আমি জানতে চাই তাহাজ্জুদ নামাজ কি সুন্নত নাকি নফল?
তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নাত নাকি নফল? সুন্নত দুই ধরনের। একটি হচ্ছে রাসূল (সা.) যা করেছেন তার সবকিছুই সুন্নত। সেদিক থেকে রাসূল (সা.)-এর সব কাজই সুন্নত। ফরজ ও ওয়াজিবের পরবর্তী স্টেপের নাম সুন্নত। এদিক থেকে এটাকে নফলও বলা হয়। আর তাহাজ্জুদ নামাজকে জরুরি করে দেয়া হয়নি মানুষের ওপর কঠিন হয়ে যাবে বলে। তবে রাসূল (সা.) যেহেতু সর্বদা তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন অতএব এটার গুরুত্ব অপরিসীম। সম্ভব হলে পড়ার চেষ্টা করা উচিত। তবে তা না পড়লে কোনো গুনাহ হবে না। “এবং রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদের নামায পড়তে থাক। এ তোমার জন্যে আল্লাহর অতিরিক্ত ফযল ও করম। শীঘ্রই আল্লাহ তোমাকে উভয় জগতে বাঞ্ছিত মর্যাদায় ভূষিত করবেন” (বনি ইসরাইল :৭৯) যারা নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামায আদায় করে কুরআনে তাদেরকে মুহসেন ও মুত্তাকী নামে অভিহিত করে তাদেরকে আল্লাহর রহমত এবং আখেরাতে চিরন্তন সুখ সম্পদের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। “নিশ্চয়ই মুত্তাকী লোক বাগ-বাগিচায় এবং ঝর্ণার আনন্দ উপভোগ করতে থাকবে এবং যে যে নিয়ামত তাদের প্রভূ পরোয়ারদিগার তাদেরকে দিতে থাকবেন সেগুলো তারা গ্রহণ করবে। (কারণ) নিসন্দেহে তারা এর পূর্বে (দুনিয়ার জীবনে) মুহসেনীন (বড় নেক্কার) ছিল। তারা রাতের খুব অল্প অংশেই ঘুমাতো এবং শেষ রাতে ইস্তেগফার করতো।(কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে মাগফেরাত চাইতো)”। (সূরা যারিয়াত:১৫-১৮) প্রকৃতপক্ষে তাহাজ্জুদ নামায মন ও চরিত্রকে নির্মল ও পবিত্র করার এবং সত্য পথে অবিচল থাকার জন্যে অপরিহার্য ও কার্যকর পন্থা। “বস্তুতঃ রাতে ঘুম থেকে উঠা মনকে দমিত করার জন্যে খুব বেশি কার্যকর এবং সে সময়ের কুরআন পাঠ বা যিকির একেবারে যথার্থ”। (সূরা মুয্যাম্মিল-৬) এসব বান্দাদেরকে আল্লাহ সুবহানাওয়া তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দা বলেছেন এবং নেকী ও ঈমানদারীর সাক্ষ্য দিয়েছেন।(সুবহানাল্লাহ) আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা যারা তাদের প্রতিপালকের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়। (সূরা ফুরকান:৬৩-৬৪) মুমিনদের এ বিশেষ গুণ তাদেরকে কুফরের প্রবল আক্রমণের মুকাবিলায় অটল রাখতো এবং বিজয় মালায় ভূষিত করতো। বদরের ময়দানে হকের আওয়াজ বুলন্দকারী নিরস্ত্র মুজাহিদগণের অতুলনীয় বিজয়ের বুনিয়াদী কারণগুলোর মধ্যে এটিও ছিলো একটি যে, তাঁরা রাতের শেষ সময়ে আল্লাহর সামনে চোখের পানি ফেলে কাঁদতেন এবং গুনাহ থেকে মাফ চাইতেন। “এসব লোক অগ্নি পরীক্ষায় অটল অচল, সত্যের অনুরাগী, পরম অনুগত, আল্লাহর পথে মাল উৎসর্গকারী এবং রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে ভুলত্রুটির জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী”। (সূরা আলে ইমরান -১৭) স্বয়ং নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাহাজ্জুদের ফযীলত সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মদীনায় তাশরীফ আনেন তখন প্রথম যে কথাগুলো তাঁর মুখ থেকে শুনি তা হলো : “হে লোক সকল ! ইসলামের প্রচার ও প্রসার করো, মানুষকে আহার দান করো,আত্মীয়তা অটুট রাখ, আর যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকবে তখন তোমরা রাতে নামায পড়তে থাকবে। তাহলে তোমরা নিরাপদে বেহেশতে যাবে” (হাকেম,ইবন মাজাহ,তিরমিযী) হযরত সালমান ফারসী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন- “তাহাজ্জুদ নামাযের ব্যবস্থাপনা কর, এ হচ্ছে নেক লোকের স্বভাব, এ তোমাদেরকে আল্লাহর নিকট করে দেবে, গুনাহগুলোকে মিটিয়ে দিবে, গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং শরীর থেকে রোগ দূর করবে”। অন্য আরেক সময় তিনি বলেন, “ফরয নামাযের পর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নামায হল রাতে পড়া তাহাজ্জুদ নামায” (সহীস মুসলিম, আহমদ)। তিনি আরো বলেন, রাতের শেষ সময়ে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার দিকে নাযিল হন এবং বলেন, “ডাকার জন্যে কেউ আছে কি যার ডাক আমি শুনব, চাওয়ার জন্যে কেউ আছে কি যাকে আমি দেব, গুনাহ মাফ চাওয়ার কেউ আছে কি যার গুনাহ আমি মাফ করব?”(সহীহ বুখারী)। _________________________________ তাহাজ্জুদ নামাযের ওয়াক্ত তাহাজ্জুদের অর্থ হল ঘুম থেকে উঠা। কুরআনে রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদের যে তাকীদ করা হয়েছে তার মর্ম এই যে, রাতের কিছু অংশ ঘুমিয়ে থাকার পর উঠে নামায পড়া। তাহাজ্জুদের মসনূন সময় এই যে,এশার নামায পর লোকে ঘুমাবে। তারপর অর্ধেক রাতের পর উঠে নামায পড়বে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো মধ্য রাতে,কখনো তার কিছু আগে অথবা পরে ঘুম থেকে উঠতেন এবং আসমানের দিকে তাকিয়ে সূরা আলে-ইমরানের শেষ রুকুর কয়েক আয়াত পড়তেন। তারপর মেসওয়াক ও অযু করে নামায পড়তেন। ঘুম থেকে উঠার পর তিনি নিম্নের আয়াতগুলো পড়তেন। “বস্তুত আসমান যমীনের সৃষ্টি ও রাত দিনের আবর্তনের মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে ঐসব জ্ঞানী ব্যক্তিদের জন্যে যারা দাঁড়ানো, বসে থাকা এবং শুয়ে থাকা অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান ও যমীনের সৃষ্টি নৈপূণ্যের উপর চিন্তা গবেষণা করে। অতঃপর তারা আপনা আপনি বলতে থাকে, হে আমাদের রব । এসব কিছু তুমি অযথা পয়দা করনি। বেহুদা কাজ থেকে তুমি পাক, পবিত্র ও মহান। অতএব, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাও। তুমি যাকে দোযখে নিক্ষেপ কর তাকে প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত লাঞ্ছনার মধ্যেই ফেল। তারপর এসব যালেমদের আর কোন সাহায্যকারী থাকবে না। হে প্রভু ! আমরা একজন আহবানকারীকে শুনলাম, যে ঈমানের দিকে আহবান করে নিজেদের রবকে মেনে নিতে বলে। আমরা তার দাওয়াত কবুল করলাম। হে আমাদের প্রভূ! আমাদের গুনাহ মাফ করে দাও। আমাদের মধ্যে যেসব মন্দ কাজ আছে তা তুমি দূর করে দাও এবং আমাদের শেষ পরিণতি নেক লোকদের সাথে কর। হে আল্লাহ ! তুমি যেসব ওয়াদা তোমার রাসূলদের মাধ্যমে করেছো, তা পূরণ করো এবং কিয়ামতের দিনে লাঞ্ছনায় ফেলো না। নিশ্চয়ই তুমি ওয়াদার বরখেলাপ করো না”। (সূরা আল ইমরান) তাহাজ্জুদের রাকায়াতসমূহ _________________________________ তাহাজ্জুদের রাকায়াতসমূহ অন্ততপক্ষে দুই এবং ঊর্ধতম সংখ্যা আট। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অভ্যাস ছিল দুই দুই করে আট রাকায়াত পড়া। সে জন্যে আট রাকায়াত পড়াই ভালো, তবে তা জরুরী নয়। অবস্থা ও সুযোগের প্রেক্ষিতে যতটা পড়া সম্ভব ততটা পড়লেই চলবে।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার আগে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর তাহাজ্জুদ নামাজ বাধ্যতামূলক ছিল। তাই তিনি জীবনে কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া থেকে বিরত হননি। তবে উম্মতে মুহাম্মদির জন্য এটা সুন্নতে গায়রে মুয়াক্কাদা অর্থাৎ এ নামাজ আদায় করলে অশেষ পুণ্য লাভ করা যায়, কিন্তু আদায় করতে না পারলে কোনো গুনাহ হবে না। এছাড়া এটিকে সকল নফল ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ইবাদত বলা হয়েছে।