শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
Call

হযরত লূত (আ:) এর পরিচয় : লূত শব্দটির উদ্ভব লাতা শব্দ থেকে। এর অর্থঃ নিজেকে স্নেহভাজন করা। হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর হৃদয় লুত (আ:) এর প্রতি অতিশয় স্নেহানুরক্ত ছিল বলে তার এরুপ নামকরন সার্থক হয়েছিল। আল্লাহ তার বান্দার (লুত) প্রতি বিশেষভাবে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে আপন বন্ধু গ্রহণ করে নবুওয়্যাত দান করেছিলেন। বাইবেলে এ নবীকেই লুট বলা হয়েছে। বংশ পরিচয় : লুত (আ:) ছিলেন ইব্রাহীম (আ:) এর ভাতিজা হারানের পুত্র। তার শৈশবকাল ইব্রাহীম (আ:) এর ছত্রছায়াই কেটেছে। লুত (আ:) কে ইব্রাহীম (আ:) লালন-পালন করেছেন। এজন্যই লুত (আ:) এবং বিবি সাবাহ দ্বীনে ইব্রাহীমের প্রথম মুসলিম বা আনুগত্যকারীদের অন্যতম। ইব্রাহীম (আ:) এর প্র্রতিটি সফরে লুত (আ:) এবং তার স্ত্রী তার সফরসঙ্গী থাকতেন। ইব্রাহীম (আ:) যখন হিজরত করে মিসর গেলেন তখনো লুত (আ:) এবং তার স্ত্রী সঙ্গে ছিলেন। পরবর্তী সময় লুত (আ:) মিসর থেকে হিজরত করে পূর্ব জর্দানের সুদুম (সোডম) ও আরা অঞ্চলে চলে যান। ইব্রাহীম (আ:) চলে যান ফিলিস্তিনে। সেখানে অবস্থান করেন এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। লুত (আ:) এর সময়কাল ইব্রাহীম (আ:) এর সময়কালেই লূত (আ:) নবুওয়্যাতের দায়িত্ব পালন করেছেন। ইব্রাহীম (আ:) এর সময়কাল নির্নয় করা সম্ভব হলে লূত (আ:) এর সময়কাল নির্ণয় করার ক্ষেত্রে আর কোন সমস্যাই থাকে না। আধুনিক নৃতাত্বিক গবেষণার ফলে মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহীম (আ:) এর জন্মস্থানই শুধু আবিষ্কৃত হয়নি, যে সময়ে তিনি পৃথিবীতে আগমণ করেছিলেন, সে সমাজের অবস্থা কেমন ছিল এবং তাদের সভ্যতা সংস্কৃতি কেমন ছিল ইত্যাদি সম্পর্কে নানা তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। স্যার নিওনার্ড ওলঙ্গ- এর দেয়া তথ্য হতে জানা যায় ২১০০ খৃষ্টপূর্বের কাছাকাছি সময়ে ইব্রাহীম (আ:) এই পৃথিবীতে আগমণ করেছিলেন বলে গবেষক ঐতিহাসিককগণ মনে করেন। সাম্প্রতিক কালের গবেষণা হতে দেখা যায় ইব্রাহীম (আ:) খৃষ্টপূর্ব ২১৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং খৃষ্টপূর্ব ১৯৮৬ সালে মৃত্যবরণ করেন। তিনি ১৭৪ বছর বেছে ছিলেন। আসমানী গযবের কবলে লুত (আ:) এর জাতি : এমন মানুষ নিজের সঙ্গে অন্তত একজন পুরুষকে অস্বাভাবিক স্ত্রীজনাচিত কাজে নিয়োজিত করে এবং অন্তত দুইজন নারীর জন্য যৌন উচ্ছ্বঙ্খলতা, নৈতিক অধ:পতন ও বিপর্যয়ের দুয়ার খুলে দেন। লুত জাতি শুধুমাত্র নির্লজ্জ নৈতিকতা বিবর্জিত ও চরিত্রহীন ছিল না, তাদের অধ:পতন এতো নিম্নে নেমে গিয়েছিল যে, এই ঘৃণ্য কাজকে তারা কোন অপরাধ বলেই মনে করতো না। এবং এই কাজ যারা ঘৃণা করতো তাদেরকেই ঐ জাতির লোকজন ঘৃনা করতো। যে ব্যাক্তি তাদেরকে এই কাজ ত্যাগ করতে উপদেশ পরতো তাদের অস্তিত্বই তারা তাদের সমাজে বরদাশত করতে রাজি ছিল না। লূত (আ:) এবং তার আদর্শ যারা গ্রহণ করেছিল তাদেরকে ঐ সমাজের লোকজন সে সমাজ হতে বের করে দেয়ার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। এ জাতির সামগ্রিক জীবনে পবিত্রতার সামান্যতম উপাদানও অবশিষ্ট থাকে না, এমন জাতিকে পৃথিবীর বুজে জীবিত রাখার কোন যু্ক্তিসঙ্গত কারন থাকতে পারে না। লুত (আ:) এর স্ত্রী সুদুম জাতিরই মেয়ে ছিল। সে ছিল সুদুম জাতির যাবতীয় কর্মকান্ডের সমর্থক। এ কারনেই আল্লাহ পাক লূত (আ:) কে আযাব অবতীর্ণ হবার আগে বলেছিলেন, এই স্ত্রীকে তোমাদের সাথে গ্রহণ করো না, সে আল্লাহর বিধানের বিপরীত কর্মকান্ডের সমর্থক। আযাব আসার পূর্বে লুত (আ:) কে ও তার ঈমানদ্বার সঙ্গীদেরকে উক্ত এলাকা থেকে হিজরত করার জন্য আদেশ দিয়ে ছিলেন। গযবের ফেরেশতার আগমন : লুত (আ:) কে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতির জাতির পিতা ইব্রাহীম (আ:) এর সহযোগী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। সুদুম জাতিকে ধ্বংস করার জন্য যে ফেরেশতা দলের (দুইজন মতান্তরে তিনজন) আগমন ঘটেছিল সে ফেরেশতা দল সরাসরি লুত এর কাছে না যেয়ে প্রথমে সমকালীন শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল ইব্রাহীম (আ:) এর নিকট এসেছিলেন। ইব্রাহীম (আ:) তাদের জন্য খাওয়ার আয়োজন করলেন। কিন্তু মেহমানগণ খেতে অস্বীকার করলেন। এতে ইব্রাহীম (আ:) ধারণা করলেন-এরা কোন শত্রু পক্ষের লোক হবে। মেহমানগন বললেন, আমরা আযাবের ফেরেশতা। আমরা আল্লাহর নির্দেশে লুত (আ:) এর জাতিকে ধ্বংস করার জন্য এসেছি। ইব্রাহীম (আ:) বললেন, সামান্য কোন কল্যাণও যদি ঐ জাতির ভিতর বিদ্যমান থাকে তাহলে সেই কল্যাণের বিনিময়ে ঐ জাতিকে রক্ষা করুন। কিন্তু ফেরেশতাগণ তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, তাদেরকে অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছিল কিন্তু তারা সে সুযোগ গ্রহণ করেনি। এখন আর কোন অবকাশ নেই। তাদের ধ্বংস অনিবার্য এবং অত্যাসন্ন। এ প্রসঙ্গে কুরআন বলতেছে, "ইব্রাহীম বললেন, হে ফেরেশতাগণ আপনারা কোন অভিযানে আগমন করেছেন? তারা উত্তর দিল, আমরা এক অপরাধি জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছি-যেন আমরা তাদের প্রতি পাক মাটির পাথর বর্ষণ করি। যা আপনার প্রতিপালক এর সীমা লংঘনকারীদের জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে। পরে আমি সে সব লোকদেরকে বের করে দিলাম, যারা এই জনপদে মুমিন ছিল"। (সূরা যারিয়াত : ৩১-৩৫) অবশেষে আযাবের ফেরেশতাগন ইব্রাহীম (আ:) এর সাথে দেখা করে লুত (আ:) এর জাতির আবাসস্থল সুদুমে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তারা অপূর্ব সুন্দর চেহারার কিশোর বালক বা তরুনের আকৃতি ধারণ করে লুত (আ:) এর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন আল্লাহর নবী মেহমানদের দেখে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন। তার চিন্তার কারন ছিল সুদুম জাতি সুন্দর চেহারার কিশোর তরুন দেখলেই তার সাথে জোর করে বলাৎকার করতো। লূত (আ:) ভাবলেন এই মেহমানগণ বয়সে এমন যে, এদেরকে তার জাতির লোকজন দেখলেই তারা এসে শাক্তি প্রয়োগ করে মেহমানদের ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। সুতরাং মেহমান রক্ষার চিন্তায় তিনি অত্যন্ত পেরেশান হয়ে পড়লেন। ইতিমধ্যে তার জাতির লোকজন জানতে পারলো যে, এমন কয়েকজন অদ্ভুত সুন্দর চেহারার তরুন তাদের শত্রু লুতের বাড়িতে এসেছে। তারা দলবদ্ধভাবে এসে লূত (আ:) এর বাড়ি ঘেরাও করলো। তারা তরুনদেরকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বারবার দাবি করতে লাগলো, অন্যথায় তারা শক্তি প্রয়োগ করে বাড়ি থেকে বের করে নেওয়ারও হুমকি দিল। লুত (আ:) তাদের বুঝালেন এবং বললেন, এই দেশে সুন্দর নারীর অভাব নেই। আমরাও মেয়ে রয়েছে, যাকে ইচ্ছে করলে তোমরা বিয়ে করে স্বাভাবিক ঘর সংসার করতে পার। কিন্তু সুদুম জাতির লোকজন নবীর কোন যুক্তিই গ্রহণ করলো না। তারা শেষে সময় বেধে দিল, এই সময়ের মধ্যে সুন্দর তরুনদেরকে তাদের হাতে তুলে না দিলে তারা জোর করে বাড়ি থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। লুত (আ:) কথায় কৌশলে তাদের বাড়ির বাইরে রেখে মেহমানদের কাছে এলেন। নবী আল্লাহর নিকট সাহায্য কামনা করলেন। আল্লাহ যেন তার জালিম জাতির লোকদের নিকট মেহমানদেরকে রক্ষা করেন। মেহমানরুপী ফেরেশতাগণ বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমাদের এই চেহারা দেখে আপনি চিন্তিত হবেন না, কারণ আমরা মানুষ নই আমরা আল্লাহর ফেরেশতা। আল্লাহর আদেশে আপনার জাতিকে ধ্বংস করার জন্য এসেছি। কারণ আপনার জাতির কর্মকান্ড এমন স্তরে পৌছেছে যে, তারা আল্লাহর গযবের উপযুক্ত হয়ে পড়েছে। আপনি এবং আপনার সঙ্গি সাথীগণ এই ধ্বংসলীলা হতে সংরক্ষিত হবেন। কিন্তু আপনার স্ত্রীকে তাদের সাথে ধ্বংস করে দেয়া হবে। লুত (আ:) আল্লাহর আদেশে তার ঈমানদ্বার সাথীদের নিয়ে রাতের প্রথম প্রহরেই নিরাপদ এলাকায় চলে গেলেন। তার স্ত্রী তাদের সাথে যেতে অস্বীকার করেছিল। সে তার নবী স্বামীকে ত্যাগ করে তার জাতীর সাথেই থাকতে অধিক পছন্দ করলো। রাতের এক অংশে যখন অপরাধী জাতি গভীর সুসুপ্তিতে নিমগ্ন ছিল, এমন সময় আল্লাহর ফয়সালা কর্যকর হয়ে গেলো। ভয়ংকর একটা গর্জন হলো, গোটা এলাকাটিকে উপরে উঠিয়ে নিয়ে তা উল্টিয়ে ফেলে দেয়া হলো। উপর হতে পাথর নিক্ষেপ করে গোটা জনপদ নিশ্চিহৃ করে দেয়া হলো। অপরাধী জাতি তাদের অপরাধের বিনিময় এভাবেই আল্লাহর নিকট থেকে লাভ করেছিল। নবীগণ হলেন নৈতিকতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তার বাড়িতে মেহমান এলো আর সেই মেহমানকে নোংরা উদ্দেশ্যে সেই জাতি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য আক্রমন পরিচালিত করেছিল। এ থেকেই অনুমান করা যায় যে, সেই জাতি কতটা নিম্নস্তরে নেমে গিয়েছিল। তাদের পশু প্রবৃত্তি কতটা নিকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল। নির্লজ্জতা তাদেরকে কিভাবে গ্রাস করে ফেলেছিল এ ঘটনা থেকেই তা অনুমান করা যেতে পারে। একজন নবীর বাড়ীর মেহমান এর যখন জান, মাল ইজ্জতের কোন মূল্য তাদের কাছে ছিল না তাহলে সেই জাতির সাধারণ মানুষের জান মাল ইজ্জতের যে কানাকড়ি মূল্য ছিল না, এ ঘটনা হতে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। তালমুদ গ্রন্থে এই সুদুম জাতির আরো বিচিত্র অপরাধের কথা উল্লেখ রয়েছে। পোড়া মাটির বর্ষণ সম্পর্কে গবেষকগণ বলেন, হতে পারে তা পোড়া মাটিকে পাথরে রুপান্তরিত করে তা বৃষ্টির আকারে বর্ষণ করা হয়েছিল। অথবা উর্ধ্বগগন হতে পোড়া মাটির মত উল্কাপাত ঘটানো হয়েছিল। আবার এমন হতে পারে, আগ্নেয়গিরি অগ্নুৎপাতের ফলে তা মৃত্তিকাগর্ভ হতে বের হযে তাদের উপর চতুর্দিক হতে বৃষ্টির মত বর্ষিত হয়েছিল। অথবা একটা প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় তাদেরকে পরিবেষ্টন করেছিল এবং সেই ঝড় তাদের উপর পাথর বর্ষণ করেছিল। ধ্বংস প্রাপ্ত এই এলাকাটি লোক চলাচলের পথের পাশে অবস্থিত, হিজাজ থেকে সিরিয়া এবং ইরাক হতে মিসর যাবার পথে এই ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকাটি দেখা যায়। সাধারণত বাণিজ্য যাত্রীদল এ ধ্বংসের নিদর্শনগুলো দেখে থাকে। বার্তমানেও সমগ্র এলাকা জুড়ে এ ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ