আসহাবে কাহফরা কি বর্তমানে জীবিত আছে? বিস্তারিত উত্তর চাই? 


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
Call

 

সুরা কাহাফের ৯ নাম্বার আয়াত থেকে আল্লাহ তাআলা “আসহাবে কাহ্ফের” ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এটা ছিল একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা। কাহিনীর ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক পটভূমি বিশাল। উক্ত ঘটনাটর সাতজন যুবক তারা কি এখনো জীবিত আছে, না মারা গেছে এসমস্থ ঘটনা কোরআন হাদিসের কোথাও স্পষ্টভাবে বর্ননা হয়নি।

তবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে তাদের যে বর্ণনা এসেছে তাতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ হয়েছে যে উক্ত ঘটনাটর সাতজন যুবক তারা এখন আর জীবিত নেই তারা মারা গেছে।

বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে তাদের যে বর্ণনা এসেছে তা সংক্ষেপ করলে নিম্নরূপ দাঁড়ায়ঃ

তারা ছিলেন সাতজন যুবক। তাদের ধর্মান্তরের কথা শুনে তৎকালীন রাজা তাদেরকে নিজের কাছে ডেকে পাঠান। তাদের জিজ্ঞেস লরেন তোমাদের ধর্ম কি?

তারা জানতেন, এ রাজা ঈসার অনুসারীদের রক্তের পিপাসু। কিন্তু তারা কোন প্রকার শংকা না করে পরিষ্কার বলে দেন, আমাদের রব তিনিই যিনি পৃথিবী ও আকাশের রব। তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদকে আমরা ডাকি না। যদি আমরা এমনটি করি তাহলে অনেক বড় গুনাহ করবো। রাজা প্রথমে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, তোমাদের মুখ বন্ধ করো, নয়তো আমি এখনই তোমাদের হত্যা করার ব্যবস্থা করবো। তারপর কিছুক্ষণ থেমে থেকে বললেন, তোমরা এখনো যুবক। তাই তোমাদের তিনদিন সময় দিলাম। ইতিমধ্যে যদি তোমরা নিজেদের মত বদলে ফেলো এবং জাতির ধর্মের দিকে ফিরে আসো তাহলে তো ভাল, নয়তো তোমাদের শিরচ্ছেদ করা হবে।

এ তিন দিন অবকাশের সুযোগে এ সাতজন যুবক শহর ত্যাগ করেন। তারা কোন গুহায় লুকাবার জন্য পাহাড়ের পথ ধরেন। পথে একটি কুকুর তাদের সাথে চলতে থাকে। তারা কুকুরটাকে তাদের পিছু নেয়া থেকে বিরত রাখার জন্য বহু চেষ্টা করেন। কিন্তু সে কিছুতেই তাদের সংগ ত্যাগ করতে রায়ী হয়নি। শেষে একটি বড় গভীর বিস্তৃত গুহাকে ভাল আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়ে তারা তার মধ্যে লুকিয়ে পড়েন। কুকুরটি গুহার মুখে বসে পড়ে। দারুন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত থাকার কারণে তারা সবাই সংগে সংগেই ঘুমিয়ে পড়েন। কয়েকশত বছর পর তারা জেগে উঠেন। তখন ছিল অন্য রাজার শাসনামল। রোম সাম্রাজ্য তখন নাসারা ধর্ম গ্ৰহণ করেছিল এবং আফসোস শহরের লোকেরাও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেছিল।

এটা ছিল এমন এক সময় যখন রোমান সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের মধ্যে মৃত্যু পরের জীবন এবং কিয়ামতের দিন হাশরের মাঠে জমায়েত ও হিসেব নিকেশ হওয়া সম্পর্কে প্ৰচণ্ড মতবিরোধ চলছিল। আখেরাত অস্বীকারের বীজ লোকদের মন থেকে কিভাবে নিৰ্ম্মল করা যায় এ ব্যাপারটা নিয়ে কাইজার নিজে বেশ চিন্তিত ছিলেন। একদিন তিনি আল্লাহর কাছে দো'আ করেন যেন তিনি এমন কোন নির্দশন দেখিয়ে দেন যার মাধ্যমে লোকেরা আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। ঘটনাক্রমে ঠিক এ সময়েই এ যুবকরা ঘুম থেকে জেগে উঠেন। জেগে উঠেই তারা পরস্পরকে জিজ্ঞেস করেন, আমরা কতক্ষণ ঘুমিয়েছি?

কেউ বলেন একদিন, কেউ বলেন দিনের কিছু অংশ। তারপর আবার একথা বলে সবাই নীরব হয়ে যান যে এ ব্যাপারে আল্লাহই ভাল জানেন। এরপর তারা নিজেদের একজন সহযোগীকে রূপার কয়েকটি মুদ্রা দিয়ে খাবার আনার জন্য শহরে পাঠান। তারা ভয় করছিলেন, লোকেরা আমাদের ঠিকানা জানতে পারলে আমাদের ধরে নিয়ে যাবে এবং মূর্তি পূজা করার জন্য আমাদের বাধ্য করবে। কিন্তু লোকটি শহরে পৌঁছে সবকিছু বদলে গেছে দেখে অবাক হয়ে যান। একটি দোকানে গিয়ে তিনি কিছু রুটি কিনেন এবং দোকানদারকে একটি মুদ্রা দেন। এ মুদ্রার গায়ে অনেক পুরাতন দিনের সম্রাটের ছবি ছাপানো ছিল। দোকানদার এ মুদ্রা দেখে অবাক হয়ে যায়। সে জিজ্ঞেস করে, এ মুদ্রা কোথায় পেলে?

লোকটি বলে, এ আমার নিজের টাকা, অন্য কোথাও থেকে নিয়ে আসিনি। এ নিয়ে দু'জনের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়। লোকদের ভীড় জমে উঠে। এমন কি শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নগর কোতোয়ালের কাছে পৌছে যায়। কোতোয়াল বলেন, এ গুপ্ত ধন যেখান থেকে এনেছো সেই জায়গাটা কোথায় আমাকে বলো। সে বলেন, কিসের গুপ্তধন?

এ আমার নিজের টাকা। কোন গুপ্তধনের কথা আমার জানা নেই। কোতোয়াল বলেন, তোমার একথা মেনে নেয়া যায় না। কারণ তুমি যে মুদ্রা এনেছো এতো কয়েক শো বছরের পুরনো। তুমি তো সবেমাত্র যুবক, আমাদের বুড়োরাও এ মুদ্রা দেখেনি। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন রহস্য আছে। লোকটি যখন শোনেন অত্যাচারী যালেম শাসক মারা গেছে বহুযুগ আগে তখন তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর্যন্ত তিনি কোন কথাই বলতে পারেন না। তারপর আস্তে আস্তে বলেন, এ তো মাত্ৰ কালই আমি এবং আমার ছয়জন সাথী এ শহর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম এবং যালেম বাদশার যুলুম থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। লোকটির একথা শুনে কোতোয়ালও অবাক হয়ে যান। তিনি তাকে নিয়ে যেখানে তার কথা মতো তারা লুকিয়ে আছেন সেই গুহার দিকে চলেন। বিপুল সংখ্যক জনতাও তাদের সাথী হয়ে যায়। তারা যে যথার্থই অনেক আগের সম্রাটের আমলের লোক সেখানে পৌঁছে। এ ব্যাপারটি পুরোপুরি প্রমাণিত হয়ে যায়। এ ঘটনার খবর তৎকালীন সমাটের কাছেও পাঠানো হয়। তিনি নিজে এসে তাদের সাথে দেখা করেন। তারপর হঠাৎ তারা সাতজন গুহার মধ্যে গিয়ে সটান শুয়ে পড়েন এবং তাদের মৃত্যু ঘটে। এ সুস্পষ্ট নির্দশন দেখে লোকেরা যথার্থই মৃত্যুর পরে জীবন আছে বলে বিশ্বাস করে। এ ঘটনার পর সম্রাটের নির্দেশে গুহায় একটি ইবাদাতখানা নির্মাণ করা হয়।

[বিস্তারিত দেখুন, কুরতুবী; বাগভী; ইবনে কাসীর; তাফসীর ও আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহঃ ২/৫৭০]

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ


জনাকয়েক পলাতক যুবক, একটি গুহা আর তিন শতাব্দীর নিদ্রা- আসহাবে কাহাফের কাহিনী কেবল মুসলিমদের কাছেই প্রবল জনপ্রিয় একটি ঘটনা নয়, বরং খ্রিস্টানদের কাছেও ছিল খুব জনপ্রিয় ও অলৌকিক ঘটনা। কুরআনে বর্ণিত এই কাহিনীর সাথে সাথে সেই সিরিয়ান উপাখ্যান এবং যে নগরীতে এই ঘটনা ঘটেছিল- সবই আমরা এ লেখায় আলোচনা করার চেষ্টা করব।

শুরুতেই বলে রাখা দরকার, এই ঘটনাটি কুরআনে বর্ণিত বিধায়, মুসলিমদের বিশ্বাস ওতপ্রোতভাবে এর সাথে জড়িত। অনেক পাঠকই অভিযোগ করে থাকেন বিধায়, কুরআনের আয়াত বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করার সময় কেবল ইসলামিক সূত্র ব্যবহার করা হবে, এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে তাফসির ইবনে কাসিরের বঙ্গানুবাদের চতুর্দশ খণ্ড।

তবে কুরআনে যে ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে, সেটি কুরআন অবতরণের কয়েক শতাব্দী আগের ঘটনা এবং সেটার বিস্তারিত বিবরণও দেওয়া হবে, একই সাথে খৃষ্টান এবং ইহুদিরা এই ব্যাপারে কি বলছে তাও দেয়া হবে। তাহলে প্রথমে শুরু করা যাক কুরআনে বলা ঘটনাটি দিয়ে।

নবুওয়তের পর ইসলামের প্রথম দিকে সায়্যাদুল মুরসালীন নবী মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম যখন জাহেলিয়াতের যুগে মানবজাতীর মুক্তির জন্যে ইসলামের ছায়াতলে আহ্বান করা শুরু করলেন তখন মক্কার কোরাইশদের মাঝে এক অনাকাঙ্খিত ভয় কাজ করতে লাগলো। ‪

ইমাম‬ ইবনে জরীর তাবারী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, মক্কায় যখন রসূলুল্লাহ্‌ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তের দাওয়াত শুরু হয় কোরাইশরা তাতে বিব্রত বোধ করতে থাকে, তখন তারা নযর ইবনে হারেস ও ওকবা ইবনে আবী মুয়ী’তকে মদীনার ইহুদী পন্ডিতদের কাছে প্রেরণ করে।

রসূলুল্লাহ্‌ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তারা কি বলে, জানার জন্যে। ইহুদী পন্ডিতরা তাদেরকে বলে দেয় যে,তোমরা তাঁকে তিনটি প্রশ্ন করো। তিনি এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলে বুঝে নেবে যে,তিনি আল্লাহ্‌র রসূল। অন্যথায় বোঝবে, তিনি একজন বাগাড়ম্বরকারী রসূল নন।

(১) তাঁকে ঐসব যুবকের অবস্থা জিজ্ঞাস কর, যারা প্রাচীনকালে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তাদের ঘটনা কি? কেননা, এটা অত্যন্ত বিস্ময়কর ঘটনা।

(২) তাঁকে সে ব্যক্তির অবস্থা জিজ্ঞেস কর,যে পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম এবং সারা বিশ্ব সফর করেছিল। তার ঘটনা কি?

(প্রশ্নের উত্তরটি সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করলাম,এ সূরার ৮৩-১০১ অংশে জুলকারনাইন সম্পর্কিত বর্ণনা আছে,জুলকারনইন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়াতেন নির্যাতীত,বঞ্চিত,শাসকের হাতে শোসিত লোকদের মুক্তি দিতেন। পবিত্র কুরআনের বর্ননা অনুযায়ী অরুণাচলে,যেখান থেকে সূর্য উদিত হয় সেখানে ইয়াজুজ,মাজুজের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন জুলকারণাইন)

(৩) তাঁকে রূহু সম্পর্কে প্রশ্ন কর যে,এটা কি? (তার উত্তরটি সূরা বনী ইসরাঈলের শেষে বর্ণনা করা হয়েছে)

উভয় কোরাইশী মক্কায় ফিরে এসে ভ্রাতৃসমাজকে বললঃ আমরা একটি চূড়ান্ত ফয়সালার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফিরে এসেছি। অতঃপর তারা তাদেরকে ইহুদী আলেমদের কাহিনী শুনিয়ে দিল। কোরাইশরা রসূলুল্লাহ্‌ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এ প্রশ্নগুলো নিয়ে হাযির হল। তিনি শুনে বললেনঃ আগামীকাল উত্তর দেব। কিন্তু তিনি ইনশাআল্লাহ্‌ বলতে ভুলে গেলেন। কোরাইশরা ফিরে গেল।

রসূলুল্লাহ্‌ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর আলোকে জওয়াব দেবার জন্যে আল্লাহ্‌র তরফ থেকে ওহী আসার অপেহ্মায় রইলেন। কিন্তু ওয়াদা অনুয়াযী পর দিবস পর্যন্ত ওহী আগমন করল না; বরং পনের দিন এ অবস্থায় কেটে গেল।

ইতিমধ্যে জিবরাঈল(আঃ)ও এলেন না এবং কোন ওহীও নাযিল হল না। অবস্থাদৃষ্টে কোরাইশরা ঠাট্টা-বিদ্রূপ আরম্ভ করে দিল। এতে রসূলুল্লাহ্‌ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুবই দুঃখিত ও চিন্তিত হলেন।

পনের দিন পর জিবরাঈল(আঃ) সূরা কাহফ নিয়ে অবতর করলেন। এতে ওহীর বিলম্বের কারণও বর্ণনা করে দেয়া হল যে, ভবিষ্যতে কোন কাজ করার ওয়াদা করা হলে ইনশাআল্লাহ্‌ বলা উচিত। কোরাইশদের প্রথম প্রশ্নটি ছিল যুবদের সম্পর্কে।সূরা আল-কাহফ এ যুবকদের ঘটনা পুরোপুরি বর্ণনা করা হয়েছে।যাদেরকে “আসহাবে কাহফ” বা গুহাবাসী বলা হয়।

◉ এবার আসুন সংক্ষেপে যুবকদের ঘটনাটি সম্পর্কে জানি।
একদল ধর্মপরায়ণ যুবক যারা এক মূর্তিপূজক অত্যাচারী রোমান সম্রাট যে কিনা ধর্মের ব্যাপারে মানুষের ওপর জোরদারি চালাত। কেউ যদি তখনকার সত্য দ্বীনের অনুসারী হতো, তাকে ডেকে সে দুইটি বিকল্পের একটি গ্রহণের কথা বলত। প্রথম বিকল্প হলো, তার মতো মূর্তিপূজারি হয়ে সত্য ধর্মকে ত্যাগ করা। অথবা দ্বিতীয় বিকল্প হলো, তার জল্লাদের হাতেই প্রাণ দেয়া। আর এ দুইটি বিকল্পের যে কোনো একটিকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করতে হয়। চিন্তাভাবনা করার সময় দেয়া হয় না। এমন অবস্থায় সে রাজ্যের কয়েকজন যুবককে রাজদরবারে ডেকে আনা হলো, তাদের সামনে দুইটি বিকল্প পেশ করা হলো। তবে তাদের বয়সের দিকে খেয়াল করে রাজা তাদের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হলো।

তাদের কয়েক দিন চিন্তাভাবনা করার সুযোগ দেয়া হলো,যা অন্যদের দেয়া হয় না। তারা রাজদরবার থেকে বেরিয়ে গেল। এরপর অনেক চিন্তাভাবনার পর সিদ্ধান্ত করল তারা এ দুই বিকল্পের একটিকেও গ্রহণ করতে চায় না।

বরং তারা অন্য কোথাও গিয়ে আত্মগোপন করবে এবং সত্য ধর্মে থেকে আল্লাহর ইবাদত করবে। পরে রাজার উৎপীড়ন থেকে নিজেদের ঈমান ও জীবন রক্ষার জন্য পাহাড়ের একটি গর্তে আশ্রয় নিয়েছিল। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে গুহার ভেতর প্রায় ৩০৯ বছর ঘুমিয়ে রেখেছিলেন। যখন তারা ঘুম থেকে জাগ্রত হল, তাদের একজন সাথীকে একটি মুদ্রা দিয়ে খাবার কিনে আনার জন্য পাঠাল। যখন সে শহরে প্রবেশ করল, দেখতে পেল পুরো শহর সম্পূর্ণরূপে বদলে গেছে। দোকানী এত প্রাচীন মুদ্রা দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেল।

সে মনে করল, এই যুবক কোনো ধরনের ধনভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছে এবং সে এই মুদ্রার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইল। যুবকটি এমন বিপত্তির মুখে পড়ে আরও অধিক বিস্মিত হল।বিষয়টি শেষ পর্যন্ত রাজ দরবার পর্যন্ত গড়াল।

রাজা যুবকটির কাহিনী শুনে বিস্মিত হলেন। অতঃপর তার সভাসদদের সঙ্গে নিয়ে সেই গুহার কাছে গেলেন এবং যুবকদেরকে তাদের জন্য দুআ করতে বললেন। পরবর্তীতে তারা সেই একই গুহার মধ্যেই বসবাস করতে লাগল এবং মৃত্যু বরণকরল। একটি কুকুরও তাদের সাথে ছিল নাম ছিল ‘কিতমির’। কুকুরসহ এদেরকে আসহাবে কাহফ বা গুহাবাসী বলা হয়৷

‪-চলুন কুরআনে পাকের আসহাবে কাহাফের আয়াতগুলি পড়ি :

أَمْ حَسِبْتَ أَنَّ أَصْحَابَ الْكَهْفِ وَالرَّقِيمِ كَانُوا مِنْ آيَاتِنَا عَجَبًا
আপনি কি ধারণা করেন যে, গুহা ও গর্তের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ছিল?

إِذْ أَوَى الْفِتْيَةُ إِلَى الْكَهْفِ فَقَالُوا رَبَّنَا آتِنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً وَهَيِّئْ لَنَا مِنْ أَمْرِنَا رَشَدًا
যখন যুবকরা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয়গ্রহণ করে তখন দোআ করেঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে নিজের কাছ থেকে রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্যে আমাদের কাজ সঠিকভাবে পূর্ণ করুন।
فَضَرَبْنَا عَلَى آذَانِهِمْ فِي الْكَهْفِ سِنِينَ عَدَدًا

তখন আমি কয়েক বছরের জন্যে গুহায় তাদের কানের উপর নিদ্রার পর্দা ফেলে দেই।

ثُمَّ بَعَثْنَاهُمْ لِنَعْلَمَ أَيُّ الْحِزْبَيْنِ أَحْصَى لِمَا لَبِثُوا أَمَدًا

অতঃপর আমি তাদেরকে পুনরত্থিত করি,একথা জানার জন্যে যে, দুই দলের মধ্যে কোন দল তাদের অবস্থানকাল সম্পর্কে অধিক নির্ণয় করতে পারে।
نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ نَبَأَهُم بِالْحَقِّ إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى

আপনার কাছে তাদের ইতিবৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল কয়েকজন যুবক। তারা তাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

وَرَبَطْنَا عَلَى قُلُوبِهِمْ إِذْ قَامُوا فَقَالُوا رَبُّنَا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَن نَّدْعُوَ مِن دُونِهِ إِلَهًا لَقَدْ قُلْنَا إِذًا شَطَطًا

আমি তাদের মন দৃঢ় করেছিলাম, যখন তারা উঠে দাঁড়িয়েছিল। অতঃপর তারা বললঃ আমাদের পালনকর্তা আসমান ও যমীনের পালনকর্তা আমরা কখনও তার পরিবর্তে অন্য কোন উপাস্যকে আহবান করব না। যদি করি, তবে তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ হবে।

هَؤُلَاء قَوْمُنَا اتَّخَذُوا مِن دُونِهِ آلِهَةً لَّوْلَا يَأْتُونَ عَلَيْهِم بِسُلْطَانٍ بَيِّنٍ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا

এরা আমাদেরই স্ব-জাতি, এরা তাঁর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে। তারা এদের সম্পর্কে প্রকাশ্য প্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, তার চাইতে অধিক গোনাহগার আর কে?

وَإِذِ اعْتَزَلْتُمُوهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ فَأْوُوا إِلَى الْكَهْفِ يَنشُرْ لَكُمْ رَبُّكُم مِّن رَّحمته ويُهَيِّئْ لَكُم مِّنْ أَمْرِكُم مِّرْفَقًا

তোমরা যখন তাদের থেকে পৃথক হলে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের এবাদত করে তাদের থেকে, তখন তোমরা গুহায় আশ্রয়গ্রহণ কর। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের জন্যে দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ কর্মকে ফলপ্রসু করার ব্যবস্থা করবেন।

وَتَرَى الشَّمْسَ إِذَا طَلَعَت تَّزَاوَرُ عَن كَهْفِهِمْ ذَاتَ الْيَمِينِ وَإِذَا غَرَبَت تَّقْرِضُهُمْ ذَاتَ الشِّمَالِ وَهُمْ فِي فَجْوَةٍ مِّنْهُ ذَلِكَ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ مَن يَهْدِ اللَّهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِي وَمَن يُضْلِلْ فَلَن تَجِدَ لَهُ وَلِيًّا مُّرْشِدًا

তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডান দিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বামদিকে চলে যায়, অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত। এটা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম। আল্লাহ যাকে সৎপথে চালান, সেই সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি কখনও তার জন্যে পথপ্রদর্শনকারী ও সাহায্যকারী পাবেন না।

وَتَحْسَبُهُمْ أَيْقَاظًا وَهُمْ رُقُودٌ وَنُقَلِّبُهُمْ ذَاتَ الْيَمِينِ وَذَاتَ الشِّمَالِ وَكَلْبُهُم بَاسِطٌ ذِرَاعَيْهِ بِالْوَصِيدِ لَوِ اطَّلَعْتَ عَلَيْهِمْ لَوَلَّيْتَ مِنْهُمْ فِرَارًا وَلَمُلِئْتَ مِنْهُمْ رُعْبًا

তুমি মনে করবে তারা জাগ্রত, অথচ তারা নিদ্রিত। আমি তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাই ডান দিকে ও বাম দিকে। তাদের কুকুর ছিল সামনের পা দুটি গুহাদ্বারে প্রসারিত করে। যদি তুমি উঁকি দিয়ে তাদেরকে দেখতে, তবে পেছন ফিরে পলায়ন করতে এবং তাদের ভয়ে আতংক গ্রস্ত হয়ে পড়তে।

وَكَذَلِكَ بَعَثْنَاهُمْ لِيَتَسَاءلُوا بَيْنَهُمْ قَالَ قَائِلٌ مِّنْهُمْ كَمْ لَبِثْتُمْ قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ قَالُوا رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثْتُمْ فَابْعَثُوا أَحَدَكُم بِوَرِقِكُمْ هَذِهِ إِلَى الْمَدِينَةِ فَلْيَنظُرْ أَيُّهَا أَزْكَى طَعَامًا فَلْيَأْتِكُم بِرِزْقٍ مِّنْهُ وَلْيَتَلَطَّفْ وَلَا يُشْعِرَنَّ بِكُمْ أَحَدًا

আমি এমনি ভাবে তাদেরকে জাগ্রত করলাম, যাতে তারা পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের একজন বললঃ তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ? তাদের কেউ বললঃ একদিন অথবা একদিনের কিছু অংশ অবস্থান করছি। কেউ কেউ বললঃ তোমাদের পালনকর্তাই ভাল জানেন তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ। এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ শহরে প্রেরণ কর; সে যেন দেখে কোন খাদ্য পবিত্র। অতঃপর তা থেকে যেন কিছু খাদ্য নিয়ে আসে তোমাদের জন্য; সে যেন নম্রতা সহকারে যায় ও কিছুতেই যেন তোমাদের খবর কাউকে না জানায়।

إِنَّهُمْ إِن يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ يَرْجُمُوكُمْ أَوْ يُعِيدُوكُمْ فِي مِلَّتِهِمْ وَلَن تُفْلِحُوا إِذًا أَبَدًا
তারা যদি তোমাদের খবর জানতে পারে, তবে পাথর মেরে তোমাদেরকে হত্যা করবে, অথবা তোমাদেরকে তাদের ধর্মে ফিরিয়ে নেবে। তাহলে তোমরা কখনই সাফল্য লাভ করবে না।

وَكَذَلِكَ أَعْثَرْنَا عَلَيْهِمْ لِيَعْلَمُوا أَنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَأَنَّ السَّاعَةَ لَا رَيْبَ فِيهَا إِذْ يَتَنَازَعُونَ بَيْنَهُمْ أَمْرَهُمْ فَقَالُوا ابْنُوا عَلَيْهِم بُنْيَانًا رَّبُّهُمْ أَعْلَمُ بِهِمْ قَالَ الَّذِينَ غَلَبُوا عَلَى أَمْرِهِمْ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَيْهِم مَّسْجِدًا

এমনিভাবে আমি তাদের খবর প্রকাশ করে দিলাম, যাতে তারা জ্ঞাত হয় যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কেয়ামতে কোন সন্দেহ নেই। যখন তারা নিজেদের কর্তব্য বিষয়ে পরস্পর বিতর্ক করছিল, তখন তারা বললঃ তাদের উপর সৌধ নির্মাণ কর। তাদের পালনকর্তা তাদের বিষয়ে ভাল জানেন। তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল, তারা বললঃ আমরা অবশ্যই তাদের স্থানে মসজিদ নির্মান করব।

سَيَقُولُونَ ثَلَاثَةٌ رَّابِعُهُمْ كَلْبُهُمْ وَيَقُولُونَ خَمْسَةٌ سَادِسُهُمْ كَلْبُهُمْ رَجْمًا بِالْغَيْبِ وَيَقُولُونَ سَبْعَةٌ وَثَامِنُهُمْ كَلْبُهُمْ قُل رَّبِّي أَعْلَمُ بِعِدَّتِهِم مَّا يَعْلَمُهُمْ إِلَّا قَلِيلٌ فَلَا تُمَارِ فِيهِمْ إِلَّا مِرَاء ظَاهِرًا وَلَا تَسْتَفْتِ فِيهِم مِّنْهُمْ أَحَدًا

অজ্ঞাত বিষয়ে অনুমানের উপর ভিত্তি করে এখন তারা বলবেঃ তারা ছিল তিন জন; তাদের চতুর্থটি তাদের কুকুর। একথাও বলবে; তারা পাঁচ জন। তাদের ছষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর। আরও বলবেঃ তারা ছিল সাত জন। তাদের অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর। বলুনঃ আমার পালনকর্তা তাদের সংখ্যা ভাল জানেন। তাদের খবর অল্প লোকই জানে। সাধারণ আলোচনা ছাড়া আপনি তাদের সম্পর্কে বিতর্ক করবেন না এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে তাদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ ও করবেন না।
وَلَا تَقُولَنَّ لِشَيْءٍ إِنِّي فَاعِلٌ ذَلِكَ غَدًا
আপনি কোন কাজের বিষয়ে বলবেন না যে, সেটি আমি আগামী কাল করব।
إِلَّا أَن يَشَاء اللَّهُ وَاذْكُر رَّبَّكَ إِذَا نَسِيتَ وَقُلْ عَسَى أَن يَهْدِيَنِ رَبِّي لِأَقْرَبَ مِنْ هَذَا رَشَدًا
‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে’ বলা ব্যতিরেকে। যখন ভুলে যান, তখন আপনার পালনকর্তাকে স্মরণ করুন এবং বলুনঃ আশা করি আমার পালনকর্তা আমাকে এর চাইতেও নিকটতম সত্যের পথ নির্দেশ করবেন।
وَلَبِثُوا فِي كَهْفِهِمْ ثَلَاثَ مِائَةٍ سِنِينَ وَازْدَادُوا تِسْعًا
তাদের উপর তাদের গুহায় তিনশ বছর, অতিরিক্ত আরও নয় বছর অতিবাহিত হয়েছে।
قُلِ اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثُوا لَهُ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَبْصِرْ بِهِ وَأَسْمِعْ مَا لَهُم مِّن دُونِهِ مِن وَلِيٍّ وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا

বলুন : তারা কতকাল অবস্থান করেছে, তা আল্লাহই ভাল জানেন। নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলের অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই কাছে রয়েছে। তিনি কত চমৎকার দেখেন ও শোনেন। তিনি ব্যতীত তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। তিনি কাউকে নিজ কর্তৃত্বে শরীক করেন না। (সূরা কাহফ- আয়াতঃ ৯-২৬ )

অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা এই ঘটনা যেভাবে বিশ্বাস করে থাকে,

তখন ইফেস ছিলো রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে, আর সেই সময়ে রোমান সম্রাট ছিলেন গাইয়াস মেসসিয়াস কুইন্টাস ডেসিয়াস অগাস্টাস- বিশাল বড় নাম!

সংক্ষেপে সম্রাট ডেসিয়াস নামেই আমরা ডাকতে পারি। তিনি ছিলেন কড়া খ্রিষ্টান বিরোধী সম্রাট এবং মূর্তিপূজক। তিনি যারা খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারী ছিলেন তাদের গণহারে হত্যা করতে লাগলেন। এই কাজেই তিনি এলেন ইফেস শহরে। তৈরী করলেন মন্দির, স্থাপন করলেন বহু মূর্তি, আদেশ দিলেন শহরের সবাইকে এই মূর্তিগুলোকে পূজা করার এবং পশু উৎসর্গ করতে। যারা এই আদেশ অমান্য করতে লাগলো, নির্বিচারে তাদের হত্যা করা হতে লাগলো।

ঠিক তখন ইফেস-এ সাতজন ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান যুবক ছিলেন- ম্যাক্সিমিয়ান, মালক্যাস, মারসিয়ান, ডিওনিসিয়াস, জন, সেরাপিওন এবং কন্সট্যানটাইন। তারা ছিলেন এক ইশ্বরে বিশ্বাসী খ্রীষ্টান এবং সকলেই সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান।

তারা সম্রাটের আদেশ অমান্য করে বাড়িতেই অবস্থান করতে থাকলেন এবং মূর্তিগুলোকে পূজা করতে অস্বীকৃতি জানালেন। যথাসময়ে সম্রাটের কাছে এই খবর পৌঁছে গেলো। এই সাত যুবককে সম্রাটের সামনে আনা হলো এবং তারা একেশ্বরবাদ বাদ দিয়ে পৌত্তলিকতার অনুসারী হতে আবারো অস্বীকৃতি জানালেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় সম্রাট সঙ্গে সঙ্গে এদেরকে হত্যা করার আদেশ দিলেন না। তিনি এই সাতজন যুবককে আরো একদিন ভাবার সুযোগ দিলেন।

সাতজন যুবক ভাবাভাবির দিকেই গেলেন না। তারা তাদের সব সম্পত্তি গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন এবং ইফেস শহরের নিকটবর্তী সেলিওন পাহাড়ের এক গুহায় আত্মগোপন করলেন। মালক্যাস ছদ্মবেশে শহরের বাজারে গেলেন কিছু শুকনো খাবার আনার জন্য। বাজারে শুনলেন, সম্রাট তাদের খুঁজছেন।

তিনি তাড়াতাড়ি খাবার নিয়ে গুহায় আসলেন। সেখানে খাওয়ার পর এক ইশ্বরের প্রার্থনা করতে করতে তারা সকলেই একসময় ঘুমিয়ে পরলেন। ততক্ষণে সম্রাট ডেসিয়াস এই সাতজনকে আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ক্ষুদ্ধ হয়ে তিনি এদের বাবা-মাকে ধরে আনলেন, তারাও কিছু বলতে পারলেন না। শুধু বললেন, এই সাতজন যুবক তাদের সমস্ত সম্পত্তি গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছেন।

রাগান্বিত, বিক্ষুদ্ধ সম্রাট সন্দেহ করলেন যে, যুবকরা হয়তোবা সেলিওন পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু গুহার অভ্যন্তরভাগ বিশাল এবং অন্ধকার হওয়াতে কেউ ভিতরে ঢুকে খোঁজার সাহস করেননি। তাই সম্রাট এক বিশাল বড় বড় পাথর দিয়ে গুহামুখ বন্ধ করে দিলেন, যাতে এই সাতজন যুবক যদি গুহাতে আশ্রয় নেন, তাহলে ক্ষুধায় যেনো মৃত্যুবরণ করেন। সম্রাটের বাহিনীতে দুজন ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান যুবক ছিলেন, থিওডোরাস এবং রুফিনাস, তারা নিজেদেরকে গোপন করে রাখতে পেরেছিলেন। তারা গোপনে বড় পাথরটিতে এই সাতজন যুবকের নাম এবং ঘটনার বিবরন লিপিবদ্ধ করে রাখলেন।

কিন্তু ইশ্বরের ইচ্ছায় সম্রাট ডেসিয়াস পরের বছরেই, অর্থাৎ ২৫১ খ্রীষ্টাব্দে নিজেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে খুন হয়ে গেলেন। সেই সাতজন যুবক খুন হলেন না, কিন্তু তাদের কি অবস্থা হলো- সেটাও আর কেউ জানতে পারলেন না। ধীরে ধীরে একসময়ে দৃশ্যপটের আড়ালে হারিয়ে গেলেন সেলিওন পাহাড়ের এক গুহায় আত্মগোপনকারী সেই সাতজন ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান যুবক।

সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সেই ঘটনার পর একশত চুরাশি বছর পেরিয়ে গেলো। রোমান সাম্রাজ্যে তখন খ্রীষ্টান ধর্মের শুধু প্রচারই হচ্ছে না, ততদিনে তা রাস্ট্রীয় ধর্মও বটে। রোমের ক্ষমতায় তখন সম্রাট থিওডেসিয়াস দ্বিতীয়, আর সময়কালটা তখন ৪৩৪ খ্রীষ্টাব্দ।

ধার্মিক সম্রাট থিওডোসিয়াস তখন মারাত্মক এক সংকটের মুখে। মৃত্যুর পর শেষ বিচারের দিনে মানুষের পুনরুজ্জীবন হবে না- এই অধর্মীয় মতবাদ তখন প্রচার পাওয়া শুরু হয়েছে, বিশেষ করে ইফেসেই এর প্রচলনটা হচ্ছিল বেশি করে। ঠিক সেই সময়ে এক ইফেসবাসী, নাম ছিলো ডালিয়াস, তিনি ছিলেন সেলিওন পাহাড়ের মালিক, সিদ্ধান্ত নিলেন সেই পাহাড়ে একটি আস্তাবল তৈরী করবেন। তার লোকেরা আস্তাবল তৈরীর জন্য পাথর খোঁজার সময় দেখলেন এক গুহার প্রবেশপথ তৈরী করা পাথরদিয়ে বন্ধ করা। তারা সেই পাথরগুলো দিয়ে আস্তাবল তৈরী করার জন্য পাথরগুলো সরাতে লাগলেন।

সেই দিনের মধ্যে একজন বের হবার মতো পাথর সরানো হলে, তারা কাজ বন্ধ রেখে চলে যান, পরের দিন এসে আবার কাজ শুরু করবেন বলে। সেদিনই সেই সাতজন যুবকের ঘুম ভাঙ্গলো।

তাদের ঘুম এমনভাবে ভাঙ্গলো, যেনো তাদের কাছে মনে হলো তারা মাত্র একরাত ঘুমিয়েছেন। ঘুম থেকে উঠে তারা মালক্যাসকে জিজ্ঞেস করলেন, গতরাতে বাজারে কি শুনে এসেছেন তিনি? মালক্যাস বললেন, “ডেকিয়াস আমাদের খুঁজছে, খুঁজে পেলে আমাদের হত্যা করবে”, “না, সেটা আমরা হতে দিতে পারি না,” সঙ্গে সঙ্গে বললেন ম্যাক্সিমিয়ান। খাবারের প্রয়োজনে তারা আবার মালক্যাসকে পাঁচটি মুদ্রাসহ বাজারে পাঠালেন, আর সর্বশেষ খবর নিয়ে আসতে বললেন।

মালক্যাস পাঁচটি মুদ্রা নিয়ে বাজারে এলেন। গুহা থেকে বের হবার সময় গুহামুখে বিশাল বিশাল পাথরগুলো দেখে মালক্যাস খুব অবাক হলেও, তিনি শহরের দিকে এগিয়ে গেলেন। আরো অবাক কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছিলো!

যখন শহরের ফটকের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, ফটকে দেখলেন ক্রস চিহ্ন- খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতীক। তিনি অন্য ফটক দিয়ে শহরে ঢুকতে চাইলেন, সেখানেও একই চিহ্ন দেখলেন, দেখলেন শহরের সবগুলো প্রবেশ ফটকেই।

মালক্যাস ভাবলেন, তিনি স্বপ্ন দেখছেন! চোখ কচলে শহরে ঢুকলেন এবং রুটি কেনার জন্য বেকারির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। পথে তিনি প্রায় সবার মুখে যিশুর কথা শুনতে পাচ্ছিলেন। তিনি আবারো অবাক হলেন। গতকাল পর্যন্ত যিশুর নাম মুখে নেওয়া নিষিদ্ধ ছিলো, আর আজ সবার ঠোটে তাঁর নাম! তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তিনি ইফেস-এ আছেন! একজন পথিককে জিজ্ঞেস করলেন, শহরের নাম কি? ‘ইফেস’ শুনে তিনি আবারো বিভ্রান্ত হলেন! বেকারীতে যখন রুটি কেনার জন্য মুদ্রা দিলেন, দোকানী মুদ্রাটি দেখে অদ্ভূতভাবে তাকিয়ে রইলেন, আশেপাশের দোকানীদের সাথে ফিসফাস করতে লাগলেন। মালক্যাস ভাবলেন, তিনি হয়তোবা ধরা পড়ে গেছেন, দোকানী বোধহয় তাকে সম্রাটের কাছে ধরিয়ে দিবে। এই চিন্তা করে তিনি যখনই দোকান ছেড়ে চলে আসতে যাবেন, দোকানী খোপ করে তার হাত ধরলেন, “তুমি যেই হও না কেনো, মনে হচ্ছে তুমি এক গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছ। আমাদেরকে সেই গুপ্তধন দেখাও এবং আমরা অংশীদার হবো”, মালক্যাস ভীষন ভয় পেয়ে গেলেন। কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না। ততক্ষনে দোকানীরা তার গলায় দড়ি লাগিয়ে শহরের মাঝখানে টেনে নিয়ে গেলো। আশেপাশের বহু মানুষও জমে গেলো। মালক্যাস নিজের নির্দোষিতা বার বার বলছিলেন এবং ভীড়ের মধ্যে পরিচিত মুখ খুঁজছিলেন। কিন্তু তাকেও কেউ চিনতে পারছিলেন না, তিনিও কাউকেই চিনতে পারছিলেন না।

এরই মধ্যে শহরের বিশপ সেইন্ট মার্টিন এবং গভর্নর এন্টিপাটেরের কাছেও এই খবর পৌঁছে গেলো। তারা মালক্যাসকে তাদের কাছে নিয়ে যেতে বললেন। সেখানে মালক্যাসের কাছে জানতে চাইলেন, কোথায় সে গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছে। “আমি কোথাও গুপ্তধন খুঁজে পাই নি, আর এই মুদ্রাটি আমার, কোনো গুপ্তধন নয়”।

– তাহলে তুমি কোথা থেকে এসেছ?
– আমি ইফেস-এরই সন্তান।
– তাহলে তোমার বাবা-মা বা কোন আত্মীয়-স্বজন নিশ্চয়ই আছেন এই শহরে?
– নিশ্চয়ই।

মালক্যাস তখন তার বাবা-মায়ের নাম বললেন, কিন্তু কোনো ব্যক্তিই তাদেরকে চিনতে পারলেন না। গভর্নর ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বললেন, “এতোবড় সাহস তোমার! যে মুদ্রার গায়ে একশত চুরাশি বছর আগের তারিখ খোদাই করা, যে মুদ্রা ডেকিয়াসের শাসনামলের শেষের দিকের মুদ্রা, সেটা তোমার মুদ্রা হয় কি করে! আর বাবা- মা বা আত্মীয় হিসেবে যাদের নাম বলছ, তারা ছিলো এই এলাকারই সম্ভ্রান্ত পরিবার, কিন্তু সে তো শ’খানেক বছর আগে মারা গিয়েছেন! তুমি কি আমাকে বোকা পেয়েছ? আমি তোমাকে কঠোর শাস্তি দিবো”।
মালক্যাস প্রমাদ গুণলেন। বিভ্রান্ত কন্ঠে তিনি বললেন, “আমি আপনাদের সব প্রশ্নেরই জবাব দিবো, তার আগে আপনারা আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিন। সম্রাট ডেকিয়াস এখন কোথায় গেছেন?

– ডেকিয়াস নামে এখন কোনো সম্রাট নেই। তিনি বহু বছর আগে মারা গেছেন (বিশপ জবাব দিলেন)।
– আমি যতই শুনছি, ততই বিভ্রান্ত হচ্ছি। আমি আপনাদেরকে আমার বন্ধুদের কাছে নিয়ে যাবো, যারা গতকালকেই নিষ্ঠুর সম্রাট ডেকিয়াসের ভয়ে সেলিওন পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছি।

তখন মালক্যাস তাদেরকে নিয়ে গুহার উদেশ্যে রওয়ানা দিলেন, তার সাথে সাথে এলাকার অধিবাসীরাও পিছু নিলেন। প্রথমে গুহার ভিতরে মালক্যাস প্রবেশ করলেন। তিনি তার বন্ধুদের সবকিছু খুলে বললেন। এদিকে গুহামুখের পাশের এক পাথরের গায়ে উৎকীর্ণ লিপি বিশপের নজরে আসে। তিনি পড়া শুরু করলেন থিওডোরাস এবং রুফিনাসের লিখে যাওয়া সেই সাত যুবকের গুহায় জীবিত আটকে রাখার কাহিনী। বিশপসহ এলাকার অধিবাসীদের কাছে তখন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো। তারা ইশ্বরের গুণগান করতে লাগলেন। কিছুক্ষন পর যখন বিশপ গুহার ভিতরে প্রবেশ করলেন, দেখলেন মালক্যাসসহ সাতজন সুদর্শন যুবক গুহার গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছেন। দ্যুতি ছড়াচ্ছে যেনো তাদের মুখমন্ডল থেকে।

একসময় এই খবর পৌঁছে গেলো সম্রাট থিওডোসিয়াসের কাছে। তিনিও এই যুবকদের সাথে দেখা করার জন্য ইফেস-এ শহরে এলেন। যুবকদের সাথে কথা বললেন, তাদেরকে সম্মান দেখালেন। ম্যাক্সিমিয়ান বললেন, “মানুষ মৃত্যুর পর শেষ বিচারের দিনে পুনরুজ্জীবিত হবে, এটাই ইশ্বরের ইচ্ছা। সেই স্বাক্ষী দেবার জন্যই হয়তোবা তিনি আজ আমাদের জাগিয়ে তুলেছেন”।

এরপর যুবকরা আবার ধ্যানমগ্ন হলেন, এবং এবার সত্যি সত্যি মারা গেলেন। সম্রাট থিওডোসিয়াস গুহার উপর পাথর দিয়ে এক বিশাল সৌধ নির্মান করতে চাইলেন। কিন্তু তিনি রাতে সেই যুবকদের স্বপ্ন দেখলেন। তারা স্বপ্নে সম্রাট থিওডোসিয়াসকে বললেন, সেখানে সৌধ না করে একটি ইবাদতখানা করতে। সম্রাট পরে সেটাই করেন। যুগ যুগ ধরে সেটা এক তীর্থস্থান হিসেবেই পরিগণিত হয়ে আসছিলো।

অসাধারণ ধর্মীয় ভাবধারাপুষ্ট একটি গল্প। গল্পটিতে দেওয়া সময়কাল অনুযায়ী যুবকদের ঘুম ভেঙ্গেছিলো ৪৩৪ খ্রীষ্টাব্দের দিকে। লক্ষ্যনীয় ব্যাপার এই যে, গল্পটি ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান যুবকদের নিয়ে হলেও এটি কখনই ওল্ড টেষ্টামেন্ট বা নিউ টেষ্টামেন্টের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, এখানে দেখা যাচ্ছে প্রাচীনকালে ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টানরা যিশুকে খোদার সন্তান হিসেবে গন্য করতেন না, তারা প্রকৃত একেশ্বরবাদেরই উপাসনা করতেন।

গল্পটি প্রথম বর্ণনা করেন ইফেসেরই বিশপ স্টেফান অব ইফেস, ৪৪৮ থেকে ৪৫১ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে। ঘটনাটি ঘটার প্রায় ১৪ বছর তিনি বর্ণনা করেন, সম্ভবত গ্রীক ভাষায়। আর এই ঘটনা সর্বপ্রথম লিপিবদ্ধ করেন এক সিরিয়ান বিশপ, জ্যাকোব অব সেরুগ (জীবনকালঃ ৪৫২-৫২১ খ্রীষ্টাব্দ), যিনি জন্মগ্রহনই করেন ঘটনাটি ঘটার কয়েক বছর পর। তিনি ৪৭৪ খ্রীষ্টাব্দের দিকে ধর্মোপদেশগুলো কবিতার আকারে লেখা শুরু করেন, সেখানেই এই সাত ঘুমন্ত যুবকের কথা তিনি লিখেন। ঠিক কতসালের দিকে এটি লিখেন, সেটা বলা কষ্টসাধ্য। জ্যাকোব অব সেরুগের লেখাটা ছিলো সিরিয়ান ভাষায়। উপরের গল্পটির উৎস হচ্ছে জ্যাকোব অব সেরুগের লেখা। এরপর গ্রেগরি অব টোরাসই বোধহয় সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি এই ঘটনাকে ৫২৫ খ্রীষ্টাব্দের কিছু পরে তার ল্যাটিন ভাষায় লিখিত Gloria Martyrum-এ লিখে ইউরোপবাসীর কাছে পরিচিত করে তুলেন।

এর বেশকিছু বছর পরেই মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরানে গুহাবাসী কয়েকজন যুবকদের নিয়ে একটি সূরা নাযিল হয়। কোরান শরীফের আঠার নম্বর সূরা কাহ’ফের ৯ থেকে ২৬ আয়াত পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা এই গুহাবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন। কিন্তু কোরানে বর্নিত গুহাবাসী এবং উপরের বর্নিত গুহাবাসী আদৌ একই কি না, সেই বিষয়ে আলোচনা সবশেষে করা যাবে, তার আগে আরো অন্যান্য বর্ণনায় আসি।

গ্রেগরি অব টোরাসের পর মধ্যযুগে এই কাহিনী সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয় দ্য গোল্ডেন লিজেন্ড অব জ্যাকোবাস ডে ভোরাগিনের মাধ্যমে। সেই সময়কাল পর্যন্ত কাহিনীর সত্যতা নিয়ে খ্রীষ্টান সমাজে কারোই কোনো সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর দিকে প্রোটেষ্ট্যান্টবাদের কারণে এবং ইউরোপে রেনেসার জন্য কাহিনীর সত্যতা নিয়ে প্রথম সন্দেহ দেখা দেয়। সিজার বারোনিয়াস, রেনেসা যুগের একজন পন্ডিতই শুধু নন, ল্যাটিন চার্চের একজন কার্ডিনাল হিসেবেই প্রথম ব্যক্তি তিনি, যিনি গুহাবাসীদের ঘটনাকে ‘অপ্রামাণিক’ বলেন। এরপর থেকে ইউরোপ আর কখনোই এই ঘটনাকে ঐতিহাসিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, দিয়েছে মিথ বা লিজেন্ড বলে। এই কাহিনীর মূল থিমের উপর ভিত্তি করে সাহিত্য জগতে পরবর্তীতে অনেক গল্পও লেখা হয়েছে। এদের মধ্যে খুব বিখ্যাত হচ্ছে ওয়াশিংটন আরভিং-এর ‘রিপ ভ্যান উইংক্যাল’, এবং এইচ জি ওয়েলসের ‘দ্য স্লিপার এওয়েকস’।

রিপ ভ্যান উইংক্যাল :

কাহিনীর সূত্রপাত আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধের আগে। নিউইয়র্কের কাটস্কিল পাহাড়ের পাদদেশে সুন্দর একটি গ্রাম ছিলো তখন, সেখানে বাস করতেন এক ডাচ বংশদ্ভূত ব্রিটিশ-আমেরিকান, নাম রিপ ভ্যান উইংক্যাল। রিপ খুব বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন, কিন্তু তিনি পছন্দ করতেন নির্জনে বনে-বাদাড়ে কাজ করতে। তাই বলে বাচ্চাদের সাথে যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো, তা নয়, বরঞ্চ বাচ্চারা তাকে খুব পছন্দ করতো এবং তিনি বাচ্চাদের খেলনাও উপহার দিতেন। যদিও লাভজনক কাজ এড়িয়ে যেতেন বলে তার খুঁতখুঁতে স্ত্রী সবসময় তাকে বাড়িতে থাকতে দিতেন না।

এক শরতের দিনে তার পোষা কুকুরটি নিয়ে রিপ পাহাড়ে হাটতে বেড়াচ্ছিলেন, তখন পিছন থেকে কেউ একজন তার নাম ধরে উচ্চস্বরে ডাকলেন। রিপ দেখলেন, ডাচ পোশাক পরা এক ব্যক্তি পিপা নিয়ে পাহাড়ে উঠছেন এবং রিপের সাহায্য চাইছেন। একে অপরের সাথে কোনো কথা না বলে তারা পাহাড়ে উঠতে লাগলেন এবং গ্যালারীর মতো এমন এক জায়গায় আসলেন, সেখানে রিপ দেখলেন, ভালো পোশাক সজ্জিত কিছু দাড়িওয়ালা লোক নিরবে নাইন-পিন নামে একটি খেলা খেলছে। যদিও ওদের কারো সাথে রিপের কথা হয় নি, রিপ জিজ্ঞাসাও করেনি – ওদেরই একজন কিভাবে তার নাম জেনেছে, তবুও রিপ তাদের জন্য রাখা মদ থেকে কিছু মদ খেয়ে ফেলেন। এবং তাড়াতাড়ি তিনি ঘুমে তলিয়ে যান।

তিনি যখন ঘুম থেকে উঠেন, তখন দেখেন এটা সকাল। তার সাথের বন্দুকটিতে জং ধরে গিয়েছে, তার দাড়ি এক ফুটের মতো লম্বা হয়ে গেছে এবং তার কুকুরটিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। রিপ তার গ্রামে ফিরে গেলেন, সেখানে কাউকে চিনতে পারলেন না। আশেপাশের মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, তার স্ত্রী মারা গেছেন এবং তার বন্ধুরাও হয় কোনো এক যুদ্ধে মারা গেছেন বা কোথাও চলে গেছেন। তিনি বিপদে পড়ে গেলেন, যখন নিজেকে রাজা তৃতীয় জর্জের অনুগত প্রজা বলে দাবী করেন। তিনি তখনো জানতেন না আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে, গ্রামের সরাইখানাতে রাজা জর্জের ছবির পরিবর্তে জর্জ ওয়াশিংটনের ছবি লাগানো হয়েছে। তিনি আরো অবাক হলেন যখন দেখলেন, আরো একজনকে ডাকা হচ্ছে রিপ ভ্যান উইংক্যাল নামে।

অবশেষে রিপ জানতে পারলেন, পাহাড়ে যেসব মানুষদের সাথে তার দেখা হয়েছিলো তারা ছিলেন বিখ্যাত অভিযাত্রী হেন্ড্রিক হাডসনের নাবিকদের ভূত বা আত্মা এবং রিপ প্রায় বিশ বছর পাহাড়ে ঘুমিয়েছিলেন। যাকে রিপ ভ্যান উইংক্যাল নামে ডাকা হচ্ছিলো, সে হচ্ছে এই রিপের ছেলে, এখন বড় হয়ে গেছে। গ্রামের এক বৃদ্ধ রিপকে চিনতে পারেন এবং রিপের মেয়ে তাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে রিপ অলস সময় কাটাতেন, আর সবাইকে তার কাহিনী বলতেন। যুদ্ধের বিভীষিকা দেখতে হয় নি বলে সবাই রিপের ভাগ্যকে হিংসে করতেন!

গুহাটির আরেকটি ছবি; source:Wikimedia Commons
যে বিষয় গুলি খেয়াল রাখতে হবে,

১) কুরআনে এই ঘটনার সুস্পষ্ট ভাবে জায়গার নাম দেওয়া নেই। শুধু বলা হয়েছে গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা। প্রশ্ন আসে গুহা এবং রাকীমের অধিবাসীরা- দু’টি কি একই গ্রুপ, না কি আলাদা গ্রুপ? সহীহ বুখারী শরীফে, আসহাবে কাহফ এবং আসহাবে রাকীম নামে দুটি অধ্যায় আছে। আসহাবে রাকীম অধ্যায়ে- সেই তিন ব্যক্তির কাহিনী বলা হয়েছে, যে তিন ব্যক্তি একদা পাহাড়ের এক গুহার ভিতর আটকে গিয়েছিলো, এবং পরবর্তীতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার মাধ্যমে মুক্ত হয়েছিলো। সহিহ সিত্তার অন্যতম, বুখারী শরীফের এই দুই অধ্যায় চিন্তা করলে মনে হবে, গুহাবাসী (আসহাবে কাহফ) এবং রাকীমবাসী (আসহাবে রাকীম)- দু’টি আলাদা গ্রুপ।

কিন্তু আয়াতটির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আল্লাহ শুধুমাত্র আশহাবে কাহফের কথাই বলেছেন। রাকীম যদি আলাদা গ্রুপ হতো, তাহলে এখানে আসহাবে রাকীমের কথাও আসতো। তারমানে আসহাবে কাহফ এবং রাকীম একইসাথে জড়িত। তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে- আয়াতে ‘রাকীম’ মানে কি? কোনো কোনো ইসলামী পন্ডিতের মতে, আসহাবে কাহাফের ঘটনাটি যে জনপদে ঘটেছিলো, সে জায়গার নাম রাকীম। এটি আকাবাহ ও ফিলিস্তিনের মাঝামাঝি একটি জায়গায় অবস্থিত। ‘রাকীম’ নামক জায়গা আছে এবং সেখানে আসহাবে কাহফের অস্তিত্বের খবর পাওয়া গেছে, এরকম আরো দুইটি জায়গা হচ্ছে স্পেনের গ্রানাডার একটি গ্রাম এবং জর্ডানের আম্মানের নিকটে আরেকটি গ্রাম। আবার অনেকে বলেন, এর অর্থ হচ্ছে ‘উৎকীর্ণ’, অর্থাৎ, গুহা মুখে সেই যুবকদের স্মৃতিরক্ষার্থে যে ফলক লাগানো হয়েছিলো। কোরানে অবশ্য স্মৃতিফলক লেখার কথা বলা হয় নি, তাই বলা চলে এখানে ‘রাকীম’ বলতে জায়গার নামই বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত ইফেস শহরে কোনোক্রমেই আসহাবে কাহফের অবস্থান হয় না, কারণ সেখানে ‘রাকীম’ নামে কোনো জায়গা নেই!

তাহলে বাকী তিনটি শহরের যে কোন একটি হতে পারে! ১৯৬১ সালের খনন কার্য অনুযায়ী, জর্ডানের আম্মানের নিকট রাকীম গ্রামেই আসহাবে কাহফ হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। তবে এই বিষয়ে কোরানের সর্বশেষ চূড়ান্ত কথা হচ্ছে- তাদের খবর অল্প লোকই জানে। সাধারণ আলোচনা ছাড়া আপনি তাদের সম্পর্কে বিতর্ক করবেন না এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে তাদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদও করবেন না। আর তাই আসহাবে কাহফ কোন শহরে অবস্থিত, সেটা বের না করাই ভালো। একজন মুসলমান হিসেবে বিশ্বাস করি, আল্লাহ যে জিনিস তার নবীকেও জানতে নিষেধ করেছেন, সেটা না জানাই উত্তম।

২) যুবকদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া নেই। শুধু বলা হয়েছে, কেউ কেউ বলবে ৩ জন, ৫ জন অথবা ৭ জন। লক্ষ্যনীয়- সিরিয় বর্ননামতে ৭ জনের কথা আছে। এখানেও সেই একই কথা- আল্লাহতায়ালা নিশ্চয়ই কোনো গূঢ় রহস্যের কারণে এই ব্যাপারটি স্পষ্ট করেন নি।

৩) ঘটনার সূত্রপাতঃ নির্দিষ্ট সময় বলে দেওয়া নেই।
৪) গুহার বর্ণনা এখানে দেওয়া আছে- তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডান দিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বামদিকে চলে যায়, অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত- গুহা মুখের অবস্থান কোনদিকে বা গুহার অভ্যন্তরভাগ কেমন- এই আয়াতটির মাধ্যমে তা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়।

৫) এবার ডাক্তার হিসেবে একটা কথা বলি। কোরানের এক আয়াতে আছে- আমি তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাই ডান দিকে ও বাম দিকে- একজন ডাক্তার হিসেবে জানি, টানা কয়েকদিন একই ভাবে শুয়ে থাকলে বা বসে থাকলে শরীরের Dependent part-এ ঘা হয়। ঘা যাতে না হয়, তাই প্যারালাইসিস রোগীদের শরীরের মুভমেন্ট করিয়ে দেওয়া হয় কয়েক ঘন্টা পর পর। এই আয়াতের অর্থ এটি কি না, আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু অনেকটা সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়।

৬) মধ্যবর্তী সময়ে একটি কুকুর কিভাবে তাদের পাহারা দিয়ে রেখেছে, সেটাও বলা আছে।
৭) ঘুম থেকে উঠার সময়ঃ নির্দিষ্ট সময় বলে দেওয়া নেই।
৮) মধ্যবর্তী সময়কালঃ নির্দিষ্ট করে বলা হয় নি। তবে একজায়গায় বলা হয়েছে, তিনশত বছর বা আরো অতিরিক্ত নয় বছর। কিন্তু এই বাক্যে যে তিনশ আর নয় বছরের সংখ্যা বলা হয়েছে, তা আসলে লোকদের উক্তি- এখানে বর্ণনা করা হয়েছে, এটা আল্লাহর নিজের উক্তি নয়। এর প্রমাণ হচ্ছে, পরের বাক্যেই বলা হয়েছে- বলুনঃ তারা কতকাল অবস্থান করেছে, তা আল্লাহই ভাল জানেন- যদি তিনশ আর নয় আর নিজেই বলতেন, তাহলে আল্লাহর আর পরের বাক্য বলার প্রয়োজন পরতো না। আর তাই আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (র) বলেছেন, এটি আল্লাহর উক্তি নয়, লোকদের কথার উদ্ধৃতি মাত্র।

৯) ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর গুহার উপরে ইবাদতখানা বানানো হয়েছিলো(সিরিয় বর্ননাতে এটি ছিলো)।

এখানে একটি কথা বলা যেতে পারে, যখন একদল লোক আসহাবে কাহফের উপর সৌধ করতে চেয়েছিল, পরের অংশেই আল্লাহ বলেছেন, তাদের বিষয়ে তাদের পালনকর্তা ভালো জানেন। তারমানে বোঝা যাচ্ছে, আল্লাহতায়ালা এই কাজ পছন্দ করছিলেন না। এরপর মসজিদ তৈরীর ব্যাপারটিও আল্লাহ বর্ণনাচ্ছলে বলেছেন। এছাড়া, কবরের উপর যে মসজিদ বা সৌধ তৈরী করা নিষিদ্ধ, সে ব্যাপারেও অনেক সহিহ হাদিস আছে।

বর্তমানে গুহার বাইরে এই ফলক রয়েছে source: Out Of Hadhramout
এ ঘটনা থেকে কতিপয় শিক্ষা :
১) ভবিষ্যতে কোন কাজ করতে ইচ্ছা করলে আমাদের প্রথমে ইনশা-আল্লাহ্ বলা উচিৎ।
২) একত্ববাদের এবাদত করা এবং তাঁর এবাদতে অন্য কিছুকে শরীক না করা।
৩) যুবকদের সাহসের সাথে আল্লাহর বাণী প্রচার করা জরুরী।
৪) চিন্তা ও গবেষণা করে কুরআন ও কুরআনে বর্ণিত ঘটনাগুলো অধ্যয়ন করা ।
৫) বিপদাপদে আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তাঁর দয়া কামনা করা জরুরী।
৬)প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সত্যের উপর অবিচল থাকার গুরুত্ব অপরিসীম।
৭) তিন শত নয় বছর পর তাদেরকে জীবিত করা এটাই প্রমাণ করে যে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সত্য, কিয়ামত সত্য। এতে কোন সন্দেহ নেই।রূহ এবং দেহ উভয়েরই পুনরুত্থান হবে। কেননা আসহাবে কাহাফগণ এভাবেই জীবিত হয়েছিলেন।
৮) হেদায়াত আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর বান্দার প্রতি বিরাট একটি নেয়ামত। বান্দার উচিত সর্ব অবস্থায় আল্লাহর কাছে হেদায়াত প্রার্থনা করা।
৯) আসহাবে কাহাফের ঘটনা, পরকাল বিশ্বাসের সত্যতার এক উজ্জ্বল ও অকাট্ট প্রমাণ বিশেষ। আল্লাহ তায়ালা যেভাবে আসহাবে কাহাফকে এক দীর্ঘকাল পর্যন্ত মৃত্যুর মহানিদ্রায় নিমজ্জিত রাখার পরও পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছেন, অনুরূপভাবে মৃত্যুর পরে পুনরায় জীবন দান করাও তাঁর কুদরতে সামান্যতমও অসম্ভব নয়।এছাড়াও আরও অসংখ্য শিক্ষণীয় দিক আছে উক্ত ঘটনায়।

◉ সম্মানিত বন্ধুরা “আসুন ইসলামের রাহে উম্মতে মুহাম্মদীর মুক্তির কথা বলি ”
আললাহপাক যেন আমাদের সবাইকে গভীরভাবে পবিত্র কুরআন,হাদিস সঠিকভাবে অধ্যয়ন করার সে তৌফিক দান করুন। আমিন,সুম্মা আমিন।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ

আসহাবে কাহাফ দ্বারা সাতজন গুহাবাসীকে বুঝানো হয়।
তারা যে গুহায় ছিলেন সেটি জিনঝিয়াং উইঘুর অটোনোমাস অঞ্চলের তুরপান নামক স্থানে অবস্থিত।

(না তারা জীবিত নেই)

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ
Waruf

Call

না তাহারা আর জীবিত নাই। 

আসহাবে কাহাফ হচ্ছে ৭ জন গুহাবাসী ও একটি কুকুর। রোমান রাজার রোষানলে পড়ে তাহারা গুহায় আশ্রয় গ্রহন করে। তখন একটি কুকুরও গুহায় প্রবেশ করে ও গুহামুখেই থাকে। এক সময় তাহারা ঘুমিয়ে পড়ে। বাহ্যিক সময় অনুযায়ী তাহারা ৩০০ বছর ঘুমায়। কিন্তু ওরা যখন জেগে ওঠে তখন ওরা ভাবছিল যে ওরা মনে হয় একদিন ঘুমিয়েছে তাই তারা খাবার কিনতে তাদের কাছে থাকা কিছু মুদ্রা নিয়া বের হয়ে বাজারে যান কিন্তু তারা কিছু পরিবর্তন দেখেও ভাবেননি। কিন্তু দোকানদার টাকা নিয়া বুঝতে পারল এটি বহু পুরানা মূদ্রা। একসময়ে সেখানেই তারা অন্যদের কথা ইতিহাস শুনে বুঝতে পারলেন তারা বহুদিন গুহায় ছিলেন। এই অলৌকিক ব্যাপার বুঝতে পেরে তাহারা আল্লাহুর ইবাদাত শুরু করলেন এবং ইবাদাতরত অবস্থায় মারা গেলেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/আল-কাহফ

https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%86%E0%A6%B8%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87_%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%AB

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ
Call

বিষয় গুলি খেয়াল রাখতে হবে,

১) কুরআনে এই ঘটনার সুস্পষ্ট ভাবে জায়গার নাম দেওয়া নেই। শুধু বলা হয়েছে গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা। প্রশ্ন আসে গুহা এবং রাকীমের অধিবাসীরা- দু’টি কি একই গ্রুপ, না কি আলাদা গ্রুপ? সহীহ বুখারী শরীফে, আসহাবে কাহফ এবং আসহাবে রাকীম নামে দুটি অধ্যায় আছে। আসহাবে রাকীম অধ্যায়ে- সেই তিন ব্যক্তির কাহিনী বলা হয়েছে, যে তিন ব্যক্তি একদা পাহাড়ের এক গুহার ভিতর আটকে গিয়েছিলো, এবং পরবর্তীতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার মাধ্যমে মুক্ত হয়েছিলো। সহিহ সিত্তার অন্যতম, বুখারী শরীফের এই দুই অধ্যায় চিন্তা করলে মনে হবে, গুহাবাসী (আসহাবে কাহফ) এবং রাকীমবাসী (আসহাবে রাকীম)- দু’টি আলাদা গ্রুপ।

কিন্তু আয়াতটির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আল্লাহ শুধুমাত্র আশহাবে কাহফের কথাই বলেছেন। রাকীম যদি আলাদা গ্রুপ হতো, তাহলে এখানে আসহাবে রাকীমের কথাও আসতো। তারমানে আসহাবে কাহফ এবং রাকীম একইসাথে জড়িত। তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে- আয়াতে ‘রাকীম’ মানে কি? কোনো কোনো ইসলামী পন্ডিতের মতে, আসহাবে কাহাফের ঘটনাটি যে জনপদে ঘটেছিলো, সে জায়গার নাম রাকীম। এটি আকাবাহ ও ফিলিস্তিনের মাঝামাঝি একটি জায়গায় অবস্থিত। ‘রাকীম’ নামক জায়গা আছে এবং সেখানে আসহাবে কাহফের অস্তিত্বের খবর পাওয়া গেছে, এরকম আরো দুইটি জায়গা হচ্ছে স্পেনের গ্রানাডার একটি গ্রাম এবং জর্ডানের আম্মানের নিকটে আরেকটি গ্রাম। আবার অনেকে বলেন, এর অর্থ হচ্ছে ‘উৎকীর্ণ’, অর্থাৎ, গুহা মুখে সেই যুবকদের স্মৃতিরক্ষার্থে যে ফলক লাগানো হয়েছিলো। কোরানে অবশ্য স্মৃতিফলক লেখার কথা বলা হয় নি, তাই বলা চলে এখানে ‘রাকীম’ বলতে জায়গার নামই বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত ইফেস শহরে কোনোক্রমেই আসহাবে কাহফের অবস্থান হয় না, কারণ সেখানে ‘রাকীম’ নামে কোনো জায়গা নেই!

তাহলে বাকী তিনটি শহরের যে কোন একটি হতে পারে! ১৯৬১ সালের খনন কার্য অনুযায়ী, জর্ডানের আম্মানের নিকট রাকীম গ্রামেই আসহাবে কাহফ হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। তবে এই বিষয়ে কোরানের সর্বশেষ চূড়ান্ত কথা হচ্ছে- তাদের খবর অল্প লোকই জানে। সাধারণ আলোচনা ছাড়া আপনি তাদের সম্পর্কে বিতর্ক করবেন না এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে তাদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদও করবেন না। আর তাই আসহাবে কাহফ কোন শহরে অবস্থিত, সেটা বের না করাই ভালো। একজন মুসলমান হিসেবে বিশ্বাস করি, আল্লাহ যে জিনিস তার নবীকেও জানতে নিষেধ করেছেন, সেটা না জানাই উত্তম।

২) যুবকদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া নেই। শুধু বলা হয়েছে, কেউ কেউ বলবে ৩ জন, ৫ জন অথবা ৭ জন। লক্ষ্যনীয়- সিরিয় বর্ননামতে ৭ জনের কথা আছে। এখানেও সেই একই কথা- আল্লাহতায়ালা নিশ্চয়ই কোনো গূঢ় রহস্যের কারণে এই ব্যাপারটি স্পষ্ট করেন নি।

৩) ঘটনার সূত্রপাতঃ নির্দিষ্ট সময় বলে দেওয়া নেই।
৪) গুহার বর্ণনা এখানে দেওয়া আছে- তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডান দিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বামদিকে চলে যায়, অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত- গুহা মুখের অবস্থান কোনদিকে বা গুহার অভ্যন্তরভাগ কেমন- এই আয়াতটির মাধ্যমে তা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ
Call

জনাকয়েক পলাতক যুবক, একটি গুহা আর তিন শতাব্দীর নিদ্রা- আসহাবে কাহাফের কাহিনী কেবল মুসলিমদের কাছেই প্রবল জনপ্রিয় একটি ঘটনা নয়, বরং খ্রিস্টানদের কাছেও ছিল খুব জনপ্রিয় ও অলৌকিক ঘটনা। কুরআনে বর্ণিত এই কাহিনীর সাথে সাথে সেই সিরিয়ান উপাখ্যান এবং যে নগরীতে এই ঘটনা ঘটেছিল- সবই আমরা এ লেখায় আলোচনা করার চেষ্টা করব।

মধ্যযুগীয় চিত্রকর্মে সেভেন স্লিপার্স; source: The Onion Dome

শুরুতেই বলে রাখা দরকার, এই ঘটনাটি কুরআনে বর্ণিত বিধায়, মুসলিমদের বিশ্বাস ওতপ্রোতভাবে এর সাথে জড়িত। অনেক পাঠকই অভিযোগ করে থাকেন বিধায়, কুরআনের আয়াত বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করার সময় কেবল ইসলামিক সূত্র ব্যবহার করা হবে, এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে তাফসির ইবনে কাসিরের বঙ্গানুবাদের চতুর্দশ খণ্ড। তবে কুরআনে যে ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে, সেটি কুরআন অবতরণের কয়েক শতাব্দী আগের ঘটনা এবং সেটার বিস্তারিত বিবরণও দেওয়া হবে, সেজন্য আমরা ব্যবহার করব ৫ম শতকের স্থানীয় সিরীয় উপকথা, ঠিক যেমনটা লিপিবদ্ধ ছিল। কাহিনীগুলোর পার্থক্য তখনই প্রতীয়মান হবে। তাহলে প্রথমে শুরু করা যাক কুরআনে বলা ঘটনাটি দিয়ে।

কুরআনের ১৮ নম্বর সুরা ‘সুরা কাহাফ’ মক্কাতে অবতীর্ণ হয়; অর্থাৎ তখনও নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর অনুসারীরা মদিনায় চলে যাননি। কিন্তু মক্কাতে তখন তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে দেখে কুরাইশরা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ে। যেহেতু নবী (সা) এমন ধর্ম প্রচার করে চলেছিলেন, যেখানে আগের নবীদের সাথে ইহুদি-খ্রিস্টানদের নবীরা মিলে যায়, তাই কুরাইশ নেতারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, তাঁরা ইহুদি র‍্যাবাইদের (আলেম) সাথে পরামর্শ করবে। নাযার ইবনে হারিস এবং উকবা ইবনে মুয়িত নামের দুজনকে তাঁরা মদিনার ইহুদি র‍্যাবাইদের কাছে প্রেরণ করে এই বলে যে, তাঁরা যেন মুহাম্মাদ (সা) এর ব্যাপারে তাদের মতামত জানায়।

তারা মদিনা পৌঁছালে ইহুদি আলেমরা তাদের কথা শুনে মীমাংসা করার জন্য একটি উপায় বাতলে দেন,

দেখো, আমরা তোমাদের মীমাংসা করার জন্য একটি কথা বলছি। তোমরা ফিরে গিয়ে তাঁকে তিনটি প্রশ্ন করবে। তিনি যদি উত্তর দিতে পারেন, তবে তিনি যে সত্য নবী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর না দিতে পারলে তিনি মিথ্যেবাদী। প্রথম প্রশ্ন: পূর্বযুগে যে যুবকেরা বেরিয়ে গিয়েছিলেন তাদের ঘটনা বর্ণনা করুন তো? এ এক বিস্ময়কর ঘটনা…”

এরকম আরো দুটি প্রশ্ন তাঁরা করতে বলেন। বাকি ঘটনা এখানে আমরা লিখছি না, তবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হিসেবেই অবতীর্ণ হয় সুরা কাহাফ (‘গুহা’)

‘আসহাবে কাহাফ’ অর্থ ‘গুহাবাসী’। এ ঘটনা ঘটেছিল প্রাচীন গ্রিক শহর আনাতোলিয়া বা এফিসাসে (Ephesus)। কাছেই ছিল গ্রিক দেবী আরটেমিসের বিখ্যাত মন্দির। বর্তমানে ভৌগোলিকভাবে শহরটি তুরস্কে পড়েছে। তবে কুরআনে অবশ্য নাম-ঠিকানা উল্লেখ করা নেই।

এই সেই এফিসাসের গুহা; source: Alamy

প্রথমে কুরআনের ভাষ্যতেই কাহিনী শুনে নেয়া যাক।তুমি কি ধারণা করো যে, গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ছিল? যখন যুবকেরা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে তখন দোয়া করে: “হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে নিজের কাছ থেকে রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্য আমাদের কাজ সঠিকভাবে পূর্ণ করুন।” তখন আমি কয়েক বছরের জন্য গুহায় তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় রাখলাম। অতঃপর আমি তাদেরকে পুনরুত্থিত করি, একথা জানার জন্যে যে, দুই দলের মধ্যে কোন দল তাদের অবস্থানকাল সম্পর্কে অধিক নির্ণয় করতে পারে। আপনার কাছে তাদের ইতিবৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল কয়েকজন যুবক। তারা তাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি তাদের মন দৃঢ় করেছিলাম, যখন তারা উঠে দাঁড়িয়েছিল। অতঃপর তারা বলল: “আমাদের পালনকর্তা আসমান ও যমীনের পালনকর্তা, আমরা কখনও তার পরিবর্তে অন্য কোনো উপাস্যকে আহবান করব না। যদি করি, তবে তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ হবে। এরা আমাদেরই স্ব-জাতি, এরা তাঁর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে। তারা এদের সম্পর্কে প্রকাশ্য প্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, তার চাইতে অধিক পাপী আর কে?” তোমরা যখন তাদের থেকে পৃথক হলে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের এবাদত করে তাদের থেকে, তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের জন্যে দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসু করার ব্যবস্থা করবেন। তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডান দিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বাম দিকে চলে যায়, অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত। এটা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম… তুমি মনে করবে তারা জাগ্রত, অথচ তারা নিদ্রিত। আমি তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাই ডান দিকে ও বাম দিকে। তাদের কুকুর ছিল সামনের পা দুটি গুহাদ্বারে প্রসারিত করে। যদি তুমি উঁকি দিয়ে তাদেরকে দেখতে, তবে পেছন ফিরে পলায়ন করতে এবং তাদের ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়তে। আমি এমনিভাবে তাদেরকে জাগ্রত করলাম, যাতে তারা পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের একজন বলল: “তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ?” তাদের কেউ বলল: “একদিন অথবা একদিনের কিছু অংশ অবস্থান করছি।” কেউ কেউ বলল: “তোমাদের পালনকর্তাই ভালো জানেন তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ। এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ শহরে প্রেরণ কর; সে যেন দেখে কোন খাদ্য পবিত্র। অতঃপর তা থেকে যেন কিছু খাদ্য নিয়ে আসে তোমাদের জন্য; সে যেন নম্রতা সহকারে যায় ও কিছুতেই যেন তোমাদের খবর কাউকে না জানায়। তারা যদি তোমাদের খবর জানতে পারে, তবে পাথর মেরে তোমাদেরকে হত্যা করবে, অথবা তোমাদেরকে তাদের ধর্মে ফিরিয়ে নেবে। তাহলে তোমরা কখনই সাফল্য লাভ করবে না।” এমনিভাবে আমি তাদের খবর প্রকাশ করে দিলাম, যাতে তারা জ্ঞাত হয় যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কেয়ামতে কোনো সন্দেহ নেই। যখন তারা নিজেদের কর্তব্য বিষয়ে পরস্পর বিতর্ক করছিল, তখন তারা বলল: “তাদের উপর সৌধ নির্মাণ কর।” তাদের পালনকর্তা তাদের বিষয়ে ভালো জানেন। তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল, তারা বলল: “আমরা অবশ্যই তাদের স্থানে উপাসনালয় নির্মাণ করব।” অজ্ঞাত বিষয়ে অনুমানের উপর ভিত্তি করে এখন তারা বলবে: তারা ছিল তিন জন, তাদের চতুর্থটি তাদের কুকুর। একথাও বলবে, তারা পাঁচ জন। তাদের ছষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর। আরও বলবে, তারা ছিল সাত জন। তাদের অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর। বলুন: আমার পালনকর্তা তাদের সংখ্যা ভালো জানেন। তাদের খবর অল্প লোকই জানে। সাধারণ আলোচনা ছাড়া তুমি তাদের সম্পর্কে বিতর্ক করবে না এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে তাদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদও করবে না… তাদের উপর তাদের গুহায় তিনশ বছর, অতিরিক্ত আরও নয় বছর অতিবাহিত হয়েছে। বল: তারা কতকাল অবস্থান করেছে, তা আল্লাহই ভালো জানেন। নভোমণ্ডল ও ভুমণ্ডলের অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই কাছে রয়েছে।” [আল কুরআন ১৮:৯-২৬]

এটুকুই কুরআন কাহিনীটি সম্পর্কে জানায়। এ বিষয়ে তাফসিরে রয়েছে অনেক অনেক বক্তব্য। যেমন- ইবনে কাসিরে একটি মতবাদ লিখিত আছে যে, উপরে আয়াতে লিখা ‘রাকীম’ বলতে ফলকে লেখা বোঝায়, গুহার বাইরে কি কোনো ফলকে করে লিখে দেওয়া হয়েছিল? আমরা কিছুক্ষণ পরেই সেটা জানতে পারব। ইবনে কাসিরে এ-ও লিখা আছে যে, যে অত্যাচারী শাসকের তাড়ায় যুবকেরা পালিয়ে যায়, তার নাম ছিল দাকইয়ানুস। তাছাড়া, যে কুকুরটি তাদের সাথে ছিল, সেটি রাজবাবুর্চির কুকুর ছিল, কুকুরের নাম কিতমির। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) নিশ্চিত করে বলেন যে, গুহাবাসীর সংখ্যা সাতজনই ছিল। কোনো কোনো মত অনুযায়ী, তাদের নাম ছিল মুকসালমিনা, তামলিখা, মারতুনিস, সানুনিস, সারিনুনিস, যুনিওয়াস, কাস্তিতিউনিস। নামগুলো দেখে বোঝা যায়, রোমান নামের আরবিকরণ করা হয়েছে।

এবার চলুন আমরা শুনে আসি সেই সিরিয়ার উপকথাটি। পঞ্চম শতকের সিরিয়ান বিশপ জ্যাকব অফ স্যারাগ এর কাছ থেকে আমরা এই ঘটনার বর্ণনা পাই, তিনি আবার সেটা সংগ্রহ করেছেন আরো আগের গ্রিক কোনো সূত্র থেকে, সেই সূত্র কালের বিবর্তনে আজ হারিয়ে গিয়েছে। এছাড়াও আরো কয়েক জায়গায় আমরা এর দেখা পাই।

এ কাহিনী অনুযায়ী, আড়াইশ সালের দিকে রোমান সম্রাট ডিসিয়াস এর শাসনকালে (২৪৯-২৫১) সাতজন তরুণ ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান যুবককে ধর্মত্যাগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পৌত্তলিক রোমান সাম্রাজ্যে তাদের জোর করা হয় পুরনো দেবদেবীদের বিশ্বাসে ফিরে যেতে। তাদের সময় দেওয়া হয় পুরনো বিশ্বাসে ফেরত আসতে, কিন্তু তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাদের সকল সম্পদ গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। এরপর তাঁরা পালিয়ে যান অক্লন পাহাড়ের এক গুহায়। সেখানে প্রার্থনা শেষে তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েন। বলা আছে, গুহার খবর পাবার পর সম্রাট তাদের সেই গুহা সিলগালা করে দেন, যেন তাঁরা ক্ষুধায় মারা যান।

গুহাটির আরেকটি ছবি; source:Wikimedia Commons

ডিসিয়াস মারা যান ২৫১ সালে। পৌত্তলিক রোমান সাম্রাজ্যের অত্যাচারিত খ্রিস্টানদের ধর্ম এক সময় রাজ্যের প্রধান ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তবে সে অনেক অনেক বছর পরের কাহিনী। কাহিনীর একটি বর্ণনা মোতাবেক, সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস (৪০৮-৪৫০) এর আমলে, গুহার সিলগালা ধ্বংস করা হয়। যিনি খুলেছিলেন, তিনি ভাবছিলেন ওটাকে গোয়ালঘর বানাবেন, তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি ভেতরে সাত জন যুবক ঘুমিয়ে। যুবকেরা ঘুম ভেঙে উঠলেন, তাঁরা ভাবলেন এক দিন পুরো ঘুমিয়ে উঠেছেন। তাদের একজনকে বাজারে পাঠানো হলো, সাবধানে বাজার করতে বলা হলো যেন কেউ চিনে না ফেলে তাদের, চিনে ফেললে অত্যাচারী রাজার পৌত্তলিক অনুসারীরা তাদের গ্রেফতার করবেন। কিন্ত শহরে গিয়ে তো যুবক ম্যাল্কাস তো অবাক! আশপাশে ক্রুশ লাগানো দালানকোঠা, লোকে প্রকাশ্যেই যীশুর নাম করছে! আবার দোকানি তাঁর মুদ্রাও নিচ্ছে না, এটা নাকি অনেক পুরনো ডিসিয়াসের আমলের মুদ্রা।

বিশপ তাদের কাছ থেকে ঘটনা শুনলেন। ধর্মপ্রাণ সম্রাট নিজে এসে তাদের সাথে কথা বললেন। সম্রাট তাদের জন্য অনেক কিছু করতে চাইলেন, কিন্তু তাঁরা না করে দিয়ে সেই গুহায় গিয়েই ঘুমালেন এবং এক সময় মারা গেলেন। অর্থোডক্স খ্রিস্টান চার্চ এই সাত মহাপ্রাণকে বছরে দুদিন স্মরণ করে ভোজ করবার রীতি করে- আগস্ট ৪ এবং অক্টোবর ২২ তারিখে।

কুরআনে যে এফিসাস শহরের এই ঘটনাই বলা হচ্ছিল সে ব্যাপারে স্কলারগণ একমত। তবে ট্রাডিশনের জায়গায় জায়গায় রয়েছে কিছু পার্থক্য, কিন্তু অধিকাংশই মিলে যায়। দুটো ঘটনাই নিশ্চিত করে যে, একজন অত্যাচারী শাসক ছিলেন। সিরিয়ার উপাখ্যানে তো নামই বলে দেওয়া আছে। এও বলা আছে, ডিসিয়াসের শাস্তি এত ভয়ংকর ছিল যে, বন্ধু বন্ধুকে ভুলে যেত, পিতা ছেলেকে এবং ছেলে পিতাকে ভুলে যেত!

সিরিয়ান কাহিনীতে বলা আছে, গুহার বাইরে সম্রাট সিলগালা করার পাশাপাশি ফলকে লিখেও দিয়েছিলেন এই বিপথগামীদের কথা। ইবনে আব্বাস (রা) এই মতবাদ সমর্থন করেন।

বর্তমানে গুহার বাইরে এই ফলক রয়েছে; source: Out Of Hadhramout

তবে কুরআনে বলা হয়েছে তাদের ঘুমন্ত থাকবার সময় ৩০০ বছর, সাধারণ সৌর হিসেবে। তবে চান্দ্র হিসেবে অতিরিক্ত ৯ বছর ধরলে, সেটি ৩০৯। তৎকালীন চান্দ্র ক্যালেন্ডার ব্যবহারকারীগণ প্রতি একশ সৌর বছরের তিন বছর যোগ করে নিত। কিন্তু সিরিয়ার কাহিনীতে নিশ্চিত করে সময় বলা নেই। কোনো কোনো মতে সেটি ১৮৪ বছর, কোনো কোনো মতে দু’শো বছরের বেশি, কেউ কেউ বলেন ২০৮ বছর। তবে তাঁরা যে যুবক ছিলেন, সে ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই কোথাও। তাঁরা মনে করেছিলেন, তাঁরা মাত্র একদিনের মতো ঘুমিয়েছেন- এটাও সিরীয় কাহিনীতে বলা আছে। যে যুবক খাবার কিনতে গিয়েছিলেন, তাঁর নাম ম্যাল্কাস এবং তিনি একটি রুপার মুদ্রা নিয়ে গিয়েছিলেন।

তাদের নামগুলো ছিল Maximian, Malchus, Marcian, John, Denis, Serapion ও Constantine। ভিন্ন উচ্চারণ ও বানানে তাদের নামগুলো Maximilian, Jamblichus, Martin, John, Dionysius, Antonius এবং Constantine।

এফিসাস শহরের বাইরের সেই গুহার এলাকায় ১৯২৭-১৯৩০ সালের দিকে প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান চালানো হয়, সেখানে ২,০০০ টেরাকোটা ল্যাম্প পাওয়া যায়, যেগুলো চার্চের জন্য উৎসর্গ করা ছিল। কার্বন ডেটিংয়ে সেগুলো চতুর্থ বা পঞ্চম শতকের বলে নির্ধারিত হয়। এর মানে, সেখানে চার্চ বানিয়েছিল স্থানীয়রা। ল্যাম্পগুলোর গায়ে ছিল ক্রুশের ছবি, কোনো কোনোটার গায়ে ছিল আদম-হাওয়া থেকে শুরু করে তাওরাতের মহারথীদের ছবি- যেমন ইব্রাহিম (আ), ইসহাক (আ) এবং সিংহের গুহায় দানিয়েল (আ)। এছাড়াও সামাজিক ছবিও ছিল, যেমন জেলেদের কাজ বা সবাই মিলে কোনো অনুষ্ঠান উপভোগের ছবি। কিন্তু এগুলোর পাশে হারকিউলিস ও সিংহ, জিউস ও আফ্রোদিতি, মন্দিরের ছবি ও দেবতা আত্তিসের মাথার ছবিও ছিল। অর্থাৎ এগুলোর নির্মাতারা নব্য খ্রিস্টান হলেও আদি রোমান সংস্কৃতি ফেলে আসেনি। ঐতিহাসিক বিশ্লেষকগণ অবশ্য এ ঘটনার কোনো নিশ্চয়তা দেন না এবং রিপ ভ্যান উইংকেলের শত বছরের ঘুমের সাথে সাদৃশ্য দেখিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য, আসহাবে কাহাফ নিয়ে ইরানে জনপ্রিয় একটি টিভি সিরিজ ‘দ্য মেন অফ অ্যাঞ্জেলোস’ নির্মাণ করা হয়।

ইরানের সেই টিভি সিরিজ, যেটি বাংলাতে ডাবিং করে প্রচার করা হয়; source: YouTube

তুরস্কের এই শহরটির বাইরে গেলে গুহাটি দেখতে পাওয়া যায়। তবে জর্ডানের আম্মানের কাছেও ১৯৬৩ সালে বের করা আরেকটি জায়গাকে আসহাবে কাহাফের জায়গা বলে দাবি করা হয়। এ জায়গাকে আল রাকীম ডাকা হয়। তবে স্থানীয় বর্ণনা ছাড়া আর কোনো ঐতিহাসিক সূত্র এটির ব্যাপারে পাওয়া যায় না, যার সাথে কোনোভাবে সেভেন স্লিপার্স (খ্রিস্টানরা এ নামেই ডাকে এ ঘটনাকে) এর ঘটনার মিল করা যায়। দাবি করা হয়, এখানে নাকি সাতজনের কঙ্কাল এবং একটি কুকুরের কঙ্কালও পাওয়া গেছে, আর সাথে ছিল কিছু তামার মুদ্রা। তবে সেগুলোর কার্বন ডেটিং করে সময়ের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। সেই গুহায় চারজনের কবর করবার জায়গা পাওয়া গেছে, যার দ্বারা বোঝা যায়, ওটা সাতজনের কিছু ছিল না।

এসব ছাড়াও অনেক মুসলিম দেশের অনেক স্থানকেই আসহাবে কাহাফের জায়গা বলে দাবি করা হয়েছে- যেমন, তুরস্কের আম্মুরিয়াগ হায হামজা, টারসাস, মিসরের কায়রোতে, এমনকি উত্তর আফ্রিকা কিংবা চীনেও! মূলত পেছনের কাহিনী না জেনে হরহামেশা ধর্মীয় রেলিক পাবার দাবিদাওয়া করবার কারণেই পৃথিবীর নানা প্রান্তে এরকম দেখা যায়। অথচ কুরআনের বর্ণনা মতেই জানা যায় যে, এই ঘটনাটি আরবদের কাছে অজানা হলেও বিদেশি লোকদের অজানা ছিল না, অন্তত যে এফিসাসে কাহিনী হয়েছিল, সেখানে যে সেটি খুবই জনপ্রিয় ছিল, তা তো বলবার অপেক্ষা রাখে না।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ
Call

 নিচের উত্তরটি সম্পূর্ণ পড়লেই বুঝতে পারবেন।

গুহাবাসীরা ছিল কয়েকজন যুবক। ঈমানদার অবস্থায় তারা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের সংখ্যা অজ্ঞাত। তারা ছিল শারীরিকভাবে শক্ত সামর্থ্য। ঈমানের দিক দিয়ে অটল, অবিচল এবং আপন জাতির অনসৃত নীতির বিরোধিতায় আপোষহীন। আল্লাহ সুবহানুতায়ালা এরশাদ করছেন- “তারা ছিল এমন কতিপয় যুবক, যারা তাদের রবের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদেরকে আরো বেশি হেদায়াত দিয়েছিলাম।” (১৮:১৩)
অর্থাৎ তাদের কী কর্মপন্থা অবলম্বন করা উচিত, তা তাদের মন মগজে এলহাম করে দিয়েছিলেন।
“আমি তাদের দিল ঐ সময় মজবুত করে দিয়েছিলাম।” (১৮:১৪)
অর্থাৎ তাদের মন শান্ত হয়ে গেল। তারা যে সত্যের পথে আছে সে সম্পর্কে সংশয়মুক্ত হলো এবং ঈমানদার হওয়াকেই তারা গর্ব ও সম্মানের ব্যাপার বলে মনে করলো। তখন তারা উঠে দাঁড়াল এবং ঘোষণা করলো, যিনি আসমান ও জমিনের রব একমাত্র তিনিই আমাদের মাবুদ। তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদকে আমরা ডাকব না। যদি আমরা তা করি তাহলে তা একেবারেই বেহুদা কাজ হবে। (১৮:১৪) বস্তুত এখানে দাঁড়ানো হলো দৃঢ় সংকল্প ও স্থিরতার লক্ষণ। বিপথগামী হয়ে যাওয়া বা সঠিক পথ হারিয়ে ফেলার ব্যাপারে তারা সচেতন হলো। এ যুবকদের নীতিগত অবস্থান যে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন তা বুঝা যায় তাদের উক্তির মাধ্যমে- ‘যে আল্লাহর উপর মিথ্যা চাপায় তার চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে?’ (১৮:১৫)
দুটি পথ ও মতাদর্শ পরস্পর বিরোধী। কাজেই উভয়ের মধ্যে আপোষ ও সমঝোতার অবকাশ নেই। কিন্তু সেই আদর্শের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ্যে ঘোষণা করলে সেখানে তাদের জীবন ধারণ করা সম্ভব নয়। আবার স্বজাতির সাথে আপোষ করাও তাদের পক্ষে অসম্ভব। নিজেদের দ্বীন ও ঈমানকে বাঁচাতে তাদের পালিয়ে যাওয়া অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। তাই পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে তারা পর্বত গুহায় আত্মগোপন করার সিদ্ধান্ত নিল। আপন জনগণ, ঘরবাড়ি, আত্মীয়-স্বজন এবং পার্থিব ভোগবিলাসের যাবতীয় উপকরণ পরিত্যাগকারী যুবকেরা সংকীর্ণ, অন্ধ কারাচ্ছন্ন ও কষ্টকর গুহার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে এবং এই অনুগ্রহকে অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী মনে করে।
‘তোমাদের  রব তাঁর রহমত তোমাদের উপর বাড়িয়ে দেবেন এবং তোমাদের কাজের জন্য সাজ সরঞ্জাম জোগাড় করে দেবেন।’ (১৮:১৬)। আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ ছড়িয়ে পড়ায় সেই সংকীর্ণ, কষ্টকর ও শ্বাসরুদ্ধকর গুহা তাদের জন্য সহনীয়। কোমল আনন্দময় ও সুপরিসর স্থানে পরিণত হলো। যে উপকরণটি এমন কষ্টকর স্থানকেও সুখময় বানিয়েছিল তা হচ্ছে ঈমান। আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ, সন্তোষ একজন মুমিনের কাছে পার্থিব জগতের সব কিছুর চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।
যুবকেরা গুহার অভ্যন্তরে অবস্থান নেবার পর আল্লাহ তায়ালা তাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন। কি বিস্ময়কর দৃশ্য। তারা যথাস্থানে নিশ্চল কিন্তু জীবিত অবস্থায় তাদের অবস্থান। সূর্য তাদের কাছে গিয়ে আলো দিলেও তার তীব্র কিরণ দ্বারা তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় না। তারা দীর্ঘস্থায়ী ঘুমে পাশ ফিরে ঘুমাতেও থাকে। তাদের কুকুরটা গুহার দরজার পাশেই প্রহরী হিসেবে থাবা মেলে অবস্থান করতে থাকে কুকুরের স্বভাব অনুসারে। যাতে কেউ তাদের উত্যক্ত করার সাহস না পায়।
অকস্মাৎ তাদের মধ্যে স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসে। তারা জেগে উঠে, ইতিমধ্যে বহুপ্রজন্ম একের পর এক অতিবাহিত হয়ে গেছে। তারা নিজেদের চোখ কচলে একে অপরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আমরা কতোক্ষণ ঘুমালাম? তারা বললো, একদিন বা একদিনের কিছু অংশ। তারা ভাবলো এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এ ব্যাপারটি আল্লাহর উপর ন্যস্ত করাই উত্তম। ক্ষুধার্ত থাকাতে সাথে থাকা রৌপ্য মুদ্রা নিয়ে তাদের একজন শহরে গেল উৎকৃষ্টমানের খাবার আনতে, তবে তাদের গোপনীয়তা যাতে প্রকাশ না পায় এবং তাদের অবস্থানস্থল কেউ যেন জেনে না ফেলে, এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হলো। কেননা শহরের ক্ষমতাসীন লোকেরা তাদের পাকড়াও করে মেরে ফেলতে পারে। কারণ তারা ধর্মত্যাগী বলে আখ্যায়িত ছিল। তবে তারা জানত না তাদের গুহার অবস্থানকালে বহু বছর অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। সময় পাল্টে গিয়েছে, জালেম শাসকগোষ্ঠীর পতন হয়েছে।
খাবার কিনতে যাবার সময়কার শহরবাসী সবাই মুসলমান, খাবার কিনতে যাওয়া ব্যক্তি যে বহু বছর আগে ঈমান নিয়ে পালানো যুবকদেরই একজন, তা টের পাওয়ার পর শহরবাসী তাদের প্রতি ভক্তির আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল সে ও তার সাথী গুহাবাসীরা কয়েক শতাব্দী পূর্বের প্রজন্মের লোক, জনগণের দৃষ্টিতে ও অনুভূতিতে তারা এক মহাবিস্ময়।
বর্তমান প্রজন্মের সাথে লেনদেন করার মত কোন মুদ্রা নেই। আল্লাহপাকও তাদেরকে প্রয়োজন শূন্য করে দেন এবং তাদের মৃত্যু ঘটিয়ে দেন। আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ পাকের এই পরকালীন পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়ার আওতায়ই ঘটেছে যুবকদের ঘুম থেকে জাগানো এবং জনগণকে তাদের সন্ধানদানের ঘটনা। কয়েকজন যুবক। ঈমানদার অবস্থায় তারা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের সংখ্যা অজ্ঞাত। তারা ছিল শারীরিকভাবে শক্ত সামর্থ্য। ঈমানের দিক দিয়ে অটল, অবিচল এবং আপন জাতির অনসৃত নীতির বিরোধিতায় আপোষহীন। আল্লাহ সুবহানুতায়ালা এরশাদ করছেন- “তারা ছিল এমন কতিপয় যুবক, যারা তাদের রবের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদেরকে আরো বেশি হেদায়াত দিয়েছিলাম।” (১৮:১৩)
অর্থাৎ তাদের কী কর্মপন্থা অবলম্বন করা উচিত, তা তাদের মন মগজে এলহাম করে দিয়েছিলেন।
“আমি তাদের দিল ঐ সময় মজবুত করে দিয়েছিলাম।” (১৮:১৪)
অর্থাৎ তাদের মন শান্ত হয়ে গেল। তারা যে সত্যের পথে আছে সে সম্পর্কে সংশয়মুক্ত হলো এবং ঈমানদার হওয়াকেই তারা গর্ব ও সম্মানের ব্যাপার বলে মনে করলো। তখন তারা উঠে দাঁড়াল এবং ঘোষণা করলো, যিনি আসমান ও জমিনের রব একমাত্র তিনিই আমাদের মাবুদ। তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদকে আমরা ডাকব না। যদি আমরা তা করি তাহলে তা একেবারেই বেহুদা কাজ হবে। (১৮:১৪) বস্তুত এখানে দাঁড়ানো হলো দৃঢ় সংকল্প ও স্থিরতার লক্ষণ। বিপথগামী হয়ে যাওয়া বা সঠিক পথ হারিয়ে ফেলার ব্যাপারে তারা সচেতন হলো। এ যুবকদের নীতিগত অবস্থান যে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন তা বুঝা যায় তাদের উক্তির মাধ্যমে- ‘যে আল্লাহর উপর মিথ্যা চাপায় তার চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে?’ (১৮:১৫)
দুটি পথ ও মতাদর্শ পরস্পর বিরোধী। কাজেই উভয়ের মধ্যে আপোষ ও সমঝোতার অবকাশ নেই। কিন্তু সেই আদর্শের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ্যে ঘোষণা করলে সেখানে তাদের জীবন ধারণ করা সম্ভব নয়। আবার স্বজাতির সাথে আপোষ করাও তাদের পক্ষে অসম্ভব। নিজেদের দ্বীন ও ঈমানকে বাঁচাতে তাদের পালিয়ে যাওয়া অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। তাই পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে তারা পর্বত গুহায় আত্মগোপন করার সিদ্ধান্ত নিল। আপন জনগণ, ঘরবাড়ি, আত্মীয়-স্বজন এবং পার্থিব ভোগবিলাসের যাবতীয় উপকরণ পরিত্যাগকারী যুবকেরা সংকীর্ণ, অন্ধ কারাচ্ছন্ন ও কষ্টকর গুহার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে এবং এই অনুগ্রহকে অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী মনে করে।
‘তোমাদের  রব তাঁর রহমত তোমাদের উপর বাড়িয়ে দেবেন এবং তোমাদের কাজের জন্য সাজ সরঞ্জাম জোগাড় করে দেবেন।’ (১৮:১৬)। আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ ছড়িয়ে পড়ায় সেই সংকীর্ণ, কষ্টকর ও শ্বাসরুদ্ধকর গুহা তাদের জন্য সহনীয়। কোমল আনন্দময় ও সুপরিসর স্থানে পরিণত হলো। যে উপকরণটি এমন কষ্টকর স্থানকেও সুখময় বানিয়েছিল তা হচ্ছে ঈমান। আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ, সন্তোষ একজন মুমিনের কাছে পার্থিব জগতের সব কিছুর চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।
যুবকেরা গুহার অভ্যন্তরে অবস্থান নেবার পর আল্লাহ তায়ালা তাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন। কি বিস্ময়কর দৃশ্য। তারা যথাস্থানে নিশ্চল কিন্তু জীবিত অবস্থায় তাদের অবস্থান। সূর্য তাদের কাছে গিয়ে আলো দিলেও তার তীব্র কিরণ দ্বারা তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় না। তারা দীর্ঘস্থায়ী ঘুমে পাশ ফিরে ঘুমাতেও থাকে। তাদের কুকুরটা গুহার দরজার পাশেই প্রহরী হিসেবে থাবা মেলে অবস্থান করতে থাকে কুকুরের স্বভাব অনুসারে। যাতে কেউ তাদের উত্যক্ত করার সাহস না পায়।
অকস্মাৎ তাদের মধ্যে স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসে। তারা জেগে উঠে, ইতিমধ্যে বহুপ্রজন্ম একের পর এক অতিবাহিত হয়ে গেছে। তারা নিজেদের চোখ কচলে একে অপরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আমরা কতোক্ষণ ঘুমালাম? তারা বললো, একদিন বা একদিনের কিছু অংশ। তারা ভাবলো এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এ ব্যাপারটি আল্লাহর উপর ন্যস্ত করাই উত্তম। ক্ষুধার্ত থাকাতে সাথে থাকা রৌপ্য মুদ্রা নিয়ে তাদের একজন শহরে গেল উৎকৃষ্টমানের খাবার আনতে, তবে তাদের গোপনীয়তা যাতে প্রকাশ না পায় এবং তাদের অবস্থানস্থল কেউ যেন জেনে না ফেলে, এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হলো। কেননা শহরের ক্ষমতাসীন লোকেরা তাদের পাকড়াও করে মেরে ফেলতে পারে। কারণ তারা ধর্মত্যাগী বলে আখ্যায়িত ছিল। তবে তারা জানত না তাদের গুহার অবস্থানকালে বহু বছর অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। সময় পাল্টে গিয়েছে, জালেম শাসকগোষ্ঠীর পতন হয়েছে।
খাবার কিনতে যাবার সময়কার শহরবাসী সবাই মুসলমান, খাবার কিনতে যাওয়া ব্যক্তি যে বহু বছর আগে ঈমান নিয়ে পালানো যুবকদেরই একজন, তা টের পাওয়ার পর শহরবাসী তাদের প্রতি ভক্তির আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল সে ও তার সাথী গুহাবাসীরা কয়েক শতাব্দী পূর্বের প্রজন্মের লোক, জনগণের দৃষ্টিতে ও অনুভূতিতে তারা এক মহাবিস্ময়।
বর্তমান প্রজন্মের সাথে লেনদেন করার মত কোন মুদ্রা নেই। আল্লাহপাকও তাদেরকে প্রয়োজন শূন্য করে দেন এবং তাদের মৃত্যু ঘটিয়ে দেন। আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ পাকের এই পরকালীন পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়ার আওতায়ই ঘটেছে যুবকদের ঘুম থেকে জাগানো এবং জনগণকে তাদের সন্ধানদানের ঘটনা।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ

থ্যাংক । 
অনেকে অনেক সুন্দর ভাবে উপাস্থাপন করেছে বিষয়টি। 
তাই আমি আর লিখলাম না। 
ধন্যবাদ। 
আপনারে অফারের জন্য। 

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ
Ovictg99

Call

পবিত্র কুরআন বা হাদীসের আলোকে তারা জীবিত আছেন এই বিষয়ে কোন স্পষ্ট দলীল নেই। সব ঘটনার বিস্তারিত দেখলে এটুকু বলা যায় তারা মারা গেছেন।

এই ঘটনা তাফসিরে রয়েছে অনেক অনেক বক্তব্য। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) নিশ্চিত করে বলেন যে, গুহাবাসীর সংখ্যা সাতজনই ছিল। কোনো কোনো মত অনুযায়ী, তাদের নাম ছিল মুকসালমিনা, তামলিখা, মারতুনিস, সানুনিস, সারিনুনিস, যুনিওয়াস, কাস্তিতিউনিস। আড়াইশ সালের দিকে রোমান সম্রাট ডিসিয়াস এর শাসনকালে (২৪৯-২৫১) সাতজন তরুণ ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান যুবককে ধর্মত্যাগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পৌত্তলিক রোমান সাম্রাজ্যে তাদের জোর করা হয় পুরনো দেবদেবীদের বিশ্বাসে ফিরে যেতে। তাদের সময় দেওয়া হয় পুরনো বিশ্বাসে ফেরত আসতে, কিন্তু তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাদের সকল সম্পদ গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। এরপর তাঁরা পালিয়ে যান অক্লন পাহাড়ের এক গুহায়। সেখানে প্রার্থনা শেষে তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েন। বলা আছে, গুহার খবর পাবার পর সম্রাট তাদের সেই গুহা সিলগালা করে দেন, যেন তাঁরা ক্ষুধায় মারা যান। ডিসিয়াস মারা যান ২৫১ সালে। পৌত্তলিক রোমান সাম্রাজ্যের অত্যাচারিত খ্রিস্টানদের ধর্ম এক সময় রাজ্যের প্রধান ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তবে সে অনেক অনেক বছর পরের কাহিনী। কাহিনীর একটি বর্ণনা মোতাবেক, সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস (৪০৮-৪৫০) এর আমলে, গুহার সিলগালা ধ্বংস করা হয়। যিনি খুলেছিলেন, তিনি ভাবছিলেন ওটাকে গোয়ালঘর বানাবেন, তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি ভেতরে সাত জন যুবক ঘুমিয়ে। যুবকেরা ঘুম ভেঙে উঠলেন, তাঁরা ভাবলেন এক দিন পুরো ঘুমিয়ে উঠেছেন। তাদের একজনকে বাজারে পাঠানো হলো, সাবধানে বাজার করতে বলা হলো যেন কেউ চিনে না ফেলে তাদের, চিনে ফেললে অত্যাচারী রাজার পৌত্তলিক অনুসারীরা তাদের গ্রেফতার করবেন। কিন্ত শহরে গিয়ে তো যুবক ম্যাল্কাস তো অবাক! আশপাশে ক্রুশ লাগানো দালানকোঠা, লোকে প্রকাশ্যেই যীশুর নাম করছে! আবার দোকানি তাঁর মুদ্রাও নিচ্ছে না, এটা নাকি অনেক পুরনো ডিসিয়াসের আমলের মুদ্রা। বিশপ তাদের কাছ থেকে ঘটনা শুনলেন। ধর্মপ্রাণ সম্রাট নিজে এসে তাদের সাথে কথা বললেন। সম্রাট তাদের জন্য অনেক কিছু করতে চাইলেন, কিন্তু তাঁরা না করে দিয়ে সেই গুহায় গিয়েই ঘুমালেন এবং এক সময় মারা গেলেন। 

 অর্থোডক্স খ্রিস্টান চার্চ এই সাত মহাপ্রাণকে বছরে দুদিন স্মরণ করে ভোজ করবার রীতি করে- আগস্ট ৪ এবং অক্টোবর ২২ তারিখে। কুরআনে বলা হয়েছে তাদের ঘুমন্ত থাকবার সময় ৩০০ বছর, সাধারণ সৌর হিসেবে। তবে চান্দ্র হিসেবে অতিরিক্ত ৯ বছর ধরলে, সেটি ৩০৯। তৎকালীন চান্দ্র ক্যালেন্ডার ব্যবহারকারীগণ প্রতি একশ সৌর বছরের তিন বছর যোগ করে নিত। কিন্তু সিরিয়ার কাহিনীতে নিশ্চিত করে সময় বলা নেই। কোনো কোনো মতে সেটি ১৮৪ বছর, কোনো কোনো মতে দু’শো বছরের বেশি, কেউ কেউ বলেন ২০৮ বছর। তবে তাঁরা যে যুবক ছিলেন, সে ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই কোথাও। তাঁরা মনে করেছিলেন, তাঁরা মাত্র একদিনের মতো ঘুমিয়েছেন- এটাও সিরীয় কাহিনীতে বলা আছে। যে যুবক খাবার কিনতে গিয়েছিলেন, তাঁর নাম ম্যাল্কাস এবং তিনি একটি রুপার মুদ্রা নিয়ে গিয়েছিলেন।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ
Unknown

Call

আসহাবে কাহাফের ওই যুবকরা গুহায় ঢোকার পর ঘুমিয়ে পড়েন। সুরা কাহাফে এ প্রসঙ্গে ১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: '(১৮) তুমি মনে করবে তারা জাগ্রত, অথচ তারা গভীর ঘুমে নিমগ্ন। এবং আমি তাদের কখনও ডান পাশে আবার কখনও বাম পাশে পাশ ফিরিয়ে দেই যাতে তাদের শরীর সুস্থ থাকে; আর তাদের কুকুর গুহায় ঢোকার মুখে পা দু’টি ছড়িয়ে বসে আছে।

যদি তুমি তাদের অবস্থা সম্বন্ধে জানতে, তবে অবশ্যই তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে পালিয়ে যেতে এবং অবশ্যই তাদের দেখে ভয়ানকভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তে।'

যাই হোক এখন আমরা পুরো ঘটনাটি তুলে ধরছি: তারা ছিলেন এফসুস শহরের ছয় সভ্রান্ত যুবক। তাদের বাদশা ছিল ওয়াকীয়ানুস বা দাকিয়ানুস। সে জনগণকে মূর্তি পূজায় বাধ্য করত। সে শহরের দ্বারে প্রহরী নিযুক্ত করে রেখেছিল যাতে যারা শহরের বাইরে যাবে তার যেন প্রথমে মূর্তিকে সিজদা করে। এ ছয় জন এক আল্লাহয় বিশ্বাসী ছিলেন। ফলে তাদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে। তখন তারা একদিন শিকার করার ছলে শহরের বাইরে চলে আসেন এবং এক মেষপালক ও তার কুকুরসহ এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মুখ থেকে বের হল- ‘আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্মসম্পাদক।’গুহায় আশ্রয় নিতেই আল্লাহ তাদের ওপর ঘুম চাপিয়ে দেন। কুকুরটি গুহার মুখে সামনের পা দু’টি ছড়িয়ে বসে থাকল। গুহায় আশ্রয় নেওয়ার জন্য তাদের ‘আসহাবে কাহাফ' বলা হয়।

এদিকে বাদশাহ তার লোকলস্কর নিয়ে গুহা প্রান্তে পৌঁছে গেল এবং তার মন্ত্রী ওয়ারিয়ুম যে অন্তরে ঈমান রাখত তাকে গুহার ভিতরে তাদের সন্ধান করতে পাঠাল। সে ভিতরে গিয়ে ডাকাডাকি করে সাড়া পেল না, তাছাড়া সেও তাদের মুক্তি কামনা করত, তাই বাইরে এসে বাদশাহকে বলল, ‘তোমার ভয়ে তারা সবাই মারা গেছে।’এ কথা শুনে বাদশাহ আনন্দিত হল এবং গুহার মুখ বন্ধ করার আদেশ দিল। তখন মন্ত্রী ওয়ারিয়ুম একটি ফলকে তাদের নাম, বংশ ও পলায়নের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে গুহার মুখে আটকে দিল। এজন্য তাদের ‘আসহাবে রাকীম’বা ফলকওয়ালা বলা হয়।

ওই যুবকরা গুহার ভিতর একটানা ৩০৯ বছর ঘুমালেন। ইতোমধ্যে সম্রাট ওয়াকীয়ানুসের যুগসহ বহু সম্রাট গত হয়েছে। যুবকরা জেগে দেখলেন যে, গুহার মুখ বন্ধ। ফলে তারা উদ্বিগ্ন হন। তাদের একজন আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, ‘একদিন আমি আমার এক কাজে এক শ্রমিককে নিয়োগ করি, সে অর্ধেক দিন কাজ করলেও আমি পুরোদিনের মজুরি দিতে চাই। কিন্তু সে তা প্রত্যাখ্যান করে ও রুষ্ট হয়ে চলে যায়। আমি তার মজুরি দিয়ে একটি বাছুর কিনি এবং গরুর পালে ছেড়ে দেই। এর বংশ বৃদ্ধি পেল। দীর্ঘ দিন পর শ্রমিকটি অভাবগ্রস্ত হয়ে তার মজুরি চাইতে আমার কাছে এল। আমি তাকে নিয়ে জঙ্গলে গেলাম এবং এক পাল গরু দেখিয়ে বললাম, ‘এসবই তোমার মজুরি।’সে বলল, ‘আমাকে পরিহাস করলেন?’ আমি শপথ করে বললে সে বিশ্বাস করল এবং তা বুঝে নিল। হে আল্লাহ! আমার এ কাজ যদি কেবল তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য হয়ে থাকে তবে এর দরজা উন্মুক্ত করে দাও।’ এরপরই দরজার এক-তৃতীয়াংশ খুলে গেল।

গুহার দরজার এক-তৃতীয়াংশ খুলে গেলে অন্য একজন বললেন, ‘খরার সময় এক সুন্দরী নারী আমার কাছে গম চাইতে আসলে আমি তাকে অবৈধ কাজের প্রস্তাব করি, কিন্তু সে নাকচ করে চলে গেল। কয়েক দফা প্রস্তাব ও নাকচের পর একান্তই অসহায় ও বাধ্য হয়ে সে সম্মত হয়। যখন আমি ইচ্ছা করলাম তখন সে কাঁপতে থাকে। আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, ‘আমি আল্লাহকে ভয় করছি।’এ কথা শুনতেই আমি তওবা করলাম এবং তাকে গম দিয়ে বিদায় দিলাম। হে আল্লাহ! আমার এ কাজ যদি শুধু তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি তবে দরজা খুলে দাও।’ এ কথা বলার পরই দরজার দুই-তৃতীয়াংশ খুলে গেল। এরপর তৃতীয়জন বললেন, ‘আমার বাবা-মা বৃদ্ধ ছিলেন। এক রাতে আমি তাদের জন্য দুধ নিয়ে যাই, কিন্তু তারা ঘুমিয়ে ছিলেন। তাদের কষ্ট হবে মনে করে জাগালাম না এবং সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। নিজের ছাগল ও মেষগুলোর ক্ষয়ক্ষতির পরোয়া করলাম না। হে আল্লাহ! আমার এ কাজ যদি কেবল তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি তবে দরজা খুলে দাও।' সাথে সাথে পুরো দরজা খুলে গেল, গুহার ভিতর আলো পৌঁছে গেল।

এরপর ওই মু'মিন যুবকরা পরামর্শ করলেন যে, একজন শহরে গিয়ে কিছু খাবার নিয়ে আসবে। তবে এমনভাবে যেন কেউ জানতে-বুঝতে না পারে। তারা মনে করেছিলেন যে, তারা একদিন বা আরও কম সময় ঘুমিয়েছিলেন। তাদের একজন দশ দিরহাম নিয়ে বাজারে গেলেন এবং শহর দেখে বিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহ! একদিনে এত পরিবর্তন হয়ে গেছে!’

ওই যুবক যখন বাজারে এলেন তখন তিনি কাউকে চিনলেন না, তাকেও কেউ চিনল না। রুটির দোকানে পৌঁছে ওয়াকীয়ানুসের যুগের মুদ্রা দিলে দোকানদার জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি গুপ্তধন কোথায় পেলে?’ যুবক অস্বীকার করেন। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে তাকে কাজী ও পরে সম্রাটের কাছে নেয়া হয়। এ সময় ওই যুবক কাঁদতে কাঁদতে নিবেদন করলেন, ‘আমাকে ওয়াকীয়ানুসের কাছে নিয়ে যেও না, সে আমাকে হত্যা করবে। তারা জিজ্ঞেস করল, ‘ওয়াকীয়ানুস আবার কে?’ তিনি বললেন, ‘এই দেশের সম্রাট।’ তারা বলল, ‘তুমি পাগল হয়ে গেছ, সে তো কত কাল আগে মরে জাহান্নামে গেছে। এখনকার সম্রাট তো ঈসা (আ.)-এর ধর্মের অনুসারী।’তাকে সম্রাটের কাছে নিয়ে গেলে তিনি সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। সম্রাট বিজ্ঞ ব্যক্তিদের তলব করলেন এবং ওই যুবকের সঙ্গে গুহার কাছে এলেন। সেখানে ফলকে তাদের নাম ও ইতিহাস দেখা গেল।

এদিকে ওই যুবক গুহার ভিতরে ঢুকে তার সাথীদের সব ঘটনা জানান। ঘটনা শুনে তারা সিজদাবনত হয়ে দোয়া করলেন, ‘আল্লাহ! আমাদের আবার ঘুমন্ত করুন।’ফলে তারা আবার ঘুমিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর সম্রাট ভিতরে গিয়ে তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলেন। এই যুবকরা রাসূল (সা.)-এর যুগে একবার নড়ে উঠেছিলেন, এরপর আবার ঘুমিয়ে পড়েন। ইমাম মাহদী (আ.)'র আবির্ভাবের সময় হবেন তারা জাগবেন এবং ইমামের সঙ্গী হবেন।#

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ