Call

আহলেহাদীছ-এর পরিচয় : পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসারী ব্যক্তিকে ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয়। যিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে শর্তহীনভাবে মেনে নিবেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের তরীকা অনুযায়ী নিজের সার্বিক জীবন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন, কেবলমাত্র তিনিই এ নামে অভিহিত হবেন। এটি ইসলামের আদিরূপ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, যা ছাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে এ যাবৎ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিচালিত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য যে, আহলেহাদীছ হওয়ার জন্য রক্ত, বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চল শর্ত নয়। ছাহাবায়ে কেরাম হ’লেন জামা‘আতে আহলেহাদীছের প্রথম সারির সম্মানিত দল। যাঁরা এ নামে অভিহিত হ’তেন। যেমন প্রখ্যাত ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) কোন মুসলিম যুবককে দেখলে খুশী হয়ে বলতেন, রাসূল (ছাঃ)-এর অছিয়ত অনুযায়ী আমি তোমাকে ‘মারহাবা’ জানাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে তোমাদের জন্য মজলিস প্রশস্ত করার ও তোমাদেরকে হাদীছ বুঝাবার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। কেননা তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর ও পরবর্তী আহলুল হাদীছ’।[ খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ১২; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৮০ ।] ‘বড় পীর’ বলে খ্যাত শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী (মৃঃ ৫৬১ হিঃ) ‘নাজী’ ফের্কা হিসাবে আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বর্ণনা দেওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে বিদ‘আতীদের ক্রোধ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, বিদ‘আতীদের নিদর্শন হ’ল আহলেহাদীছদের গালি দেওয়া ও বিভিন্ন নামে তাদের সম্বোধন করা। এগুলি সুন্নাতপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের দলীয় বিদ্বেষ ও অন্তর্জ্বালার বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন কিছুই নয়। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্য কোন নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। সেটি হ’ল ‘আছহাবুল হাদীছ’ বা আহলেহাদীছ।[ আব্দুল কাদের জীলানী, কিতাবুল গুনিয়াহ ওরফে গুনিয়াতুত ত্বালেবীন (মিসরী ছাপা, ১৩৪৬ হিঃ), ১/৯০ পৃঃ ।] স্পেনের বিখ্যাত মনীষী হিজরী পঞ্চম শতকের ইমাম ইবনু হযম আন্দালুসী (৩৮৪-৪৫৬ হিঃ) বলেন, আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত যাদেরকে আমরা হকপন্থী ও তাদের বিরোধীদের বাতিলপন্থী বলেছি, তারা হলেন, (ক) ছাহাবায়ে কেরাম (খ) তাদের অনুসারী শ্রেষ্ঠ তাবেঈগণ (গ) আহলেহাদীছগণ (ঘ) ফক্বীহদের মধ্যে যাঁরা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে আজকের দিন পর্যন্ত (ঙ) এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সকল ‘আম জনসাধারণ, যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছে’।[ ইবনু হযম, কিতাবুল ফিছাল, বৈরূত: ১/৩৭১ ।] ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হিঃ) বলেন, মুসলমানদের মধ্যে আহলেহাদীছদের অবস্থান এমন মর্যাদাপূর্ণ, যেমন সকল জাতির মধ্যে মুসলমানদের অবস্থান’।[ ইবনু তায়মিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ, বৈরূত: ২/১৭৯ ।] ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (১১১৪-৭৬/১৭০৩-৬২খৃঃ) বলেন, চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান নির্দিষ্টভাবে কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের তাক্বলীদের উপর সংঘবদ্ধ ছিল না’।[ শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১/১৫২-৫৩ ‘চতুর্থ শতাব্দীর পূর্বের ও পরের লোকদের অবস্থা’ অনুচ্ছেদ।] হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৫১হিঃ) বলেন, মাযহাবী তাক্বলীদের এই বিদ‘আত আবিষ্কৃত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ভাষায় নিন্দিত ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে[ ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াকক্বেঈন ২/২০৮ ।] শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, আববাসীয় খলীফা হারূনুর রশীদের খেলাফতকালে (১৭০-৯৩/৭৮৬-৮০৯ খৃঃ) আবু হানীফা (রহঃ)-এর প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফ (রহঃ) প্রধান বিচারপতি থাকার কারণে ইরাক, খোরাসান, মধ্য তুর্কিস্তান প্রভৃতি অঞ্চলে হানাফী মাযহাবের বিস্তৃতি ঘটে’।[ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৪৬ ‘ফক্বীহদের মাযহাবী মতভেদের কারণ সমূহ’ অনুচ্ছেদ।] পরে হানাফীরা শাফেঈদের বিরুদ্ধে মোঙ্গলবীর হালাকু খাঁকে ডেকে আনলে ৬৫৬/১২৫৮ খৃষ্টাব্দে বাগদাদের আববাসীয় খেলাফত ধ্বংস হয়ে যায়। এ সময়ের কিছু পূর্বে গযনীর সুলতান মোহাম্মাদ ঘোরীর তুর্কী গোলাম কুতুবুদ্দীন আইবক ও ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজীর মাধ্যমে ৬০২ হিঃ/১২০৩ খৃষ্টাব্দে দিল্লী হ’তে বাংলা পর্যন্ত সামরিক বিজয় সাধিত হয়। এঁরা ছিলেন নওমুসলিম তুর্কী হানাফী। যাতে মিশ্রণ ঘটেছিল তুর্কী, ঈরানী, আফগান, মোগল, পাঠান এবং স্থানীয় হিন্দু ও বৌদ্ধ আক্বীদা ও রীতি-নীতি সহ অসংখ্য ভারতীয় কুসংস্কার। ছাহাবা, তাবেঈন এবং আরব বণিক ও মুহাদ্দিছগণের মাধ্যমে ইতিপূর্বে প্রচারিত বিশুদ্ধ ইসলামের সাথে যার খুব সামান্যই মিল ছিল’। এ সময়কার অবস্থা বর্ণনা করে খ্যাতনামা ভারতীয় হানাফী বিদ্বান আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী (১৮৪৮-৮৬ খৃঃ) বলেন, ‘ফিক্বহ ব্যতীত লোকেরা কুরআন ও হাদীছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ...আহলেহাদীছগণকে তারা জানত না। কেউ কেউ ‘মিশকাত’ পড়লেও তা পড়ত বরকত হাছিলের জন্য, আমল করার জন্য নয়। তাহকীকী তরীকায় নয়। বরং তাকলীদী তরীকায় ফিক্বহের জ্ঞান হাছিল করাই ছিল তাদের লক্ষ্য’।[ আহলেহাদীছ আন্দোলন, ডক্টরেট থিসিস (রাবি ১৯৯২; প্রকাশক, হা.ফা.বা. ১৯৯৬), পৃঃ ২৩০ ।] সুলায়মান নাদভী (১৮৮৪-১৯৫৩) বলেন, ‘তুর্কী বিজয়ী যারা ভারতে এসেছিলেন, দু’চারজন সেনা অফিসার ও কর্মকর্তা বাদে তাদের কেউই না ইসলামের প্রতিনিধি ছিলেন, না তাদের শাসন ইসলামী নীতির উপর পরিচালিত ছিল। এরা ছিলেন আরব বিজয়ীদের থেকে অনেক দূরে’।[ প্রাগুক্ত।] তাই বলা চলে যে, মধ্য এশিয়া থেকে উত্তর ভারত হয়ে তুর্কী-ঈরানী সাধক-দরবেশদের মাধ্যমে ও রাজশক্তির ছত্রছায়ায় পরবর্তীতে বাংলাদেশে যে ইসলাম প্রচারিত হয়, তা ইতিপূর্বে আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে দ্বীনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আগত প্রাথমিক যুগের মূল আরবীয় ইসলাম হ’তে বহুলাংশে পৃথক ছিল। ফলে হানাফী শাসক ও নবাগত মরমী ছূফীদের প্রভাবে বাংলাদেশের মুসলমানেরা ক্রমে হানাফী ও পীরপন্থী হয়ে পড়ে। তারা বহুবিধ কুসংস্কার এবং শিরক ও বিদ‘আতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে এদেশের মূল শরীয়তী ইসলাম পরবর্তীতে লৌকিক ইসলামে পরিণত হয়। যার ফলশ্রুতিতে ঘোড়াপীর, তেনাপীর, ঢেলাপীর প্রভৃতি অসংখ্য ভুয়া পীর বাংলার মুসলমানের পূজা পায়।[ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪০৩-০৫ ।] শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, হানাফী মাযহাবের ক্বিয়াসী ফৎওয়া সমূহ এবং ফিক্বহ ও উছূলে ফিক্বহের নামে যেসব মাসআলা-মাসায়েল ও আইনসূত্র সমূহ লিখিত হয়েছে, সেগুলিকে ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর দুই শিষ্যের দিকে সম্বন্ধিত করার ব্যাপারে একটি বর্ণনাও বিশুদ্ধ নয়’।[ শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১/১৬০ ।] তিনি ‘আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়-এর পার্থক্য’ শিরোনামে তাঁর জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ্র মধ্যে (১/১৪৭-৫২) আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের দলীল গ্রহণের নীতিমালা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি মযহাবপন্থী মুক্বাল্লিদগণের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তারা মনে করে যে, একটি মাসআলাতেও যদি তাদের অনুসরণীয় বিদ্বানের তাক্বলীদ হতে সে বেরিয়ে আসে, তাহলে হয়তবা সে মুসলিম মিল্লাত থেকেই খারিজ হয়ে যাবে। ঐ বিদ্বান যেন একজন নবী, যাকে তার কাছে প্রেরণ করা হয়েছে’।[ ঐ, তাফহীমাতে ইলাহিয়াহ ১/১৫১ ।] তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ছালাতে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করে, ঐ ব্যক্তি আমার নিকট অধিক প্রিয় ঐ ব্যক্তির চাইতে, যে ব্যক্তি রাফ‘উল ইয়াদায়েন করে না। কেননা রাফ‘উল ইয়াদায়েনের হাদীছ সংখ্যায় অধিক এবং অধিকতর মযবুত’।[ ঐ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ২/১০ ।] হানাফী ও শাফেঈ মাযহাবের বিশ্বস্ত ফিক্বহ গ্রন্থ হেদায়া, আল-ওয়াজীয প্রভৃতির অমার্জনীয় হাদীছবিরোধিতা সম্পর্কে আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী বলেন, এগুলি মওযূ বা জাল হাদীছ দ্বারা পরিপূর্ণ।[ আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী, নাফে‘ কাবীর (জামে‘ ছগীর-এর ভূমিকা, লাক্ষ্ণৌ : ১২৯১ হিঃ), পৃঃ ১৩ ।] ইমাম ইবনু দাক্বীকুল ঈদ (মৃ: ৭০২ হিঃ) চার মাযহাবে প্রচলিত ছহীহ হাদীছ বিরোধী ফৎওয়াসমূহের একটি বিরাট সংকলন তৈরী করেছিলেন। যার ভূমিকাতে তিনি ঘোষণা করেছেন যে, এই মাসআলাগুলিকে চার ইমামের দিকে সম্বন্ধ করা ‘হারাম’।[ ছালেহ ফুল্লানী, ঈক্বাযু হিমাম পৃঃ ৯৯ ।] কারণ চার ইমামের প্রত্যেকে ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন এবং তারা প্রত্যেকে বলে গেছেন, যখন তোমরা ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনে রেখ সেটাই আমাদের মাযহাব’।[ শা‘রানী, কিতাবুল মীযান (দিল্লী ছাপা, ১২৮৬ হিঃ), ১/৭৩ পৃঃ।] আহলেহাদীছগণ তাঁদের সেকথাই মেনে চলেন এবং তাদের সার্বিক জীবন পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ

উৎপত্তি ও ইতিহাস :
আহলে হাদীস পরিভাষাটি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. এর হাত ধরেই উৎপত্তি লাভ করে। এর পূর্বে হুবহু এ শব্দটির ব্যবহার তেমন পাওয়া যায় না। অবশ্য আহলে হাদীস শব্দের সমর্থক শব্দের ব্যবহার এর পূর্বে সাহাবা তাবিয়ীদের যুগেও লক্ষ্য করা যায়। নবম শতাব্দিতে খলীফা মামুনুর রশীদের খিলাফত যুগে যখন কুরআন আল্লাহর সৃষ্টি কি সৃষ্টি নয়- এ দ্বন্দ্ব
মাথা চাড়া দিয়ে উঠে তখন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এবং তার হাদীস বিশেষজ্ঞ শিষ্যগণ এক্ষেত্রে নীরবতার পথ অবলম্বন করেন। তখন থেকেই আহলুল হাদীস শব্দটি
ব্যাপকভাবে আলোচনায় উঠে আসে। ফলে শব্দটি একটি পারিভাষিক রূপ পরিগ্রহ করে। <!-- a briet history of islam by karen arms armstrong, phoenix, london, আলকামিল ফিত তারীখ ৩/১৭৯।
অন্য একটি সূত্র মতে ইসলাম আগমনের তৃতীয়তম শতাব্দির দিকে সমসাময়িক আইন শাস্ত্রের আলেমদের হাদীসের উপর অধিক জোর দেয়ার মাধ্যমে এ পরিভাষার সূচনা হয়। oxford islamic studiese

আহলে হাদীসের সমর্থক শব্দ : আসহাবুল হাদীস, সাহিবুল হাদীস, আসহাবুল আসার, সাহিবুল আসার, আহলুস সুন্নাহ, মুহাদ্দিস।
আহলে হাদীস শব্দের আভিধানিক অর্থ :
আহলে হাদীস শব্দটি একটি ফারসী ব্যাকরণিক যুক্ত শব্দ। তবে সংযুক্ত শব্দ দুটি ভিন্নভাবে মূলত আরবী ভাষার শব্দ। যৌগিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ফারসী ব্যকরণ নীতি ব্যবহৃত হয়েছে। মূল আরবী শব্দ হলো, আহলুল হাদীস। আহলুন শব্দের অর্থ ধারক, অনুসারী, উপযুক্ত, বিশিষ্টতর, অধিকতর নিজস্ব বা একান্ত, ঘনিষ্ঠতর। আরবীতে বলা হয় আহলুর রজুলি। অর্থ
ব্যক্তির বেশি ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং আহলুল হাদীস যুক্ত শব্দটির আভিধানিক অর্থ দাড়ায়, এমন ব্যক্তি যে হাদীসের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ, হাদীসের অনুসারী, হাদীসের ধারক। যেমন হাদীসে এসেছে أوترو يا اهل القرآن । অর্থ হে কুরআনের ধারকগণ তোমরা বিতর নামাজ আদায় করো।
সুনানে তিরমিযী, হাদীস ৬৭৫। অতএব আভিধানিক অর্থে যে ব্যক্তি যে কোনো উপায়ে যে কোনো পদ্ধতিতে হাদীসের সাথে সম্পৃক্ত হবে তাকেই আহলে হাদীস উপাধিতে
ভূষিত করা যাবে। অন্যদিকে পবিত্র করআনের অনেক জায়গায় কুরআনকে হাদীস বলে অভিহিত করা হয়েছে। সুতরাং আভিধানিক অর্থে কুরআনের সাথে যারা বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত হয় তাদেরকেও আহলে হাদীস বলা যেতে পারে।
আহলে হাদীস শব্দের পারিভাষিক অর্থ :
আহলে হাদীস শব্দের দুটি পরিভাষা রয়েছে। একটি হলো শাস্ত্রীয় পরিভাষা। দ্বিতীয়টি হলো পরিবর্ধিত আধুনিক পরিভাষা।
আহলে হাদীস শব্দের শাস্ত্রীয় পরিভাষা :
১। শাস্ত্রীয় পরিভাষা সম্বন্ধে আবু মুহাম্মদ ইবনে কুতাইবা রাহ. বলেন, সাহিবে হাদীসগণ সত্যকে যথাস্থান থেকে অন্বেষণ করেন এবং মূল জায়গা থেকে একে অনুসন্ধান করে আনেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ ও আসারকে জলে স্থলে, পূর্ব পশ্চিমে অন্বেষণ করার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করেন। তারা একটি হাদীস বা একটি
সুন্নাহকে অন্বেষণ করার ক্ষেত্রে মূল বর্ণনাকারী থেকে সরাসরি গ্রহণ করা অবধি পদব্রজে ভ্রমণ করতে থাকেন। এরপর হাদীসগুলোর উপর অবিরাম পর্যালোচনা ও গবেষণা-বিশ্লেষণ করতে থাকেন। এরপর হাদীসের শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা, কার্যকারিতা ও বিলুপ্ত হওয়া না হওয়ার ব্যাপারগুলো চূড়ান্তভাবে নির্ণয় করেন। ফকীহদের মধ্য হতে যারা নিজস্ব অভিব্যক্তি বা অভিমতের মাধ্যমে হাদীসের বিপরীত মত পোষণ করেছেন তাদেরকে
চিহ্নিত করে এ ব্যাপারে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। এতে করে অস্পষ্ট থাকার পর প্রকৃত সত্যটি পরিস্ফুটিত হয়েছে, বিলুপ্ত হওয়ার পর সমুন্নত হয়েছে, বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর সমন্বিত হয়েছে। ফলে যে ব্যক্তি সুন্নাহ বিরোধী ছিল সে সুন্নাহর অনুসারী হয়ে গেছে, যে এ ব্যাপারে অসচেতন ছিল সে সচেতন হয়েছে এবং অমুক তমুকের উক্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দেয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। তাবীলু মুখতালিফিল হাদীস ১/৬৯
২। খতীব বাগদাদী রাহ.  বলেন, আল্লাহ তাআলা আহলে হাদীসদেরকে শরীয়তের মূল ভিত্তি বানিয়েছেন। তাদের মাধ্যমে সর্বধরনের কদাকর বিদাতকে নির্মূল করেছেন। তারা সৃষ্টিজীবের মাঝে আল্লাহ তাআলার বিশ্বস্তজন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং উম্মাহর মধ্যকার সেতুবন্ধ। উম্মাহকে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে চেষ্টা সাধনাকারী, তাদের আলো
সমুজ্জ্বল, তাদের মাহাত্ম চলমান, তাদের নির্দেশনাবলি আলোকোজ্জ্বল, তাদের মাযহাব-পথ সুস্পষ্ট, তাদের প্রমাণাদি শক্তিশালী। আসহাবে হাদীস ব্যতীত প্রত্যেক শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের প্রবৃত্তি-চাহিদার পক্ষাবলম্বন করে থাকে এবং নিজেদের মতামতকেই সুন্দর মনে করে থাকে। কারণ আসহাবে হাদীসের পাথেয় হলো আলকুরআন। সুন্নাহ হলে তাদের প্রমাণপুঞ্জি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন তাদের দলনেতা। তার সাথেই তারা সম্পৃক্ত হন। প্রবৃত্তিক চাহিদার বাহনে তারা সমাসীন হন না। নিজেদের মত-অভিমতের ব্যাপারে তারা ভ্রক্ষেপ করেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তারা যা কিছু বর্ণনা করেন তাই তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়। তারাই ন্যায় পরায়ন। তারাই বিশ্বাসযোগ্য এবং নিরাপদ। তারাই দীনের রক্ষক এবং প্রহরী। তারাই ইলমের বাহক এবং
সংরক্ষক। কোনো হাদীসের ব্যাপারে মতভিন্নতা হলে তারাই হবেন আশ্রয়স্থল। তারা যে সিদ্ধান্ত দিবেন তাই গ্রহীত এবং শ্রুত হবে। তাদের প্রত্যেক আলেম ফকীহ, সচেতন, মহান ইমাম, খোদাভীরু, বিশেষ শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী, নির্ভরযোগ্য কুরআন বিশেষজ্ঞ, সুন্দর আলোচক। তারাই সংখ্যাগুরু। তাদের পথই সঠিক পথ। -শরাফু আসহাবিল হাদীস লিল খতীব আলবাগদাদী ১/৮
৩। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, মুক্তিপ্রাপ্ত দল হওয়ার সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত হল ঐসব আহলুল হাদীস ওয়াস সুন্নাহ ব্যক্তিবর্গ যারা
১। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কাউকে অনুসৃত ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করে না। এবং গোড়ামি, স্বদলপ্রীতি কিংবা প্রান্তিকতায় লিপ্ত হয় না।
২। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী এবং সামগ্রিক অবস্থা সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি অবগত।
৩। হাদীসের শুদ্ধতা ও দুর্বলতা নির্ণয়ে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন। এবং মানুষের ইমাম।
৪। হাদীসের ক্ষেত্রে ফকীহ তথা গভীর ব্যুৎপত্তি এবং পাণ্ডিত্বের অধিকারী এবং হাদীসের অর্থ ও তাৎপর্য সম্বন্ধে সবিশেষ অবগত।
৫। সত্যায়ন, কার্যকর করণ এবং ভালবাসার দিক থেকে হাদীসের অনুসারী।
৬। যারা হাদীসকে ভালবাসে তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখে এবং যারা হাদীসের সাথে বৈরিভাব পোষণ করে তাদের সাথে বৈরিতার সম্পর্ক রাখে।
৭। কুরআন সুন্নাহর আলোকে নিবন্ধ রচনা করে। যেসব নিবন্ধ সুন্নাহর আলোকে প্রমাণিত নয় সেগুলোকে দীনের মূলনীতি এবং সারবস্তু হিসেবে গ্রহণ করে না। বরং যেগুলো কুরআন সুন্নাহর আলোকে প্রমাণিত একমাত্র সেগুলোকেই তারা মূলনীতি হিসেবে বিশ্বাস করে এবং
তার উপর আস্থা পোষণ করে। মাজমূউল ফাতাওয়া লিইবনে তাইমিয়া ৩/৩৪৭
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. আরো বলেন, নিঃসন্দেহে আহলে হাদীস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার শিষ্যবৃন্দ যথা খুলাফায়ে রাশিদীন এবং অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম এর ইলম সম্বন্ধে উম্মাহর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবগত এবং ঘনিষ্ঠ। -মাজমূউল
ফাতাওয়া লিইবনে তাইমিয়া ১/৩০৮
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. অন্যত্র বলেন, আমরা আহলে হাদীস বলে শুধু হাদীস শ্রবণকারী, লিপিবদ্ধকারী কিংবা বর্ণনাকারীদেরকেই উদ্দেশ্য নেই না; বরং আহলে হাদীস বলে আমরা ঐ সমস্ত ব্যক্তিবর্গকেও উদ্দেশ্য নিয়ে থাকি যারা হাদীস মুখস্থ করে, তার দৃশ্যমান ও নিগূঢ় অর্থ সম্বন্ধে অবগতি লাভ করে এবং তা গভীরভাবে উপলব্ধি করে এবং অনুসরণ করে। -মাজমূউল
ফাতাওয়া ৪/৯৪
তিনি আরো বলেন, আহলুল হাদীস ওয়াস সুন্নাহ সাহাবায়ে কেরামের কর্মপন্থা সম্বন্ধে সবিশেষ অবগত। প্রতি যুগের প্রতিটি জনপদে তারাই কুরআন সুন্নাহর ইলমের ধারক-বাহক। পূর্ববর্তী এবং পরবর্তীদের মধ্য হতে তারাই সৃষ্টি জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ। শারহু আকীদাতিল আসফাহানিয়্যাহ ১/১৬৫
৪। ইবনে হাজর আসকালানী রাহ. বলেন, একটি দল সদা সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। আর তারা হলো ফুকাহাউ আসহাবিল হাদীস। অর্থাৎ আহলে হাদীস ফকীহগণ সদা সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত দল হিসেবে পরিগণিত হবে। ফাতহুল বারী ১/১৪০
৫। আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. সাহায্যপ্রাপ্ত দল সম্বন্ধে বলেন, যদি তারা আসহাবুল হাদীস না হন তবে আমি জানি না তারা কারা? মুজামু লিসানিল মুহাদ্দিসীন ৩/১২৯
২। আধুনিক আহলে হাদীস পরিভাষা :
 যে ব্যক্তি ফিকহের গভীরতায় না গিয়ে হাদীসের দৃশ্যমান অর্থ গ্রহণ করে নিছক হাদীসকে অনুসরণ করে তাকেও আধুনিক পরিভাষায় আহলে হাদীস বলা হয়। ইবনে তাইমিয়া রাহ. আহলে হাদীস পরিভাষায় ব্যাপকতা আনতে গিয়ে বলেন, শুরু তিন যুগের সালাফ তাথা
পূর্বসূরিগণ এবং তৎপরবর্তীদের যারা অনুসরণ করে তারাও হল আহলে হাদীস। -মাজমূউল ফাতাওয়া
৬/৩৫৫
আধুনিক আহলে হাদীস পরিভাষার শ্রেণী ভাগ :
যারা আহলে হাদীসের পারিভাষিক অর্থকে বিস্তৃত অর্থে গ্রহণ করেন তাদের মাঝে দুটি শ্রেণী লক্ষ করা যায়। এক। ভারত উপমহাদেশীয় আহলে হাদীস। দুই। আরব্য আহলে হাদীস।
উপমহাদেশীয় আহলে হাদীসের বৈশিষ্টগত পরিচিতি :
১। সাধারণত উপমহাদেশীয় আহলে হাদীসগণ তাকলীদ তথা নির্দিষ্ট কোনো সালাফ ইমামের ব্যাখ্যা গ্রহণ করাকে শিরক বলে অভিহিত করেন।
২। সালাফের মধ্যকার মতবিরোধপূর্ণ ধর্মীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ের বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হন।
৩। তারা কখনো নিজেদেরকে সালাফী বলে পরিচয় দিলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা অনুসৃত আসলাফ ইমামদের ব্যাপারে শ্রদ্ধাবোধ দেখান না।
৪। তারা এক কুরআন এবং এক হাদীস বলে শ্লোগান দিলেও তাদের মাঝে প্রচুর পরিমাণ মত-পথ বা মতভিন্নতা লক্ষ করা যায়। এমন কি তাদের এক শ্রেণী কর্তৃক অন্য শ্রেণীকে কাফের বলার তথ্যও লক্ষ্যগোচর হয়।
৫। তারা নিজেদের মতাদর্শকে অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ার মানষিকতা পোষণ করেন । পরমত সহিষ্ণুতাবোধ তারা লালন করতে চান না।
৬। তারা নিজেদেরকেই একমাত্র হাদীসের অনুসারী বলে দাবি করেন। অন্যদেরকে হাদীস বিরোধী বলে অভিহিত করেন।
৭। তারা হাদীস অনুসরণকে কেন্দ্র করে স্বতন্ত্র পরিচিতি লাভের জন্য আহলে হাদীসের মত অতি সম্মানিত একটি উপাধিব্যাঞ্জক শব্দকে সাম্প্রদায়িক এবং দলীয় রূপে চিত্রায়িত করে থাকেন।

আরব্য আহলে হাদীসের বৈশিষ্টগত পরিচিতি :
১। তারা আহলে হাদীস শব্দটিকে কেবল বৈশিষ্টগত দিক থেকে ব্যবহার করেন। স্বতন্ত্র পরিচিতি লাভের জন্য ব্যবহার করেন না।
২। তারা ঢালাওভাবে তাকলীদকে বাকা চোখে দেখেন না। বরং তারা সাধারণ মানুষের জন্য নির্দিষ্ট কোনো আলেম বা ইমামের তাকলীদকে আবশ্যক মনে করেন।
৩। মতবিরোধপূর্ণ ধর্মীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে তারা উদার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন।
৪। তারা আইম্মায়ে সালাফের ব্যাপারে আদৌ বিরূপ মন্তব্য করেন না কিংবা অশ্রদ্ধা দেখান না।
৫। তারা আহলে হাদীস শব্দের বিস্তৃত অর্থ গ্রহণ করলেও নিজেদেরকেই একমাত্র আহলে হাদীস মনে করেন না। বরং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর সকল সদস্যকেই আহলে হাদীস মনে করেন।
৬। তারা নিজেদের মতাদর্শকে অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ার মানষিকতা লালন করেন না।
৭। তাদের অধিকাংশ আলেম কোনো না কোনো মাযহাবের অনুসরণ করে থাকেন।
৮। তাদের কেউ কেউ নিজেদেরকে সরাসররি কোনো মাযহাবের সাথে সম্পৃক্ত না করলেও ফিকহ, ফতওয়া, মাযহাব এবং মাযহাবের অনুসারীদের ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন। তারা সাধারণ মানুষকে আলেমদের অনুসরণ এবং তাদের সাথে যুক্ত থাকার জন্য
উৎসাহিত করে থাকেন।
৯। আরবের মূল ধারার আলেমগণ মুজতাহিদ ইমাম ও তাদের সংকলিত ফিকহী মাযহাবসমূহের ব্যাপারে পরিপূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। তারা কখনোই মাযহাব অনুসারীদের ব্যাপারে অশালীন মন্তব্য করেন না। যারা এ ধরনের অনাকাক্সক্ষীত কাজে ব্যতিব্যাস্ত তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন দেশ থেকে সেখানে গিয়ে স্থানান্তরিত হয়েছেন।
১০। শাইখ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব ইবনে সুলাইমান নাজদী রাহ., শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম আলে শায়খ রা., শায়খ আব্দুর রহমান সা’দী রাহ., শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ., শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আলউসাইমীন রাহ., শায়খ সালেহ ইবনে
ফাওযান, শায়খ আবু বকর জাবের আল জাযায়েরী রা., শায়খ আতিয়্যা সালেম, শায়খ শানকীতি রাহ. প্রমুখ আরব বিশ্বের খ্যাতনামা শায়খদের প্রায় সকলেই নির্দিষ্ট কোনো ইমামকে অনুসরণ করে থাকেন। তাদের সকলেই মতবিরোধপূর্ণ মাসআলা মাসায়েলের ব্যাপারে উদার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন।

উপমহাদেশীয় আহলে হাদীস এবং তাদের যুগ-সীমানা :
প্রকৃত অর্থে আহলে হাদীস হলো, হাদীস শাস্ত্রের সুগভীর পাণ্ডিত্ব অর্জনকারী উলামায়ে মুহাদ্দিসীন। হাদীস, ফিকহ, তাফসীরসহ দীনে ইসলামের বিভিন্ন শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলোতে প্রচুর পরিমাণ আহলুল হাদীস শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তাদের রিফারেন্সে প্রচুর পরিমাণ
হাদীস বিষয়ক আলোচনা সেখানে স্থান পেয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় আহলে হাদীস শব্দটি মূলত বর্তমান কালের ডক্টর  শব্দটির মতই একটি শাস্ত্রীয় উপাধিব্যঞ্জক পরিভাষা। মূলত এ অর্থেই আহলে হাদীস পরিভাষাটি ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে কেউ কেউ এ পরিভাষাটিতে
আরো ব্যাপকতা এনেছেন। যদি আহলে হাদীসের এ বর্ধিত ও বিস্তৃত অর্থ গ্রহণ করা হয় তবে ইমাম আবু হানীফ, ইমাম শাফিয়ী, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. এর ব্যাখ্যা অনুসারে যারা হাদীস অনুসরণ করে থাকে তারাও আহলে হাদীস শ্রেণীভুক্ত হবে।
কারণ ইমাম চতুষ্টয়ের প্রত্যেকেই হাদীসের শাস্ত্রের একেকজন উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। ড.
আব্দুল্লাহ ফকীহ বলেন, তেমনিভাবে অনেকে আহলে হাদীস নাম ব্যবহার করেন। এ আহলে হাদীস অর্থ হলো, বর্ণনা এবং বোধগত দিক থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহকে ধারণকারী এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাহ্যিক এবং লুকায়িত পথনির্দেশনাকে অনুসরণ কারী। সুতরাং এ অর্থে আহলে সুন্নাতের প্রতিটি সদস্যই আহলে হাদীস। বস্তুত মূল পারিভাষিক অর্থ বিবেচনায় সাধারণ হাদীস অনুসারীদেরকে আহলে হাদীস বলা যায় না। এবং বলাটা সমীচীনও নয়। কারণ
মুহাদ্দিসীনে কেরাম পরিভাষাটিকে এতটা ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করেন নি। কুরআন হাদীস সম্বন্ধে সামান্য জানা শোনা ব্যক্তিও এ সত্য ও বাস্তবতাকে স্বীকার করতে বাধ্য। তাছাড়া আহলে হাদীসদের অনুসরণ করলেও আহলে হাদীস নাম ধারণ করা যায় না। কারণ বিশেষ
উপাধী ধারী কোনো ব্যক্তির অনুসরণ করে কেউ সে উপাধি ধারণ করতে পারে না। সাহাবীদের অনসরণ করলেই সাহাবী উপাধী ধারণ করা যায় না। উপাধী ধারণ করা আর অনুসরণ করা এক জিনিস নয়। একথা ইতিহাস স্বীকৃত, অতীতে পৃথিবীর অনেক জায়গায় আহলে হাদীসদের মাযহাব চালু ছিল। সেখানকার অধিবাসীরা আহলে হাদীসদেরকে অনুসরণ করতেন। তাই বলে তারা নিজেদের ক্ষেত্রে আহলে হাদীস নাম ধারণ বা ব্যবহার করতেন এমন কোনো ঐতিহাসিক তথ্য খুজে পাওয়া যায় না। হাদীস অনুসরণ করে আহলে
হাদীস নাম ধারণ করা এবং সেটাকে দলীয় ও সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ার প্রবণতা কেবল এ ভারত উপমহাদেশেই লক্ষ করা যায়। শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. এর
বক্তব্যেও এ কথাটির প্রমাণ পাওয়া যায়। আর একথা ইতিহাস স্বীকৃত বৃটিশ ভারতের পূর্ব যুগে পৃথিবীর কোথাও নিছক হাদীস অনুসরণ করেই আহলে হাদীস উপাধি বা নাম ধারণ করা কিংবা এ নামে দলীয় রূপ দেয়ার তথ্য পাওয়া যায় না। -মাজমূউ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িলি ইবনে উসাইমিন ৯/৩৯৩, ফাতওয়াশ শাবাকাতিল ইসলামিয়া ৯/২২৫৯, মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে বায ৮/৩৬১, আদদুররুরস সানিয়্যাহ, ১/২৭৭, মুকাদ্দামাতুল ইজায ফি বা’দী মাখতাফা ফীহিল আলবানী ওয়াবনু উসাইমীন, ওয়াবনু বায ১/৬, লিকাআতুল বাবিল মাফতুহ ১৯/৩২, ১২/১০০, মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে বায ৪/১৬৬, ইয়ানাতুল মুসতাফীদ শারহু কিতাবিত তাওহীদ ১/১২, আইসারুত তাফাসীর ৭৭৭, মাউকিফুল উম্মাহ মিন ইখতিলাফিল আইম্মাহ ১৪, ফাতাওয়া আরকানিল ইসলাম ৩৯৭, মাজাল্লাতুল মাজমাইল ফিকহি ৫৯, ২১৯, মাসিক আলকাউসার জানুয়ারী ’১৬, ২১

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ

যুগযুগ ধরে হাদীস, উসূলে হাদীস, ফিক্বহ, উসূলে ফিক্বহ এবং হাদীসের ব্যাখ্যা ও হাদীসের বর্ণনাকারীদের ইতিহাসের কিতাব সমূহের ভাষ্য মতে, যারা হাদীসের সনদ ও মতন (বর্ণনাকারী ও মূল বিষয়) নিয়ে নিবেদিত এবং হাদীস শরীফের সংরক্ষণ, হিফাযত, সঠিক বুঝ এর অনুসরণ-অনুকরণে নিজের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদেরকেই আহলে হাদীস বা আছহাবুল হাদীস বলা হয়। চাই সে হানাফী হোক বা শাফেয়ী , মালেকী অথবা হাম্বলী। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা যাকে লা-মাযহাবীরাও অনুসরণ করে থাকে , তিনি বলেন- ﻧﺤﻦ ﻻ ﻧﻌﻨﯽ ﺑﺎﮬﻞ ﺍﻟﺤﺪﯾﺚ ﺍﻟﻤﻘﺘﺼﺮﯾﻦ ﻋﻠﯽ ﺳﻤﺎﻋﮧ ﺍﻭﮐﺘﺎﺑﺘﮧ ﺍﻭ ﺭﻭﺍﯾﺘﮧ ﺑﻞ ﻧﻌﻨﯽ ﺑﮭﻢ ﮐﻞ ﻣﻦ ﮐﺎﻥ ﺍﺣﻖ ﺑﺤﻔﻈﮧ ﻭﻣﻌﺮﻓﺘﮧ ﻭﻓﮭﻤﮧ ﻇﺎﮬﺮﺍ ﻭﺑﺎﻃﻨﺎ ﻭﺍﺗﺒﺎﻋﮧ ﻇﺎﮬﺮﺍ ﻭﺑﺎﻃﻨﺎ۔ শুধু মাত্র হাদীস শ্রবণ, লিখন অথবা বর্ণনায় সীমাবদ্ধ ব্যক্তিদেরকেই “আহলে হাদীস” বলা হয় না; বরং আমাদের নিকট “ আহলে হাদীস” বলতে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের বুঝায় যারা হাদীস সংরক্ষণ , পর্যবেক্ষণ, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থ অনুধাবন করার যোগ্যতা সম্পন্ন এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থের অনুসারী হবে।” { নাক্বদুল মানতিক, পৃ. ১৮ কায়রো থেকে প্রকাশ ১৯৫১ইং} আল্লামা হাফেয মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আল-অজীর (মৃ.৮৪০ হিজরী) লিখেন- ﻣﻦ ﺍﻟﻤﻌﻠﻮﻡ ﺍﻥ ﺍﮬﻞ ﺍﻟﺤﺪﯾﺚ ﺍﺳﻢ ﻟﻤﻦ ﻋﻨﯽ ﺑﮧ ﻭﺍﻧﻘﻄﻊ ﻓﯽ ﻃﻠﺒﮧ “একটি জ্ঞাত কথা হল “আহলে হাদীস” বলতে ঐ ব্যক্তিকে বুঝায়, যিনি এর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে খেদমত করেছেন এবং এর অন্বেষণে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।” উভয়ের বক্তব্যের দ্বারা এ কথাই পরিস্ফুটিত হয় যে, আহলে হাদীস হতে হলে হাদীস সংরক্ষণ ও পর্যবেক্ষণে নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। ফিক্বহে হাদীস তথা হাদীসের মর্মকথা অনুধাবণ করতে হবে, আর আমল করতে হবে সে অনুযায়ী। চাই সে যে মাযহাবেরই হোক না কেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপ ও আশ্চর্যের সাথে ব্যক্ত করতে হচ্ছে যে, লা-মাযহাবীরা “আহলে হাদীস” বলতে মাযহাব অমান্যকারী একটি দল ও একটি নির্দিষ্ট মতবাদ বুঝায়। অনুরূপভাবে যেথায়ই আহলে হাদীস বা আহলুল হাদীস শব্দ দেখতে পাওয়া যায় এর দ্বারা তারা নিজেদেরকেই মনে করে। চাই সে জাহেল বা মূর্খ হোক, নামাযী হোক বা বেনামাযী হোক……হাদীস সম্বন্ধে তার কোন জ্ঞান থাক বা না থাক। কেবল আহলে হাদীস দলে ভর্তি হলেই আহলে হাদীস উপাধি পেয়ে যাবে। { আখবারুল ইত্তেছাল, পৃ.৫ কলাম-১, সংখ্যা-২ ফে. ১৯৬২ আহলে হাদীসের তদানিন্তন সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা ইসমাইল কর্তৃক প্রকাশিত।} তাই এ দলের সবার উপাধি “আহলে হাদীস” যদিও তাদের অনেকেরই পেটে বোমা বিস্ফোরণ ঘটালেও একটি হাদীস নির্গত হবে না। উপরন্তু তাদের দলীয় আলেমদের অনেকেই ফিক্বহে হাদীস সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ জ্ঞানও রাখে না, বুঝার চেষ্টাও করে না। এর প্রমাণ হিসেবে তাদের নেতা নবাব ছিদ্দিক হাসান খানের উক্তি পেশ করছি- ﺗﺮﺍﮬﻢ ﯾﻘﺘﺼﺮﻭﻥ ﻣﻨﮭﺎ ﻋﻠﯽ ﺍﻟﻨﻘﻞ ﻭﻻ ﯾﺼﺮﻓﻮﻥ ﺍﻟﻌﻨﺎﯾۃ ﺍﻟﯽ ﻓﮭﻢ ﺍﻟﺴﻨۃ ﻭﯾﻈﻨﻮﻥ ﺍﻥ ﺫﻟﮏ ﯾﮑﻔﯿﮭﻢ ﻭﮬﯿﮭﺎﺕ ﺑﻞ ﺍﻟﻤﻘﺼﻮﺩ ﻣﻦ ﺍﻟﺤﺪﯾﺚ ﻓﮭﻤﮧ ﻭﺗﺪﺑﺮ ﻣﻌﺎﻧﯿﮧ ﺩﻭﻥ ﺍﻻﻗﺘﺼﺎﺭ ﻋﻠﯽ ﻣﺒﺎﻧﯿﮧ۔ “আপনি তাদেরকে কেবল হাদীসের শব্দ নকল করতে দেখবেন, হাদীস বুঝার প্রতি তারা কোন ভ্রুক্ষেপই করে না। এতটুকু তারা নিজেদের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করে। অথচ এ ভ্রান্ত ধারণা মূল লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে, কেননা হাদীসের কেবল শব্দের গ-ীতে সীমাবদ্ধ না থেকে হাদীস বুঝা, এর অর্থ ও মর্ম নিয়ে গবেষণা করাই হল মূল উদ্দেশ্য”। { আল-হিত্তাহ ফী যিকরিচ্ছিহাহ ছিত্তাহ পৃ.৫৩} তিনি আরও লিখেন- ﻭﻻ ﯾﻌﺮﻓﻮﻥ ﻣﻦ ﻓﻘﮧ ﺍﻟﺴﻨۃ ﻓﯽ ﺍﻟﻤﻌﺎﻣﻼﺕ ﺷﯿﺌﺎ ﻗﻠﯿﻼ ، ﻻﯾﻘﺪﺭﻭﻥ ﻋﻠﯽ ﺍﺳﺘﺨﺮﺍﺝ ﻣﺴﺌﻠۃ ﻭﺍﺳﺘﻨﺒﺎﻁ ﺣﮑﻢ ﻋﻠﯽ ﺍﺳﻠﻮﺏ ﺍﻟﺴﻨﻦ ﻭﺍﮬﻠﮭﺎ ، ﻭﮬﻢ ﺍﮐﺘﻔﻮﺍ ﻋﻦ ﺍﻟﻌﻤﻞ ﺑﺎﻟﺪﻋﺎﻭﯼ ﺍﻟﻠﺴﺎﻧﯿۃ ﻭﻋﻦ ﺍﺗﺒﺎﻉ ﺍﻟﺴﻨۃ ﺑﺎﻟﺘﺴﻮﯾﻼﺕ ﺍﻟﺸﯿﻄﺎﻧﯿۃ۔ “ আহলে হাদীস মতবাদের দাবিদাররা লেনদেন বিষয়ক হাদীসের ফিক্বহ তথা এর গূঢ়তত্ত্বে সামান্যতম জ্ঞান রাখে না। হাদীস ও আহলে সুন্নাতের নীতিমালা অনুসারে হাদীস থেকে একটি মাসআলা বা একটি শরয়ী বিধান বের করতে তারা সক্ষম নয়। তাদের মৌখিক দাবি অনুযায়ী আমল ও সুন্নতের অনুসরণের পরিবর্তে কেবল শয়তানী চক্রের অনুকরণই যথেষ্ট মনে করে” { আল-হিত্তাহ-পৃ.৫১} তিনি আরো লিখেন- ﻟﻮﮐﺎﻥ ﻟﮭﻢ ﺍﺧﻼﺹ ﻻﯾﮑﺘﻔﻮﺍ ﻣﻦ ﻋﻠﻢ ﺍﻟﺤﺪﯾﺚ ﻋﻠﯽ ﺭﺳﻤﮧ ﻭﻣﻦ ﺍﻟﻌﻤﻞ ﺑﺎﻟﮑﺘﺎﺏ ﺍﻻ ﻋﻠﯽ ﺍﺳﻤﮧ۔ “ তাদের মধ্যে যদি নিষ্ঠা থাকতো তাহলে প্রথাগত আহলে হাদীস আর নামে মাত্র কুরআন-কিতাবের অনুসারী হওয়াই যথেষ্ট মনে করতো না।” { আল-হিত্তাহ-পৃ.১৫৬} উপরোল্লেখিত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, আহলে হাদীস দলে ভর্তি হলেই বা এ মতবাদ গ্রহণ করলেই অথবা আহলে হাদীস নাম করণেই প্রকৃত অর্থে “আহলে হাদীস” হওয়া যায় না। বরং এর জন্য চাই অসীম ত্যাগ ও পরিপূর্ণ যোগ্যতা। আরও বুঝা গেল যে, বর্তমানে যাদের নাম “আহলে হাদীস” তারা কাজে ও বাস্তবে আহলে হাদীস নয়, তাদের নামে আর কাজে কোন মিল নেই। কেবল সরলমনা সাধারণ মুসলমানগণকে প্রতারণার জন্য ষড়যন্ত্রের ফাঁদ হিসেবে এ নামটি গ্রহণ করেছে। যেমন-জামের ন্যায় কালো মানুষের নামও অনেক সময় লাল মিয়া বা সুন্দর আলী রেখে থাকে। সত্যিকারার্থে “আহলে হাদীস” নামটি তারা তৎকালীন বৃটিশ সরকারের মাধ্যমে এর প্রকৃত অর্থ থেকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে নিজেদের জন্য, যাতে করে সাধারণ মানুষ তাদেরকে পূর্বের যুগের প্রকৃত “ আহলে হাদীস” মনে করে প্রতারিত হয়। আহলে হাদীস দাবিদারদের মুহাদ্দিসগণ ও তাদের কিতাবগুলো কোথায়? হাদীস সংকলনের সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত হাদীস, তাফসীর, ফিক্বহ ও ইলমে হাদীস সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় এবং হাদীসের ব্যাখ্যামূলক অসংখ্য কিতাব রচিত হয়ে আসছে। আর উম্মতে মুসলিমার নিমিত্তে এ মহান খিদমাত মুজতাহিদ ইমাম অথবা তাদেরই মুকাল্লিদ উলামায়ে কিরামের অসীম ত্যাগ তিতীক্ষার ফলাফল। যা প্রতিটি জ্ঞানী মুসলিম মাত্রই স্বীকার করতে বাধ্য। ছিহাহ ছিত্তাহ (বুখারী শরীফ, নাসাঈ, আবুদাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ) এবং শরহে মায়া’নিল আসার , সুনানে বায়হাক্বী, মু’জামে তাবরানী, মুসতাদরাকে হাকেম, আল-মুখতারাহ, শরহুসসুন্নাহ, মুসনাদে আহমাদ সহ হাদীসের যাবতীয় কিতাবের সংকলকগণ হয়ত স্বয়ং মুজতাহিদ ছিলেন অথবা অন্য কোন ইমামের মুক্বাল্লিদ ছিলেন। ইমাম বুখারীকে (রহ.) অনেকে মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যে গণ্য করেছেন, পক্ষান্তরে শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রহ.) “ আল-ইনসাফের” ৬৭ পৃষ্ঠায় ও আল্লামা তাজউদ্দীন সুবকী “ তবক্বাতুশ শাফেয়ীয়ার” ২/২ পৃষ্ঠায় এবং গাইরে মুক্বাল্লিদ আলেম নবাব ছিদ্দিক্ব হাসান খাঁন “আবজাদুল উলূমের” ৮১০ পৃষ্ঠায় তাঁকে শাফেয়ী মাযহাবের অন্তর্ভূক্ত বলে গণ্য করেছেন। ইমাম মুসলিমও শাফেয়ী ছিলেন বলে “ছিদ্দিক্ব হাসান খান” “আল হিত্তার” ১৮৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন। আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী “ফয়জুল বারী” ১/৫৮ পৃষ্ঠায় ইবনে তাইমিয়্যার উদ্ধৃতি দিয়ে ইমাম নাসাঈ ও আবু দাউদকে হাম্বলী মাযহাব অবলম্বী বলেছেন। অনুরূপভাবে ছিদ্দিক্ব হাসান খানও “আবজাদুল উলুম” ৮১০ পৃষ্ঠায় উভয়কে হাম্বলী বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম তিরমিযী সম্বন্ধে শাহ অলি উল্লাহ “ আল-ইনসাফের”৭৯ পৃষ্ঠায় মুজতাহিদ তবে হাম্বলী মাযহাবের প্রতি আকৃষ্ট এবং এক পর্যায়ে হানাফী বলে ও উল্লেখ করেছেন। আর ইমাম ইবনে মাজাহকে আল্লামা কাশ্মীরী “ফয়জুল বারী” ১/৫৮ পৃষ্ঠায় শাফেয়ী বলে উল্লেখ করেছেন। মোট কথা সবাই মুক্বালিদ তথা কোন না কোন মাযহাবের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। যদিও কোন কোন মাসআলায় আপন মাযহাবের খেলাফও করেছেন। যেমন ইমাম ত্বাহাবী হানাফী হওয়া সত্বেও কোন কোন মাসআলায় হানাফী মাযহাবের ভিন্ন মতও অবলম্বন করেছেন। অনুরূপভাবে বুখারী শরীফের বিশেষ বিশেষ ব্যাখ্যাগ্রন্থের প্রণেতা, যেমন- “ফাতহুল বারী” প্রণেতা ইবনে হাজার আসক্বালানী শাফেয়ী, উমদাতুল ক্বারী প্রণেতা বদরুদ্দীন আইনী হানাফী, ইরশাদুস সারী প্রণেতা শিহাবুদ্দীন ক্বাসতালানী শাফেয়ী, ফয়জুল বারী প্রণেতা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী হানাফী, লামিউদ দারারী প্রণেতা রশীদ আহমদ গাংগুহী হানাফী। (রাহিমাহুমুল্লাহু তা’আলা) অনুরূপভাবে মুসলিম শরীফের বিশেষ বিশেষ ব্যাখ্যা গ্রন্থ প্রণেতা, যেমন- “ আল-মুফহিম ” প্রণেতা আব্দুল গাফের ফারেসী, “ আল মু’লিম ” প্রণেতা “ আবু আব্দুল্লাহ আল-মা’যারী ” ইকমালুল মু’লিম প্রণেতা ক্বাজী আয়ায, আল মিনহাজ প্রণেতা ইমাম নববী প্রমুখ এবং নাসাঈ , আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থের প্রবীণ ব্যাখ্যাকারগণ সবাই কোন না কোন মাযহাবের মুক্বাল্লিদ ছিলেন। যা সর্বজন স্বীকৃত ও তাদের জীবনী গ্রন্থ সমূহে এবং অধিকাংশ কিতাবের প্রচ্ছদে উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া হাদীসের বর্ণনাকারীদের জীবনী সম্বলিত বিশেষ বিশেষ গ্রন্থ প্রণেতা, যেমন- “আল-কামাল ফী আসমাইর রিজাল ” প্রণেতা হাফেয আব্দুল গণী আল-মাক্বদাসী ৩৫ ভলিয়মে মুদ্রিত “ তাহযীবুল কামাল ” প্রণেতা হাফেয আবুল হ্জ্জাাজ আল মিযযী, ১২ ভলিয়মে মুদ্রিত “ ইকমালু তাহযীবিল কামাল ” প্রণেতা হাফেয আলাউদ্দীন মুগলতাঈ আল হানাফী, ২৫ ভলিয়মে মুদ্রিত “ছিয়ারু আলা’মিন নুবালা” প্রণেতা হাফেয শামছুদ্দীন যাহাবী, ১২ ভলিয়মে মুদ্রিত “তারিখে বাগদাদ” প্রণেতা খতীবে বাগদাদী, ৭০ভলিয়মে মুদ্রিত “তারিখে দামেশক্ব” প্রণেতা হাফেয ইবনে আসাকিরসহ তারাজীমের প্রায় পাঁচ শতেরও অধিক সমস্ত কিতাবেরই সংকলকগণ কোন না কোন মাযহাবের মুক্বাল্লিদ বা অনুসারী ছিলেন। এখন প্রশ্ন হল, যারা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে দাবি করে এবং এ দলের নির্ধারিত ফরম পূর্ণ করলেই “আহলে হাদীস” নামের সার্টিফিকেট লাভে ধন্য হয় (!) হাদীস তথা ইলমে হাদীসের জগতে তাদের কোন অবদান নেই কেন? তারা মাযহাব মানাকে শিরক বলে, সুতরাং তাদের ভাষ্য মতে মাযহাব মানে এমন মুশরিকদের সংকলিত হাদীসের কিতাব সমূহের উপর তাদের আস্থা ও নির্ভরতা হয় কোন হাদীসের ভিত্তিতে? তাই আমি তাদেরকে বলব লা-মাযহাবী হিসাবে আপনাদের মাযহাব অবলম্বী কারও মাধ্যম ব্যতীত হাদীস বর্ণনা করতে হবে। তবেই হাদীসের ক্ষেত্রে “আহলে হাদীসের” দৌরাত্ম্য ও চাতুরী ধরা পড়বে। আর মুসলমানরা বুঝতে সক্ষম হবে যে, “আহলে হাদীস” নামের অন্তরালে ইসলামপ্রিয় সাধারণ মুসলমানদেরকে দ্বীন থেকে সরানোর দুরভিসন্ধি আর ঈমান হরণের গভীর ষড়যন্ত্র বৈ আর কোনো উদ্দেশ্য তাদের নেই। সব কিছু মিলিয়ে আমরা একথা বলতে পারি যে, তাদের এ নাম অবলম্বন, লবণের কৌটায় চিনি আর বিষের বোতলে মধুর লেবেল লাগানোরই নামান্তর।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ