হুমায়ূন আহমেদের গল্পগুলো আমার কখনো পড়া হয়নি। কেমন যেন ‘হিজিবিজি হিজিবিজি’! কিন্তু এই লকডাউনে বইগুলো খুলে বসে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, চরিত্রগুলোর সঙ্গে আমাদের এত মিল! 
ছনপা তো আগে থেকেই বলত, বড়পা নাকি ওনার গল্পের নায়িকাদের মতো ভাবত—কোনো এক বর্ষার প্রথম দিনে চালচুলোহীন কোনো এক বেকার যুবকের সঙ্গে পালিয়ে যাবে! শেষ পর্যন্ত অবশ্য তা হয়নি। তবে ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভেজা হয়েছিল ঠিকই।
সেই দুলাভাইয়ের করোনা পজিটিভ এল। হাসপাতালের ডিউটি শেষে আগে থেকেই কোয়ারেন্টিনে থাকা বড়পার সঙ্গে এবার দুলাভাইও যুক্ত হলেন। প্রাইমারি না পেরোনো মুসা, নুহা একচিলতে জানালা দিয়ে মা–বাবাকে দেখে যায়। সে কথা শুনে আম্মা সারা রাত কেঁদে আনল জ্বর। আমি হেসে বললাম, ‘আম্মা, তোমাকে দেখতে পুরো “মুনার মামির” মতো লাগছে।’ আম্মা রক্তচোখে তাকালেন।
এর মধ্যেই ঈদ এসে গেল। ঈদের দিন এক বছরের নাফসু আর ছয় মাসের রোদেলাকে পাশাপাশি বসিয়ে ছবি তুললাম। ছবি দেখে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশে থাকা রুমি-সুমি আপু একসঙ্গে বলে উঠল, ‘ওয়াও!’ যেন ‘তিতলী আর কংকা!’ 
কিন্তু তারপরও ছোটবেলার ঈদগুলোই বেশি ভালো ছিল। চাঁদরাতে আমরা সবাই মিলে রংবেরঙের কাগজ দিয়ে ঘর সাজাতাম। আব্বা সেই কাগজ কেটে দিত…। আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে রূপকথা শুনি। আমারও জ্বর আসছে বোধ হয়! তারপর দিন এল আব্বার, তারপরের দিন ভাইয়ার।

বড়পা সমন জারি করল সবার টেস্ট করা লাগবে। আমরা সমস্বরে বললাম, ‘আরে এ তো “সামান্য ভাইরাস” জ্বর। টেস্ট লাগবে না। বরং টেস্ট করাতে গেলেই ভাইরাস ঘরে ঢুকবে।’ ছনপা বলল, ‘আমি দোয়া করছি যেন কালকে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। আর তোদের বাইরে যাওয়া ভেসে যায়।’ আমি বললাম, ‘কালকে না গেলে বড়পা পরশু দিন যেতে বলবে।’ ‘আরে ধুর। পরশু দিন তো শুক্রবার। পরপর দুই দিন বাদ গেলে তৃতীয় দিন এমনিই যাওয়া হবে না।’ ছনপার উত্তর। আসলেই শুনলাম মেঘ ডাকছে, যেন ‘মেঘ বলেছে যাব যাব!’
 

Untitled-12পরদিন সকালে উঠল খটখটে রোদ। আমরা সবাই গ্লাভস আর তিনটা করে মাস্ক পরে কিম্ভূতকিমাকার সেজে টেস্ট করাতে গেলাম। ভাইয়া বলল, ‘আরে করোনা তো আমি কবেই ভাতের সঙ্গে খেয়ে ফেলেছি। ওরা তো পাকস্থলীর এসিডের সঙ্গে মিশে গিয়ে এখন কোনপথে আগাচ্ছে…।’ আমি বললাম, ভাইয়া, তুমি তো পুরা ‘হিমু’র মতো কথা বলছ! ও বলল, ‘হিমু হওয়াই ভালো।’ আমি মুঠোফোন খুলে দেখলাম রিপোর্ট দিয়েছে। পজিটিভ!

পরদিন সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি। আব্বা বলল, ‘দুপুরে পাটশাক আর মাগুর মাছের ঝোল ভালো লাগত। মুন্না না আসবে বলল...।’ ‘মেজ মেয়ে সকালে রুটিভাজি দেয়, ছেলের বউ দুপুরে রাঁধে। তা–ও তোমার বড় মেয়ের কাছে আবদার করা লাগবে? ও আছে কত যন্ত্রণায়’ আম্মা চেঁচাল। আমি ভাবছি, ছনপা বোধ হয় ভুলই বলল, বড়পা যদি হুমায়ূন আহমেদের গল্পের নায়িকাদের মতোই ভাবত, তবে এতক্ষণে খাবারগুলো নিয়ে হাজির হয়ে বলত, ‘ভোরবেলা স্বপ্নে দেখলাম আব্বা এগুলো খাইতে চান!’

সন্ধ্যাবেলা আমার ফোনটা বেজে উঠল। ‘আশু, একটু বারান্দায় আসত; তোমাকে আর আম্মাকে দেখে যাই।’ বড়পার গলা। ‘আর দরজার সামনে একটা ব্যাগ আছে দেখ—ওইটার মাগুর মাছের ঝোল আর পাটশাক আব্বাকে দিয়ো।’ আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আমি কাউকে দেখতে পেলাম না। বৃষ্টিটা আবার নামল নাকি?


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে