ধর্মের চোখে ধর্মকুটুম মুফতি আবদুল হালীম পার্থিব জীবন যেমন ক্ষণকালীন তেমনি এর বন্ধন-সম্পর্কও নশ্বর ধ্বংসশীল। বিপরীত ইসলামী ভ্রাতৃত্ব, যা ইহকাল পরকাল তথা দুনিয়া ও আখেরাতে সমান কার্যকরী, উপকারী ও মহান প্রভুর সন্তুষ্টির উপায়। বংশগত আত্মীয়তা ও ইসলামী ভ্রাতৃত্ব কারও মধ্যে সমবেত হলে অবশ্যই তা রক্ষা করা কর্তব্য। এটা আল্লাহর দান। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, 'আর তোমরা আল্লাহর রশি অাঁকড়ে ধরো ও বিভক্ত হইও না। তোমাদের ওপর আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ করো, যখন তোমরা ছিলে (পরস্পরের) শত্রু। অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়-মনে মিলন ঘটিয়েছেন। ফলে তোমরা তার নেয়ামতে ভাই ভাই হয়ে আছো, অথচ তোমরা অগি্নকু-ের গর্তের কিনারে ছিলে। পরে তিনি সেখান থেকে তোমাদের উদ্ধার করেছেন।' (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সারকথা, পৃথিবীর সব মুসলমান ভাই ভাই। ইসলামের ছায়াতলে যারা আশ্রয় নেবে তাদের বংশগত সম্পর্ক পিতৃত্ব, মাতৃত্ব, ভ্রাতৃত্ব, চাচাতো, মামাতো, খালাতো, আপন-পর, প্রতিবেশী-পরদেশি যাই হোক, মুসলিম হিসেবে তাদের সম্পর্ক ভাইয়ের মতো সহানুভূতিপূর্ণ হতে হবে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, 'মোমিনরা সব ভাই ভাই।' (সূরা হুজরাত : ১০)। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরতের পর মুসলমানদের উন্নতিকল্পে কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে একেকজন মোহাজের ও আনসারের মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দিয়েছিলেন। নবী করিম (সা.) সায়াদ বিন রাবি আনসারিকে আবদুর রহমান বিন আউফের সঙ্গে, আবু দারদার সঙ্গে সালমান ফারসি (রা.) এর ভ্রাতৃত্ব করে দিয়েছিলেন। (বোখারি : ৩৭২২)। নবীজির ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের দৃষ্টান্ত আমাদের গ্রাম-গঞ্জে কিছুকাল আগেও ছিল। এক ছেলের সঙ্গে আরেক ছেলের ভ্রাতৃত্ববন্ধন গড়ে দেয়া হতো। আজীবন তারা পরস্পরকে দোস্ত বলে ডাকত। মেয়েরা বলত 'সই' বা 'সখী'। এসব সম্পর্ক স্থাপন হতো ছেলের সঙ্গে ছেলের, মেয়ের সঙ্গে মেয়ের। তাই বলে কখনও বিপরীত লিঙ্গের এমন সম্পর্ক হতো না, যা শরিয়ত সমর্থন করে না। মোমিন পুুরুষরা যেমন ইসলামী ভ্রাতৃত্বে ভাই ভাই, মোমিন নারীরা তেমনই বোন বোন। এর অর্থ এটা নয় যে, মোমিন নারী-পুরুষের পর্দার বিধান অকার্যকর। যাদের সঙ্গে বিবাহ বৈধ, অবশ্যই তাদের পর্দা করতে হবে। তাদের বিয়ে না করে পরস্পরে সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। শরিয়তের পরিভাষায় এদের বলা হয় 'গায়রে মাহরাম', যাদের সঙ্গে বিয়েশাদি হারাম নয়। সূরা নিসার ২৪, ২৫ আয়াতে 'মাহরাম' আত্মীয়দের তালিকার ফিরিস্তি আছে। কিন্তু ধর্মকুটুমের নামে কোনো আত্মীয়তার অনুমোদন তাতে নেই। অথচ ইসলামে অনুমোদন না থাকলেও অনেকের কাছে ধর্মকুটুমের বাড়াবাড়ি লক্ষণীয়। বর্তমানে ধর্মভাই, ধর্মবোন, ধর্মপিতা, ধর্মমাতা, ধর্মফুফু, ধর্মখালা, ধর্মমামা, ধর্মচাচা, ধর্মছেলে, ধর্মমেয়ে, এভাবে ধর্মের নামে নানাবিদ ধর্মকুটুমের অধর্মের নিষিদ্ধ সম্পর্ক গড়া হয়। অথচ ধর্মকুটুমের চেয়ে পালককুটুমের সম্পর্ক আরও অটুট হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম বলেছে, পালকের সম্পর্ক আপনের মতো নয়। তাহলে নিষিদ্ধ সম্পর্ক কীভাবে আপনের মতো হতে পারে! এমনকি অনেককে দেখা গেছে, আপনের চেয়ে ধর্মকুটুমের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষায় বেশি উদ্গ্রিব। আপন বোনের খবর নেই পাতানো বোনের দরদ উপচে পড়ে। ভাইবোনের সম্পর্ক সৃষ্টি হয় পিতামাতার মাধ্যমে। কিন্তু এসব ধর্মভাইবোনদের সম্পর্ক পিতামাতার মধ্যস্থতা ছাড়াই সৃষ্টি হয়। তারা যেন বোঝাতে চায়, তাদের সম্পর্ক আদম-হাওয়ার মতো মা-বাবার মাধ্যম ছাড়া কুদরতি সম্পর্ক। ইসলামে এ ধরনের জন্মহীন সম্পর্কের কোনো অবকাশ নেই। কোরআন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছে, অন্যের ছেলেকে পুত্র দাবি করলে সে আপন ছেলের মতো নয়। অন্য মহিলাকে মা বলে ডাকলে সে মা হয়ে যায় না। বরং নারী যাকে জন্ম দিয়েছে, সে-ই তার সন্তান, ওই নারী তার মা। মা-সন্তান অন্য কেউ নয়। অন্যকে 'মা' ডাকাডাকি শুধু শুধু তাদের মুখের বুলি। এর বাস্তবতা নেই। হজরত জায়েদ বিন হারেসা (রা.)-কে নবীজি (সা.) ছোট থেকে পেলেপুষে বড় করেছিলেন। লোকেরা তাকে জায়েদ বিন মুহাম্মাদ বলে ডাকা শুরু করল। আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিলেন, তোমরা তাকে 'জায়েদ বিন হারেসা' বলে ডাক। জায়েদ বিন মুহাম্মাদ বলবে না। কেননা নবীর কোনো পুত্রসন্তান জীবিত নেই। জায়েদকে ছেলের মতো লালন-পালন করলেও সে তার ছেলে হয়ে যায়নি। বরং সে তার পালকপুত্র। (সূরা আহজাব : ৪-৪০, মুসলিম : ২৪২৫)। বিশেষত এমন সম্পর্কের অজুহাতে যখন বেপর্দায় নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি হয়, তখন কিছুতেই এটা বৈর্ধ সম্পর্ক হতে পারে না। এমন অদ্ভুত সম্পর্ক ইসলামী শরিয়ত যেমন মেনে নেয় না, দেশের কোনো আইনেও তা স্বীকৃত হতে পারে না। এমনকি সচেতন অভিজাত কোনো অভিভাবক এভাবে তাদের ব্যক্তিত্ব ও সম্মান-সম্ভ্রম বিলিয়ে দেবে না। ধর্মকুটুমের মতো আরেকটা সম্পর্ক আমাদের দেশে লক্ষ করা যায়, 'উকিল সম্পর্ক'। বিয়েশাদিতে কনের এজিন বা সম্মতি নিতে গায়রে মাহরাম পুরুষ উকিল হন। বিবাহ-পরবর্তী জীবনে তারা উকিল বাপ হিসেবে আখ্যা পান। অথচ উকিল বাপ হতে হলে তারাই হবেন যারা কনের মাহরাম। যাদের সঙ্গে তার কথাবার্তা-দেখাশোনা জায়েজ। কিন্তু অন্যেরা কেউ উকিল পিতা হলে তার সঙ্গে এ সুবাদে কোনোরূপ দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তা মুসলিম নারীর জন্য জায়েজ হবে না। (সূরা নিসা : ২৩, রদ্দুর মুহতার : ৩/২৮)।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ