লবণ: রন্ধনশিল্পী ব্যবহৃত অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি সামগ্রিক। যা মূলত সোডিয়াম ক্লোরাইড সমৃদ্ধ (crystalline mineral)। সমুদ্রের লবনাক্ত পানিকে (evaporation)বাষ্পীভবন করে লবন প্রস্তত করা হয় যা: সি সল্ট (sea salt) নামে পরিচিত।

এছাড়া পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চলে মাটির নিচে রক (Rock) ফর্মেও লবন পাওয়া যায় যাকে (Rock Salt) বলা হয়। পিংক হিমালয়ান (Pink Himalayan) সল্ট তেমনি একটি রক সল্ট।

পিংক হিমালয়ান সল্ট মূলত এক প্রকার গোলাপি বর্ণের লবন যা হিমালয়ের পাদ দেশে থেকে মাইনিং করে বের করা হয় ।

৯৫% ভাগ সোডিয়াম ক্লোরাইড এর পাশা-পাশি, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম এবং ক্যালসিয়াম থাকায় এই লবনের রং গোলাপি হয়ে থাকে।

তাছাড়া এই লবনে: মানব দেহে থাকা ৮৪টি মিনারেল পাওয়া যায়। যার ফলে সাধারন টেবিল সল্ট এর থেকে পিংক হিমালয়ান সল্টকে বেশি স্বাস্থ্যকর বিবেচনা করা হয়।প্রতি ১০০ গ্রাম লবনের দাম ৫ ডলার হতে ৮ ডলার পযর্ন্ত হয়ে থাকে। যা সাধারন টেবিল সল্ট এর তুলনায় প্রায় ২০ গুন বেশি দামী।


রন্ধন শিল্প ছাড়াও ,স্পা, বেডিং সল্ট এমনকি শোপিস হিসেবে হিমালয়ান সল্ট ব্যবহার হয়ে থাকে। যার দরুন 2025 সালের মধ্যে পিংকি হিমালয়ান সল্ট এর ভ্যালু গ্লোবাল মার্কেটে ১৩ মিলিয়ন ডলার হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

পিংক হিমালয়ান সল্ট এর ইতিহাস:

পৃথিবীতে প্রধানত তিন ধরনের লবণ পাওয়া যায়। সমুদ্রের একেবারে তলদেশে ডিপ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে লবণাক্ত পানি বের করে তা পিউরিফাইং প্লান্টের রিফাইন করে টেবিল সল্ট প্রস্তুত করা হয়। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সমুদ্রের পানিকে (evaporation) বাষ্পীভবন মাধ্যমে সি সল্ট প্রস্তুত করা হয়।

কিন্তু দুই প্রক্রিয়াতে ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস এর কারণে বেশ কিছু প্রাকৃতিক মিনারেল হারিয়ে যায়। অন্যদিকে রক সল্ট মূলত কয়েক হাজার বছর আগে শুকিয়ে যাওয়া সমুদ্রের পানি যা লম্বা সময় ধরে ভৌগোলিক পরিবর্তনের ফলে মাটির গভীরে চাপা পড়ে যাওয়ার রক ফর্ম ধারণ করে।

বিশ্বের বেশ কিছু অঞ্চলের মাটির হাজারো ফিট গভীরে রক সল্ট পাওয়া যায়।পরবর্তীতে এ ধরনের লবণকে মাইনিং এর মাধ্যমে উত্তোলন এবং প্রক্রিয়াজাত করে খাবার উপযোগী করা হয়। সব রক সল্টই মূলত সি সল্ট।

কিংবদন্তি অনুসারে আলেকজান্ডার দি গ্রেট এশিয়া জয় করার লক্ষ্যে পাকিস্তান পৌছান। পাকিস্তানের খেওয়ারতে (khewra) যাত্রা বিরতি কালে তার ঘোড়া গুলো আশপাশে থাকা গোলাপি রঙের পাথর চাটতে শুরু করে।

প্রাণী হিসেবে ঘোড়া লবণ খুবই পছন্দ করে বিধায় সৈনিকরা পাথরগুলোকে পরীক্ষা করে সেগুলোতে লবণের সন্ধান পায়।


১২০০ শতাব্দীর দিকে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের জানজুয়া গোত্রের লোকেরা প্রথমেই লবণের মাইনিং শুরু করে। মূলত পাকিস্তানের হিমালয়া পথহর মালভূমির দক্ষিণ প্রান্তে প্রায় 300 কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বৃস্তিত সল্ট রেঞ্জ এর 6 টি খনি থেকে লবণ মাইনিং করা হয়।

যদিও ক্যানাডার সিফটো সল্ট মাইন (Sifto Salt Mine) পৃথিবীর সবচাইতে বড় সল্ট মাইন। যা ১৮০০ ফিট গভীর যা একশো ১৫০ তলা ভবনের সমান। তবে পাকিস্তানের খেওড়া সল্ট মাইন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সল্ট মাইন হলেও।পিংক হিমালায়ান সল্ট মাইনের দিক থেকে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সল্ট মাইন।

মাইনটি প্রায় ৭৪৮ ফিট গভীর যা একটি ১১ তলা বিল্ডিং এর সমান। মাইনটিতে প্রায় ৬.৭ বিলয়ন টন রক সল্ট আছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় পিংক রক সল্ট প্রস্তত কারক হয়েও পাকিস্তানের অবস্থান : ২০তম যেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারত ৭তম অবস্থানে রয়েছে। কারন পাকিস্তান মাইনিং থেকে প্রাপ্ত রক সল্ট গুলো খাবার উপযোগী না করেই রক ফর্মেই রপ্তানী করে থাকে।

পিংক হিমালয়ান সল্ট কেন দামী?

বাংলাদেশের সাধারন খাবার লবণ কেজি প্রতি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা ।সেখানে মাত্র ১০০ গ্রাম হিমালয়ান পিংক সল্ট এর দাম ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

যা কেজি হিসেবে দুই হাজার থেকে ২৫ শো টাকা। অন্যদিকে বিজনেস ইনসাইডারের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী। প্রতি ১০০ গ্রাম হিমালয়ান সল্ট এর দাম ৫ থেকে ৮ ডলার অর্থাৎ ১ কেজি লবণের দাম ব্র্যান্ডভেদে ৫০ থেকে ৮০ ডলার হয়ে থাকে। কিন্তু কেন পিংক হিমালয়ান সল্ট এর দাম এত বেশি?

দুষ্প্রাপ্যতা:

পিংক হিমালয়ান সল্ট এর উচ্চমূল্যের: কারণগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে খনির দুষ্প্রাপ্যতার। কেননা পিংক হিমালয়ান সল্ট এর খনিগুলো শুধুমাত্র পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের অবস্থিত। এই খনি গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়: খেওরা সল্ট মাইন। প্রতি বছর প্রায় 4 লক্ষ টন লবণ উৎপাদন করে থাকে।

মাইনিং এর সমস্যার কারনে:

পাকিস্তানের সল্ট রেঞ্চ এর খনি থেকে মাইনিং এর মাধ্যমে পিংক সল্ট উত্তোলন করা হয়। উত্তোলনের ক্ষেত্রে উন্নত টেকনোলজি ব্যবহার করা হয় না বিধায় পিংক সল্ট মাইনিং বেস লেবার ইনটেনসিভ একটি কাজ।

খনি উত্তোলন এর কাজে চেম্বার এন্ড পিলার মেথড (Chamber & Pillar Method) ব্যবহার করা হয়।.
এই প্রসেসটি বেশ রিস্কি এবং সময় সাপেক্ষ হয় বিধায় পিংক সল্ট বেশ এক্সপেন্সিভ।




ডিমান্ড বেশি থাকায়:

হিমালায়ান সল্ট মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় ফসফরাস, ব্রোমিন, বরন এবং জিংক এর মতো ৮৪টি মিনারেল রয়েছে। বিভিন্ন মিনারেল এর উপস্থিতির কারণে রোগ নিরাময়ে এই লবন বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখে।তাছাড়ও ভোজনরসিকদের দাবি লবণের ব্যবহারে খাবারের স্বাদ ও ঘ্রাণ বাড়ে।

এছাড়া এ্যাজমা রোগীদের (Breathing) সুবিধার্থে পিংক সল্ট রক দিয়ে তৈরি ল্যান্ড হোল্ডার সহ বিভিন্ন শোপিস অনেক চাহিদা রয়েছে। এর পাশাপাশি স্পা থেকে শুরু পারর্সোনাল কেয়ার ও বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিতে এর ব্যবহার রয়েছে।

এই সল্ট এর চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কিন্তু খনির সল্পতা এবং অনুন্নত মাইনিং এর ফলে হিমালয়ান সল্ট এর প্রোডাকশন সিমীত হয়ে থাকে।যেহেতু এটি একটি প্রাকৃতিক খনিজ তাই চাইলেও এর প্রোডাকশন বাড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠেনা ।


প্রোসেসিং মেথড:

পাকিস্তান মূলত পিংক হিমালয়ান সল্টের রক ফর্ম প্রসেসিং বিভিন্ন দেশের স্বল্পমুল্যের রপ্তানি করে থাকে। সেই রক সল্টকে প্রসেসিং এর মাধ্যমে খাবার উপযোগী লবণের রূপান্তরিত করা হয়।

রক সল্টে থাকা মেটাল, ম্যাগনেটিক কন্টামিনিশন, প্লান্ট ম্যাটার ও ফাইবার এর মতো ক্ষতিকর ম্যাটেরিয়াল রিমুভ করতে যে সকল মেথড ব্যবহার করা হয় তা খুবই ব্যয়বহুল।

প্রসেস হওয়া লবনটি পরবর্তীতে চাহিদা অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পুনরায় রপ্তানি করা হয় যার ফলে: হিমালায়ান সল্ট এর মূল্য আরো বেড়ে যায় ।

পাকিস্তান বিভিন্ন দেশের রক সল্ট স্বল্পমূল্যের রপ্তানি করার ফলে। বিশ্বের সবচাইতে বড় পিংক সল্ট এর প্রস্তুতকারক হয়েও রপ্তানিকারক পাকিস্তান, ভারত ও চায়না থেকেও অনেক বেশি পিছিয়ে.

কেননা পাকিস্তানে রকসল্ট প্রসেসিং করার মতো নিজস্ব কোন ফ্যাসিলিটি নেই। যেখানে মাত্র ১০০ গ্রাম পিংকি সল্ট এর দাম ৫ থেকে ৮ ডলার সেখানে পাকিস্তান ভারতের কাছে প্রতি টন মাত্র চল্লিশ ডলার এর বিনিময়ে রপ্তানি করে।


মাইক্রো ব্লগ বিডি




শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে