শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

মূল কবিতাটি নিম্নরূপ :

 হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক - কাজী নজরুল ইসলাম
হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই 
ভারতের দুই আঁখি তারা 
এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা।। 
যেন গঙ্গা সিন্ধু নদী 
যায় গো বয়ে নিরবধি 
এক হিমালয় হতে আসে, এক সাগরে হয় গো হারা।। 
বুলবুল আর কোকিল পাখী 
এক কাননে যায় গো ডাকি, 
ভাগীরথী যমুনা বয় মায়ের চোখের যুগল ধারা।। 
ঝগড়া করে ভায়ে ভায়ে 
এক জননীর কোল লয়ে 
মধুর যে এ কলহ ভাই পিঠোপিঠী ভায়ের পারা।। 
পেটে ধরা ছেলের চেয়ে চোখে ধরারা মায়া বেশী, 
অতিথী ছিল অতীতে, আজ সে সখা প্রতিবেশী। 
ফুল পাতিয়ে গোলাপ বেলী 
একই মায়ের বুকে খেলি, 
পাগলা তা'রা আল্লা ভগবানে ভাবে ভিন্ন যারা।।
শেষ পংক্তিটির ব্যাখ্যা :
দেখুন, কবিরা তাদের কবিতায় বিপুল পরিমাণে অলঙ্কার শাস্ত্র প্রয়োগ করে থাকেন। তাত প্রচুর পরিমাণ উপমা ও রূপকল্প ব্যবহার করেন। কবিদের কবিতার পংক্তির বাহ্যিক রূপ এক ধরণের বার্তা দিলেও কবিরা অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা মর্ম গ্রহণ করে থাকেন। এ জন্য কবিতার মূল মর্ম বা ব্যাখ্যা কবিদের থেকেই গ্রহণ করা শ্রেয়। এখানে কবি নজরুল রচিত হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক কবিতাটির শেষ পংক্তির দৃশ্যমান অভিব্যক্তি স্পষ্ট। বাহ্যত এখানে তিনি হিন্দুদের ভগবান এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের আল্লাহকে একাকার করে ফেলেছেন। এটা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চরম আপত্তিকর। একাকারের মাত্রা বেড়ে যদি হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাসের সত্যতা পর্যন্ত গড়ায় তবে ঈমান-কুফরের প্রশ্ন চলে আসবে। জানি না, তিনি বিশ্বাসের কোন পর্যায় থেকে পংক্তিটি রচনা করেছেন। তবে সম্পূর্ণ কবিতাটি পাঠ করলে অনুমিত হয়, তিনি এ কবিতাটিতে হিন্দু-মুসলিমের বিবাদ নিরসনে উভয় পক্ষকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। ঈশ্বর-আল্লাহে বিবাদ না করে আপন আপন ধর্ম পালন করে পারস্পারিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে বলেছেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি আল্লাহ এবং ভগবানকে একাকার করেন নি; বরং উভয় পক্ষই যেন স্বস্ব ধর্মপালনকে বিবাদ-বিসম্বাদ এবং হিংসা বিদ্বেষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত না করে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশে থেকে জীবন ধারণ করে- এ বার্তাই তিনি দিতে চেয়েছেন। তবে মূল এবং প্রকৃত ব্যাখ্যাটি কবির জাম্বিলেই রয়ে গেছে।  
ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ

মানুষ সামাজিক জীব। কবি সম্প্রদায় সমাজের-ই একটা অংশ। তাঁরাও সমাজ নিয়ে ভাবেন, ভাবেন জীবনের নানা দিক নিয়ে। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই শান্তিপ্রিয়। কবিগণও তার ব্যতিক্রম নয়। পৃথিবীর জন্ম থেকে আজ অবধি নানান চড়াই-উৎরাই করে মানব সভ্যতা আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে শান্তির পূর্বশর্ত স্বরূপ বিশ্বাসের তারতম্যের সৃষ্টি হয়েছে, যার মাঝে রয়েছে স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং তাঁর নির্দেশাবলী, মানুষের সৃষ্টি দর্শন ও তাতে আস্থা স্থাপণ। সেই সাথে যোগ হয়েছে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব ও প্রভূত্ব স্থাপণে অতি উৎসাহী রাজনৈতিক উচ্চাভিলাসীদের মনগড়া স্বর্থান্বেষী চিন্তার প্রয়োগ! ফলে পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে মানুষে মানুষে আচরণ ও বিশ্বাসগত তারতম্য তথা ভেদাভেদ! সৃষ্টি হয়েছে উচ্চ-নীচ, সৃষ্টি হয়েছে ভূখন্ডগত সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু, যার প্রভাব কখনও কখনও সমাজকে বসবাসের অনুপযোগী করে তুলেছে! যার প্রভাবে পৃথিবীতে বেঁধেছে কত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ!

ভারতবর্ষ আগাগোড়াই বহুমতাদর্শে বিশ্বাসীদের আবাসভূমি। বিশেষতঃ মাঝে-মধ্যে রাজনৈতিক কারণেই সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সুত্রপাত হয়ে বহু নিরাপরাধ মানুষের জীবনহানী ঘটেছে! সেই অপরিণামদর্শী পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধকল্পেই আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ কবিতাটি রচনা করতে উদ্বুদ্ধ হযেছিলেন। তিনি ছিলেন সমাজ সচেতন দূরদর্শী জ্ঞানসম্পন্ন কবি। তাই তাঁর পক্ষে দার্শনিকের স্তর স্পর্শ করা অসম্ভব ছিল না। আর সে দৃষ্টিকোন থেকেই তিনি চেয়েছিলেন, যার যার বিশ্বাসকে অক্ষুণ্ণ রেখেই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবাই এগিয়ে আসুক, পালন করুক অগ্রনী ভূমিকা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে কখনও কখনও বাড়াবাড়ি মনে হলেও শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই তিনি এমনতর নানান উপমায় সজ্জিত কবিতাটি রচনা করেছিলেন। এর অর্থ এই নয় যে, তিনি সবাইকে ধর্ম ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কেননা, এই কবি-ই এক সময় লিখেছেনে, “মসজিদেরই পার্শ্বে আমার কবর দিও ভাই”।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ