,
প্রকৃতি অপরূপ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। মানুষ প্রকৃতিতে বসবাস করে বলেই তারা প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল, প্রকৃতিই তাকে পরম যত্নে লালন পালন করে। আমাদের প্রয়োজনীয় সকল কিছুর আধার প্রকৃতি। জীবন ধারনের জন্য দরকারী সবই প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষ অতিরিক্ত পাওয়ার আশা করে। ফলে শুরু হয় প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তারের খেলা। অতিবিলাসিতা, সম্পদের প্রতি লোভ, অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা পেতে মানুষ প্রতি মুহূর্তে প্রকৃতিকে ব্যবহার করছে। সম্পদের প্রতি অতিমাত্রায় লোভ মানুষকে নির্মম করেছে। এতে মানুষ প্রকৃতি ধ্বংসের লীলায় মেতে উঠেছে। এর ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো বায়ুদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদির মতো ঘটনাগুলো। এছাড়া বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, ওজন স্তর ক্ষয়ে যাচ্ছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির এই রুদ্রমূর্তি দেখে মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে যে প্রকৃতির উপর আধিপত্য করে বেশিদিন টিকতে পারবে না, বরং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে মৈত্রীর বন্ধন। তবেই পৃথিবী হয়ে উঠবে মানুষের বসবাসের উপযোগী। সৃষ্টিকর্তাই মূলত মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য প্রকৃতির সকল উপাদান সৃষ্টি করেছেন। মানুষও প্রকৃতির সাথে মেলবন্ধন স্থাপন করে তা থেকে উপকৃত হয়। প্রকৃতির সাথে শত্রুতা বা আধিপত্য বিস্তার কখনই সুখকর নয়।
শিক্ষা: প্রকৃতির তার নিজস্ব নিয়মে চলে। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। বরং প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুললেই কেবল মানুষ, সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
তাই আজ প্রকৃতির উপর আধিপত্য নয়,
মানুষ গড়ে তুলতে চাইছে প্রকৃতির সঙ্গে মৈত্রীর সম্বন্ধ।
ভাব-সম্প্রসারণ : মানুষের অস্তিত্ব প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে মানুষ যে নিজের ধ্বংস ডেকে আনছে। মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে যে, প্রকৃতির সঙ্গে শত্রুতা করে নয় তার সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুলেই মানব-অস্তিত্বকে রক্ষা করতে হবে।
মানুষ প্রকৃতির সন্তান। একসময় প্রকৃতির কোলেই তার জন্ম। কিন্তু কাল পরিক্রমায় সংগ্রামশীল মানুষ একসময় প্রকৃতিকে নিয়ে এসেছে তার হাতের মুঠোয়। জয় করেছে সাগর, মাটি, আকাশ এমনকি মহাশূন্যও। প্রকৃতিকে ইচ্ছে মতো ব্যবহার ও পরিবর্তন করে সে গড়ে তুলেছে মানব সভ্যতা। এ জন্যে সে পাহাড়কে কেটে করেছে সমতল ভূমি, জলাভূমিকে করেছে ভরাট, বন উজাড় করে গড়েছে বসত, নদীর গতিপথকে নিয়ন্ত্রণ করেছে বাঁধ দিয়ে। কিন্তু জগতে সমস্ত ক্রিয়ারই এক ধরনের বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। প্রকৃতির সম্পদকে এভাবে যথেচ্ছা ব্যবহার করতে গিয়ে মানুষ নষ্ট করেছে প্রকৃতির ভারসাম্য, বিপন্ন করেছে জীবপরিবেশ। দূষিত হয়েছে বায়ু, মাটি, পানি। ফলত মানব সভ্যতার অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। সংকট আজ গোটা বিশ্বজুড়ে। সৌভাগ্যের কথা, মানুষ আজ এ সংকটের প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন। প্রকৃতির ওপর আধিপত্য ও তার যথেচ্ছা ব্যবহার যে চরম অকল্যাণকে ত্বরান্বিত করবে, এর জন্যে মানুষকে যে চরম মূল্য দিতে হবে মানুষ তা উপলব্ধি করতে পেরেছে। আর তাই মানুষ এখন বেছে নিয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ার পথ। অরণ্য ধ্বংসের বদলে গ্রহণ করেছে অরণ্য সৃজনের পথ। প্রকৃতির নিয়মকে মান্য করেই প্রকৃতিকে সবচেয়ে মঙ্গলজনকভাবে ব্যবহারের দিকে আজ বিশ্বব্যাপী সচেতনা বাড়ছে।
বস্তুত, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার পাশাপাশি সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে হলে চাই প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা এবং তার পরিবেশ-সহায়ক ব্যবহার।
ভাব-সম্প্রসারণ : প্রকৃতির ওপর আধিপত্য নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে সহযোগিতা করে তা থেকে উপকৃত হতে হবে।
পরিবেশ মানবসভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সভ্যতার ক্রমবিকাশ থেকেই মানুষ ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে তার পরিবেশ। মানুষের রচিত পরিবেশ তারই সভ্যতার বিবর্তন ফসল। পরিবেশই প্রাণের ধারক, জীবনীশক্তির যোগানদার। যুগে যুগে পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে প্রাণীর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার ওপরেও তার অস্তিত্ব নির্ভরশীল। পরিবেশ প্রতিকূল হলে তার ধ্বংস ও সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী। পরিবেশের বিরুদ্ধতা বেঁচে থাকার পথকে অবলীলাক্রমে রুদ্ধ করে। পরিবেশের ওপর সম্পৃক্ত হয়ে মানুষ, অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণী-জীবনের বিকাশ ঘটে। তাই পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে রয়েছে এক নিবিড় যোগসূত্র। মানুষ একদিন প্রকৃতিকে জয় করার নেশায় মেতেছিল। প্রকৃতিকে জয় করেও মানুষের সেই নেশার অবসান হল না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ জলে স্থলে মহাশূন্যে আধিপত্য বিস্তার করল। কিন্তু মানুষের এই বিজয় মানুষকে আরও এক পরাজয়ের মধ্যে ফেলে দিল। আজ আমরা এক ভয়ঙ্কর সংকটের মুখোমুখি। এ সংকট কোনো বিশেষ মানুষকে আরও এক পরাজয়ের মধ্যে ফেলে দিল। আজ আমরা এক ভয়ঙ্কর সংকটের মুখোমুখি। এ সংকট কোনো বিশেষ দেশের নয়, বিশেষ জাতির নয়। এ সংকট আজ বিশ্ব জুড়ে। বিশ্বের পরিবেশ আজ নানাভাবে দূষিত। এই দূষণ আজ ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেই ভয়াবহ দিনের কথা স্মরণ করেই আজ বিশ্বের মানুষ এগিয়ে এসেছে। মানুষ প্রকৃতিকে বশীভূত করে তা থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রকৃতির ওপর যে কোনো উপায়ে আধিপত্য বিস্তার করে লাভবান হওয়া যাবে, এরকম একটি ধারণা ও আধিপত্যের জন্যে মানুষ বন কেটে বসত করেছে, মানুষ নদীর গতি অবরুদ্ধ করেছে। কিন্তু এমন ধারণা করে মানুষের কল্যাণ হয় নি। এতে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। তাতে মানুষের জন্যে অকল্যাণ ঘটেছে। মানুষ তার এই কৃতকর্ম উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাই তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। এখন মানুষ বনায়নের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে। প্রকৃতির সঙ্গে বিরূপতার সম্পর্ক না রেখে তার সঙ্গে সহযোগিতা প্রদর্শন করে প্রকৃতি থেকে মানুষ উপকৃত হতে পারে। এখন মানুষ প্রকৃতির ওপর আধিপত্য দেখাতে চায় না, চায় প্রকৃতির সহযোগিতা।
প্রকৃতির দুর্যোগ মানবজাতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এর জন্যে মানুষ প্রকৃতি থেকে সহযোগিতা লাভের চেষ্টা করলে যথার্থই উপকৃত হবে।