এই ধরণের একটা কথা শুনেছিলামঃবুদ্ধিমানের বোঝা বোকায় বয়

কিছু বুদ্ধিমান মানুষ ঋদ্ধিমানও হয়েছেন তাঁদের সকল বোঝা অন্যদের ঘড়ে তুলে দিয়ে, নিজে আড়ালে থেকে।

এই বুদ্ধিমানের ছোট্ট একটা দল, ধরুন আনুমানিক আট জন মানুষ মিলে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ নিউ ইয়র্ক (ফেডনি) বলে একটা টাকার মেশিন বানিয়েছেন। সে আজব মেশিন এমন টাকা বানায় যার প্রতি ৪০০টার মাত্র একটা কাগজে ছাপানো হয়, বাকি ৩৯৯টা থেকে যায় একদম হাওয়ায়। হাওয়া থেকে পাওয়া সেই টাকা হাওয়াতেই ভাসে। সেই টাকার নাম ডলার। আমরা যে অল্প কয়জন বঙ্গসন্তান আমেরিকা-কানাডায় বাস চড়ি (বাস করি বললে একটু বেশি হয়ে যায়), আমরা এই ডলারকে টাকাই বলি।

এর মহিমা অনন্ত। রথচাইল্ড আর ওয়ারবার্গ, ডুপন্ট আর মরগান, শ্রয়েডার আর লোয়েব আর লেহম্যান নাম থেকেই বুঝা যায় উনারা বুদ্ধির খনি। উনাদের জ্ঞাতিভাই হ্যারী ডেক্সটার হোয়াইট সাহেব সারা দুনিয়ার মানুষকে ডলারের প্রেমে ফেলে দিলেন।

দুনিয়াতে একটা মাত্র ব্যাঙ্ক আছে যে ব্যাঙ্কে সকল সার্বভৌম রাষ্ট্র (এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রদের নিয়ে গঠিত বহু-রাষ্ট্রিক প্রতিষ্টান) একাউণ্ট খুলতে পারে। এই ব্যাঙ্কে সাধারণ লোক তো দূরের কথা, সবচেয়ে বড় ব্যঙ্ক বা কর্পোরেশনকেও একাউন্ট খুলতে দেওয়া হয়না। হাজার হাজার বিল গেইট হাজার বছর কান্না করলেও ফেডনি-তে একাউন্ট খুলতে পারবেন না।

এতে লাভ কিসে? ধরুন, জার্মানি বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ইউরো ধার হিসাবে কিংবা দান হিসাবে দিতে চায়। কিন্তু কিভাবে দেবে? আপনি প্রথমেই জেনে নেবেন যে একশ কোটি ইউরো কাগজে ছাপানোর কোন প্রকার প্রশ্নই উঠে না। একটা বিশাল কার্গো বিমানে ১০০ কোটি ইউরো নিয়ে বিমান এলে আমাকে বলুন কে বা কারা এতো কাগজের টাকা গূণে বুঝে নেবে? তার পর এই টাকা কোথায় নিরাপদে রাখবে? তারপর এই টাকা কবে কি পরিমাণে বস্তায় ভরে কোন বিমানে করে পাঠাবে? প্রতিবার গ্রহীতার লোক এসে শত কোটি ইউরো গুণে গুনে নেবে? তাহলে আর অন্য কোন কাজ করা লাগবেনা, টাকা গুনেই জীবন পার হয়ে যাবে।

তাহলে কি করে লেন দেন হয়? একটা একাউন্ট থেকে টাকা আরেকটা একাউন্টে চলে যায়। আপনি যদি বিদেশ থেকে ৬০ কোটি টকার কাপড় কিনে জাহাজে তুলেন, কোন দিন আপনি এই বিশাল টাকা বড় বড় ঠোঙ্গায় ভরে লোক দিয়ে পাঠাবেন না। আপনার ব্যাঙ্ক থেকে বিদেশের ব্যাঙ্কে লেটার অফ ক্রেডিট নামক এক ধরণের চেক চলে যাবে, আর সেটা ঘটবে ক্যাবল ও ইলেক্ট্রনিক উপায়ে।

এখন জার্মানি যদি ছাপানো কাগজ না দিতে পারে, তাহলে কি ভাবে হাওয়াই টাকা দেবে? একটা মাত্র উপায় হল জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যঙ্ক ফেডনি-কে অনুরোধ করবে জার্মানির একাউন্ট থেকে বাংলাদেশের একাউন্টে টাকাটা দিয়ে দিতে। ফেডনি ইউরো-মিউরো কোন কিচ্ছুর ধার ধারেনা। ফেডনিতে জার্মানির ডলার থাকতে হবে, আর কেবল সেই ডলারটাই বাংলাদেশের একাউন্টে পাঠানো সম্ভব। ইউরো পাঠানোই সম্ভব নয়। বাংলাদেশের টাকা আর ইউরো একরকম টাকাইঃ ফেডনি যাকে পাত্তা দেয় না। কিন্তু বুদ্ধি যাদের কম তারা দেখবে যে বাংলাদেশ জার্মানির কাছ থেকে ইউরো পেয়েছেঃ কারণ হিসাব করার সময় জার্মানি ডলারকে বলবে ইউরো আর বাংলাদেশ সেই ডলারকেই ইউরো হিসাবে মানবে, কেবল ডলার-ইউরোর বিনিময় হার ব্যবহার করে। ধরুন ১০০ ইউরো হল বিনিময় হারে ১১৫ ডলার। বাস্তবে জার্মানি ১১৫ ডলার দিয়ে বলবে ১০০ ইউরো দিয়েছি, আর বাংলাদেশ ১১৫ ডলার পেয়ে বলবে ১০০ ইউরো পেয়েছি। একই কাহিনীঃ সৌদি আরব থেকে আমার ভাইপো বাড়িতে পাঠিয়েছে আসলে ৩০০০ রিয়াল, কিন্তু আমার ভাই ব্যঙ্কে গিয়ে তুলে এনেছেন ৬৬০০০ বাংলাদেশী টাকা, আর বলছেনঃ মাশাল্লাহ, বড় পোলায় ৬৬০০০ টাকা পাঠাইছে।

এখানেও গোলমাল। আপনি ঢাকায় গেলে সউদী আরবের ছাপানো কাগুজে রিয়াল কিনতে পারবেন, আমেরিকান কানাডিয়ান বা সিঙ্গাপুরী ডলার বা চীনা রেন্মিনবি ছাপানো অবস্থায় কিনতে পারবেন। কিন্তু আপনি যেটা দেখছেন না সেটা হল টুরিস্টরা পকেটে করে যে কয়টা ছাপানো টাকা নিয়ে আসে, তা মোট টাকার অতিশয় ক্ষুদ্র অংশঃ অই যে, প্রতি ৪০০ ডলারের মাত্র একটা ছাপানো হয়।

ডলার ছাড়া আর কোন আন্তর্জাজিক মুদ্রা নাই। বৃটিশ পাউন্ড বা ইউরো এইসব সবই স্থানীয় মুদ্রা মাত্র। টুরিস্টের পকেটে করে বাংলাদেশী টাকা মক্কায় যায়, মক্কার বাংলাদেশী টাকা দিয়ে রিয়াল বা ডলার ব্য অন্য যে কোন দেশের মুদ্রা কিনা যায়। নিউয়র্কে কিছু বাঙ্গালী থাকেন, আপনি তাদের কাছে বাংলাদেশী টাকা দিয়ে আমেরিকার ডলার নিতে পারেন, কেননা যারা বাংলাদেশে যাচ্ছেন তারা টাকা নিতেই পারেন। কিন্তু এ দেখে ভাববেন না যে তাহলে বাংলাদেশী টাকাও আন্তর্জাতিক টাকা হয়ে গেছে।

আসল মহিমা হল যে একটাই ব্যাঙ্ক আছে যেখানে এক দেশের টাকা অন্য দেশে পাঠানো যায়। ইউরো চালু করার ব্যাপারে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ পরামর্শ দিয়েছিলেন, যার ফলে ইউরো আন্তর্জাতিক মুদ্রা হতে পারেনি। সেই পরামর্শ কি জানেন তো? সেটা হল সবাই তোমার টাকা নিতে চাইবে, কিন্তু সাবধান, তুমি কাউকে এক টাকাও ধার দেবেনা। এখন সারা দুনিয়ার সকল দেশ ইউরো নিতে আগ্রহী, কিন্তু ইউরো দিতে কেউ আগ্রহী নয়? তাহলে ইউরো চালু হবে কি করে? ইউরো চালু করতে হলে একটা ব্যাঙ্ক লাগবে যেখানে এক দেশের ইউরো একাউন্ট থেকে অন্য দেশের ইউরো একাউন্টে টাকা পাঠানো যাবে। তেমন কোন ব্যাঙ্ক দুনিয়াতে পয়দায়েশ হয় নি। সেখানেই বুদ্ধির প্রশ্ন। আপনি রথচাইল্ড না হলে আপনার মাথায় এই বুদ্ধি কেন থাকবে?

আপনি কি রথচাইল্ড না লুয়েব না লেহম্যান যে আপনি বুঝে ফেলবেন কি করে বাংলাদেশের টাকা সারা দুনিয়াতে চালানো যাবে? ধরুন আপনি ঠিক করলেন যে বিদেশী যে সব কোম্পানী বাংলাদেশী শ্রমিকদেরকে চাকুরি দেন, আপনি তাদেরকে এই বছর দুই লক্ষ কোটি টাকা ধার দিলেন, যা দিয়ে তারা বাংলাদেশী শ্রমিকদেরকে দিয়ে কাজ করাবেন। এছাড়াও আপনি আরও তিন লক্ষ কোটি টাকা ধার দিলেন যা দিয়ে বিদেশীরা বংলাদেশী মাল কিনে নিয়ে যেতে পারবেন। বলুন তো বিদেশীরা কেন বাংলাদেশী টাকা ধার নেবেন না যা দিয়ে তারা বাংলাদেশী শ্রম ও মালামাল কিনতে নিতে পারেন? হ্যাঁ, আপনার টাকা তাঁদের কাজে লেগে যাবে, তাই তার টাকা নেবেন। এইবার আপনার চালাকি হল যে আপনি এই ধার ফেরত নিবেন বাংলাদেশী টাকায়, অন্য কোন মুদ্রা আপনি নেবেন না। তখন তাঁরা বাধ্য হবেন বাংলাদেশে মাল বেচে সেই মালের বিনিময়ে বাংলাদেশী টাকা রুজি করে তাঁদের ঋণ শোধ করতে। চালাকিটা হল আপনি আগে টাকাটা ঋণ দেবেন। বছরে ৫ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দিতে রেডি আছেন তো?

আমেরিকার ডলার দুনিয়া জুড়ে চলে কারণ কুহন লোয়েব মর্গান সাহেবরা সারা দুনিয়াকে ডলার ধার দেন। তাঁদের লেনদেনের পরিমাণ শুনলে আকাশ থেকে পাতালে পড়ে যেতে হয়। আপনি রাজি করাতে পারলে ফেডনি আপনার দেশকে একসাথে বিশ লক্ষ কোটি ডলার ধার দিতে কয়েক মিনিট সময় নেবেন। আসলে ধার আপনি সরাসরি ফেডনি থেকে পাবেন নাঃ আপনাকে যেতে হবে মর্গান ট্রাস্ট বা কুহন লোয়েব বা লেহম্যান ব্রাদার্স প্রমুখের কাছে। নানা ক্লিয়ারিং চক্র পার হয়ে ফেডনিতে আপনার দেশের নামে (বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের একাউন্টে) ডলার জমা হয়ে যাবে।

এই হলো রহস্য। আপনার বানানো টাকা চালু হয়ে যাবে যদি আপনি সেটা ঋণ হিসাবে দিতে পারেন। কাজটা একদম সোজা, কেবল করতে গেলে ঋণ দেবার মত ধনী হতে হয় এই যা। তাহলে কিছু একটা উপায়ে আপনি এক হাজার কোটি বাংলাদেশী টাকা যোগার করুন, বাংলাদেশেই একটা ব্যঙ্ক খুলে নেন, দেখবেন আপনিও লক্ষ কোটি টাকা ধার দিতে পারছেন, কারণ ব্যঙ্ক থাকলে আপনি হাওয়া থেকে টাকা পেতে পারেন, যা আপনি হাওয়াতেই ধার দিতে পারেন। এক কাজ করুনঃ বাংলাদেশে সবকয়টা ব্যঙ্কের মিলিত পূঁজির পরিমাণ কত জেনে নিন, তারপর মাথা চুলকাতে চুলকাতে প্রশ্ন করুনঃ পুঁজির ৩০ গুণ বেশী টাকা তাঁরা কি করে ঋণ দিলেন?

বুদ্ধিমান হয়ে যান, বোকারা আপনার বোঝা বহনে করবে আর বলঅবেঃ আহা কি আনন্দ, অনেক গুলি টাকা ঋণ পেয়ে গেলাম, খুব আরামে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। খুব ভালো লাগছে ঋণ বহন করতে। কারণ বোকারা জানেনা ঋণ বহনের পরেই আসে দহনঃ ঋণ ফেরত দিতে হয়।পিঠের চামড়া একটু একটু করে খুলে দিয়ে। তবে বোঝা বহন করাতে হলে সেটা সহনীয় বহনীয় করে দিতে হয়, এই যা। সুদের হার কম রাখবেন, ঋণ ফেরত দিবের সময়টা লম্বা করে দেবেন, বোঝার উপর বোঝা চাপিয়ে দেন, যেন পিঠে চুলকানি হয়, আর চুলকানি দিলে আরাম লাগে। টাকা ধার দেবার মত সোজা কাজ না পারলে হবে কি করে?


ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ