শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
FoyEz00

Call

কোনো পরিবার থেকে একজন নারী সতী হওয়া মানে বিরাট সম্মানের বিষয়। একজন নারীর তার স্বামীর প্রতি চূড়ান্ত অধীনতা, সতীত্ব ও ধর্মপরায়ণতার লক্ষণ ছিল এই প্রথা। ছেলের মৃত্যুর পর তার বউ বাড়িতে থাকা আলাদা একটা বোঝার মতোন ছিল। স্বভাবতই সব পরিবার চাইত তাদের বউটিও সহমরণে গিয়ে তার এই স্বল্পদামী জীবনের বিনিময়ে পরিবারের সম্মান বাড়াক।

কিন্তু দেখা যেত অনেক ছোট বয়সে বিধবা হয়ে গেছে, স্বামীর মৃত্যুতে হতবিহবল হলেও শোকের মাতম তোলার কারণ নেই। আবার বউটি বেশ বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন। পরলোকের প্রতিশ্রুতির চেয়ে বড় তার কাছে আরো কিছুক্ষণের জন্য বেঁচে থাকা। এমন সব নারীরা চিতায় ওঠার আগে বেঁকে বসতো। আসলে খুব কম নারীই ছিল যারা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে পরলোকের মোহে পড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যেত। কেউ কেউ চিৎকার করে কাঁদত, ছেড়ে দিতে বলত। এই আওয়াজ যেন কেউ না শোনে তাই শবযাত্রীরা ঢোল, মাদল, বাঁশির আওয়াজে ভরিয়ে তুলত। অনিচ্ছুক মেয়েদের খাওয়ানো হত আফিম জাতীয় ওষুধ, যেন তারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। কাউকে মাথার পেছন দিকে আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলা হত। লক্ষ্য রাখা হত আঘাত আবার এত জোরে না হয় যাতে মেয়েটা মরেই যায়। রীতি অনুযায়ী জীবিত পোড়াতে হবে। তাহলেই স্ত্রী পরবর্তী জন্মে উঁচু বংশে জন্মাতে পারবে, ভাগ্য ভালো হলে এই স্বামীর স্ত্রী হয়েই।

পরের জন্মে সম্মান অথবা সমাজে দর্প করে বেড়ানোর আশায় ১৫০০ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত কয়েক হাজার নারীকে জীবিত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্বামীর চিতায়।

সহমরণে যাওয়ার কিছু নিয়ম ছিল। এর মাঝে ছিল যারা সহমরণে যেতে পারবে না তাদের তালিকা- যদি কোনো নারীর সন্তান এতই ছোট হয় যে নিজের দেখাশোনা করতে পারে না, যদি কোনো নারী মাসিক চলার সময়ে থাকেন, যদি তার গর্ভে বাচ্চা থাকে। মুঘল শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে সহমরণ বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন সম্রাটরা, বাদ সাধলো ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা’র অভিযোগ। শিশুর মাকে সহমরণে যেতে না দেওয়ার নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। বাদশাহরা নিয়ম করেন, কাউকে দিয়ে সতীদাহ পালন করাতে হলে তার অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু বাদশাহরা যেহেতু মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে নামতেন না, প্রজাদের সুখ দুঃখের সাথে মিশে যেতে পারতেন না, স্বামীর পরিবার ঘুষ দিয়ে অনুমতি আদায় করে নিত।

৪ ডিসেম্বর, ১৮২৯ সাল। লর্ড বেন্টিঙ্ক আইন জারি করে সতীদাহ নিষিদ্ধ ও সতীদাহের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ফৌজদারি আদালতে শাস্তির ব্যবস্থা করেন। এর অনুবাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় উইলিয়াম কেরিকে। ধার্মিক কেরি সেদিন তার চার্চ বাদ দিয়েছিলেন অনুবাদ করার জন্য। তার মনে হয়েছিল, অনুবাদ করার দেরির জন্য একজন বিধবার প্রাণ গেলেও সেটা তার দায়। ১৮৩০ সালের মাঝে বোম্বে ও মাদ্রাজেও আইনের হাত প্রসারিত হয়। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার কয়েক হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী পিটিশন করেন এই আইনের বিরুদ্ধে। তাদের মতে, ইংরেজ সরকার তাদের ধর্মীয় বিষয়ে নাক গলাবার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত গড়ালে রামমোহন রায় উল্টো আইনের পক্ষে পিটিশন করেন। প্রিভি কাউন্সিল আইনের পক্ষে মত দেয়।

তখনও ভারতের সব অঞ্চল সতীদাহ বিরোধী আইন করেনি। ভারতে পুরোপুরি সতীদাহ আইন করে বন্ধ করতে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত লেগে যায়।

মেবার অনেক দিন পর্যন্ত প্রথা টিকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু জনগণের মাঝে সতীদাহ বিরোধী সচেতনতা তখন তুঙ্গে। মহারাণা স্বরূপ সিং মারা গেলে তার কোনো স্ত্রীই তার সাথে সহমরণে যেতে রাজি হয়নি।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের দিকে আইন জারি করে সতীদাহ বন্ধ করা যায়নি। লুকিয়ে সতীদাহ চলছিলই। প্রথা যখন সামাজিক নিন্দার শিকার হতে শুরু করে, তখন ধীরে ধীরে ভারত থেকে সতীদাহের মতো শতবর্ষের কুপ্রথা একেবারে বিলুপ্ত হয়।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ