যদি বাপ মা বলেন, স্ত্রীকে তালাক দাও তাহলে দেখতে হবে স্ত্রী দোষী কিনা। যদি স্ত্রী নিরপরাধ হয় তাহলে বাপ মায়ের কথায় স্ত্রীকে তালাক দেয়া জায়েজ নেই। তারা যদি বলেন স্ত্রীকে পৃথক বাসায় রাখার দরকার নেই, একথাও শোনা ঠিক হবে না। স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে থাকতে রাজি হয় সেটি ভিন্ন কথা। নইলে তার মর্যাদা অনুযায়ী আলাদা বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়ার দায়িত্ব স্বামীর। এ সম্পর্কে শরঈ নির্দেশ রয়েছে। শরঈ নির্দেশ লংঘন করার অধিকার কারও নেই। শাশুড়ি বউ এর ঝগড়া তো নিত্যদিনের ঘটনা। তবে এ ঝগড়ায় কোন একপক্ষ দোষী নয়। উভয় পক্ষেরই কম বেশি দোষ থাকে। প্রত্যেকেরই উচিত খুঁটিনাটি ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করা। একপক্ষ বাড়াবাড়ি করে ফেললে অন্যপক্ষের উচিত ধৈর্য ধরা।”
“শরিয়াহ্ তালাককে নিকৃষ্টতম বৈধ কাজ বলে আখ্যায়িত করছে। তাই, শরিয়াহ কারণ ছাড়া তালাক প্রদান করলে আল্লাহর নিকট অবশ্যি অপরাধী হিসেবে গুণাহগার হতে হবে।
পিতা মাতা যদি সন্তানকে কোন কারণ ছাড়াই বৌকে তালাক দিতে বলে তাহলে তালাক দেওয়া যাবে না।
স্ত্রীকে পিতার নির্দেশে তালাক দেওয়া যাবে তবে তার কারন থাকতে হবে।
ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমার বিবাহিত এক স্ত্রী ছিল যাকে আমি ভালোবাসতাম, কিন্তু তাকে আমার পিতা পছন্দ করতেন না। তিনি আমাকে নির্দেশ দেন তাকে তালাক প্রদানের জন্য। কিন্তু আমি তা অস্বীকার করি। বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে আমি উল্লেখ করলে তিনি বললেনঃ হে উমারের পুত্র আবদুল্লাহ! তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দাও।
(সূনান আত তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ১১৮৯
ইবনু মাজাহঃ ২০৮৮) এ হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহীহ বলেছেন)।
আবূদ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, তার কাছে একজন লোক এসে বলল, আমার এক স্ত্রী আছে। আমার মা আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন তাকে তালাক দেয়ার জন্য। আবূদ দারদা (রাঃ) বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি বলতে শুনেছিঃ জান্নাতের সর্বোত্তম দরজা হচ্ছে বাবা। তুমি ইচ্ছা করলে এটা ভেঙ্গে ফেলতে পার অথবা এর রক্ষণাবেক্ষণও করতে পার।
(সূনান আত তিরমিজী, হাদিস নম্বরঃ ১৯০০ সহীহাঃ ৯১০, মিশকাত, তাহকীক ছানীঃ ৪৯২৮ হাদিসের মানঃ সহিহ)।
জনাব! বাবা-মায়ের সন্তুষ্টি ও তাদের কথা মান্য করার জন্য তাদের নির্দেশে তালাক দেওয়া যাবে তবে তার নির্দিষ্ট কারন থাকতে হবে।
মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করা, ভালবাসা, তাঁদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা, কথা শোনা, গুরুত্ব দেওয়া, বাধ্য হওয়া শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াজিব এবং তাঁদের অবহেলা করা, নাফরমানি করা হারাম। তবে বাবা-মা যদি অনৈতিক কাজে কিংবা অবৈধ কাজে জোর করে তাহলে বাধ্য হওয়া যাবে না। কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ
অসৎকাজে আনুগত্য নয় ;আনুগত্য কেবলমাত্র সৎকাজের ক্ষেত্রেই হতে হবে।(বুখারী ৭১৪৫ মুসলিম ১৮৪০)
*হাসান বসরী রহ. বলেন, إن منعتْه أمُّه عن العشاء في الجماعة شفقة : لم يطعها যদি মা সন্তানের প্রতি মায়া দেখিয়ে ইশার জামাতে শরিক হতে বারণ করে তাহলে এ ক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্য করা যাবে না। (বুখারী ১/২৩০)
*শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রহ. বলেন,
ويلزم الإنسان طاعة والديه في غير المعصية وإن كانا فاسقين ، وهو ظاهر إطلاق أحمد ، فإن شق عليه ولم يضره : وجب ، وإلا فلا
বাবা-মা ফাসেক হলেও বৈধ কাজের ক্ষেত্রে তাঁদের বাধ্য থাকা আবশ্যক। ইমাম আহমাদ রহ.-এর বক্তব্যের উদ্দেশ্যও এটাই। আর যদি বৈধ কাজ করতে গিয়ে সন্তানের জন্য কেবল কষ্ট হয় কিন্তু ক্ষতিকর না হয় তাহলেও তাঁদের বাধ্য থাকা ওয়াজিব। ( আল ফাতাওয়াল কুবরা ৫/৩৮১)
*উক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বাবা-মায়ের আনুগত্যের সীমারেখা সংক্ষেপে এভাবে নির্ণয় করতে পারি–
তাঁদের বাধ্য থাকার বিষয়টি কেবল বৈধ কাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং যদি তাঁরা ফরযে আইন, ওয়াজিব কিংবা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বর্জন করতে বলেন অথবা যদি তাঁরা কোনো হারাম কাজ করতে বলেন তাহলে সে ক্ষেত্রে তাঁদের আনুগত্য করা জায়েয হবে না।
হ্যা!যদি তাঁরা নফল-মুস্তাহাব পুরোপুরি নয় বরং বিশেষ কোনো যৌক্তিক কারণে নির্দিষ্ট কোনো নফল-মুস্তাহাব ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন তাহলে এক্ষেত্রে তাঁদের হুকুম মানা ওয়াজিব। যেমন, সন্তানের শরীর দুর্বল তাই তাকে নফল রোজা না রাখার নির্দেশ দিলেন কিংবা বাবা বা মায়ের কোনো প্রয়োজনে সন্তানকে নফল আমল ছেড়ে দিয়ে ওই কাজটি করে দিতে বললেন– তাহলে এই হুকুম মানা সন্তানের উপর ওয়াজিব।
উল্লেখ্য-তাদের হুকুমকৃত কাজটি তাদের জন্য উপকারী হতে হবে। সুতরাং যদি তা তাদের জন্য ক্ষতিকর হয় তাহলে ওই হুকুম মান্য করা যাবে না।বাবা-মা যদি এমন কাজ করতে বলেন যা সন্তানের পক্ষে অসম্ভব কিংবা সম্ভব তবে জীবনের ঝুঁকি আছে তাহলে সে ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতি বাধ্য থাকা জরুরি নয়। কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, لا ضرر ولا ضرار ক্ষতি ও ক্ষতি সাধনের কোন অনুমতি নেই। (সুনানে দারাকুতনী ৩০৭৯)
*উক্ত ক্ষেত্রসমূহে তাঁদের আনুগত্য না করা মানে তাঁদের সঙ্গে অসদাচারণ করা নয়। কেননা, উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, পিতামাতার সেবা ও সদ্ব্যবহারের জন্য তাঁদের মুসলমানও হওয়া জরুরী নয়।
★তবে বাবা-মায়ের কথায় স্ত্রীকে তালাক দেয়া যাবে কিনা? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর এই যে, বাবা-মা স্ত্রীকে তালাক দিতে বললে কারণ জানতে হবে। কারণ যদি সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত হয় এবং সে কারণে তালাক ছাড়া আর কোনো পথ বাকি না থাকে, পাশাপাশি যদি তালাক প্রদান করার দ্বারা আপনার জিনায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে পিতা মাতার সন্তুষ্টির জন্য স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে।
عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: كَانَتْ لِي امْرَأَةٌ كُنْتُ أُحِبُّهَا، وَكَانَ أَبِي يَكْرَهُهَا، فَقَالَ لِي: طَلِّقْهَا، فَأَبَيْتُ، فَأَتَى رَسُولَ اللَّهِ ﷺ فَذَكَرَ ذَلِكَ لَهُ، فَقَالَ: «طَلِّقْهَا» فَطَلَّقْتُهَا
হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার একজন স্ত্রী ছিল। যাকে আমি ভালবাসতাম। কিন্তু আমার পিতা [হযরত উমর বিন খাত্তাব রাযি. যৌক্তিক কারণে] তাকে পসন্দ করতো না। তিনি আমাকে বললেন, তাকে তালাক দিতে। কিন্তু আমি তালাক প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানালাম। তখন আমার পিতা রাসূল ﷺ-এর কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করলে রাসূল ﷺবললেন, তাকে তালাক দিয়ে দিতে। ফলে আমি আমার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করি। (মুসনাদে আবু দাউদ তায়ালিসী ১৯৩১, মুসনাদে আহমাদ ৪৭১২, সুনানে আবু দাউদ ৫১৩৮)
পক্ষান্তরে কারণ যদি সঠিক না হয়, কেবল বউয়ের প্রতি ঈর্ষাবশতঃ হয়, তাহলে তালাক দেওয়া জায়েয হবে না।এতে আপনি এবং আপনার মা সবাই গেনাহগার হবেন৷
[আল্লাহর নিকট তালাক একটি নিকৃষ্টতর বৈধ কাজ,অনুমতি আছে কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া নয়৷ ]