পীর শব্দটি ফার্সি। শব্দগতভাবে এর অর্থ হল জ্ঞানি বা জ্ঞানবৃদ্ধ। কিন্তু এর ব্যবহৃত অর্থ একটু অন্য রকম।আমাদের সমাজে পীর হলেন তিনি যিনি আল্লাহ পাককে পাইয়ে দেবার ক্ষেত্রে বা আল্লাহ পাক এর সাথে রূহানী সংযোগ করে দেয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ। এই আলোচনা হবে পীরের ব্যবহৃত অর্থ নিয়ে তথা সমাজ-বাস্তবতার আলোকে। আমাদের সমাজের বহু মুসলমান ভাই-বোন আছেন যারা বিশ্বাস করে পীর না ধরলে জান্নাত হাসিল করা সম্ভব নয়।তাই তারা নানা পীরের কাছে যেয়ে তাদের মুরীদ হচ্ছেন, জান্নাত লাভের আশায় পীরকে নানা উপঢৌকন দিচ্ছেন।অথচ যে পীরের কাছে তারা জান্নাতের জন্য পারি জমাচ্ছেন সেই পীর নিজেও জানে না তিনি বেহেশত পাবে কিনা। অনেক পীর সাহেব মুরীদদেরকে নানান রকমের কেচ্ছা কাহিনী শুনিয়ে বলে থাকেন , আমার কাছে মুরীদ হও । তাহলে আমি তোমাদেরকে আমার হাত ধরে বেহেশতে নিয়ে যাব। অনেকে আছে অগ্রিম ভবিষ্যৎও দিয়ে থাকেন । অনেকে আবার টাকার বিনিময়ে দোয়া দিয়ে থাকেন । যেইখানে পীরসাহেবকে নিজের ব্যাপারে গ্যারান্টি দেওয়ার ক্ষমতা মহান আল্লাহ দেন নাই , সেখানে তিনি তার মুরিদদের জান্নাত পাওয়ার গ্যারান্টি দিচ্ছেন। তাই একজন মুসলমান হিসেবে অবশ্যই আমাদের জানা দরকার ইসলাম পীর সম্পর্কে কী বলে।কিয়ামতের দিন যখন অল্লাহর সম্মুখে দাড়াবো তখন পীর সাহেবের দোহাই দিয়ে কি পার পাওয়া যাবে? বাস্তবতা হল কেয়ামতের মাঠে পীর সাহেব কাউকে কোন প্রকার উপকার করার ক্ষমতা রাখে না। আল্লাহ পাক সূরা ইনফেতারের ১৯তম আয়াতে বলেছেন, “ যেদিন কোন মানুষই একজন আরেক জনের কাজে আসবে না; আর সেদিন ফয়ষালার সব ক্ষমতা থাকবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার হাতে।” এছাড়াও আল্লাহ বলেন, “আজকে (কিয়ামতের দিন) তোমাদের কেউ কাউকে উপকার কিংবা ক্ষতি করতে পারবে না। আর আমি অপরাধীদেরকে বলব-জাহান্নামের আগুনের স্বাদ গ্রহণ কর দুনিয়ায় যাকে তোমরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছ। (সুরা সাবা: ৪২) সমাজের বহু মুসলমান মনে করেন পীর গায়েব জানে।এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন :”তাঁর নিকট রয়েছে গায়েবের চাবিসমূহ, এবং এক তিনি ছাড়া এ সম্পর্কে কারও জ্ঞান নেই।”(সূরা আল আনআম: ৫৯) পীরের ব্যাপারটি যদিও রাসুল (সা.) এর ওফাতের বহু পরে মুসলমানদের মাঝে প্রচলন শুরু হয়েছে কিন্তু আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগেও এইরূপ ধারনা ছিল। তবে তখন পীরের জায়গাতে ছিল মূর্তি। কাফের-মুশরিকদেরকে যখন বলা হত কেন তোমরা নিজের হাতে তৈরি মূর্তিকে পূজা করো? তখন তারা বলত আমরা আল্লাহকেই আমাদের প্রভু মানি। কিন্তু এই মূর্তিগুলো আমাদের সাথে আল্লাহর যোগাযোগ স্থাপন করে দিবে। ঠিক যেমন আজ কিছু মুসলমান মনে করছে পীর তাদেরকে আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপন করে দিবে। “আর তারা (মুশরেকরা) আল্লাহ ভিন্ন এমন কতিপয়ের ইবাদত করে, যারা তাদের কোন অপকারও করতে পারেনা এবং তাদের কোন উপকারও করতে পারেনা, ও তারা বলে-এরা হল আল্লাহ তায়ালার কাছে আমাদের সুপারিশকারী। (হে রাসূল!) আপনি বলে দিন, তোমরা কি আল্লাহ তায়ালাকে এমন বিষয়ের সংবাদ দিচ্ছ যা আছে বলে তিনি (নিজেও) জানেন না, না আসমানে না জমিনে! তিনি তাদের শিরকী কার্যকলাপ হতে পবিত্র ও অনেক ঊর্দ্ধে “।(সূরা ইউনুস-১৮) আমাদের সমাজ আজ বিদায়াতে ভরপুর । সঠিক ইসলাম জানার মাধ্যমে আমাদের এই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হবে , যা এখন বাংলাদেশের মুসলিমদের জন্য অতীব প্রয়োজন । বাংলাদেশে এখন অনেক ভণ্ড এবং বিদা’তি পীর রয়েছে যারা আমাদের সঠিক ইসলাম থেকে শধুমাত্র দুরে সরিয়ে রাখছে না বরং আমাদের দেশের সহজ-সরল মানুসগুলোকে মাজারে-পীরের আসরে অনৈতিক কাজে প্রলুব্ধ করে বিদা’তি কর্মে লিপ্ত করছে।এখন তা সমাজে ভাইরাস আকার ধারন করেছে। কুরআন হাদিসের কোথাও রাসুল (সাঃ)ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির নির্দেশ সর্বাবস্থায় বিনাপ্রশ্নে মেনে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি । আলেমগন-মুহাদ্দিস-ইমামগনকে মূল্যায়ন করতে হবে শুধুমাত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে । নিজের মন, আবেগ বা অন্য কারো মতামত দিয়ে নয়। আল্লাহ কুরআনে বলেন : “ না, তোমার মালিকের শপথ, এরা কিছুতেই ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের যাবতীয় মতবিরোধের ফয়সালায় তোমাকে(শর্তহীনভাবে)বিচারক মেনে নেবে, অতপর তুমি যা ফয়সালা করবে সে ব্যাপারে তাদের মনে আর কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না, বরং তোমার সিদ্ধান্ত তারা সর্বান্তকরণে মেনে নেবে।( সূরা নিসা:৬৫) আল্লাহ পাক আরেক জায়গাতে বলেন,”যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবে,আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন,যার নিম্নদেশে ঝর্ণা ধারাসমূহ প্রবাহমান থাকবে। আর যে মুখ ফিরিয়ে নেবে আল্লাহ তাকে মর্মান্তিক আযাব দেবেন। (সুরা ফাতহ:১৭) এমন যদি হয় কেউ দীনের একটা মাসাআলা বুঝছে না তখন কোন আলেম থেকে তা জেনে নেওয়ার পর কুরান এবং হাদীস থেকে তার রেফেরেন্স মিলিয়ে নিতে হবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ”তোমরা যদি না জেনে থাক তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর।”(সুরা নাহল:৪৩) আলেমদের কাছ থেকে জানার পর রেফেরেন্স মিলিয়ে যখন দেখা যাবে তা সহীহ তখন তা আমল করবেন । আর যখন দেখা যাবে তা সহীহ নয় তখন তা আমল করা যাবে না। এভাবেই একজন ব্যক্তি বুঝতে পারবে কে সত্তিকার অর্থে “আলেম” এবং কে “ভণ্ড” ।অথচ আমরা তা না করে ভণ্ড পীর-মাজার পুজারীদের কথা শুনে নিজেকে বিদা’তি কর্মে লিপ্ত করি। আমরা আমাদের বিবেগকে একটু খাটিয়ে ভাবলেই দেখি যে, রাসুল(সঃ) কে আল্লাহ দুনিয়ায় সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়েছিলেন । অথচ সেই রাসুল(সঃ) এর জীবন ও কর্ম এর সাথে এই সমস্ত ভণ্ড পীরগুলোর চরিত্রের কোন মিল নেই। কখনও ভেবে দেখেছেন কি রাসুল(সঃ) পরিচালিত জীবন এবং এই সকল ভণ্ডপীরদের পরিচালিত জীবনের মধ্যে এত তফাৎ কেন?এদের বিলাসিতা জীবন পরিচালন কি আপানার মনে কোন প্রশ্নের জন্ম দেয় না ? এরা কতোটুকু সহিহভাবে কুরআন-সুন্নাহ অনুসরণ করছে ? আপনি কখনও কুরআন-হাদীস দিয়ে তা মিলিয়ে দেখেছেন কি ? এইসকল পীর কি আপনাকে জান্নাত দিতে পারে,নাকি রাসুল(সঃ)এর সহিহ সুন্নাত এবং পরিপূর্ণ জীবন বিধান ‘আল-কুরাআন” আপনাকে জান্নাত দিবে ? অবশ্যই পরিপূর্ণ জীবন বিধান ‘আল-কুরাআন” ই আপনাকে জান্নাত দিবে। মাজারে সিজদা দেওয়া , গানের আসর জমিয়ে গাঁজাখানার আড্ডা এগুলো রাসুল(সঃ) এর সুন্নাহ’র মধ্যে পড়ে না।এগুলো করা কবিরা গুনাহ। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,”সাবধান ! তোমাদের পূর্বের যুগের লোকেরা তাদের নবী ও নেককার লোকদের কবর সমূহ মসজিদ (সিজদার স্থান) হিসেবে গন্য করতো। তবে তোমরা কিন্তু কবর সমূহকে সিজদার স্থান বানাবে না। আমি এরূপ করতে তোমাদের নিষেধ করে যাচ্ছি” । [মুসলিম, ১০৭৭] রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরও বলেন,”তোমরা স্বীয় ঘরকে কবর বানিয়োনা। (অর্থাৎ কবরের ন্যায় ইবাদত-নামায, তেলাওয়াত ও যিকির ইত্যাদি বিহীন করনা।) এবং আমার কবরে উৎসব করোনা।(অর্থাৎ বার্ষিক, মাসিক বা সাপ্তাহিক কোন আসরের আয়োজন করনা। তবে হ্যাঁ আমার উপর দুরূদ পাঠ কর। নিশ্চয় তোমরা যেখানেই থাক না কেন তোমাদের দুরূদ আমার নিকট পৌঁছে থাকে।(আল্লাহ তায়ালার ফেরেশতারা পৌঁছিয়ে দেন।)”(সুনানে আবু দাউদ: হাদিস নং-২০৪৪/৪০) কবরের সামনে বাতি প্রজ্জ্বলন করাকে হারাম সাব্যস্ত করে রাসূলে কারীম সাঃ ইরশাদ করেন-“হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর নবী সাঃ অভিশম্পাত করেছেন (বেপর্দা) কবর যিয়ারতকারীনী মহিলাদের উপর, এবং সেসব লোকদের উপর যারা কবরকে মসজিদ বানায় (কবরকে সেজদা করে) এবং সেখানে বাতি প্রজ্জ্বলিত করে।(জামি তিরমীযী-২/১৩৬) আল্লাহ ছাড়া কারো নামে মান্নত বা কুরবানী করা যায়না। কারণ মান্নত ও কুরবানী হচ্ছে ইবাদত। আর ইবাদত আল্লাহ ছাড়া কারা জন্য করা জায়েজ নয় । অথচ আমরা পীরের নামে ,মৃত বেইক্তির নামে মান্নত করি। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, “আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কুরবানী এবং আমার জীবন ও আমার মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই। তাঁর কোন অংশিদার নেই। আমি তা-ই করতে আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম আনুগত্যশীল। (সূরা আনআম-১৬২-১৬৩) পীর/মাজারে মৃত ব্যক্তি কাউকে বেহেশত দিতে পারবেনা। কর্মই মানুষকে জান্নাত দিবে যদি তা সহীহ হয় এবং আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্য হয় । তাই সহীহভাবে ইসলাম অন্বেষণ করা এবং আল্লাহ’র ভয়ে কাতর হয়ে সঠিকভাবে তা পালন করাই একজন মুসলমানের দ্বায়িত্ব।
না। কুরআন শরীফ এ কুরআন এবং নবীর দেখানো পথ এ চলতে বলা হয়েছে। তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে নয়। তবে যারা কুরআন, হাদিস সম্পর্কে বেশি জানাশুনা [যেমন- হাফেজ, মাওলানা, অন্য যেকোনো ব্যক্তি (পীর, আওলিয়া, সাধারণ মানুষ)] তাদের কথা আপনি শুনতে পারেন। তবে তাদের কথা অবশ্যই কুরআন এবং হাদিস এর আলোকে হতে হবে। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই নবীকে বাদ দিয়ে (হাদিস/সুন্নাহ) পীর এর ভক্ত হয়। আবার তারা পীরকে সিজদাহ পর্যন্ত করে যা কিনা শিরক। এবং আল্লাহ তাআলা সকল গুণাহ মাফ করবেন কিন্তু শিরকের গুণাহ মাফ করবেন না। আপনি যদি কুরআন ও হাদিস বুঝে (বিস্তারিত মাসআলা সহ) পড়েন তাহলে আপনার কাউকে (হাফেজ, মাওলানা, পীর...) দরকার হবে না। কারণ, সকল সমস্যা এর সমাধান, জীবন চালানোর নিয়ম সবকিছুই কুরআন এবং হাদিস এ দেয়া আছে।
সর্বোপরি একটা কথাই বলতে চাই, মহানবী মুহাম্মাদ (সাঃ) ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেছিলেন তার সংক্ষিপ্ত কিছু-
★ নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের প্রভূর সাথে মিলিত হবে, যখন তোমাদের প্রভূ তোমাদের কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন এবং আমি তোমাদেরকে তাঁর সংবাদ পৌঁছে দিয়েছি।
★ এর পর হে মানব মন্ডলী! শয়তান এদেশে পূজিত হওয়ার আশা ত্যাগ করেছে সে অন্য দেশে মান্য হবে। সুতরাং তোমরা তোমাদের বিশ্বাস (ঈমান) সম্পর্কে সতর্ক থাকবে, যেন তোমাদের ভাল কাজগুলো অন্য লোকের দ্বারা নষ্ট হয়ে না যায়।
★ সুতরাং হে মানব মন্ডলী ! তোমরা আমার কথাগুলো ভালভাবে অনুধাবন কর, যার জন্য আমি আমার কথাগুলো তোমাদের জন্য রেখে গেলাম। যদি তোমরা এটা দৃঢ়ভাবে গ্রহণ কর, তাহলে তোমরা কোন দিনই বিপথগামী হবেনা। বিশেষ করে আল্লাহর আল-কুরআন ও আমার সুন্নাহ (তাঁর দূতের ধর্মীয় নীতি ও জীবন ধারা)।
★ সাবধান! ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না। এই বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।
★ চারটি কথা স্মরণ রেখো: (ক) শিরক (আল্লাহর অংশী) করো না। (খ) অন্যায়ভাবে নর হত্যা করো না। (গ) চুরি করো না। (ঘ) ব্যভিচার করো না।
★ তোমাদের প্রত্যেককেই আল্লাহ তাআলার সন্মুখে হাজির হতে হবে এবং আপন আপন ভাল মন্দের হিসাব-নিকাশ (আমল নামা) পাঠ করতে হবে। তোমরা সাবধান! সেইদিন কেউ কাউকেও সাহায্য করতে পারবেনা।