শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
Sumya Akter

Call

সরকারী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পর আমাদের কৃষকগণ মৌমাছির মতই গাপ্টি মেরে থাকেন। স্বেচ্ছায় তারা কখনোই ঋণের টাকা পরিশোধ করতে চান না। আমাদের সঠিক তদারকীর অভাবে একটি সময়ের পর কৃষকগণ ঋণগুলো না দেয়ার নানান ফন্দি আটে, অথবা অন্য কোথাও চলে যায় বা মরে যায়। সময় অতিবাহিত করে মৌয়াল যেমন করে মৌমাছিবিহীন মধু শূণ্য শুষ্ক মৌচাক দেখে আপসোস করে। আমাদেরও ঠিক তেমনী দীর্ঘদিন পর তদারকী করতে গিয়ে কৃষকের খালি ভিটায় দাড়িয়ে শুধু আপসোস করে খালি হাতেই ফিরতে হয়।

পল্লী ঋণে মৌয়াল পদ্ধতি বলতে সাধারনত ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী কৃষকদের মধ্যে একটি আশা-নিরাশা এবং শংঙ্কার ধোঁয়াশা তৈরি করে ঋণগুলো ফেরৎ নিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে বুঝায়। ব্যাপক ভাবে বলতে গেলে- রিকভারিতে মৌয়াল পদ্ধতি হলো, শ্রেণীকৃত ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর অনাগ্রহী ব্যক্তি এবং সবচেয়ে অসহায় অক্ষম ব্যক্তির নিকট থেকে যে কোন উপায়ে সর্ব প্রথম ঋণ আদায় করে তা অন্যদের সতর্কতামূলক জানিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি করে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করা।

যেভাবে মৌয়াল মৌচাকে ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছিদের ছত্রভঙ্গ করে মধু পেড়ে আনে। কাজটি এমন ভাবে করতে হবে, যেভাবে করলে পুনরায় কৃষক ঋণ নিতে আগ্রহ হারাবে না এবং নতুন কৃষকরাও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঋণ নিতে চাইবে। আমরা কৃষকদের বেছে বেছে পুনরায় আবার ঋণ দেব এবং মৌয়ালের মত অপেক্ষায় থাকবো কখন মেয়াদ পূর্তি হবে। সুদ-সমেত জমা নেব এবং আসলটুকু আবার তাদের ঋণ হিসেবে বিতরণ করবো।

পরিশেষে বলা যায়, মৌয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ঋণ আদায়ের এই প্রক্রিয়াকে পল্লী ঋণ আদায়ে মৌয়াল পদ্ধতি বলে।

মৌয়াল পদ্ধতিতে কতগুলো বিষয় আবশ্যক১. শাখাতে গুড টিম-ওয়ার্ক থাকতে হবে।২. শাখার সেবাদান কার্যক্রমে পজেটিভ দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে হবে।৩. এ কাজে সাহায্যকারী পক্ষসমূহের সাথে একটি সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। এবং৪. সর্বক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের শতভাগ সৎ থেকে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করতে হবে।

মৌয়াল পদ্ধতির প্রয়োগমন্দ ঋণ গুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেলো, দীর্ঘদিনের অনাদায়ী ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে সাবেক মেম্বার জনাব আবুল হাসেম (ছদ্মনাম) নামের ব্যক্তিটি সবচেয়ে ক্ষমতাধর এবং চতুর। ২০০৮ সালে তিনি নিজ নামে ৪০,০০০ টাকা কৃষি ঋণ নিয়েছিলেন। কয়েক বছর পর পর জনাব হাসেম তার ঋণ হিসাবে ৫০০ অথবা ১০০০ টাকা করে জমা দিয়েছেন। ২০১৮ সাল নাগাদ তার বকেয়া প্রায় দ্বিগুণ। ধারনা করা যায়, খুব বিপদে না পড়লে সে ব্যাংকের কাছাকাছি ঘেষেন না।

আমরা জনাব হাসেমকে টার্গেট করে এগুতে লাগলাম। পনের দিনের মধ্যে তার সাথে আমার তিন বার দেখা হয়েছে, চা খাওয়া হয়েছে কিন্তু একটি বারও তার ঋণের ব্যাপারে জানতে চাইনি। সে হয়তো ভেবেছে তার ঋণের বিষয়ে আমরা অবগত নই। যতবারই দেখা হয়েছে অন্য ঋণ গ্রহীতাদের ব্যাপারে তার কাছ থেকে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করেছি। তার পরামর্শ মোতাবেক কয়েকটি ঋণ আদায়ের পর্যায় এসেছে। এরি মধ্যে জনাব হাসেম এর সাথে আমাদের একটি চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।

তার সাথে চতুর্থবারের দেখাটি হয় আমাদের শাখায়। সে নিজে ব্যাংকে এসেছে। কুশল বিনিময়ের পর সে বলল “ম্যানেজার সাব, আপনাকে বলা হয়নি, আমার নামে একটি লোন আছে, একটু দেখবেন কত টাকা হয়েছে?”

আমি অবাক হলাম! কি বলেন? আপনার নামে আমাদের শাখায় ঋণ আছে? তারপর খেলাপি ঋণের তালিকাটি একটু নেড়েচেড়ে হঠাৎ আৎকে উঠার অভিনয় করলাম। বললাম হাসেম ভাই, ব্যাপারটি আপনার মত লোকের জন্য মানানসই নয়। এই যে তালিকাটি দেখছেন, এটি মামলার জন্য প্রস্তুতকৃত তালিকা। আমাদের হেড অফিস থেকে পাঠিয়েছে। আগামী সপ্তাহে আমাকে নিশ্চিত মামলা করতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই আমার কাছে। ঠিক তার দুদিন পর সে ঋণের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করে দিয়েছেন। মজার বিষয় হলো, পরে জানতে পারলাম তিনি উপরোক্ত টাকা কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আমাদের ঋণ পরিশোধ করেছেন।

এবার হাসেম ভাইকে যখম ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে আর বাদ থাকবে কে? তিনি নিজে আমাদের আগে দৌড়াচ্ছেন ঋন আদায়ের জন্য। আমরা কেবল তাকে একটু সম্মান দেখাচ্ছি এবং মাঝে মধ্যে একটু-আধটু চা-নাস্তা খাওয়াচ্ছি। অতপর পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক হাসেম মেম্বারকে নিয়ে গেলাম আমাদের মন্দ ঋণ তালিকার সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি, হরিদাস এর বাড়িতে।

নৌকা চালিয়ে সংসার চালায় হরিদাস। ব্যাংকের নিকট তার দায় ৩৭০০ টাকা। হরিদাসের দুঃখের কথা শুনে হাসেম ভাইকে বললাম কি করা যায়? সে বলল, কি করবেন স্যার গরিব মানুষ! কোন একটা ব্যবস্থা করেন।

হরিদাসকে জিজ্ঞেস করলাম কত টাকা দিতে পারবে। সে জানালো এই মহূর্তে ১০০০ টাকা দিতে পারবে। আমি আমার পকেট থেকে ২০০০ টাকা এবং আমার আরেক কর্মকর্তার কাছ থেকে ৭০০ টাকা নিয়ে তার নামে ৩৭০০ টাকার জমা শ্লিপ দিয়ে আসলাম। হরিদাসের ঋণটিও নিল হলো।

এতোদিন হাসেম মেম্বারের কারনে অন্যরাও ঋণ পরিশোধ করতে প্রয়োজন বোধ করেন নি। আজ যখন সে নিজে বলছে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে দিতে হবে, অন্যরা দিতে বাধ্য। ব্যাপারটি তাই হলো। মাত্র দু’মাসের মধ্যে আমাদের শাখার সিএল শূণ্য হয়ে গেলো।

সুতরাং কৃষি ও পল্লী ঋণ আদায়ে “মৌয়াল পদ্ধতি” একটি কার্যকর ঋণ আদায় পদ্ধতি হতে পারে।

লেখকঃ মোহাম্মদ জসীম উদ্দীনব্যবস্থাপক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড, বাতাকান্দি শাখা, কুমিল্লা উত্তর।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ