জাহিরুল হাসানের "বাংলায় মুসলমানের আটশো বছর " বইটাতে এই বিষয়ে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ভাবে বিষদে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ৷ এছাড়াও ইটন সাহেবের গবেষণা ও আরও অনেক লেখকের গবেষণা থেকে যা পাওয়া যায় এবং তার মধ্যে স্ববিরোধিতা থাকলেও কোথাও না কোথাও কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায় ৷ একটা রেখাচিত্র ফুটে ওঠে ৷ আমি সেই বিষয়গুলিই তুলে ধরার চেষ্টা করছি ৷ তার আগে এই বিষয়ের কালপঞ্জি তুলে ধরলাম ৷ বাংলার বাইরের-ও কিছু ঘটনাপঞ্জি তুলে ধরলাম, যার প্রভাব বাংলায় সুদূরপ্রসারী হয়েছিল ৷

তিন শতক --- বাংলায় বৌদ্ধ প্রাধান্য

৪---৫ শতক গুপ্ত যুগ

৭ শতক--- শশাঙ্কর রাজত্বকাল

৭১২ --- আরব সেনানায়ক মোহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু জয়

৯৪২ শতক--- লোকশ্রুতি অনুযায়ী, কান্যকুব্জ থেকে পঞ্চ ব্যাহ্মণের বাংলায় আগমন

১০৯৫_১০৯৯---প্রথম ক্রুসেডের যুদ্ধ

১০---১২ শতক--- বাংলাসাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদ

১২০৪ --- বখতিয়ার খিলজীর নদীয়া বিজয়

১২০৬--- মধ্য এশিয়ায় চেঙ্গিজ খানের যুদ্ধ অভিযান

১২১১ --- ভারতে সুলতানি শাসনের গোড়াপত্তন

১২০০_১৩০০--- এরই মধ্যে কোনো একসময়ে বা ধীরে ধীরে তাম্রলিপ্ত বন্দরের কার্যকারিতা শেষ হয়ে যায় নদীর নাব্যতা না থাকার কারণে

১২৪৮_১২৫৪---সপ্তম ক্রুসেডের যুদ্ধ ৷ এইসময় রাজা লুই মিশরীয় আইয়ুবীয় রাজবংশের আল মোয়াজ্জেম তুরান শাহের কাছে পরাজিত ও বন্দি হন

১২৫৮--- মোঙ্গল আক্রমনে বাগদাদের পতন

১৩০০ (আনুমানিক)---অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা

১৩০১_১৩২২---শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের শাসনকাল

১৩৪১--- বাংলার মসনদে আলাউদ্দিন আলি শাহ

১৩৪২---সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের দিল্লির বশ্যতা অস্বীকার করে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা ৷ এই সময়েই সমগ্র বাংলা একটি নামেই ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক অঞ্চল হিসাবে পরিগণিত হয় ৷ গৌড়, ভাটি ও রাঢ় ইত্যাদি অঞ্চল একীভূত হয় " বাংলাহ্ " নামের মধ্যে ৷

১৩৭৫--- আদিনা মসজিদের নির্মাণ সম্পন্ন

১৩৯৮---তৈমুরের ভারত আক্রমণ

১৪১৫_১৪৩৩ ----রাজা গণেশের শাসনকাল

১৪৯৩_১৫১৯--- হোসেন শাহের শাসনকাল

১৫_১৮শতক--- চণ্ডীদাস নামের একাধিক কবি রচিত বৈষ্ণব পদাবলি ও বিভিন্ন কবির মঙ্গলকাব্য

১৪৮৬---চৈতন্যদেবের জন্ম

১৪৯৮ ভাস্কো দা গামার ভারতে আগমন

১৬শতক---বাংলায় সুলতান হোসেন শাহ ও তাঁর পুত্রের শাসনকালে রচিত বিপ্রদাসের মনসাবিজয়, বিজয় গুপ্তের পদ্মপুরাণ এবং যশোরাজ খানের কৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃষ্ণমঙ্গল৷ চট্টগ্রামের শাসক পরাগল খানের আদেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর দ্বারা বাংলায় মহাভারত অনুবাদ ৷ বৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃন্দাবন দাসের জীবনীকাব্য শ্রীচৈতন্যভাগবত ৷ কৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃষ্ণদাস কবিরাজের জীবনীকাব্য শ্রীকৃষ্ণচরিত৷ সেখ ফয়জুল্লার গোরক্ষবিজয় কাব্য

১৫২৬--- প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবরের জয় এবং ভারতে মোগল রাজত্ব প্রতিষ্ঠা

১৫৩৩---চৈতন্যদেবের মৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃত্যু

১৫৩৮--- বাংলায় অল্প সময়ে জন্য শের শাহের দখলে

১৫৭৪---বাংলায় মোগল শাসন প্রতিষ্ঠা

১৬২১_১৬৩৮--- দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য লোর চন্দ্রানী বা সতী ময়না

১৬৩২_১৬৫৪--- তাজমহল নির্মাণ

১৬৪৬--- আলাওলের পদ্মাবতী অনুবাদ

১৬৯০---জব চার্নকের কলকাতায় আগমন

আদ্য ১৭ শতক---মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্য

১৭০৭---ঔরঙ্গজেবের মৃৃৃৃৃৃত্যু

১৭১৩_১৭২৭---মুর্শিদকুলি খানের শাসনকাল

১৭৩৯---নাদির শাহের দিল্লি লুন্ঠন

১৭৪০---বাংলার মসনদে আলিবর্দি খান

১৭৫২---ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য

১৭৫৭--- পলাশির যুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয়

১৭৭০---মন্বন্তর

১৭৭৩--- কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ঘোষিত

১৭৭৮--- হ্যালহেডের এ গ্রামার অব দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ গ্রন্থে ছাপার অক্ষরে সর্বপ্রথম বাংলা হরফের ব্যবহার

১৭৮০--- ভারতে ইংরেজ আমলের সর্বপ্রথম সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্যালকাটা মাদ্রাসা স্থাপিত

১৭৮৪---কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপিত

১৭৯২--- বাংলা হরফে প্রথম সাহিত্যের বই সংস্কৃৃৃৃৃৃত ভাষায় ঝতুসংহার

১৭৯৩--- বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভূমি মালিকদের মধ্যে "চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত" প্রথার প্রবর্তন

১৮_১৯ শতক --- কবিগানের যুগ

১৮০০--- উইলিয়াম কেরি দ্বারা শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস স্থাপন এবং সাধারণ্যের পাঠোপযোগী প্রথম মুদ্রিত বই মঙ্গল সমাচার মতীয়ের প্রকাশিত ৷ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা এবং সেখান থেকে বাংলা পাঠ্য বই (গদ্যে) বেরোনো শুরু

১৮০১--- বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুদ্রিত মৌলিক বই রামরাম বসুর লেখা রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র প্রকাশিত

১৮১৫_১৮৩০--- রাজা রামমোহন রায়ের লেখা ছোটো বড়ো মিলিয়ে প্রায় ৩০ টি বাংলা বইয়ের প্রকাশ, যা দিয়ে বাংলা গদ্যের ভিত মজবুত

১৮১৭---হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা

১৮১৮--- প্রথম বাংলা সাময়িক পত্র গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের সাপ্তাহিক বাঙ্গাল গেজেট এবং আটদিনের মধ্যেই আর এক সাপ্তাহিক শ্রীরামপুরের মিশনারীদের দ্বারা পরিচালিত সমাচার দর্পণ প্রকাশিত৷ ফারায়েজি আন্দোলনের সূত্রপাত

১৮২৪--- সংস্কৃৃৃৃৃৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা

১৮২৮---আত্মীয় সভা ব্রাহ্মসমাজে নামান্তরিত

১৮৩১--- তিতুমিরের বিদ্রোহ ৷ মুসলিম সম্পাদিত প্রথম বাংলা সাময়িক পত্র সমাচার সভারাজেন্দ্র প্রকাশিত ৷ ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর প্রেরণাদাতা ও হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিওর মৃৃৃৃৃত্যু

১৮৩৪--- বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রামমোহনের গৌড়ীয় ব্যাকরণ (মৃৃৃৃৃৃত্যুর পর প্রকাশিত)

১৮৩৫--- কলকাতায় প্রথম সাধারণ পাঠাগার কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরি

১৮৩৯--- প্রথম বাংলা দৈনিক সংবাদ প্রভাকর

১৮৫৫--- বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়

১৮৫৬--- ভারতে বিধবা বিবাহ আইন পাস ৷ প্রথম বাঙালি নারী কৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃষ্ণকামিনী দাসীর কাব্য সংকলন চিত্তবিলাসিনী৷

১৮৫৭--- সিপাহি বিদ্রোহ ৷ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

১৮৫৮--- বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসাবে পরিচিত প্যারীচাঁদ মিত্রের 'আলালের ঘরের দুলাল'৷ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম কাব্য রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মিনী উপাখ্যান

১৮৫৯---পুরানো নতুন কবিতার যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মৃৃৃৃৃৃৃৃৃত্যু ৷ বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আবির্ভাব

১৮৬২--- কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নক্সা ; বাংলা সাহিত্যে কথ্যভাষার প্রথম ব্যবহার

১৮৬৩--- বাঙালি মহিলা লিখিত প্রথম গদ্যগ্রন্থ কৈলাসবাসিনী দেবীর হিন্দু ফিমেল্স বা হিন্দু মহিলাদের হীনাবস্থা

১৮৬৫--- বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী ; বাংলায় প্রথম যথার্থ উপন্যাস

১৮৬৭--- হিন্দু মেলার প্রবর্তন

১৮৬৮--- প্রথম বাংলা আত্মজীবনী রামসুন্দর দেবীর আমার জীবন

১৮৭০--- বাঙালি মহিলা দ্বারা সম্পাদিত প্রথম সাময়িকী পাক্ষিক বঙ্গমহিলা (মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়)

১৮৭২--- বাংলায় প্রথম দশকওয়ারি জনগণনায় মুসলিম সংখ্যাধিক্য

১৮৭৬--- মুসলিম মহিলার লেখা প্রথম বাংলা বই নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর রূপজালাল

১৮৭৭--- ভিক্টোরিয়া ভারতের মহারানি

১৮৭২--- বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবির্ভাব; সন্ধ্যাসঙ্গীত এর প্রকাশ ৷ গো-রক্ষনী সভা গঠিত

১৮৮৩--- প্রথম বাঙ্গালি মহিলা স্নাতক চন্দ্রমুখী বসু এবং কাদম্বিনী বসু

১৮৮৫--- ভারতে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ৷ মীর মশাররফ হোসেনের ধ্রুপদী উপন্যাস বিষাদ-সিন্ধু

১৮৮৬--- শ্রীরামকৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃষ্ণের মৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃত্যু

১৮৮৮--- লালন ফকিরের মৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃত্যু

১৮৮৯--- মীর মোশারফ হোসেনের প্রবন্ধ 'গোকুলনির্মূল আশঙ্কা ' ৷

১৮৯১--- বিদ্যাসাগরের মৃৃৃৃৃৃৃত্যু

১৮৯৩--- বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠা ৷ শিকাগোর ধর্ম সভায় বিবেকানন্দের ভাষণ

১৮৯৭--- মুসলমানদের নিজস্ব উদ্যোগে গঠিত বালিকাদের জন্য প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুসলিম বালিকা মাদ্রাসা কলকাতায় স্থাপিত

১৯০২--- অনুশীলন সমিতি গঠিত

১৯০৫--- বঙ্গভঙ্গ বিল পাস

১৯০৬--- মুসলিম লীগ স্থাপনা

১৯০৭--- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দ্বারা চর্যাপদ পুঁথি আবিস্কার

১৯০৮--- ক্ষুদিরামের ফাঁসি

১৯০৯--- মুসলমানদের জন্য পৃৃৃৃৃৃথক নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা

১৯১১--- কলকাতায় বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত মুসলিম মেয়েদের ইংরাজি শেখার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্ল্স স্কুল ৷ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি গঠিত ৷ বঙ্গভঙ্গ রদ ও ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত ৷

১৯১২--- মীর মশাররফ হোসেনের মৃৃৃৃৃত্যু

১৯১৩--- গীতাঞ্জলীর ইংরাজি তর্জমা এবং রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার লাভ

১৯১৬--- প্রথম ম্যাট্রিক পাশ মুসলিম ছাত্রী

১৯১৪_১৮---- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ

১৯১৭---রুশ বিপ্লব ও বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত রাশিয়া

১৯১৮--- মোহম্মদ নাসিরুদ্দিনের সম্পাদনায় সওগাত পত্রিকার আত্মপ্রকাশ

১৯১৯--- খেলাফত আন্দোলনের সূত্রপাত

১৯২০--- বিশ্বে প্রথম বেতার সম্প্রচার শুরু ৷

১৯২১---ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

১৯২১--- মুসলিম মহিলার লেখা প্রথম মুদ্রিত উপন্যাস এস এফ খাতুনের জোবেদা

১৯২২--- নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা ও প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা৷ লোককবি হাসন রাজার মৃৃৃৃৃত্যু ৷ প্রথম মুসলিম মহিলা স্নাতক সুলতানা বেগম মুইদজাদা

১৯২৩--- ব্রিটিশ বিরোধী কবিতা লিখে নজরুলের কারাদণ্ড

১৯২৫--- মূলত মুসলিম তরুণদের উদ্যোগে কমিউনিস্ট পার্টির পূর্বসূরি হিসেবে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস্ পার্টির গঠন

১৯২৬--- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় Origin and Developement of the Bengali Language নামক গ্রন্থে ১৯২৬ সালে চর্যাপদের ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য প্রথম আলোচনা করেন এবং তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে চর্যাপদের ভাষা বাংলা ৷ আবদুল ওদুদ ও আবুল হোসেনের নেতৃৃৃৃৃৃৃত্বে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের জন্ম ৷ কলকাতায় বড়ো আকারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা

১৯২৭--- ১ গার্স্টিন প্লেসে কলকাতা বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধন

১৯৩০--- ডা. হাসান সুহরাওয়ার্দি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম উপাচার্য নিযুক্ত

১৯৩১--- বেগম রোকেয়ার মৃৃৃৃৃত্যু

১৯৩৪--- চিনে লং মার্চ

১৯৩৫--- রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে বিশ্বভারতীতে হিন্দু মুসলমান বিরোধ নিয়ে কাজী আবদুল ওদুদের বক্তৃৃৃৃৃৃৃতা৷ জসীম উদদীনের লেখা হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির কাব্য সোজন বাদিয়ার ঘাট ৷ কলকাতা হাইকোর্টে প্রথম মুসলিম মহিলা আইনজীবী সাকিনা মুইদজাদা

১৯৩৬_৩৯--- স্পেনে গৃৃহযুদ্ধ

১৯৩৭--- ফজলুল হকের নেতৃৃৃৃৃৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠন

১৯৩৯--- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু ৷ মূলত মুসলিম মেয়েদের জন্য কলকাতায় লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ স্থাপিত

১৯৪০--- লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে ফজলুল হক দ্বারা পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপিত

১৯৪১--- মুসলিম লিগ থেকে ফজলুল হকের পদত্যাগ ৷ হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা গঠন

১৯৪২--- কলকাতায় জাপানি বোমা ৷ কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজের স্থাপনা

১৯৪৩--- পঞ্চাশের মন্বন্তর ৷ ফজলুল হকের নেতৃৃৃৃৃৃৃৃত্বাধীন মন্ত্রীসভার পতন এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী পদে খাজা নাজিমুদ্দিন ৷ উদারপন্থী আবুল হাশিম মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত ৷ আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত

১৯৪৪--- বঙ্কিমচন্দ্রের সমর্থনে রচিত রেজাউল করীমের বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ

১৯৪৫--- নাজিমুদ্দিন মন্ত্রীসভার পতন ৷ জাপানে আমেরিকার দ্বারা পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান

১৯৪৬--- রশিদ আলী দিবস উদযাপিত ৷ নির্বাচনে মুসলিম লিগের বিপুল সংখ্যায় জয়লাভ এবং সুহরাওয়ারর্দির নেতৃৃৃৃৃৃৃৃৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠন ৷ কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা ৷ তেভাগা আন্দোলন ৷ তেলেঙ্গানা গণঅভ্যুত্থান

১৯৪৭--- ভারতের স্বাধীনতা লাভ

১৯৪৮--- ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত ৷ মহাত্মা গান্ধী নিধন ৷ ইস্রায়েল রাষ্ট্রের জন্ম

১৯৪৯--- চিনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃৃৃৃৃত্বে সরকার

১৯৫০--- ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ৷ কোরিয়ার যুদ্ধ

১৯৫১---এস ওয়াজেদ আলির মৃৃৃৃৃৃৃত্যু

১৯৫২--- ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন ৷ পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন

১৯৫৩--- স্টালিনের মৃৃৃৃৃৃৃত্যু

১৯৫৭--- মহাশূন্যে স্পুৎনিক

১৯৫৯--- কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃৃৃৃৃৃৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির সরকার

১৯৬০--- নজরুলকে পদ্মভূষণ সম্মাননা প্রদান

১৯৬১--- প্রথম মহাকাশযাত্রী য়ুরি গ্যাগারিন ৷ বার্লিনের প্রাচীর নির্মাণ

১৯৬২--- ভারত-চিন যুদ্ধ

১৯৬৪--- কবি গোলাম মোস্তাফার মৃৃৃৃৃৃৃত্যু। প্যালেস্টাইনে পিএলও গঠিত

১৯৬৫--- ভারত-পাক যুদ্ধ

১৯৬৬--- চিনে সাংস্কৃৃৃৃতিক বিপ্লব

১৯৬৯--- চাঁদে মানুষের প্রথম পদার্পণ

১৯৭০--- বাংলা সাহিত্যে প্রথম মুসলিম হিসাবে আবু সয়ীদ আইয়ুবের আকাদেমি পুরস্কার ও রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ

১৯৭১--- স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ৷ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের মৃৃৃৃৃত্যু

১৯৭৩--- আল মাহমুদের সোনালী কাবিন

১৯৭৪--- সৈয়দ মুজতবা আলীর মৃৃৃৃৃৃত্যু

১৯৭৫--- ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান ৷ শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত

১৯৭৬--- কাজী নজরুল ইসলামের মৃৃৃৃত্যু ৷ জসীম উদদীনের মৃৃৃৃত্যু ৷ মাও সে তুং এর মৃৃৃৃৃত্যু

১৯৭৯--- ভুট্টোর ফাঁসি৷ বন্দে আলী মিয়ার মৃৃৃৃৃৃত্যু

১৯৮০--- কাজী মোতাহার হোসেনের মৃৃৃৃৃৃৃত্যু

১৯৮১--- এইডসের প্রথম ঘটনা

১৯৮২--- আবু সয়ীদ আইয়ুবের মৃৃৃৃৃত্যু

১৯৮৪--- ইন্দিরা গান্ধী হত্যা

১৯৮৫--- রাশিয়ার শাসন ক্ষমতা গরবাচভের হাতে ৷

১৯৮৬--- চেরনোবিল দুর্ঘটনা ৷ বায়ুমণ্ডলে ওজন স্তরে ছিদ্র

১৯৮৭--- বিশ্বে জনসংখ্যা ৫০০ কোটি অতিক্রম

১৯৮৯--- বার্লিনের প্রাচীর ভঙ্গ ৷ তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে বিক্ষোভ৷ রুমানিয়ার চসেস্কুর অপসারণ ও মৃৃৃৃৃৃত্যুদণ্ড ৷ পোল্যান্ডে অ-কমুনিস্ট প্রধানমন্ত্রী৷ চেকোশ্লোভাকিয়ায় কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ৷ সালমান রুশদির বিরুদ্ধে ইরানের ফতোয়া

১৯৯০---দুই জার্মানির মিলন৷ জেল থেকে ম্যান্ডেলার মুক্তি

১৯৯১---উপসাগরীয় যুদ্ধ ৷ রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পদে ইয়েলেতসিন

১৯৯২---বাবরি মসজিদ ধুলিসাৎ। চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের অস্কার পুরস্কার লাভ; সারা জীবনের কাজের স্বীকৃৃৃৃৃৃতি হিসেবে

১৯৯৩ রেজাউল করীমের মৃৃৃৃৃত্যু৷ তসলিমা নাসরিনের লজ্জা৷ মুম্বাইতে সন্ত্রাসবাদীদের ধারাবাহিক বিস্ফোরণ।

১৯৯৪--- ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত

১৯৯৫--- ভারতে প্রথম মোবাইল পরিষেবা চালু কলকাতায়

১৯৯৮--- অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিতে নোবেল লাভ ৷ পোখরানে ভারতের পরমাণু বিস্ফোরন ও পরীক্ষা

১৯৯৯--- ইউনেস্কো কর্তৃৃৃৃৃৃক ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস ঘোষিত ৷ কারগিলে ভারত-পাক যুদ্ধ

২০০০--- বিশ্বময় আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস উদযাপিত৷ ক্রিকেটে টেস্ট খেলিয়ে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃৃৃৃৃৃতি

২০০১--- দুঃসাহসিক সন্ত্রাসবাদী হামলায় নিউইয়র্কের ওয়ার্লড্ ট্রেড সেন্টার ধ্বংস৷ ভারতের সংসদে জঙ্গী হামলা

২০০২---গুজরাটে ভয়াবহ দাঙ্গা ৷ মস্কো থিয়েটার হলে চেচেন জঙ্গীদের হামলা হত ১৭০৷ বালিতে জঙ্গী হামলা নিহত ২০২

২০০৬--- বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনুসের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ

২০০৭_১৪--- বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সাতটি মহাসাগরীয় জনহীন দ্বীপ সমুদ্রে ডুবে যাওয়া

২০০৮--- মুম্বাই শহরে তাজ হোটেলে , রেল স্টেশনে, ছত্রপতি টার্মিনাসে বড় আকারের জঙ্গী হামলা

২০১০_১৫--- বিভিন্ন আরব দেশে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন

২০১১--- সিরিয়াতে গৃৃৃৃৃৃৃহযুদ্ধ, সিরিয়া ইরাক জুড়ে কট্টর জঙ্গি গোষ্ঠী ISIS এর উত্থান ৷

২০১৩--- আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত বোসন কণা বিজ্ঞানী হিগ্সের প্রকল্পের পরীক্ষা দ্বারা বাস্তবে প্রমাণিত হয়ে নতুন হিগ্স বোসন কণা আবিষ্কার

২০১৬--- ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগ

২০১৯--- অর্থনীতিতে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল পুরস্কার লাভ ৷

হিন্দু বাঙালিরা যেমন নিজেদের উৎস ও গঠন সম্পর্কে আত্মবিস্মৃৃৃৃৃৃৃৃৃত হয়ে থাকতে ভালোবাসে, নিজেদের পছন্দসই ঐতিহ্য নির্মাণ করে, বাঙালি মুসলমানও তাই করে ৷ মুসলমানের আছে 'আশরাফ' হওয়ার দাবি, বিদেশাগত মুসলমানদের সঙ্গে নিজেদের বংশ মর্যাদাকে জুড়বাড় চেষ্টা৷ অতীতে হিন্দু , বৌদ্ধ, অন্ত্যজ জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় থেকে ধর্মান্তরিত হওয়ার যে ঐতিহাসিক সত্য, তাতে তারা স্বস্তি বোধ করেন না৷ উত্তর ভারতীয় হিন্দুরা বাংলার হিন্দু সমাজকে ছোট চোখে দেখে ৷ কারণ তারা মনে করত এটা ছিল আমিষ ভোজী ব্রাহ্মণদের জায়গা, মারী ও মড়কের অভিশপ্ত স্থান, সামাজিক ভাবে বিতাড়িত, শাস্তিপ্রাপ্ত, কুলীনতাভঙ্গকারীদের আশ্রয়স্থল, জল জঙ্গলে ভরা দুর্গম অঞ্চল, বৌদ্ধধর্মের প্রভাবাধীন, অন্ত্যজদের আবাসভূমি ৷ তেমনি মোগল আমল থেকেই উত্তর ভারতীয় মুসলমানেরা বাংলাকে ঘৃৃৃৃৃৃৃণা করে এসেছেন দেখেছেন নীচ নজরে৷ আজও বাঙালি মুসলমানের মুসলমানত্বকে সন্দেহ করেন উর্দুভাষীরা৷ আর সত্যিই তো, সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও ইসলাম চর্চার নেতৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃত্বের জায়গাটি বাঙালি মুসলমান স্বেচ্ছায় উর্দুভাষীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন৷ কলকাতার মসজিদ, ওয়াকফ বোর্ড, এমনকী মুসলমান অধ্যুষিত ফুটবল ক্লাব ও ক্রীড়াকেন্দ্রগুলিতেও মাতব্বরি করে উর্দুভাষীরা৷

হিন্দুর কাছে বাংলার ইতিহাস শুরু রাজা রামমোহনের পর থেকে। কারণ এর সাস্কৃৃৃৃৃৃৃৃতিক মূলধন এসেছে রেনেসাঁ থেকে৷ তুর্কি, মোগল ছয়শো বছরের অধীনতা যে আরও লজ্জার ছিল, তার ধূলো ঘাঁটতে কিছু পণ্ডিত গবেষক ছাড়া আর কেউ রাজী নয় ৷

হিন্দু ঐতিহাসিকরা হিন্দু ঐতিহ্য খুঁজে বেড়িয়েছে আর গায়ের জোরে ধর্মান্তরের কথা বলেছে৷ আর মুসলমান ঐতিহাসিকরা হিন্দু গোঁড়ামী আর স্বেচ্ছা ধর্মান্তরের কথা বলেছে৷ তাই আমি রিচার্ড এম ইটন, ইরফান হাবিব ও জহর সরকার এই তিনজন ঐতিহাসিকের গবেষণামূলক গ্রন্থগুলির সাহায্য নেব৷ ইটন সাহেবের গবেষণা পূর্ববঙ্গকেন্দ্রিক ও জহর সরকারের গবেষণা পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রিক এবং পরস্পরের পরিপূরক ৷ আর ইরফান হাবিবের লেখায় পাবো তখনকার ব্যবসা বাণিজ্য, কর আদায় ব্যবস্থা, সেই অনুযায়ী তখনকার ক্ষমতাধর সামন্ত রাজা-উজিরদের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ও সেই অনুযায়ী জনবসতি গঠন উৎসাহদান ৷

কালপঞ্জিতে উল্লিখিত ঘটনাগুলিকে বিশ্লেষন করার জন্য আমি ৩ (তিন) ভাগে ভাগ করছি ৷ এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনা হল Cause বা কারন কিছু ঘটনা হল সূচক , যার সাহায্যে আমরা কোন অবস্থা পরিবর্তনের হার, কাল, পরিমান, পরিমাপ ইত্যাদি বুঝতে পারবো ৷আর বাদবাকী ঘটনাগুলি হল অন্য ঘটনার Effect বা ফলাফল , প্রভাব ইত্যাদি ৷

যদিও যাকে আমরা Cause বলছি সেগুলিও অন্য ঘটনার Effect৷ তবে এক্ষেত্রে আমরা তাকে Cause হিসাবেই ধরছি ৷

আট শতকের দ্বিতীয় দশকে আরব সেনানায়ক মোহম্মদ বিন কাশিম সিন্ধু জয় করেছিলেন (যদিও তার সময়কাল অল্পদিন ছিল) আর বখতিয়ার খিলজি বাংলায় আসেন তেরো শতকের প্রথম দশকে ৷ দুজনের মধ্যে প্রায় ৫০০ বছরের তা সত্বেও একমাত্র বাংলায় মুসলমান জনসংখ্যার এই অস্বাভাবিক স্ফীতি ঘটল কিভাবে ? ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশ চতুর্থ বৃৃৃৃৃৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যা বিশিষ্ট রাষ্ট্র ৷ আমি মোট ৪ টি কারণ আলোচনা করব এবং এই চারটে কারনেই বাংলার (দুইবাংলা, আসাম আংশিক , ত্রিপুরা, বিহার আংশিক , ঝাড়খন্ড আংশিক সহ) মুসলমান সংখ্যার বেশীরভাগ অংশই অন্য ধর্মমত থেকে মুসলমান হয়েছে ৷ এই চারটি কারণ ছাড়াও আরও কারণ আছে তবে হয় তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা তার প্রভাব অনেক কম ৷

১৯৪১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, অবিভক্ত বাংলার মোট মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৪,৩০,০৬,০০০ ৷ দেশভাগের পর পাকিস্তানের মোট মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ১৯১১৩০০০ ৷ সবার আগে যেটা জানা দরকার , সময়ের পৃৃৃৃষ্ঠপটকে বোঝার চেষ্টা ৷

মৌর্য শাসনকালে বাংলায় বৌদ্ধধর্ম বিস্তারলাভ করে৷ তিন শতকের অন্ধ্রের একটি শিলালিপিতে বাংলাকে বৌদ্ধ এলাকা বলে বর্ণনা করা হয়েছে ৷আবার গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণ্যধর্ম আনুকুল্য পেয়েছে, তা হলেও বৌদ্ধধর্ম পালনে কোনো বাধা ছিলনা ৷

রাজা শশাঙ্কের সময় বৌদ্ধদের কোনো উদারতা দেখানো হয়নি ৷ কুমারিল ভট্ট শশাঙ্কের সময়ে বলেছিলেন বৌদ্ধ মাত্রই বধ্য ৷ দেখামাত্রই বৌদ্ধদের মারতে হবে ৷ যে মারবেনা তারও মৃৃৃৃৃৃত্যুদণ্ড হবে ৷ বৌদ্ধ ধর্মকে নষ্টজ্ঞান আখ্যা দেন বিশালদেব ৷ দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, বৌদ্ধধর্মকে পরাভূত করিয়া হিন্দুরা যেভাবে বৌদ্ধ ইতিহাস লোপ করিয়াছিল, তাহা অকথ্য অত্যাচার লাঞ্ছিত ৷ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীরও উদ্ধৃৃৃৃতি দিয়েছেন তিনি, যে পূর্ববঙ্গে এককোটির বেশি বৌদ্ধ এবং১১৫০০ ভিক্ষু বাস করিত সেখানে একখানি বৌদ্ধগ্রন্থ ত্রিশবছরে চেষ্টায় পাওয়া যায় নাই যেপূর্ব ভারতে বৌদ্ধধর্মের প্রধান লীলাক্ষেত্র ছিল, তথায় বৌদ্ধ ধর্মের যে অস্তিত্ব ছিল, তথায় ইউরোপিয় প্রত্নতাত্ত্বিকগণের চেষ্টায় অধুনা আবিস্কার করিতে হইয়াছে ৷

বাংলাদেশের মহাস্থানগড়ের বৌদ্ধ পুরাতাত্বিক নিদর্শন ৷

 

নঁওগা বৌদ্ধ বিহার

Sompur Mahavihara

Bangladesh

Sompur Mahavihara

নওগাঁ জেলা

বাংলাদেশ

Naogaon District

আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা, নদীর নাব্যতা , আবাদী জমির সন্ধান, উন্নত কুঠার গাছ কাটার জন্য , কর ব্যবস্থা , ধর্মীয় দৃৃৃৃৃৃৃষ্টিকোন, ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার আগে আর একটি দিক নিয়ে আলোচনা করব তা হল ধর্ম ও সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী যেসব সঙ্গীত গত হাজার বছরে কখন কোনটার উদ্ভব হয়েছে তা দিয়ে আমরা সেই সময়কার রীতিনীতি ধর্মাচরণ বিষয়ে আমরা ধর্মবিশ্বাসের উপস্থিতির ইঙ্গিত বুঝতে পারব ৷ যদিও সংখ্যা বা পরিমান বুঝতে পারবনা ৷ আগে ইঙ্গিত বুঝে তারপর পরিমান বোঝার চেষ্টা করব ৷

হাজার বছরে সঙ্গীতকে তিন ভাগে ভাগ করে নিই ৷

  1. ১) প্রাচীন যুগ ৷ ২) মধ্য যুগ ৷ ৩) আধুনিক যুগ (১৯শতকের প্রারম্ভ থেকে রবীন্দ্র যুগের আগে পর্যন্ত)

১) প্রাচীন যুগকে আবার তিনভাগে ভাগ করছি ; i) চর্যাপদ (নবম, দশম শতাব্দি) ii) গীতগোবিন্দ (ত্রয়োদশ শতাব্দি) iii) শ্রীকৃৃৃৃৃৃৃৃষ্ঞ কীর্তন (চতুর্দশ শতাব্দি)

২) মধ্যযুগকে পাঁচভাগে ভাগ করছি ৷

i) পদাবলী সাহিত্য; a) বৈষ্ঞব পদাবলী( ১৫শ--১৮শ শতাব্দি) ৷ b) শাক্ত পদাবলী(১৮শ--১৯শ শতাব্দি) ---ক) উমা সঙ্গীত ৷ খ) শ্যামাসঙ্গীত

ii) মঙ্গলকাব্য (১৫শ--১৮শ শতাব্দি) ; a) চণ্ডীমঙ্গল b) শিবমঙ্গল c) ধর্মমঙ্গল d) মনসামঙ্গল e) অন্নদামঙ্গল

iii) অনুবাদ সাহিত্য; a) কৃৃৃৃৃৃত্তিবাসের রামায়ন ( আনুমানিক ১৪৫০ খ্রীঃ) b) কাশীরাম দাশের মহাভারত (আনুমানিক ১৬৫০খ্রীঃ)

iv) লোকসঙ্গীত; a)রাঢ়ভূমির গান ;বাউল,ঝুমুর, ভাদু, টুসু ,আলকাফ, মুর্শীদা গান ইত্যাদি ৷ b) বঙ্গালভুমির গান; ভাটিয়ালি, সারি ,জারি ইত্যাদি ৷ c) বরেন্দ্রভূমির গান ; ভাওয়াইয়া , চটকা , গম্ভীরা প্রভৃৃৃৃৃৃৃৃতি ৷ d) মধ্যভূমির গান; রামপ্রসাদী (১৭২৩ খ্রীঃ ) , লালনের গান (১৭৭৪ খ্রীঃ) ৷ d) নিম্নভূমির গান দক্ষিন রায় ও বনবিবির গান ৷

v) অন্যান্য গান; a) নাথ সম্দ্রদায়ের গান ( আনুমানিক মধ্যযুগের প্রারম্ভ) গোপীচন্দ্রের গান গোরক্ষবিজয় ৷ b) রোসঙ্গ রাজসভার গান দৌলত কাজী ( ১৭ শতাব্দির প্রথমার্ধ) সৈয়দ আলাওল (১৭শ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধ) c) সত্যপীরের গান ফৈজুল্লা (১৮শ শতাব্দি) d) কবিয়ালদের গান গোঁজলা গুঁই (১৭০০ খ্রীঃ) হরু ঠাকুর (১৭৩৯খ্রীঃ) রাম বসু ( ১৭৮৬ খ্রীঃ) ঈশ্বর গুপ্ত ( ১৮১২ খ্রীঃ) ভোলা ময়রা (১৯শ শতাব্দি) এন্টনী ফিরিঙ্গী ( ১৯ শ শতাব্দি)

৩) আধুনিক যুগ ( ১৯শতক এরপ্রারম্ভ থেকে রবীন্দ্রযুগের আগে পর্যন্ত) ৷ এটিকেআবার চার ভাগে ভাগ করা যায় ৷

i) ব্রহ্মসঙ্গীত (রাজা রামমোহন রায় , ১৭৭৪--১৮৩৩খ্রীঃ ,মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮১৭--১৯০৫)

ii) টপ্পা, বৈঠকী, রাগাশ্রয়ী গান,

iii) বাংলায় মার্গসঙ্গীত , যদুভট্ট (১৮৪০--১৮৮৩),

iv) স্বদেশী গান , বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮--১৮৯৮)

জারি গান বাংলাদেশের এক প্রকারের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতরীতি। ফার্সি জারি শব্দের অর্থ শোক। মুহাররম মাসে কারবালার বিয়োগান্তক কাহিনীর স্মরণে মূলত এই গানের উদ্ভব। ১৭শ শতক থেকে বাংলায় এই গানের ধারা শুরু হয়। ইসলামের ইতিহাস ভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারার সর্বাধিক জনপ্রিয় পরিবেশনা রীতি হচ্ছে জারিগান ।

এছাড়াও আরও বহুরকমে সঙ্গীত এর ধারা বা রীতি বাংলায় ছিল বা এখনও আছে ৷ সবগুলি এই পরিসরে বলা সম্ভব নয় ৷

এপর্যন্ত যে তথ্যগুলি দেওয়া হল তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে কোন সময়ে কি কি প্রভাব কাজ করেছে ধর্মান্তরিত হবার মাধ্যমে ৷ ধর্মান্তরিত হবার সময় পাওয়া গেলেও সংখ্যা বা পরিমান বুঝতে কয়েকটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ প্রয়োজন ৷

তবে একেবারে পিন পয়েন্টেড কতগুলি ঘটনার অবতারনা করছি ৷

১) ১২০০_১৩০০ শতাব্দিতে নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাওয়ায় তাস্রলিপ্ত বন্দরের কার্যকারিতা শেষ হয়ে যাওয়া ৷ এর ফলে অবিভক্ত বাংলার পশ্চিম অংশের বানিজ্যিকভাবে আকর্ষন শক্তি হ্রাস পায় ৷ তুলনায় পূর্ব অংশের বানিজ্যিক আকর্ষনী শক্তি বেড়ে যায় ৷ নদীর নাব্যতার কম বেশী হওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে দিল্লীর রাজশক্তির আনাগোনা ও বদান্যতা বেশী কম হতে থাকে অঞ্চল বিশেষে ৷ এমনকি বর্তমান ঢাকা শহরের নাম দিল্লির বাদশা জাহাঙ্গীরের নামে জাহাঙ্গীরনগর রাখা হয় ৷ ভারতের পশ্চিম অংশের সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের লোকজন স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে, সংখ্যায় অল্প হলেও এদের সামাজে প্রভাব ছিল বেশী , যা পরবর্তীকালে বাংলার পূর্ব অংশের মানুষকে ধর্মান্তরিত করতে পেরেছিল পেশাগত বাধ্যতা, পরিচিতির সুযোগ, ও অর্থনৈতিক ভাবে মজবুত হবার জোরে ৷

২) ক্রুসেভের যুদ্ধ ও তিনটি পানিপথের যুদ্ধের পরাজিত সেনাদের পালিয়ে বাঁচার অন্যতম প্রধান গন্তব্য হল জলজঙ্গল ঘেরা ও মারী ও মড়কের দেশ বাংলা ও আরাকানের দূর্গম পাহাড় ৷ যেখানে দিল্লীর সম্রাটের নিয়ন্ত্রন শক্তিছিল ক্ষীন ও অনিয়মিত ৷

i) ক্রুসেডের যুদ্ধে পরাজিত আরব ও তার মিত্র সেনারা নিজের দেশে ফেরা ছিল দুর অস্ত ৷ আরব সাগরেও তাদের থাকা কঠিন ছিল ৷ সেখানে গ্রীক স্পেন আর পর্তুগীজদের নৌসেনা বা জলদস্যুদের দাপাদাপি ৷ তাই অগত্যা বঙ্গোপসাগর হয়ে জলজঙ্গলের দেশ বাংলা ৷ উড়িষ্যা বিহারে উত্তরপ্রদেশে ঢুকলে সহজেই রাজশক্তির চোখে পড়ে যাবার ভয় ছিল ৷

এখানে লক্ষ্যনীয় যে ওই সময় থেকে বাংলায় আরবী শব্দ ব্যবহার হতে দেখা যায় ৷ আরাকানে যারা গিয়েছে তাদেরকে বর্তমান প্রজন্মকে আমরা রোহিঙ্গা বলি ৷ ওরা বাঙ্গালীদেরকেই বিয়ে করেছে ৷ বাঙ্গালী সমাজেই লীন হয়ে গেছে ৷

ii) প্রথম পানিপথের যুদ্ধ ইব্রিহিম লোদী ও বাবরের মধ্যে ৷ লোদীর পরাজয় ৷ এক্ষেত্রেও হরিয়ানার পানিপথ থেকে পরাজিত পশ্ তু সেনাদের নিজেদের দেশের ফেরার উপায় ছিলনা ৷

iii) দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হেমু আর আকবর তথা তার অভিভাবক বৈরাম বেগের মধ্যে যুদ্ধ হয় ৷ হেমু পরাজিত হয় ৷ হেমু হিন্দু হলেও তার আফগান সেনানায়ক ছিল শর্দী খান কাক্কর সেনাবাহিনীর বড় অংশ ছিল আফগান ৷ পরাজিত হবার পর এদের আফগানিস্তানে ফেরার রাস্তা ছিলনা ৷ বাধ্য হয়ে এরাও জলজঙ্গলে ঘেরা দুর্গম বাংলায় চলে আসে ৷

iv) তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ হয় ১৭৬১ সালে ৷ আফগান বাহিনীর নেতৃৃত্বে ছিল আহমেদ সাহ আবদালী ও মারাঠাদের নেতৃত্বে ছিল সদা শিব রাও ৷ সদা শিব রাও পরাজিত হয় তার বাহিনীর লক্ষ লক্ষ সেনা মারা পড়ে ৷ সদাশিব রাও , বিশ্ব রাও, যসবন্থ রাও, তুকোজী, সিন্ধিয়া সকলেই মারা পড়ে ৷ হলকার তার সেনাদের নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালায় ৷ যেসব মারাঠা সেনা বন্দী হয়েছিল তাদেরও পরবর্তীকালে হত্যা করা হয় ৷ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেন মারাঠাদের গোলান্দাজ বাহিনীর নায়ক ইব্রাহিম খান সর্দি ৷ তার আফগান সেনারাও শেষপর্যন্ত পালাতে বাধ্য হয় ৷ এই যুদ্ধে বেশীরভাগ পলায়নপর সেনা ছিল মুসলমান যারা বাংলাতেই পালিয়ে আসে ৷

ইটন সাহেব সহ বহু ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে পাওয়া যে সেনরাজাদের পরবর্তী সময় থেকে মুঘল আমলের শেষ পর্যন্ত বাংলার জনসংখ্যা আনুমানিক ছিল ৪০ লাখ থেকে ৭৫ লাখ ৷ এর সঙ্গে ক্রুসেডের ও তিনটি পানিপথের যুদ্ধের পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ সেনা ও তাদের স্থানীয় মেয়েদের বিবাহ করার পর মুসলমান জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায় ৷ জলজঙ্গলময় স্থান বাংলার পশ্চিম অংশের তুলনায় পূর্ব অংশে বেশী, তাই পূর্ব অংশেই পালিয়ে আসা সেনারা বেশী এসেছে ৷

৩) ধর্মান্তকরনের জন্য বাংলার পীরদের ভূমিকা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ৷ বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব সহ বহু ঐতিহাসিকের লেখায় আমরা দেখতে পাই যে ভারতে মোট কর বা খাজনা বাবদ যত টাকা আদায় হত তার অর্দ্ধেকের বেশী আসত বাংলা থেকে ৷ এর পিছনে মূল কারন ছিল পীরদের জমিদান নীতি ৷ বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি _

বাংলায় সুলতানী আমলের প্রথমদিকে বা তার আগে যে লোহা ছিল তা ছিল নিম্ন মানের তা-দিয়ে গাছ কাটার কুঠার বানালে তা ভোঁতা হয়ে যেত ৷ পরে পশ্চিমদেশগুলির থেকে লোহা থেকে ইস্পাত তৈরীর কৌশল শিখে ফেলে মুসলমান শাসকরা ৷ তাই দিয়ে উন্নত মানের তরবারী ও কুঠার তৈরী করা সম্ভব হয় ; ও গাছকাটাও সোজা হয়ে যায় ৷ ফলে জঙ্গল কেটে সাফ করে আবাদী তৈরীর প্রবনতা বেড়ে যায় ৷ দিল্লীর বাদসারা আবাদী বৃদ্ধিতে উৎসাহ দেবার জন্য জমির কর মুকুব করে দেয় ৷ পীরেদের নেতৃত্বে জঙ্গল কেটে সাফ করে সেই জমি বহু সাধারন মানুষকে বন্টন করেন পীরেরা ৷ এর ফলে লক্ষ লক্ষ গ্রামীন মানুষ নতুন জমি পাওয়ার জন্য পীরেদের প্রভাবে ধর্মান্তরিত হয় ৷ দিল্লীর সুলতান রাজা বাদসারাও দেখল যে জমির খাজনা মুকুব করে আবাদী বৃদ্ধি করে তারপর আবাদী থেকে অনেক বেশীগুন খাজনা আদায় করা যায় ৷

উপরোক্ত তিনটি কারনে বাংলার মুসলমান জনসংখ্যা সেন রাজাদের আমলের আনুমানিকশতকরা ১০ (দশ)ভাগ থেকে লাফিয়ে শতকরা ৫৫ ভাগে উঠে আসে ৷

শেখ জালাউদ্দিন তাবরিজী ( দরবেশ) লক্ষন সেনের রাজত্বকালে বাংলায় এসেছিলেন ১২১০-১২৩৬ তখন দিল্লিতে ইলতুতমিসের রাজত্বকালের বাংলায় এসেছিলেন ইরান থেকে ৷ তিনি আসন্ন তুর্কি আক্রমন সম্পর্কে ভবিষ্যতবানী করেছিলেন ৷ বহু খানকাহ ও মসজিদ তার দ্বারা নির্মিত হয়েছিল ৷ বহু জমিও তিনি দান করেছিলেন ৷ তিনি তার আধ্যাত্মিক কাজ দিয়ে বহু মানুষকে আকৃষ্ট করেছিলেন ৷

ইটন এর কথায় ১৬ শতকের আগে বাংলার মুসলমান এর কৃৃষি সম্পর্কযুক্ত নয় ৷ ১৩৪৫ এ ইবন বতুতা সিলেটে শাহ জালালের সঙ্গে দেখা করার পর লেখেন যে সেখানকার পাহাড়ীরা শাহ জালালের কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন৷ সমতলের অধিবাসীরা তখনও হিন্দু ছিলেন বলে উল্লেখ করেন ৷ মানে তারা তখনও মুসলমান হননি ৷

চীনা পর্যটক মা হুয়ান ১৪৩৩ সালে চট্টগ্রাম , সোনারগাঁও, পান্ডুয়া ঘুরেছিলেন ৷ তিনি একমাত্র পান্ডুয়াতেই মুসলমানের দেখা পেয়েছিলেন ৷ যারা কেউই কৃষক নন ৷ লুডোভিনি দি ভার্তোমা ষোলো শতকের প্রথম দশকে গৌড় ঘুরে মন্তব্য করেন সুলতানের দুলাখ সেপাই , তারা সকলেই মুসলমান ৷

দুয়ার্তো বরবোসা গৌড়ের বাসিন্দাদের বর্ণনা করেছেন সম্ভ্রান্ত মুর বলে ( ইউরোপীয়রা স্পেন জয়ী মুসলমানদের এই নামেই ডাকতেন ) ৷ তার লেখাতেই আছে যে স্থানীয় হিন্দুরা রাজ অনুগ্রহ পাবার আশায় ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছে ৷ প্রলোভনে ধর্ম পরিবর্তনের এটাই তখনকার একমাত্র সাক্ষ্য ৷ গ্রামের কোনো মুসলমানের কথা ষোলো শতকের আগে পাওয়া যায়নি ৷

মোগল অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি ৷ সেই আমলে পূর্ববঙ্গে কৃষির বিকাশ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বেশী হয়েছিল ৷ নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে পশ্চিম ও উত্তরের জনপদগুলি শুকিয়ে যেতে বসেছিল এবং পূর্বদিকে কৃৃৃৃষির উন্নতির সম্ভাবনা বাড়ছিল ৷ নদীর পুরানো ধারা শুকিয়ে যাওয়ায় চারিদিকে যেসব বদ্ধ জলাশয়ে সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলে ম্যালেরিয়া ছড়াচ্ছিল এবং পশ্চিমবঙ্গে ইসলামকে রুখে দেওয়ার জন্য এই ম্যালেরিয়াবাহী মশককূলও দায়ী ৷

ইটন ১৫৫৯ও ১৬৫৯ সালের কর আদায়ের যে সব তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাতে দেখা যায় যে ১০০ বছরের মধ্যে উত্তর-পশ্চিমে কর আদায় কমেছে ১৩ শতাংশ৷ যেখানে দক্ষিন-পশ্চিমে বেড়েছে ৫৪ শতাংশ, উত্তর-পূর্বে বৃদ্ধির হার আরও বেশী যথাক্রমে ৯৭ ও ১১৭ শতাংশ ৷ ষোলো শতকের শেষাশেষি বাংলার দক্ষিন ও পূর্ব অংশে খাদ্যশস্য উৎপাদন এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে চট্টগ্রাম ও সাতগাঁও বন্দর থেকে প্রচুর চাল রপ্তানী হত বিদেশে ৷ ১৬২৯ সালে মানরিকি দেখেছেন শতাধিক জাহাজ খাদ্যশস্য বোঝাই হয়ে বিদেশ যাচ্ছে প্রতি বছর ৷

১৬৫০-১৭২৫ এই একশো পঁচিশ বছর পূর্ববঙ্গে সবুজ বিপ্লব হবার ফলে বাংলার অর্থনীতিতে জোয়ার এসেছিল এবং স্থানীয় বাজারে সে সময়ে জিনিষত্রের দাম খুব কম ছিল ৷ ইটন সাহেব, পূর্ববঙ্গে ধান উৎপাদনে যে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছিল তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সেখানকার মুসলমান সমাজের সংখ্যাবৃদ্ধি ৷ অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও ধর্ম পরিবর্তনের মধ্যে তিনি যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছেন ৷

গোলাম মুরশিদ তাঁর হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি নামের সাড়ে পাঁচশো পৃষ্ঠার বইয়ে লিখেছেন---

প্রথম দিকে যে পীরদের সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য জানা যায়, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ধর্ম প্রচার করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ৷ যেমন, আবদুল্লা কিরমানি বীরভূমে, মখদুম শাহ গজনবি বর্ধমানে, শাহ শফিউদ্দীন পাণ্ডুয়ায়, এবং সৈয়দ আব্বাস আলি মক্কী চব্বিশ পরগনায় বসতি স্থাপন করেন ৷ তারপর যে পীরেদের আগমন , তাদের অনেকেই চলে যান উত্তরবঙ্গ এবং জলজঙ্গল ঘেরা পূর্ববঙ্গের দিকে ৷ এঁদের মধ্যে দিনাজপুরে ইসলাম প্রচার করেন বদরুদ্দীন, মখদুম শাহ দৌলা পাবনায়, সৈয়দ আলি তবারকি এবং শাহ আলি বাগদাদী ঢাকায়, ফরিদউদ্দীন ফরিদপুরে, আহমদ নূরী নোয়াখালিতে এবং বদর শাহ চট্টগ্রামে ৷ পরে সুফি ,সাধক, পীর, দরবেশদের সংখ্যা আরো বাড়তে থাকে ৷

পীর দরবেশরা যোদ্ধা ছিলেন না ৷ তবে সুলতানি আমলের পিরদের মধ্যে অনেকেই যোদ্ধা ছিলেন এবং দলবল নিয়ে চলতেন ৷ যেমন শাহ জালাল ইয়েমেন থেকে ৩৬০ জন অনুচর নিয়ে বাংলায় আসেন পরে যুদ্ধও করেন ৷ তার পুরো নাম শেখ শাহ জালাল কুনিয়াত মুজাররদ। ৭০৩ হিজরী মোতাবেক ১৩০৩ খ্রিষ্টীয় সালে ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে অধুনা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সিলেট আগমনের সময়কাল নিয়ে যদিও বিভিন্ন অভিমত রয়েছে, তদুপরি শাহ জালালের সমাধির খাদিমগণের প্রাপ্ত ফার্সি ভাষার একটি ফলক-লিপি থেকে উল্লেখিত সন-তারিখই সঠিক বলে ধরা হয়

[১]

। ফার্সি ভাষায় লিখিত ফলক-লিপি বর্তমানে ঢাকা যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে

[২]

সিলেটে তার মাধ্যমেই ইসলামের বহুল প্রচার ঘটে

সিলেট বিজয়ের পরে শাহ জালালের সঙ্গী-অনুসারীদের মধ্য হতে অনেক পীর-দরবেশ এবং তাদের পরে তাদের বংশধরগণ সিলেট সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করেন

শাহজালালের সফরসঙ্গী৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তার মৃত্যুর পর তাকে সিলেটেই কবর দেয়া হয়।

ওই আমলে এরা বদান্যতা ও নেতৃত্ব দানের মাধ্যমেই এরা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন পীরদের মধ্যে যাঁরা সুলতানদের কাছ থেকে দান হিসাবে জমি পেয়েছিলেন, তাঁরা সে জমি নিজের জন্য ব্যবহার করতেন না ৷ বরং আশ্রম এবং লঙ্গরখানা খুলে তা দিয়ে গরিবদের সাহায্য করতেন বলে ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় ৷ ধারণা করা সঙ্গত যে, শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে এই পীরদের কাছে অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন ৷

চোদ্দো-পনেরো শতকে থেকে পূর্ববঙ্গের জঙ্গল পরিস্কার করে তাকে আবাদ করার জন্যেও সুলতানদের কাছ থেকে কোনো কোনো ধার্মিক ব্যক্তি জমি পেয়েছিলেন ৷ খান জাহান হয়ত এধরনের পীর ছিলেন ৷ সেসব জঙ্গল - জলাভূমি পরিস্কার করে তারপর তাতে চাষাবাদের পত্তন করে তাঁরা সাধারণ মানুষের প্রভাব- প্রতিপত্তি অর্জন করেন এবং পীর নামে পূজিত হন ৷ সেই আবাদযোগ্য জমি দরিদ্রদের নধ্যে দান করার মাধ্যমেও তারা বহু লোককে ইসলাম ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করেছিলেন ৷

ঐতিহাসিক অসীম রায়ের মতে , শাসকদের সীমিত সমর্থন সত্ত্বেও এই ধরনের আবাদকারী পীরদের সাহায্যে বাংলার ভাটি অঞ্চলে এবং গ্রামে গ্রামে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হয়েছিল ৷

ইটন সাহেব বলেছেন আরও যে মোগল আমলে পূর্ববঙ্গে মুসলমানের সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল , সেখানে সুফিরা কৃষির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ায় ৷

গোলাম মুরশিদ এর বিরুদ্ধতা করেননি বটে কিন্তু তিনি পূর্ববঙ্গের যেসব সুফিদের নাম উল্লেখ করেছেন তাঁরা অধিকাংশই সুলতানি আমলের ৷ যেমন পাবনার মখদুম শাহ দৌলা সম্পর্কে বলা হয় যে তিনি যোদ্ধা-সুফি ছিলেন, যদিও এর কোনো ঐতিহাসিক প্রমান নেই ৷ তিনি ঠিক কোন সময়ের মানুষ তা স্পষ্ট করে জানা যায় না ৷ তবে তাঁর মাজার আছে শাহজাদপুরে এবং দরগার নামে পাওয়া ৭২২ বিঘা জমি তাঁর উত্তরসূরিরা আজও ভোগ করেন ৷

চট্টগ্রামের বদর শাহ সম্পর্কেও বলা হয় যে তিনি চৌদ্দ শতকে যুদ্ধ করে চট্টগ্রাম দখল করেছিলেন এবং সেখানে ইসলাম প্রচারের কৃতিত্ব তাঁর ৷

খান জাহান আলি পনেরো শতকের গোড়ায় বাংলায় আসেন ৷ তিনি ছিলেন একাধারে সূফি ও প্রশাসক ৷ সুন্দরবনে বিশাল জায়গির ছিল তার ৷ জঙ্গল পরিস্কার করিয়ে তিনি সে সব জায়গা বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন ৷ লোকশ্রুতি অনুযায়ী, যশোর-খুলনায় প্রথম মুসলমান বসতি স্থাপনের কৃতিত্ব তাঁরই ৷

ঢাকার জাহান আলি বাগদাদীও পনেরো শতকের সাধক ৷ সুলতান জালালুদ্দীন মোহম্মদ শাহ তাঁকে ১২০০০ বিঘা জমি দান করেছিলেন ৷ সে কি চাষের উদ্দেশ্যে ? এবিষয়ে বিষদ জানার উপায় নেই ৷ তবে তিনি বহু হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করেছিলেন এ কথা বাংলাপিডিয়া-তেও দেওয়া আছে ৷ কিন্তু গোলাম মুরশিদের লেখায় তেমন কোনো লেখা নেই যা-থেকে মনে হতে পারে যে মোগল আমলের বহু আগেই পূর্ববঙ্গে সুফিদের নেতৃত্বে চাষ-আবাদ এবং মুসলমান জনসংখ্যার ব্যাপক প্রসার হয়েছিল ৷

ইটন সাহেবের লেখায়ও এরকম অনেক পীরের নাম আছে ৷ কিন্তু তারা সকলেই মোগল আমলের পীর ৷

কোনো-এক মেহের আলি দক্ষিন ভারত থেকে এসে যশোরে চাষ-আবাদের জন্য জঙ্গল পরিস্কার করিয়েছিলেন এবং তার নামেই সেখানকার একটি জায়গার নাম হয় মেহেরপুর ৷

সিলেটের হবিগঞ্জে আর এক সাধুপুরুষ শাহ সৈয়দ নাসিরুদ্দিন মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসে স্থানীয় মানুষদের জঙ্গল পরিস্কার করে জমিতে ধান রোয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন ৷

নোয়াখালির পীর উমর শাহ সতেরো শতকের গোড়ায় এসেছিলেন ইরান থেকে ৷ তিনি তার শিষ্যদের নিয়ে একটি বিরাট এলাকা আবাদ করান ৷ এরই কাছাকাছি সময়ে ঢাকায় মোগল রাজধানী স্থাপিত হওয়ার পর বাখরগঞ্জ জেলায় অনেকে কৃষি বিস্তারে এগিয়ে আসেন ৷ প্রথম দিকে মগ দস্যুদের উৎপাতে তাঁদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি ৷ কিন্তু ১৬৬৬ সাল থেকে মোগল নৌসেনা নিরাপত্তা দেওয়ার পর নতুন-নতুন কৃষি উপনিবেশ গড়ে উঠতে থাকে সেখানে ৷

হয়তো জমিদার হিন্দু, কিন্তু তালুকদার যিনি কাজ করিয়েছেন কৃষকদের দিয়ে তাঁদের অনেকেই ছিলেন সুফি বা মৌলানা ধরনের মানুষ ৷ এঁরা কাজি, পীর শেখ ইত্যাদি নামেও পরিচিত ৷ বাখরগঞ্জ জেলার বোরহানউদ্দীন থানার কাজি আবাদ নামে যে-মৌজাটি আছে তা একজন কাজির পত্তন করা ৷ একইভাবে নারায়ণপুর থানা এলাকার কুতুবপুর গ্রাম সাধক পীর কুতুবের নাম বহন করে ৷

সাধারনত জমি তৈরীর খরচ যোগাতেন হিন্দু জমিদারেরা এবং মুসলমান সাধু পুরুষেরা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে জনবল সরবরাহ করতেন এই কাজে ৷ অনেক সময় বাদসা বা জমিদারেরা পাট্টা ছাড়াও তাঁরা নিজেরাই উদ্যোদী হয়ে জঙ্গল আবাদ করতছেন ৷ সেসব ক্ষেত্রে আবার তাদের উপর কর আদায়ের দায়িত্ব ছেড়ে দিতেন কর্তৃপক্ষ ৷ ঢাকা জেলার দক্ষিনে এরকমই একটি জায়গা পানাম দুলালপুর, সেখানে পীরই হয়ে উঠেছিলেন জমিদার ৷ অনেকে আবার গোড়ায় জমিদার না হলেও, পরে তাদের উত্তরসূরিরা জমিদারী অধিকার লাভ করেছেন ৷ কোনো কোনো পীর এতই প্রভাবশালী ছিলেন যে মোগল প্রশাসন বা নবাব কারোরই পরোয়া করতেন না ৷ আঠারো শতকে বাখরগঞ্জ জেলার ঝালাকাঠি মৌজার সয়িদপুর গ্রামের সয়িদ ফকির নামে একজন সাধু ব্যক্তি একই কারণে নবাবের শীরঃপীড়ার কারণ হয়ে ওঠেন ৷ শেষে নবাবের কর্মচারী লালা চেত সিং তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে গ্রাম থেকে চলে যেতে রাজী করান ৷ জমির উপর দখল থাকা সত্ত্বেও, সম্পত্তির প্রতি আসক্তি ছিলনা বলেই একজন এরকমভাবে ছেড়ে চলে যেতে পারেন ৷

বাংলার মাটিতে ইসলামের উদয় ও বিকাশ বইয়ের লেখক রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায় ইটনের তত্ত্বের ভিত্তিতে দক্ষিন বঙ্গের জেলাগুলিতে হোসেন মিঞাদের দ্বারা ইসলামায়ন-এর কথা বলেছেন ৷ হোসেন মিঞা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস পদ্মানদীর মাঝি-র এক অসামান্য চরিত্র ৷ মানুষের বসবাসের অনুপযোগী একটি দ্বীপ কিনে , ওখানে জনপদ বসানোর স্বপ্ন দেখিতেছে সে, জীবনে তাহার আর কিছু উদ্দেশ্য নাই, কামনা নাই,--হাজার দেড়েক মানুষ ওখানে চলাফেরা করিতেছে , একবিঘা জমিও দ্বীপের কোনোখানে অকর্ষিত নাই, মরিবার আগে এইটুকু দেখিয়া যাইতে চায় ৷

ইটন সাহেব বলেছেন, বাংলার পূর্বাঞ্চলের সভ্যতা প্রসারে অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছিল ইসলাম ৷ কিন্তু সেখানে নতুন নতুন বসতি গড়তে নিজেদের শ্রম দিয়ে সাহায্য করেছিলেন যে সব কৃষকেরা তারা কারা ? নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে কৃষির সম্ভাবনা সঙ্কুচিত হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে এসেছিলেন ৷ (আমার নিজের পূর্বপুরুষরাও বর্ধমান থেকে প্রায় ২৭৫ বছর আগে বরিসালে চলে এসেছিলেন এবং সেখান থেকে আবার তারা চট্টগ্রামে গেছিলেন, তারপর দেশভাগের পর আবার কলকাতায় ৷ আমার পূর্বপুরুষরা শুধু একা আসেননি ৷ বর্ধমানের কোনো একজমিদার নতুন বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে অনেক লোক লস্কর নিয়ে বর্ধমান থেকে বরিসালে আসেন ও তারপর চট্টগ্রামের মীরেশ্বরীতে বসতি স্থাপন করেন ৷)আবার উত্তর ভারত থেকেও কিছু মানুষ গিয়েছিলেন , পাশাপাশি স্থানীয় জেলে ও ঝুম চাষিরাও এই কাজে হাত লাগান ৷ এক দেশ থেকে আর এক দেশে যাওয়া ও এক পেশা ছেড়ে আর এক পেশা অবলম্বন করা সুলতানি আমলের শেষ দিকে এটা খুব দেখা যায় ৷

লোক সংস্কৃতিগবেষনা পত্রিকা-য় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে কল্যান চক্রবর্তী ও মনাঞ্জলী বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, সুলেমান কররানী-র রাজত্বকালে উত্তরবঙ্গের পুণ্ড্রজাতির এক বড় অংশ ইসলামে দীক্ষা নিয়ে গৌড় ও রাঢ় ছেড়ে দক্ষিন বঙ্গে বিশেষ করে ২৪পরগনা অঞ্চলে চলে আসে ৷ তাদের জাতীয় বৃত্তি রেশমের কাজ ছেড়ে কৃষিকর্মে নিযুক্ত হয় তারা ৷ সুলেমান কররানি-র রাজত্বকাল ১৫৬৫-১৫৭২

খাল কেটে সেচের জল ধানের জমিতে নিয়ে আসা সেই আমল থেকেই শুরু ৷ নয় শতকে স্পেনে আরবেরা এক সুচারু সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, যার কিছু কিছু নিদর্শন আজও সেখানে গেলে দেখতে পাওয়া যায় ৷ স্পেন যখন আবার খ্রিস্টানদের হাতে চলে যায়, আরবদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করলেও প্রতি গ্রামে তাঁরা একটি আরব পরিবারকে রেখে দিয়েছিলেন সেচব্যবস্থা চালু রাখার জন্য ৷ জলসেচ এবং চাষের ব্যাপারে আরব ও ইরানিদের বিশাল অভিজ্ঞতা ছিল, যা পূর্ববঙ্গে কৃষিবিস্তারে স্বাভাবিকভাবেই কাজে লেগেছে ৷

অতুল সুরের লেখাতেও আছে, ভূমি প্রাপকেরা গৌড়, পাণ্ডুয়া ও মুর্শিদাবাদের নিকটেই পেয়েছিল ৷ এরূপ ভূমিদান সংক্রান্ত দলিলাদি উত্তর ও পূর্ববঙ্গে খুবই কম, তথাপি বাঙলার এই দুই অংশেই মুসলমানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ৷ ফজলে রব্বি এবং অতুল সুর দূজনেই কথাটি বলেছেন নিস্কর সম্পত্তি প্রসঙ্গে, যার অস্তিত্ব পূর্ববঙ্গে খুবই কম ৷ এ থেকে অনুমান করা যায়, সুফিদের ভূমিকা পশ্চিমবঙ্গে ও পূর্ববঙ্গে একইরকম ছিলনা ৷ যারা পশ্চিমবঙ্গের তারা শুধূই ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, কিন্তু পূর্ববঙ্গের সূফিরা ছিলেন কষি উদ্যোগী ৷ জমি তারাও পেয়েছেন কিন্তু সেগুলি আবাদ-করা জমি নয় ৷ জঙ্গলের একটা অংশ দিয়ে বলা হত জমিকে চাষযোগ্য করে তুলতে হবে ৷

পূর্ববঙ্গে সূফিরা বহু মসজিদ বা খানকাহ তৈরী করিয়েছিলেন এবং এইসব নতুন বসত-করা জনপদে, সেগুলিই ছিল সামাজিক মেলামেশা ও কর্তৃৃত্বের উৎস ৷ অবশ্য তেমন জাঁকজমকপূর্ন নয় ৷ কালের কবলে পড়ে এগুলির অধিকাংশেরই আজ আর কোনো চিহ্ন নেই ৷ এমসজিদ-খানকাহ্ গুলিতে মানুষ আসত পীরের কাছে এবং ধুনিক আমলের খ্রিস্টান পাদ্রিরা গির্জা বানিয়ে স্থানীয় মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেভাবে তাদের নিজেদের ধর্মে আকৃষ্ট করেন, একই ধরনের সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সুফিরাও নিজেদের গোষ্ঠীভুক্ত কৃষকদের ইসলামে দীক্ষিত করেছিলেন, এটা নিরাপদে অনুমান করা যায় ৷

বাংলা মোগল অধিকারে আসার আগে চট্টগ্রামে কিছু ঝুম চাষ ছাড়া কোনো নিয়মিত চাষ হতনা ৷

১৭৭০ সালের এক ব্রিটিশ সমীক্ষা অনুযায়ী চট্টগ্রাম জেলার সেরা জমিগুলির দুই তৃতীয়াংশই ছিল মসজিদ বা খানকাহ্ র মুতওয়াল্লিদের অধীন, যা তারা বংশপরম্পরায় ভোগ করতেন ৷ অবশ্য জমিগুলি সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁদের পূর্বসূরীদের বহু পরিচর্যায় ৷

ইটন সাহেবে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় মোগল আমলের প্রথম একশ বছরে ২২৭টি জমি-সংক্রান্ত সনদ জারি করা হয় ৷ যার ৯শতাংশ ছিল হিন্দু মন্দির ইত্যাদির জন্য এবং বাকী ১১১৯১ একর জমি মুসলমানের ভাগে পড়ে ৷ প্রপক অধিকাংশই মুসলমান ধর্মীয় ব্যক্তিরা ৷ ২ সেপ্টেম্বর ১৬৬৬ তারিখের একটি সনদে লেখা---

শাহ জয়নুল আবেদিন জানিয়েছেন যে তাঁর অনেকগুলি পোষ্য এবং তিনি একটি মসজিদও তৈরী করিয়েছেন, যেখানে বহু ফকির ও অন্যান্য মানুষদের আগমন হয় ৷ শুধু মসজিদের রক্ষনাবেক্ষণের ক্ষমতা তাঁর কাছে নেই, তাই তিনি সরকারের কাছে কিছু জমি চান ৷ ব্যাপারটা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে ১৬৬.৪ একর জঙ্গল এলাকা , যা করের টাকার হিসেবের বাইরে, দানস্বরূপ তাঁকে দেওয়া হল মসজিদের যাবতীয় খরচ চালানোর জন্য ৷ জমির চাষ-আবাদ থেকে যেটুকু আয় হবে তার কিছু তিনি মসজিদের জন্য ব্যয় করবেন এবং বাকীটা ভোগ করবেন তিনি ও তাঁর উত্তরসূরিরা ৷

লক্ষনীয় যে, এটি পতিত জমি যেখানে আগে চাষ-আবাদ হয়নি, যা করব্যবস্থারই অন্তর্গত ছিলনা ৷ এইদানের উদ্দেশ্য কৃষির প্রসার এবং সেই সঙ্গে ধর্মীয় কাজে উৎসাহ দেওয়া ৷ সে আমলের এই সাধু ব্যক্তিরা ছিলেন কর্মযোগী, তারা অলসভাবে ধর্ম পালন করেননি ৷ লোকজন দিয়ে জঙ্গল পরিস্কার করিয়ে চাষ করেছেন ৷ জবরদস্তি বা কোনো নৈতিক চাপ নয়, কোনোরকম অলৌকিকতা প্রদর্শন করেও নয়--মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁদের জীবিকা উপার্জনে সাহায্য করে স্থানীয় উপজাতি ও নিম্নবর্ণের কৃষকদের ধর্মান্তরিত করে তাঁরা মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন ৷ মোগল বাদসারা জমি দানের ব্যাপারে এই সাধু ব্যক্তিদেরই উপর ভরসা করতেন এবং মসজিদকে তাঁরা মনে করতেন নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতার সহায় ৷

সিলেট জেলায়ও ধর্ম কর্মের জন্য মোগল আমলে প্রচুর জমি দান করা হয়েছে ৷ এ ধরনের দান হিন্দুরাও পেতেন ৷ ১৭১৯ থেকে ১৭৫৯ মোহম্মদ শাহ, আহমদ শাহ ও দ্বিতীয় আলমগিরের শাসনকালে হিন্দুরা প্রচুর দান পেয়েছেন ৷ কিন্তু মদদ-ই-মাস ও চিরাগি হিসাবে প্রাপ্ত মুসলিমদের জমির পরিমান ছিল অনেক বেশি ৷ মদদ-ই-মাস পেতেন মসজিদের ইমাম ও ধর্মিয় মানুষেরা নিজেদের ভরণ-পোষণের জন্য এবং চিরাগি দেওয়া হত মাজারের রক্ষনাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে ৷ এটা যে বাংলার জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নয় , সারা ভারতের মোগল নীতি ছিল তা-ই ৷ আবুল ফজলের বইয়ে স্পষ্ট লেখা আছে কারা-কারা মদদ-ই-মাস পাওয়ার যোগ্য ৷

অনাবাদি জমি উদ্ধার করে যে সব গ্রাম গড়ে উঠত সেখানকার বাসিন্দাদের ধর্মের ব্যপারে , গ্রামের যিনি প্রধান তার প্রভাব ছিল অনিবার্য, বিশেষ করে ওই আমলে এবং ওই পরিস্থিতিতে ৷ ব্রহ্মোত্তর বা দেবোত্তর জমি হলে সে সব গ্রামে গড়ে অঠত মন্দির, আর মুসলমান-অধীন হলে মসজিদ ও মাজার ৷ প্রাপ্ত জমি যেহেতু মুসলমানদেরই বেশি, ফলে ওইসব অঞ্চলে মুসলিম প্রভাবই বেশি ছড়িয়েছে ৷ হিন্দুদের যে জমি দান করা হত তাতে লেখা থাকত, মন্দির ও পুরোহিতদের ব্যয় নির্বাহের জন্য ৷ কিন্তু মুসলিমদের ক্ষেত্রে সনদ দান গ্রহিতার পারিবারিক খরচ এবং তাঁর অধীনস্থ শ্রমিকদের খরচের উল্লেখ থাকত ৷ ফলে স্বত্বভোগীর উপর নির্ভরশীল একটি সম্প্রদায়ের গড়ে ওঠার সুযোগ ছিল ৷ এসব ক্ষেত্রে মুসলমান সাধুপুরুষরা ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক দুই প্রকারেরই নেতৃত্ব দিতেন ৷ যদিও তারা কট্টর ছিলেন না, ইসলামকে উদারভাবে প্রয়োগ করেছেন ৷ ধর্মান্তরিতদের তাদের পুরানো আচার ত্যাগ করতে বাধ্য করেননি ৷ ধর্মান্তরিতরাও তাদের পুরানো জীবনধারার সঙ্গেই ইসলামকে গ্রহন করেছেন ৷

শুধু বাদশার দান করা জমিই নয়, হিন্দু জমিদারদের কাছ থেকে জমির পাট্টা নিয়ে চাষ-আবাদ করেছেন এইসব ধর্মগুরুরা ৷ অনেক সময় হিন্দু জমিদারেরা নিজেরাই মসজিদের জন্য জমি দান করতেন ৷ আবার সুফিরা কেউ-কেউ গভীর জঙ্গল যা বিশেষ কারও অধিকারভুক্ত নয় এমন জমি নিজেরা উদ্যোগী হয়ে আবাদ করেছেন এবং পরে বাদশাকে অনুরোধ করে জমির উপর নিজের অধিকার অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন ৷

১৭৯৮ সালে ব্রিটিশ আধিকারিক জন বুকানন জমি জরিপের যে বিবরণ দাখিল করেছিলেন তাতে মধ্যবর্তী জোতদার শ্রেণির নামের যে সব উপাধি পাওয়া যায় সেগুলি হল শেখ, চৌধুরি, খোন্দকার, তালুকদার, শাহ, ফকির, সৈয়দ, দরবেশ, খান ইত্যাদি ৷ এই উপাধিগুলি দেখে বোঝা যায় যে এঁরা অধিকাংশই পীর বা আলেম বংশের ৷

ইটন সাহেব বলেছেন যে বাংলায় ইসলামীকরন এমন ধীরে ধীরে হয়েছে যে টেরই পাও যায়নি ৷ বলা উদ্দেশ্য, রাতারাতি কেউ ধর্ম পালটে ফেলেনি ৷ পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এমন ছিল যে পীরদের অধীনে নতুন-নতুন কৃৃৃৃষি অঞ্চল গড়ে উঠেছে, ইসলামি আচার আচরণ ছড়িয়েছে, ইসলামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর জন্ম হয়েছে ; পাশাপাশি , কোনো প্রথাগত ধর্মান্তর নয় , একটু-একটু করে মানুষ ইসলামের সঙ্গে মিশে গেছে ৷

এই প্রক্রিয়ার তিনটি ধাপ বর্ণনা করেছেন ইটন ৷

এক, অন্তর্ভুক্তি অর্থাৎ পূর্বের যে সংস্কারগুলি ছিল তার মধ্যে ইসলামকেও জায়গা করে দেওয়া ৷

দুই, সংযুক্তিকরণ অর্থাৎ হিন্দু বা বৌদ্ধের ঈশ্বর বা নিরঞ্জনের সঙ্গে আল্লাহ্ র সমার্থক হয়ে যাওয়া ৷

তিন, স্থানচ্যুতি অর্থাৎ আগের দেবদেবীদের হঠিয়ে আল্লা- রসুলের নাম জনমানসে স্থায়ী হওয়া ৷

এই যে মন্থর সামাজিক প্রক্রিয়া তা কারও নির্দেশে বা পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়নি ৷ এ ছিল এক অনিবার্য ও স্বাভাবিক পরিবর্তন ৷ আজকের দিনে একজন মুসলমান ও অমুসলমানের মধ্যে যে পার্থক্য, ইসলামকে যেভাবে একটা যেভাবে একটা বদ্ধ ব্যবস্থা বলে ধরে নেওয়া হয়, সতেরো এবং আঠারো শতকের বাংলায় তেমনটি ছিলনা ৷ অ-ইসলিম এবং ইসলামের মধ্যেকার সীমানা ছিল পরিবর্তনশীল, সূক্ষ ও ছিদ্রবিশিষ্ট ৷

পলাশীর যুদ্ধের ২৫বছর পর লেখক সৈয়দ গুলাম তাঁর সিয়ার-উল-মোতাখ্ খেরিন বইয়ে লেখেন যে বাঙ্গালি মুসলমানদের জীবনযাপন প্রনালীর সঙ্গে ইসলামী সংস্কৃৃতির কোনো মিল নেই ৷

আবদুদ ওদুদ লিখছে অনেক সম্ভ্রান্ত মুসলমান বাৎসরিক দুর্গা ও কালী পূজা বাড়ীতে করতেন ৷ ওহাবী আন্দোলনের ও তার প্রভাবের আগে মুসলমান মানসিকতায় প্রতীকচর্চার একান্ত বিরোধী ছিলনা ৷

ঐতিহাসিক গোলাম রব্বানিও একই কথা বলেছেন যে অর্থোডক্স ইসলাম বলে কোনো কিছু বাঙ্গালি মুসলমানদের মধ্যে ছিলনা ৷ পীর মোল্লারাও এব্যাপারে বাধা দেননি ৷

যদি নিতেন তাহলে উনিশ শতকে ওয়াহাবি-ফারায়েজিদের শুদ্ধি আন্দোলনের দরকার হতনা এবং মুসলিমদের এতটা সংখ্যাবৃদ্ধিও ঘটতনা ৷ ইটন যাকে স্থানচ্যুতি বলেছেন অর্থাৎ পূর্বধর্মকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহন, ইসলামীকরনের বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া, তা ঘটেছে এই আন্দোলনকালেই ৷

ইটন এই আন্দোলনগুলির পিছনে যেসব অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক কারণ দেখিয়েছিন সেগুলি হল--- খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের ইসলাম বিরোধিতা, ইংরেজ আসার ফলে অমুসলিমদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মুখে পড়া, স্টিম ইঞ্জীন চালু হওয়ার ফলে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলিতে যাতায়াত সহজ হওয়া এবং মুদ্রণ ব্যবস্থার উন্নতি ৷

আমরাখুঁজতে চেয়েছি একটি প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর যে, কি প্রেক্ষাপটে বাংলায় বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠেন ৷ এতদিন এসম্পর্কে যে কথাগুলি লেখা হয়েছে সেগুলি অধিকাংশই ছিল অনুমান নির্ভর ৷ ইটনের কাছেই প্রথম এর প্রথম একটা বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া গেল ৷ ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে'র ভাবনায় সামাজিক মুক্তির তত্বকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং তিনি মনে করেন যে ইটন যেহেতু বিদেশী তাই এই ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারেননি ৷ অবশ্যই , রামাই পণ্ডিত ছবির মতো বর্ণনা দিয়েছেন ব্রাহ্মন অত্যাচারের এবং কীভাবে ব্রহ্ম হৈল মহাঁমদ/বিষ্ঞু হৈলা পেকাম্বর/ আদম্ফ হৈল সুলপানি/গনেশ হৈল গাজী/কার্ত্তিক হৈল কাজি/ফকির হৈইল্যা যত মুনি ৷

শীতলা দেবী ওলাদেবী দুই বোন , বাঙ্গালি হিন্দুদের দুই দেবী, বাঙ্গালী মুসলমান মননে শীতলা হিন্দু থেকে যায় আর ওলা দেবী, ওলাবিবিতে রূপান্তরিত হয় ৷

ইটন কথিত অন্তর্ভুক্তি এবং সংযুক্তিকরণের এটাও একটা বড়ো প্রমান ৷ ইটনে কৃষি বিস্তার তত্ত্বে সঙ্গে সামাজিক মুক্তি তত্ত্বের কোনো বিবাদ খুঁজে পাইনা ৷ শুধু কৃষিই কারণ হলে এত ব্যাপকভাবে ধর্মান্তর সম্ভব হত কিনা সন্দেহ ৷ সুতরাং, এই দুই তত্ত্বের মিলন পরস্পরকে শক্তিশালী করে ৷

কিন্তু রামাই পণ্ডিত প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন আছে, তিনি কোন আমলের মানুষ ? কেউ বলেন চৌদ্দ শতক, কেউ বলেন তেরো শতক, কেউতো আরো পেছনে যেতে চান ৷ অর্থাৎ সুলতানি আমল, কোনো অবস্থাতেই মোগল আমল নয় ৷ রামাই পণ্ডিত নিজে বৌদ্ধ ছিলেন (মতান্তরে হিন্দু ব্রাহ্মণ), তিনি মুসলমান হননি ৷ তাঁর পূত্র ধর্মদাসও বৌদ্ধ বা হিন্দু যাইহোক ছিলেন এবং বলা হয় যে তিনি কলিঙ্গর রাজাকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন ৷

রামাই পণ্ডিতের বই শূন্যপূরাণ ( নামটি আধুনিক আমলে দেওয়া) একটি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ৷ এর একটি অধ্যায় 'নিরঞ্জনের রুষ্মা', যেখানে ব্রাহ্মণ অত্যাচারের বর্ণনাটি আছে ৷ বইয়ের ওই অংশে প্রক্ষিপ্ত অর্থাৎ পরে ঢোকানো হয়েছে, এমন একটা কথা কেউ-কেউ বলেন ৷ যদি সত্যিই প্রক্ষিপ্ত হয় তা হলে সেটা মোগল আমলেই ঘটতে পারে ৷ কারণ সেখানে জাজপুরি ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের কথা আছে, যাঁদের বাস ছিল যশোর অঞ্চলে ৷ মোগল শাসনকর্তা মির্জা নাথান সম্ভবত তাঁদের দেখেই কটকি ব্রাহ্মণদের কথা লিখেছিলেন ৷ শুন্যপূরাণ-এ জাজপুরের সঙ্গে পূরবাদি শব্দটিও এসেছে অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের দিকেই ইঙ্গিত ৷ তবে রামাই পণ্ডিত বা নিরঞ্জনের রুষ্মা দিয়ে যে বিতর্কই থাকুকনা কেন, তাতে ইটনের তত্বের সঙ্গে সামাজিক মুক্তি তত্ত্বের সহাবস্থান আটকায়না ৷

শুধু একটা কথা, নিরঞ্জনের রুষ্মার রচনাকাল যদি সুলতানি আমল হয়, তাহলে ধর্মান্তরের সময়ের কাঁটা হেলে যায় সেই দিকেই ৷ অথচ ইটন মোগল আমলেই বড়ো আকারের ধর্মান্তর ঘটেছে বলে দাবি করেছেন এবং তাঁর কৃষি-বিস্তারের তত্ত্বও ওই সময়ের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ৷ তা হলেও ইটনপন্থীদের ঘাবড়াবার কিছু নেই, কেননা প্রায় ইটনেরই সমসাময়িক আরও একটি গবেষনা ১৬০০ সালের পর থেকেই যে বাংলার মুসলমান জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল তা সমর্থন করে ৷

এই তথ্য পাওয়াও যাচ্ছে গোলাম মুরশিদের পূর্বোলিখিত বই থেকে ৷ তিনি লেখেছেন! ১৫০০ সালের আগে পর্যন্ত মুসলমানের সংখ্যা ছিল খুব কম ৷ কিন্তু ১৬০০ সালের পর থেকে তাঁদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করে ৷ নিজের মতের সমর্থনে তিনি একটি রেখাচিত্র দিয়েছেন৷ যেটি মুরশিদ তৈরী করেছেন, উলরিখ ক্রেমারের গবেষণার (১৯৯৩)ভিত্তিতে ৷ তাতে দেখা যায় ১৫০০সালে বাংলার মোট মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ৩০ লাখ ৷ ১৬০০ সালে বেড়ে হয় ৪০ লাখ ৷ আরও ৫০ বছর পরে তা পৌঁছে যায় ৬০ লাখে এবং ১৭৫০ সালে হয় এককোটির কাছাকাছি ৷ এই হিসেব এম এ রহিমের দেওয়া সঙ্গতিপূর্ণ এবং ইটনের তত্ত্বকে সমর্থন করেই ৷ এর চেয়ে মজবুত আর কোনো তত্ব এখনও পাওয়া যায়নি , তাই এর উপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ৷

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ