ফলনশীল বোরো ধান প্রবর্তনের পর থেকে ধান আবাদ তথা সমুদয় কৃষি ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বসন্তকালে এই ধান জন্মে বলে একে বাসন্তিক ধানও বলা হয়। এই জাতের ধানের নামগুলো হলো আমন বোরো, কৈয়াবোরো, টুপা, পশুশাইর, বানাজিরা, কেরোবোরো ইত্যাদি।

ধানের প্রক্রিয়াজাতকরণ:

ধান কাটার পর সাধারণত একে রোদে শুকানো হয়। রোদে শুকিয়ে এর বীজের আদ্রতা কমিয়ে আনা হয় যেন, একে সংরক্ষণ করার পর কোনো ছত্রাক জাতীয় রোগ আক্রমণ না করতে পারে। এরপর ঢেঁকি বা যন্ত্রের সাহায্যে এর খোসা ছাড়ানো হয়। এ পদ্ধতিকে ইংরেজিতে বলা হয় হাস্কিং।

ধানের পুষ্টিগুণ:

ধানে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের পুষ্টি উৎপাদন। যথা-

উপাদান পরিমাণ ১০০ গ্রামেপানি ১২কার্বোহাড্রেট ৮০শক্তি ১৫২৯ কিলোজুলআমিষ ৭.১স্নেহ ০.৬৬আঁশ ১.৩চিনি ০.১২ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট: বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে নিত্য নতুন ধান উদ্ভাবনের চেষ্টায় নিয়োজিত সংস্থা BRRI (Bangladesh Rice Research institute)। ঢাকার উত্তরে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরে এই সংস্থার সদর দপ্তর অবিস্থত। সারাদেশে এই ইনস্টিটিউটের ৯টি আঞ্চলিক কেন্দ্র রয়েছে। কেন্দ্রগুলো- কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, সোনাগাজী, ভাঙ্গা, বরিশাল, রাজশাহী, রংপুর, কুষ্টিয়া এবং সাতক্ষীরায় অবস্থিত। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃতি উন্নত প্রজাতির ধান বেশির ভাগই করেছে- BRRI-এর বিজ্ঞানীরা।

ধানের উৎপাদন:

বাংলাদেশে দিন দিন ধানের উৎপাদন বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের তথ্য অনুযাযী ১৯৫০ -৫১ সালে দেশে চালের মোট উৎপাদন ছিল ৬২ লাখ টন। বীজ ও অপচয় বাবদ শতকরা ১০ ভাগ বাদ দেয়ার পর চালের নীট প্রাপ্যতা ছিল ৫৫ লাখ ৮০ হাজার টন। লোক সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ২১ লাখ। ওই বছরে খাদ্যশস্যের ঘাটতির পরিমাণ ছিল সাড়ে ১১ লাখ টন। ১৯৬৫-১৯৭৫ সালে চালের উৎপাদনে তেমন বেশি পরিবর্তন হয়নি। চাল উৎপাদনের বার্ষিক পরিমাণ ছিল এক কোটি ৭ লাখ টন। ওই সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। বর্তমানে ২০১৩-১৪ বর্ষে এসে ধানের উৎপাদন ৩ কোটি ৪০ লাখ টন। ১৯৭১-২০১৪ সাল এই ৪৩ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। অন্যদিকে একই সময়ে এই ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণ। এছাড়া ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাড়াও বাংলাদেশে পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ১৪টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। যা কৃষকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়েছে।

উপসংহার:

ধান থেকে উৎপাদিত ভাত বাঙালির প্রধান খাদ্য। আমাদের দেশে ধান প্রধান খাদ্য হলেও আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ধান চাষ করতে পারছি না; কারণ এখনো আমাদের কৃষিপদ্ধতি প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। তারপরও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে অনেক এগিয়েছে। সরকারের ব্যাপক সহযোগীতা পেলে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যাবে।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে