শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
hossainctg

Call

রচনা→ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

 ভূমিকা : বিশ্বসম্মোহনীদের নামের তালিকায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বাগ্রে। তিনি সগৌরবে সম্মোহনিতার আসনে সমাসীন। 

জন্ম ও পারিবারিক পরিচয় : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ সাবেক ফরিদপুর আর বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান ও মাতার নাম সায়েরা খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান। 

শিক্ষাজীবন : ১৯২৭ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বয়স ৭ বছর তখন তাঁকে স্থানীয় গিমাডাঙা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। তারপর ৯ বছর বয়সে অথাৎ ১৯২৯ সালে তাঁকে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি করা হয়। পরে তিনি মিশনারি স্কুলে পড়ালেখা করেন। কিন্তু ১৯৩৪ সালে তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে প্রায় ৪ বছরকাল তাঁর পড়ালেখা বন্ধ থাকে। অতঃপর ১৯৩৭ সালে আবারও তিনি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন।

 রাজনৈতিক জীবন: ছাত্রাবস্থা থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। আর তাঁর রাজনৈতিক জীবনে রয়েছে বিশেষ বিশেষ অবদান।

 ভাষা আন্দোলন : ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন আইন পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে’ বলে ঘোষণা দিলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে ওই ঘোষণার প্রতিবাদ জানান। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে ভাষার প্রশ্নে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবক্রমে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গড়ে ওঠে। 

নির্বাচনি বিজয় : ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জাতীর পরিষদের ১৬২টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে ১৬০টিতে জয়লাভ করে। তাছাড়া সংরক্ষিত ৭টি মহিলা আসনসহ আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত সর্বমোট অসনসংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৭। আবার প্রাদেশিক পরিষদের সর্বমোট ৩০০টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। ১৯৭১ : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানামুখী তালবাহানার আশ্রয় নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসভায় স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা হিসেবে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। জনতার মহাসমুদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি অসহযোগের ডাকও দেন। ২০১৭ সালে তাঁর এই ঐতিহাসিক ভাষনকে ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বকৃতি দেয়। 

উপসংহার : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিদেহী আত্মার স্মৃতির প্রতি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আমাদের অঙ্গীকার হচ্ছে- সোনার বাংলা গড়বো পিতা কথা দিলাম তোমায়; চেতনা থেকে বিচ্যুত হবো না গ্রেনেড তবা বোমায়।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ
Habib Ullah

Call

ভূমিকা:
কোন জাতি যখন প্রকৃতই কোন সংকটের সম্মুখীন হয় তখন ঠিকই সেই জাতির পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে কোন না কোন মহাপুরুষের। বাংলাদেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনই একজন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কস্বরূপ। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি যখন ভুগছে অস্তিত্ব সংকটে, তখনই বাঙালি জাতির পরিত্রাণের প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন শেখ মুজিবুর।

বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ার বুকে যে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র আজ মানচিত্রে জ্বলজ্বল করে, সেই রাষ্ট্রটির গঠনে সবথেকে বড় অবদান শেখ মুজিবুরের। সেজন্যই স্বাধীন বাংলাদেশ তাকে দিয়েছে জাতির জনকের সম্মান। শেখ মুজিব ছাড়া আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যেত না।


এই প্রবন্ধে আজ আমরা আলোচনা করতে চলেছি বাংলাদেশী মানুষের এই মহান পরিত্রাতা তথা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণময় জীবন নিয়ে।

জন্ম ও ছেলেবেলা:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর জন্মগ্রহণ করেন ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ই মার্চ অবিভক্ত ভারতবর্ষে বাংলা প্রদেশের গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। উক্ত এই গোপালগঞ্জ জেলাটি আদপে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত। বঙ্গবন্ধুর পিতা ছিলেন শেখ লুৎফর রহমান এবং মায়ের নাম সায়েরা বেগম। মুজিবুরের পিতা শেখ লুৎফর সরকারি আদালতের এক বিশিষ্ট কর্মচারী রূপে কর্মরত ছিলেন।

তাছাড়া পরিচিত মহলে স্পষ্টভাষী হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান ছিলেন শেখ মুজিব। বাড়িতে পরিচিতরা তাকে ডাকতেন খোকা নামে। চারটি বোন এবং দুইজন ভাই নিয়ে ছিল শেখ মুজিবুরের সংসার। বড় বোনের নাম ফাতেমা বেগম, সেজ বোন হেলেন, মেজ বোন আছিয়া বেগম, এবং তার ছোট বোন ছিলেন লাইলী। বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ছোট ভাইয়ের নাম ছিল শেখ আবু নাসের।


এইভাবে অতি সাধারণ একটি পরিবারে ভাই বোনের মধ্যে গ্রাম্য পরিবেশে বড় হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ছেলেবেলা থেকেই তিনি খেলাধুলা ও নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। বিদ্যালয় শিক্ষা কালীন সময়ে একাধিক খেলায় পুরস্কারও পেয়েছেন শেখ মুজিব।

শিক্ষা:
মাত্র ৭ বছর বয়সে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুজিবুর গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় ভর্তি হন। এখানেই তার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর ১৯২৯ সালে তিনি ভর্তি হন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। এরপর ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ গোপালগঞ্জ মিশনারি হাইস্কুলে বঙ্গবন্ধু সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৯৪২ সালে নাগাদ তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন।


তারপর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৪৪ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আই.এ এবং এবং ১৯৪৭ সালে বি.এ পাস করেন। ওই বছর ভারত বিভাগের পর শেখ মুজিবুর আইন অধ্যায়নের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন।

তবে ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এজন্য তিনি আইনের পড়াশুনা শেষ করতে পারেননি। যদিও ২০১০ সালে এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের আইন বিভাগে স্থাপন করেছে বঙ্গবন্ধু চেয়ার।

রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু:
রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর এর জীবন কাহিনী অত্যন্ত বর্ণময়। তিনি তার জীবদ্দশায় মোট তিনটি দেশের নাগরিকত্ব ভোগ করেছেন। প্রথমটি ব্রিটিশ ভারত, দ্বিতীয়টি পাকিস্তান রাষ্ট্র, এবং তৃতীয়টি এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাবে তার নিজের প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র।


তিনটি দেশের নাগরিক জীবনে তিনি সমকালীন পারিপার্শ্বিক রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাই আলোচনার সুবিধার্থে আমরা তার রাজনৈতিক জীবনকে প্রথমে দুইটি ভাগে এবং পরবর্তীতে পৃথকভাবে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বদানে তার ভূমিকা সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা করব।

ব্রিটিশ ভারত:
রাজনীতিতে শেখ মুজিবের হাতে খড়ি হয় ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে পড়ার সময়। এই সময় স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবির ওপর ভিত্তি করে একটি দলের নেতৃত্ব দিয়ে স্কুল পরিদর্শনকারী কতৃপক্ষের কাছে দাবি দাবি পেশ করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে মজিবর যোগ দেন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে।


এরপরে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তির পর থেকেই শেখ মুজিবুরের জীবনে সক্রিয় রাজনীতির অধ্যায় শুরু হয়। ১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে তিনি ভারতকে ভেঙে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান তৈরী সংক্রান্ত আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।

পাকিস্তানে রাজনৈতিক জীবনের সূচনা:
ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর মজিবুরের কর্মক্ষেত্র হয় ঢাকা। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে ভর্তি হবার পরে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এই প্রতিষ্ঠান তাকে বিক্ষিপ্ত আন্দোলনের নায়ক থেকে ছাত্র নেতার আসনে উন্নীত করে। রাজনৈতিক জীবনের এই পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষের জীবনযাত্রা সার্বিক উন্নয়নের এবং সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের উদ্দেশ্যে আন্দোলন শুরু করেন।

পরবর্তীকালে তিনি আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতিতে সমকালীন সরকার বিরোধী অবস্থান কথা তার সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি মুজিবুরকে তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের প্রধান বিরোধী পক্ষে পরিণত করে। তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীর মামলাও দায়ের করা হয়।


পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলন:
ভারত থেকে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি হবার পর যখন মজিবর ধীরে ধীরে সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকতে থাকেন তখনই পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব তথা স্বাতন্ত্র রক্ষার উদ্দেশ্যে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। আসলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পরই তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রের একমাত্র জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের কথা ঘোষণা করে।

এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর বাংলাভাষী নাগরিকেরা। ইতিহাসের নায়ক মুজিব এই স্বৈরাচারী পরিকল্পিত জুলুম মূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের সূচনা করেন। তার নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় যখন ধর্মঘট পালিত হচ্ছে তখন প্রথমবার গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু। যদিও ছাত্রসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে বঙ্গবন্ধুকে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

তার মুক্তির পর থেকে বাংলা ভাষা আন্দোলন আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। ১৯৫০ সাল নাগাদ মুজিবুর আবার গ্রেফতার হন। জেলে তিনি ১৩ দিন অনশন করেন। এইবারেও সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তার কিছুদিন পর প্রবল আন্দোলনের মুখে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সরকার স্বীকৃতি দেয়।

নির্বাচন ১৯৫৪:
১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনের পূর্বে সরকার গঠনের জন্য একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তার পরের বছর মার্চ মাস নাগাদ। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এবং প্রাপ্ত আসন গুলির মধ্যে সবথেকে বেশি আসন পায় আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিব নিজে তার নির্বাচন কেন্দ্র গোপালগঞ্জ থেকে ১৩,০০০ এর বেশি ভোটের ব্যবধানে শক্তিশালী মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে জয়লাভ করেন।


পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর এই সরকারে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকার গঠনের মাত্র ১৫ দিনের মধ্যেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয়। আরো একবার ঢাকা বিমানবন্দর থেকে মুজিবুরকে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় সাত মাস জেলবন্দি থাকার পর তিনি ছাড়া পান। এরপর পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

১৯৫৫ সালে পুনরায় কোয়ালিশন সরকার যোগদান করে তিনি একাধারে বাণিজ্য, শ্রম, শিল্প, দুর্নীতি রোধ, এবং গ্রামীণ সহায়তা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। যদিও মাত্র দুই বছরের মধ্যেই শেখ মুজিব দলের জন্য নিজের সম্পূর্ণ সময় ব্যয় করার উদ্দেশ্যে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের পরও তিনি সরকারি প্রতিনিধিরূপে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন সফরে গিয়েছিলেন।


গণতন্ত্রের প্রবক্তা মুজিবুর:
সমাজতন্ত্র দ্বারা প্রভাবিত আমৃত্যু মুক্তচিন্তক মুজিবুর যেকোনো ধরনের স্বৈরাচার এবং কট্টরপন্থা বিরোধী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন জনগণের শাসন বা গণতন্ত্রে। নিজেরেই মতাদর্শগত অবস্থান থেকেই সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে তৎকালীন সামরিক শাসনের তীব্র বিরোধিতা তিনি করে গেছেন। আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন বাঙালির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা মর্যাদা রক্ষায়।

১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপতি তথা মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সমগ্র দেশ জুড়ে সকল প্রকারের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এই সামরিক শাসনের তীব্র বিরোধিতা করেন শেখ মুজিবুর। সেনাশাসনের এই পর্বে আবারো একাধিকবার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। এই সময়ে জেলের ভিতর থেকেই তিনি গুপ্তভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকেন।

বহু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করে থাকেন জীবনের এই পর্বেই মুজিবের মনে বাঙালির স্বাধীন দেশ: বাংলাদেশ গঠনের বীজ রোপিত হয়। সমগ্রহ দেশজুড়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক টালমাটাল এবং গণতন্ত্রহীন অরাজকতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে মুজিবুরের নিজের দেশের প্রতি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এক বিরাট পরিবর্তন আসে।

মুক্তি আন্দোলনের পটভূমি:
সামরিক শাসনে বীতশ্রদ্ধ মুজিব আদালতে রিট পিটিশনের মাধ্যমে জেল থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী দলগুলির একটি সম্মেলনে তার ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এই দাবির মূল বক্তব্য ছিল শাসন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সুষ্ঠু প্রয়োগ।


বলাই বাহুল্য পাকিস্তান সরকার তার এই দাবিগুলি মেনে নেয়নি। এই সম্মেলনের পর থেকে একাধিক ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হতে থাকে। ৭০’এর প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেও তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মুজিবুর সরকার গঠনের জন্য ডাক পাননি।

এর ফলে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিরা বুঝতে পারে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও তাদের সরকার গঠন করতে না দিয়ে সামরিক শাসক দল পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। বাঙালিরা বুঝতে পারে তাদের নিজেদের অধিকারের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। সেই অস্তিত্ব রক্ষা এবং দাসত্ব থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে সংগ্রামের জন্য জনগণ প্রস্তুত হতে থাকে।

বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন ও স্বাধীনতা:
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন এবং তার নির্দেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। 25 শে মার্চ রাত বারোটা কুড়ি মিনিটে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তার খানিকক্ষণের মধ্যে তিনি গ্রেফতার হন।


তার পরদিনই রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক নিধন যজ্ঞ শুরু করে। বিশেষ করে হিন্দুদের কে লক্ষ্য করে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় ব্যাপক দমন-পীড়ন শুরু হয়।

অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ও পুলিশ রেজিমেন্টে কর্মরত বাংলার সদস্যগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তি আন্দোলনের উদ্দেশ্যে গঠিত মুক্তিবাহিনীতে যোগ দান করে। এই পর্যায়ে মুজিবনগরে প্রতিস্ঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই মুক্তিবাহিনী এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ রূপে পরিচিত।

তারপর ওই বছরের ডিসেম্বর মাস নাগাদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সরকারের যোগদানের পর পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশের তথা বাঙালির স্বাধীনতা লাভ সম্পূর্ণ হয়। শেখ মুজিবুর করাচির কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দিল্লি হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ঢাকায় ফিরে আসেন এবং রেসকোর্স ময়দানে প্রায় 5 লাখ মানুষের সামনে বক্তৃতা দেন।

বাংলাদেশ শাসনকালে বঙ্গবন্ধু:
নবগঠিত রাষ্ট্রের পুননির্মাণ সংগ্রামে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর রূপে শেখ মুজিবুর রহমান দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানি ইন্ডিয়ান যজ্ঞে সমকালীন সময় বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত বাংলাদেশকে পুনরায় গড়ে তুলবার কাজে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

এ সময় তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিস্তৃত পরিসরে জাতীয়করণ কর্মসূচি কার্যকর করা হয়। শরণার্থী পুনর্বাসন এর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাছাড়া গণতন্ত্রপ্রেমী মুজিবুর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পথে পরিচালিত করার সিদ্ধান্ত নেন।

ব্যক্তিগত জীবন ও হত্যাকাণ্ড:
বাংলাদেশের রূপকথার নায়ক মুজিবুরের ব্যক্তিগত জীবন ছিল আর পাঁচজনের মতো সাদামাটা এবং ছিমছাম। মাত্র ১৪ বছর বয়সে নিজের চাচাতো বোন ফজিলাতুন্নেসার সাথে তার বিবাহ হয়। এই দম্পতির ঘরে তিন পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। মতাদর্শগত ভাবে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন।

সারা জীবন বাঙালীর মুক্তির কথা চিন্তা করে যাওয়া মুজিবুর রহমান বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রশংসায় ভূষিত হয়েছেন। এমনকি ২০০৪ সালে বিবিসি রেডিও সার্ভিস এর পক্ষ থেকে চালানো একটি সমীক্ষায় শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচিত হন। যদিও বাংলার মুক্তির এই নায়কের জীবনাবসানের কাহিনী অত্যন্ত করুণ।

যে দেশকে স্বাধীন করার জন্য তিনি আজীবন লড়াই করেছেন সেই দেশেরই একদল সেনা কর্মকর্তার হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ধানমন্ডি রাষ্ট্রপতি ভবনে বঙ্গবন্ধু তার সম্পূর্ণ পরিবার এবং সকল ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ নিহত হন। তিনি নিজের জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় তার কবরে চিরশয্যায় শায়িত আছেন।

উপসংহার:
আমৃত্যু বাঙালি তথা বাংলাদেশের হিতের কথা চিন্তা করে যাওয়া মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ তার শাসনকালে আদৌ সোনারবাংলা হয়ে উঠতে পেরেছিল কিনা তা বিচার্য নয়। বিচার্য এইযে সারা জীবন তিনি রাজনৈতিকভাবে যা কাজ করেছেন তা তার দেশ তথা দেশবাসীর সামগ্রিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যেই। শাসনকালে গৃহীত নানা নীতির জন্য বিভিন্ন মহলে বঙ্গবন্ধু সমালোচিত হলেও আমাদের মনে রাখা দরকার সেই নীতিগুলি গৃহীত হয়েছিল বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই।

একথা সন্দেহাতীত যে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জাতির নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান থেকে উপমা নিয়ে এক সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তৎকালীন কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রো সার্থক উক্তিটি করেছেন-

“আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি মুজিবকে দেখেছি।
ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় যিনি হিমালয়ের মতন।”

সুত্র:-banglarachana.com

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ