৩১-৩২ নং আয়াতের তাফসীর: 


ঈমানের ছয়টি রুকনের অন্যতম একটি হল পরকালের প্রতি ঈমান। কেউ ঈমানের সকল রুকনের প্রতি বিশ্বাস করল কিন্তু পরকালের প্রতি ঈমান আনল না তাহলে তার কোন নেক আমল গ্রহণযোগ্য হবে না। সকল যুগের নাস্তিক ও বস্তুবাদীদের ন্যায় মক্কার মুশকিরদের ধারণা ছিল মানুষের পরিণতি দুনিয়াতেই শেষ। অন্যান্য বস্তু যেমন পচে গলে মাটিতে মিশে যায়, মানুষও তেমনি মাটি হয়ে শেষ হয়ে যাবে। অতএব খাও-দাও ফুর্তি কর, শক্তি ও সাধ্যমত অন্যের উপর জুলুম কর। পরকাল, হিসাব-নিকাশ, কিয়ামত, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি কিছুই নেই। নাস্তিক্যবাদী পরকাল অস্বীকারকারীদের সতর্ক সাবধান করে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন: যারা কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাসী নয় তারাই ক্ষতিগ্রস্থ। হঠাৎ যখন কিয়ামত চলে আসবে তখন আফসোস করে বলবে এ কিয়ামত সম্পর্কে আমরা অবজ্ঞা করেছিলাম। মু’মিনরা আমাদেরকে পরকাল সম্পর্কে সতর্ক করলে আমরা অসম্ভব মনে করতাম এবং পূর্ববর্তীদের রূপকথা বলে বর্জন করতাম। কিয়ামতের দিন এসব নাস্তিক কাফির-মুশরিকরা তাদের পাপের বোঝা পিঠে বহন করে উপস্থিত হবে। সেদিন কতই না অপমানজনক অবস্থা হবে তাদের। 


অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, দুনিয়া খেল-তামাশার বস্তুর মত তুচ্ছ। এর কোন মূল্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে নেই। দুনিয়ার সব কিছু ক্ষণস্থায়ী, অনিশ্চিত ও নশ্বর। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: অতএব সকলকে সতর্ক হওয়া উচিত; আরো উচিত দুুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখ-শান্তি, ক্ষমতা ও রাজত্বের ধোঁকায় না পড়ে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে চিরস্থায়ী ঠিকানার জন্য পাথেয় তৈরি করা। যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে দুনিয়ার ওপর আখেরাতকে প্রাধান্য দেয় তাদের জন্য পরকালই শ্রেষ্ঠ। সেখানে জীবনের, সুখ-শান্তির কোন শেষ নেই, কোন দুশ্চিন্তা নেই, বরং সবাই এক অনন্ত ও অনাবিল জীবন যাপন করবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দুনিয়ার ওপর আখেরাতকে প্রাধান্য দেয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন॥


 আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: 


১. পরকালসহ ইসলামের মূলনীতিতে যারা বিশ্বাসী নয়, তারাই পরকালে ক্ষতিগ্রস্থ হবে, তারা জাহান্নামে যাবে।

২. কিয়ামত সংঘটিত হবার আগে তাওবাহ না করে মারা গেলে পরে আফসোস করে কোন উপকার হবে না।

৩. কিয়ামতের দিন অপরাধীরা তাদের অপরাধের বোঝা পিঠে নিয়ে উঠবে।

৪. মুত্তাকিদের জন্য পরকালই উত্তম আর পার্থিব জীবন কষ্টদায়ক। 

 ৩৩-৩৬ নং আয়াতের তাফসীর: 


এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা দিচ্ছেন যে, শুধু তোমাকেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হচ্ছে না বরং তোমার পূর্বের রাসূলদের সাথে এমন আচরণ করা হয়েছিল। তাদেরকে কষ্ট দেয়ার এবং মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে তারা মনক্ষুণœ হয়নি বরং তাতে ধৈর্যধারণ করেছে ফলে আমি তাদেরকে সাহায্য করেছিলাম। তাই তুমিও তাদের কথায়, আচরণে ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না। 


অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন: 


(فَلَا تَذْهَبْ نَفْسُكَ عَلَيْهِمْ حَسَرٰتٍ) 


“অতএব তুমি তাদের জন্য অনুতাপ করে নিজেকে ধ্বংস করবে না।”(সূরা ফাতির ৩৫:৮)


আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: 


(فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ عَلٰٓي اٰثَارِهِمْ إِنْ لَّمْ يُؤْمِنُوْا بِهٰذَا الْحَدِيْثِ أَسَفًا)‏ 


“তারা এ হাদীসকে (কুরআনকে) বিশ্বাস না করলে সম্ভবত তাদের পেছনে ঘুরে ঘুরে তুমি দুঃখে নিজেকে ধ্বংস করে দেবে।”(সূরা কাহ্ফ ১৮:৬)


অতএব তাদের কথায় কষ্ট না নিয়ে ধৈর্য ধারণ কর। মূলত তারা তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে না বরং তারা আল্লাহ তা‘আলার আয়াতকেই অস্বীকার করছে। 


(وَإِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكَ إِعْرَاضُهُمْ) 


“যদি তাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়া তোমার নিকট কষ্টকর হয়”অর্থাৎ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বিরোধিতাকারী কাফিরদের মিথ্যা মনে করার কারণে তিনি যে মনঃপীড়া ও কষ্ট অনুভব করতেন, সে ব্যাপারেই মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এটা ছিল আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায়। আর আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ছাড়া তুমি তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করার প্রতি আকৃষ্ট করতে পার না। এমনকি যদি তুমি ভূ-তলে কোন সুড়ঙ্গ বানিয়ে অথবা আকাশে সিঁড়ি লাগিয়ে সেখান থেকে কোন নিদর্শন এনে তাদেরকে দেখিয়ে দাও, তাহলে প্রথমত এ রকম করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়, আর যদি দেখিয়েই দাও তবুও তারা ঈমান আনবে না।


আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে সকলকে হিদায়াত দিতে পারেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: 


(وَلَوْ شَا۬ءَ رَبُّكَ لَاٰمَنَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيْعًا) 


“তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলেই ঈমান আনত।”(সূরা ইউনুস ১০:৯৯) তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: হে মুহাম্মাদ! তোমার ডাকে কেবল তারাই সাড়া দেবে যারা তোমার কথা শুনে ও বুঝে।


(وَالْمَوْتٰی یَبْعَثُھُمُ) 


‘আর মৃতকে আল্লাহ পুনর্জীবিত করবেন’অর্থাৎ মৃত বলতে কাফির উদ্দেশ্য, কাফিরদেরকে মৃত বলা হয়েছে কারণ তাদের অন্তর মৃত ইসলাম কবূল না করার কারণে। 


সুতরাং দীনের পথে চলতে গেলে অনেক বাধা বিপত্তি আসবে, মানুষ শারীরিক মানসিক উভয়ভাবে আঘাত করবে যেমন পূর্ববর্তী অনেক নাবী-রাসূলগণ সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাই বলে দীনের পথ থেকে সরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। কারণ কষ্ট যত বড় প্রতিদানও তত বড়।


 আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: 


১. আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা প্রদান করা হয়েছে।

২. বিপদে-আপদে ধৈর্য ধারণ করা ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য।

৩. হিদায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।

৪. আল্লাহ তা‘আলা কথা বলেন- এর প্রমাণ এ আয়াতে রয়েছে।

(তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ) 

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ

সূরা আল আন’আম: ৩২ থেকে ৩৬ নং আয়াতের সাফসীর:
৩২. আর দুনিয়ার জীবন তো খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য আখেরাতের আবাসই উত্তম; অতএব, তোমরা কি অনুধাবন কর না?
তাফসীর:
এর মানে এ নয় যে, দুনিয়ার জীবনটি নেহাত হাল্কা ও গুরুত্বহীন বিষয়, এর মধ্যে কোন গাম্ভীর্য নেই এবং নিছক খেল-তামাসা করার জন্য এ জীবনটি তৈরী করা হয়েছে। বরং এর মানে হচ্ছে, আখেরাতের যথার্থ ও চিরন্তন জীবনের তুলনায় দুনিয়ার এ জীবনটি ঠিক তেমনি যেমন কোন ব্যক্তি কিছুক্ষণ খেলাধূলা করে চিত্তবিনোদন করে তারপর তার আসল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ কারবারে মনোনিবেশ করে। তাছাড়া একে খেলাধূলার সাথে তুলনা করার কারণ হচ্ছে এই যে, এখানে প্রকৃত সত্য গোপন থাকার ফলে যারা ভেতরে দৃষ্টি না দিয়ে শুধুমাত্র বাইরেরটুকু দেখতে অভ্যস্ত তাদের জন্য বিভ্রান্তির শিকার হবার বহুতর কারণ বিদ্যমান। এসব বিভ্রান্তির শিকার হয়ে মানুষ প্রকৃত সত্যের বিরুদ্ধে এমন সব অদ্ভুত ধরনের কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করে যার ফলশ্রুতিতে তাদের জীবন নিছক একটি খেলা ও তামাসার বস্তুতে পরিণত হয়। যেমন যে ব্যক্তি এ পৃথিবীতে বাদশাহের আসনে বসে তার মর্যাদা আসলে নাট্যমঞ্চের সেই কৃত্রিম বাদশাহর চাইতে মোটেই ভিন্নতর নয় যে, সোনার মুকুট মাথায় দিয়ে সিংহাসনে বসে এবং এমনভাবে হুকুম চালাতে থাকে যেন সে সত্যিকারের একজন বাদশাহ। অথচ প্রকৃত বাদশাহীর সামান্যতম নামগন্ধও তার মধ্যে নেই। পরিচালকের সামান্য ইঙ্গিতেই তার বরখাস্ত, বন্দী ও হত্যার সিদ্ধান্তও হয়ে যেতে পারে। এ দুনিয়ার সর্বত্র এ ধরনের অভিনয়ই চলছে। কোথাও কোন পীর-অলী বা দেব-দেবীর দরবারে মনস্কামনা পূরণের জন্য প্রার্থনা করা হচ্ছে। অথচ সেখানে মনস্কামনা পূর্ণ করার ক্ষমতার লেশ মাত্রও নেই। কোথাও অদৃশ্য জ্ঞানের কৃতিত্বের প্রকাশ ঘটানো হচ্ছে। অথচ সেখানে অদৃশ্য জ্ঞানের বিন্দু বিসর্গও নেই। কোথাও কেউ মানুষের জীবিকার মালিক হয়ে বসে আছে। অথচ সে বেচারা নিজের জীবিকার জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী। কোথাও কেউ নিজেকে সম্মান ও অপমানের এবং লাভ ও ক্ষতির সর্বময় কর্তা মনে করে বসে আছে। সে এমনভাবে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ডংকা বাজিয়ে চলছে যেন মনে হয়, আশপাশের সমুদয় সৃষ্টির সে এক মহাপ্রভু। অথচ তার ললাটে চিহ্নিত হয়ে আছে দাসত্বের কলঙ্ক টীকা। ভাগ্যের সামান্য হেরফেরই শ্রেষ্ঠত্বের আসন থেকে নামিয়ে তাকে সেসব লোকের পদতলে নিষ্পিষ্ট করা হতে পারে যাদের ওপর কাল পর্যন্তও সে প্রভুত্ব ও কৃর্তত্ব চালিয়ে আসছিল। দুনিয়ার এই মাত্র কয়েকদিনের জীবনেই এসব অভিনয় চলছে। মৃত্যুর মুহূর্ত আসার সাথে সাথেই এক লহমার মধ্যেই এসব কিছুই বন্ধ হয়ে যাবে। এ জীবনের সীমান্ত পার হবার সাথে সাথেই মানুষ এমন এক জগতে পৌঁছে যাবে যেখানে সবকিছুই হবে প্রকৃত সত্যের অনুরূপ এবং যেখানে এ দুনিয়ার জীবনের সমস্ত বিভ্রান্তির আবরণ খুলে ফেলে দিয়ে মানুষকে দেখিয়ে দেয়া হবে কি পরিমাণ সত্য সে সাথে করে এনেছে। সত্যের মীযান তথা ভারসাম্যপূর্ণ তুলাদণ্ডে পরিমাপ করে তার মূল্য ও মান নির্ধারণ করা হবে।

আয়াত:

৩৩. ‘আমি অবশ্যই জানি তারা যেসব কথা বলে বেড়াচ্ছে তা তোমাকে মানসিকভাবে দারুণ কষ্ট দেয়, কিন্তু তারা তো আসলে তোমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করছে না; বরং এই যালিমরা আল্লাহর আয়াত গুলোকেই অস্বীকার করছে।

৩৪. এবং তোমার পূর্বে বহু রাসূলের প্রতি মিথ্যা আরোপ করা হয়েছে, কিন্তু এ মিথ্যা আরোপ করে তাদেরকে যে কষ্ট দেয়া হয়েছে এর মুকাবিলায় তারা ছবর অবলম্বন করেছে, যে পর্যন্ত না আমার সাহায্য তাদের কাছে এসেছে। আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মগুলো পরিবর্তন করতে পারে এমন কেউ নেই। আর পূর্বেকার রাসূলদের কথা তো তোমার নিকট পৌঁছেছে।

৩৫. এবং তাদের এই উপেক্ষা যদি তোমার কাছে অসহনীয় হয়, তাহলে সাধ্য থাকলে তুমি মাটির গভীরে কোন সুড়ংগ খোঁজ কিংবা আসমানের দিকে সিঁড়ি লাগাও এবং তাদের জন্য কোন নিদর্শন নিয়ে আস। আল্লাহ যদি চাইতেন যে, তিনি সকলকে হিদায়াতের ওপর একত্রিত করবেনই, তা তো তিনি করতেই পারতেন। অতএব তুমি জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
৩৬. আহবানে তো তারাই সাড়া দেয়, যারা শুনতে পায়। আর মৃতদেরকে আল্লাহ পুনর্জীবিত করবেন এবং তারা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তিত হবে।
তাফসীর:
নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ৪০ বছর মক্কায় বসবাস করেন। তাঁর বিশ্বস্ততা ও আমানাতদারীতে মুগ্ধ হয়ে লোকেরা তাঁকে ‘আলআমীন’ বলে ডাকতো। অপর দিকে তিনি ছিলেন সত্যবাদিতার বিমূর্ত রূপ। জীবনে তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেননি। তাঁর সত্যবাদিতায় মুগ্ধ হয়ে লোকেরা তাঁকে ডাকতো ‘আছ ছাদিক’ বলে। তিনি ছিলেন সকলেরই প্রিয়জন।নবুওয়াত প্রাপ্তির পর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিরবে ‘আদ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ’-র কাজ করছিলেন। তিন বছর পর আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের নির্দেশেই সরবে দা‘ওয়াত প্রদানের কাজ শুরু করেন।অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ ধারণ করে।জাহিলিয়াতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত মানুষেরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করে।বেশ কিছু সত্য-সন্ধানী ব্যক্তি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হন। ইসলাম বিদ্বেষীরা এই নব গঠিত শক্তিকে অংকুরে বিনাশ করতে চায়। সমাজ অংগনে ইসলাম ও জাহিলিয়াতের দ্বন্দ্ব আত্মপ্রকাশ করে।ইসলাম বিদ্বেষীরা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার ঝড় সৃষ্টি করে। পাশাপাশি তারা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর অনুসারীদের ওপর যুলম-নির্যাতন চালাতে থাকে।ইসলাম বিদ্বেষীদের মিথ্যা প্রচারণার কতগুলো কথা ছিলো নিম্নরূপঃ মুহাম্মাদ একজন গণক।মুহাম্মাদ একজন পাগল। মুহাম্মাদ একজন কবি। মুহাম্মাদ একজন যাদুকর। মুহাম্মাদ নিজেই কালাম রচনা করে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিচ্ছে। মুহাম্মাদ তো একজন মানুষ। মানুষ নবী হবে কেন? মুহাম্মাদ নবী হলে তো তার সাথে বিশাল ধনভান্ডার এবং ফেরেশতাদের একটি বাহিনী থাকতো।০ মুহাম্মাদ আল্লাহর কালাম বলে যা পেশ করছে সেই গুলো অতীতকালের কিস্সা কাহিনী ছাড়া আর কিছু নয়। ইত্যাদি।উল্লেখ্য যে তিনজন কবি আবু সুফইয়ান ইবনুল হারিস, আমর ইবনুল আস এবং আবদুল্লাহ ইবনুল জিবয়ারী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাব মর্যাদা বিনষ্ট করার লক্ষ্যে বানোয়াট কথা সম্বলিত কবিতা রচনা করে জন সমক্ষে আবৃত্তি করে বেড়াতো।ইসলাম-বিদ্বেষীদের হাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দৈহিকভাবেও নিপীড়িত হন। একদিন কা’বার চত্বরে দাঁড়িয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বুলন্দ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। ইসলামের দুশমনেরা চারদিক থেকে ছুটে এসে তার ওপর হামলে পড়ে। তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন হারিস ইবনু আবি হালাহ (রা)। এক দুশমনের তলোয়ারের আঘাতে হারিস (রা) নিহত হন। তিনিই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসারীদের মধ্যে প্রথম শহীদ। একদিন কা’বার চত্বরে মুসলিমগণ একটি জনসভার আয়োজন করেন। বক্তা হিসেবে নিদিষ্টি ছিলেন আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা)। বক্তৃতা শুরু করার সাথে সাথেই ইসলামের দুশমনেরা হামলা চালায়। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)সহ অনেকেই আহত হন। লাঠির আঘাতে আহত আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা) গভীর রাত পর্যন্ত সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলেন।০ একদিন কা’বার চত্বরে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায়কালে উকবা ইবনু আবি মুয়াইত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গলায় একখণ্ড কাপড় পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করে। আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা) দৌড়ে এসে তাঁকে উদ্ধার করেন।০ একদিন পথিমধ্যে আবু জাহল বেশ কিছু ধূলাবালি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাথায় ছড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ‘ওহে লোক সকল, তোমরা এর কথায় বিশ্বাস স্থাপন করো না। এ চায় তোমরা লাত ও উয্যার উপাসনা ছেড়ে দাও।’ একদিন কা’বার চত্বরে ছালাত আদায় কালে সাজদায় গেলে উকবা ইবনু আবি মুয়াইত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাঁধে পিঠে মাথায় একটি উটের নাড়িভুড়ি তুলে দেয়।০ আবু লাহাব ও উকবা ছিলো মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিবেশী। তারা তাদের বাড়ির আবর্জনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরের সামনে ছুঁড়ে মারতো। ইসলামের দুশমনেরা রাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রান্নাঘরে ঢুকে হাড়ি পাতিলের ভেতর উটের নাড়িভুড়ি রেখে আসতো। ইসলামের দুশমনেরা রাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরের দরওয়াজায় কাঁটা পুঁতে ও ছড়িয়ে রাখতো।একদিন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কা’বার নিকটে বসা ছিলেন। দুর্বৃত্ত উকবা সেখানে এসে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চেহারায় থুথু নিক্ষেপ করে। নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ সন থেকে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর অনুসারীগণ এবং বনু হাশিমের সদস্যগণ শিয়াবে আবু তালিবে তিনটি বছর কষ্টকর অবরুদ্ধ জীবন যাপন করেন।  নবুওয়াতের নবম সনে ‘আদ দা’ওয়াতু ইলাল্লাহ’র কাজ করার জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তায়েফ পৌঁছেন। সেখানকার তিন সরদার আবদ ইয়ালিল ইবনু আমর, মাসউদ ইবনু আমর ও হাবীব ইবনু আমর তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করে। তারা তাঁর পেছনে একদল গুন্ডাকে লেলিয়ে দেয়। দুর্বৃত্তরা পাথর খণ্ড নিক্ষেপ করে করে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। ক্লান্ত ও রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি কয়েকবার রাস্তার ওপর পড়ে যান। এইভাবে দুই তিন মাইল পথ চলেন। এই সময় কয়েকজন প্রবীণ লোক এগিয়ে এসে তাঁকে শহরের বাইরে পৌঁছে দিয়ে যায়। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি একটি আংগুরের বাগানে ঢুকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়েন। অশ্রুভরা চোখে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাতে থাকেন। ০ তায়েফ থেকে মক্কার পথ ধরে এগুচ্ছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। পথিমধ্যে তিনি খবর পান যে মুশরিক নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁকে আর মক্কায় ঢুকতে দেওয়া হবে না। এ ছিলো যেন নাগরিকত্ব বাতিলের ঘোষণা।
এক ব্যক্তিকে পাঠিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আখনাস ইবনু শুরাইকের সহযোগিতা চান। আখনাস রাজি হলেন না। এবার তিনি সুহাইল ইবনু আমরের সহযোগিতা চান। সুহাইল রাজি হলেন না। অতপর তিনি মুতয়িম ইবনু আদীর সহযোগিতা চান। মুতয়িম রাজি হন এবং তাঁর ছেলেরা সহ অস্ত্র সজ্জিত হয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কায় এনে কা’বার চত্বরে পৌঁছে দেন। কা’বার তাওয়াফ করে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপন ঘরে ফেরেন। উল্লেখ্য যে এই কয়টি বছরে ইসলাম বিদ্বেষীদের হামলা ও নির্যাতনে প্রাণ হারান কয়েকজন মুসলিম। আহতদের সংখ্যা ছিলো আরো বেশি। অত্যাচার-নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে শতাধিক মুসলিম হাবশায় হিজরাত করেন। পরিস্থিতির প্রতিকূলতার কারণে মক্কা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লোকদের ইসলাম গ্রহণের হার কমে যায়। সামগ্রিকভাবে জনগোষ্ঠীর অবস্থান ছিলো ইসলামী আন্দোলনের বিপক্ষে। নিদারুণ মানসিক কষ্ট অনুভব করছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। এই প্রেক্ষাপটে, মাক্কী জীবনের শেষভাগে, অবতীর্ণ হয় সূরা আল আন’আম। পুরো সূরাটি একই সংগে অবতীর্ণ হয়।
ব্যাখ্যা
৩৩ নাম্বার আয়াত
قَدْ نَعْلَمُ اِنَّه لَيَحْزُنُكَ الَّذِىْ يَقُوْلُوْنَ فَاِِنَّهُمْ لَا يُكَذِّبُوْنَكَ وَلٰكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِايتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ ০
قَدْ نَعْلَمُ আয়াতাংশ দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বুঝাচ্ছেন যে ইসলাম বিদ্বেষীরা যেই সব কথা এবং যেইসব কাজ করে নবীকে কষ্ট দিচ্ছে সেই সম্পর্কে তিনি অবহিত আছেন। বস্তুতঃ বিশ্বজাহানের কোন কিছুই আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে, আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে, থাকতে পারে না। لَا يُكَذِّبُوْنَكَ আয়াতাংশ দ্বারা তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন যে ব্যক্তি মুহাম্মাদকে তারা অস্বীকার করছে না। বরং ব্যক্তি মুহাম্মাদকে তো তারা ‘আলআমীন’ ও ‘আছ-ছাদিক’ বলে ডেকে তৃপ্তিবোধ করতো। মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল্লাহকে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বলে মেনে নিতেই ছিলো তাদের আপত্তি। وَلٰكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِايتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَআয়াতাংশ দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বুঝাতে চাচ্ছেন যে ইসলাম বিদ্বেষীদের বিরোধিতার আসল লক্ষ্য বস্তু হচ্ছে আল্লাহর আয়াতসমূহ, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান।আল্লাহর আয়াতসমূহ তাদের চক্ষুশূল। আল্লাহর বিধান তাদের বড্ড অপছন্দনীয়। এই বিধান যাতে সমাজ-সভ্যতার অংগনে শিকড় গাড়তে না পারে সেই লক্ষ্যেই নিয়োজিত ছিলো তাদের সকল তৎপরতা। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের অবতীর্ণ আয়াতসমূহের, তার অবতীর্ণ বিধানের, বিরোধিতা করা মস্ত বড়ো যুলম, মস্ত বড়ো অন্যায়। এই যালিমরা সেই অন্যায় কাজেই লিপ্ত রয়েছে।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ