আমরা আগেই বলেছি, ‘আল্লাহ্র ইচ্ছা এবং সন্তুষ্টি-ভালবাসা’ এতদুভয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। যেমন: অসুস্থ ব্যক্তি ওষুধ তেতো এবং দুর্গন্ধ হওয়া সত্ত্বেও ইচ্ছা করেই তা সেবন করে, অথচ সে এই ওষুধ সেবনে সন্তুষ্ট থাকে না। এখানে দেখা গেল, সে অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও ইচ্ছা করে এই তেতো ওষুধ সেবন করল একটি মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে; আর তা হচ্ছে রোগমুক্তি। সেজন্য আল্লাহ কর্তৃক কোন কিছুর ইচ্ছা পোষণ এবং উহাকে সৃষ্টির অর্থ এই নয় যে, অবশ্যই আল্লাহ তাকে ভালবাসেন এবং তার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। আল্লাহ ইচ্ছা করে সৃষ্টি করেন অথচ ভালবাসেন না-এর একটি বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একজন শিক্ষক যখন তাঁর ছাত্রদেরকে পরীক্ষা করার জন্য এমসিকিউ (MCQ) পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরী করেন, তখন চারটি অপশনের সবগুলি ইচ্ছা করে তৈরী করা সত্ত্বেও কিন্তু সবগুলিকে তিনি পছন্দ করেন না; বরং তিনি পছন্দ করেন মাত্র একটি অপশনকে। সেজন্য কোন ছাত্র শিক্ষকের পছন্দসই উত্তরটির বৃত্ত ভরাট না করলে তিনি খুশীও হন না এবং কোন নম্বরও দেন না। এই উদাহরণে দেখা গেল, শিক্ষক অপছন্দ সত্ত্বেও ইচ্ছা করেই একটি মহৎ উদ্দেশ্যে ভুল অপশনগুলি রাখেন। কিন্তু সেজন্য তিনি মোটেও দোষী নন; বরং তিনি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। ভুলভ্রান্তির সব দায়িত্ব এককভাবে ছাত্রকেই বহন করতে হয়। কেননা শিক্ষক ছাত্রকে যথারীতি পাঠদান সত্ত্বেও সে সঠিক উত্তরটি চয়ন করতে ভুল করেছে।[112] পক্ষান্তরে আল্লাহ কর্তৃক কোন কিছু অপছন্দের অর্থ এই নয় যে, তাতে ইরাদাহ কাউনিইয়াহ নেই। বরং তিনি কিছু কিছু জিনিসকে অপছন্দ করা সত্ত্বেও ইচ্ছা করে তাকে সৃষ্টি করে থাকেন। এক্ষণে প্রশ্ন হল, পছন্দ করেন না, ভালবাসেন না- এমন জিনিসকে আল্লাহ কেন সৃষ্টি করেন? জানা আবশ্যক যে, আল্লাহ্র প্রত্যেকটি কাজে হিকমত এবং কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তবে তার মানে এই নয় যে, মানুষ সবকিছুর রহস্য জানতে পারবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সবকিছুর রহস্য অবগত করান না। বরং মানুষের কিছু কিছু বিষয়ের হিকমত জানা থাকলেও বেশীর ভাগই থাকে অজানা। এমনকি ফেরেশতামণ্ডলী এবং নবী-রাসূল (আলাইহিমুস সালাম)গণের ক্ষেত্রেও তাই। যেমনঃ ফেরেশতামণ্ডলীর নিকট মানব সৃষ্টির রহস্য গোপন ছিল এবং তাঁরা মনে করেছিলেন, এতে কোন কল্যাণ নেই। তাইতো মহান আল্লাহ সেদিন ফেরেশতামণ্ডলীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ﴿إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾ [سورة البقرة: 30] ‘আমি যা জানি, তোমরা তা জান না’ (বাক্বারাহ ৩০)। অতএব কোন কিছুর রহস্য জানা থাক বা না থাক একজন মুমিনকে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ্র সব কাজেই কল্যাণ এবং হিকমত রয়েছে।[113] এবার আমরা মূল জবাবে ফিরে আসি, অকল্যাণ কোন কিছুকে সৃষ্টির মধ্যে প্রভূত কল্যাণ এবং হিকমত নিহিত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি, ঈমান আল্লাহ্র নিকট প্রিয়। কিন্তু কুফর তাঁর নিকট অপ্রিয়। অথচ অপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও অনেক কল্যাণকে কেন্দ্র করে তিনি এই কুফরও সৃষ্টি করেছেন। কারণ কুফর না থাকলে ঈমান চেনা যেত না। কুফর না থাকলে আল্লাহ কর্তৃক বান্দাকে প্রদত্ত ঈমান নামক নে‘মতের মর্যাদা মানুষ জানতে পারত না। কুফর না থাকলে ভাল কাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধের মূলনীতি ইসলামে থাকত না। কুফর না থাকলে জিহাদ থাকত না। কুফর না থাকলে জাহান্নাম সৃষ্টি নিরর্থক হয়ে যেত। কারণ জাহান্নাম তো কাফেরদেরই আবাসস্থল। এক কথায়, কুফর এবং পাপাচার না থাকলে শরী‘আত তথা ইসলামেরই প্রয়োজন পড়ত না। আর ইসলাম না থাকলে মানুষ সৃষ্টিই অনর্থক হয়ে যেত।[114] অনুরূপভাবে বালা-মুছীবতের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেন। আল্লাহ বলেন, ﴿وَنَبْلُوكُم بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً ۖ وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ﴾ [سورة الأنبياء: 35] ‘আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি। আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (আম্বিয়া ৩৫)। বিপদাপদ দিয়ে আল্লাহ মুমিনের অন্তঃকরণ পরিচ্ছন্ন করে দেন। কারণ বিপদাপদ, রোগ-বালাই ইত্যাদি না থাকলে মানুষ অবাধ্য, অহংকারী এবং উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যেত। দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি হত। বিপদাপদের মাধ্যমে সুখ-স্বাচ্ছন্দ এবং সুস্থতার প্রকৃত মর্যাদা অনুধাবন করা যায়। কারণ কোন কিছুকে বুঝতে হলে তার বিপরীত জিনিস দিয়ে বুঝতে হয়।[115] [112]. কাশফুল গায়ূম আনিল ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/১৯-২০। [113]. ড. মুহাম্মাদ রবী‘ হাদী মাদখালী, আল-হিকমাতু ওয়াত-তা‘লীলু ফী আফ‘আলিল্লাহ, (মাকতাবাতু লীন, প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৮ইং), পৃ: ২০৭। [114]. শারহুল আক্বীদাতিল ওয়াসেত্বিইয়াহ, ২/১৯১, ২১৬-২১৮। [115]. আল-ঈমান বিল ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/১১২।