শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

যোগাসনের নিয়মিত অভ্যাস সুস্থ ও সবল ভাবে শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা সৃষ্টির মাধ্যমে আপনাকে সফলতা পেতে সাহায্য করবে ঠিকই, তবে সফলতার জন্য চাই সঠিক নিয়মে যোগাসন অভ্যাস। তাই যোগব্যায়াম শুরু করার আগে জেনে নিন এর প্রয়োজনীয় নিয়ম কানুন গুলো।


০১. ৫/৬ বছর বয়স থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যোগ-ব্যায়াম অভ্যাস করা যায়। শুধু প্রয়োজন অনুযায়ী কয়েকটি আসন বেছে নিতে হবে। সব বয়সে সব রকম আসন করা যায় না। অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের কোন আসন দুইবারের বেশি করা ঠিক নয়। ছেলেদের ১৪/১৫ বছর বয়সের পূর্বে আর মেয়েদের ঋতু প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত প্রাণায়াম ও মুদ্রা অভ্যাস করা উচিত নয়।


০২. সকাল, সন্ধ্যা ও গোসলের পূর্বে বা রাতে যেকোনো সময় যোগ-ব্যায়াম করা যায়। তবে সে সময় যেন ভরপেট না থাকে। অল্প কিছু খেয়ে আধঘণ্টা পরে আসন করা যেতে পারে, কিন্তু প্রাণায়াম বা মুদ্রা খালি পেটে অভ্যাস করাই বাঞ্ছনীয়। প্রাতঃক্রিয়াদির পর আসন করা ভালো। তবে যাদের কোষ্ঠবদ্ধতা, পেট ফাঁপা প্রভৃতি রোগ আছে, তারা সকালে ঘুম থেকে উঠেই বিছানায় কয়েকটি নির্দিষ্ট আসন ও মুদ্রা করতে পারে। যাদের অনিদ্রা-রোগ আছে, রাতে খাবার পর শোবার পূর্বে কিছুক্ষণ বজ্রাসন করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া ভরপেট খাওয়ার পরও কিছুক্ষণ বজ্রাসনে বসলে খাদ্য হজম বা পরিপাকক্রিয়া সহজতর হতে পারে।


০৪. আসন, মুদ্রা বা প্রাণায়ামে একটি ভঙ্গিমায় বা প্রক্রিয়ায় একবারে যতটুকু সময় সহজ ভাবে করা যায় বা থাকা যায়, ঠিক ততটুকু সময় করা বা থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে কোন ক্ষেত্রে কয়েকটি নির্দিষ্ট আসন ছাড়া একবারে এক মিনিটের বেশি থাকা উচিত নয়। পদ্মাসন, ধ্যানাসন, সিদ্ধাসন ও বজ্রাসনে ইচ্ছেমতো সময় নেয়া যেতে পারে।


০৫. একবারে ৭/৮ টির বেশি আসন অভ্যাস করা ঠিক নয়। আসনের সঙ্গে বয়স অনুযায়ী ও প্রয়োজনমতো দু’একটি প্রাণায়াম, মুদ্রা অভ্যাস করলে অল্প সময়ে আরো ভালো ফল পাওয়া যায়। এক একটি আসন বা মুদ্রা অভ্যাসের পর প্রয়োজনমতো শবাসনে বিশ্রাম নিতে হবে। ৫ /৭ মিনিট খালি হাতে কিছু ব্যায়ামের পর আসন বা মুদ্রা করলে ফল খুব দ্রুত পাওয়া যায়। কিন্তু কোন শ্রমসাধ্য কাজ বা ব্যায়ামের পর বিশ্রাম না নিয়ে কোন প্রকার যোগ-ব্যায়াম করা উচিত নয়। সপ্তাহে একদিন বিশ্রাম নেয়া উচিত।


০৬. আসন অভ্যাসকালে জোর করে বা ঝাঁকুনি দিয়ে কোন ভঙ্গিমা বা প্রক্রিয়া করা ঠিক নয়। আসন অবস্থায় মুখে যেন কোন বিকৃতি না আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।


০৭. আসন অভ্যাসকালে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে। কিন্তু মুদ্রা বা প্রাণায়ামে নিয়মানুযায়ী শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।


০৮. কম্বল, প্যাড বা পাতলা তোষকের উপর আসন অভ্যাস করা বাঞ্ছনীয়। শক্ত মাটি বা পাকা মেঝেতে অভ্যাস করলে যেকোনো সময়ে দেহে চোট লাগতে পারে।


০৯. আলো-বাতাসহীন বা বদ্ধ ঘরে যোগ-ব্যায়াম অভ্যাস করা ঠিক নয়। এমন জায়গায় অভ্যাস করার চেষ্টা করতে হবে, যেখানে বায়ুর সঙ্গে প্রচুর অক্সিজেন নেয়া যায়।


১০. ১২/১৩ বছরের উপর এবং ৪৫ /৪৬ বছরের নীচে (স্বাস্থ্যানুযায়ী বয়সসীমা কম-বেশি হতে পারে) মেয়েদের স্বাভাবিক কারণে মাসে ৪ /৫ দিন কোন আসন করা ঠিক নয়। তবে ধ্যানাসন, শবাসন প্রভৃতি অভ্যাস করা যায়।


১১. মেয়েদের ক্ষেত্রে সন্তানসম্ভবা হলে তিন মাস পর্যন্ত কিছু সহজ আসন বা প্রাণায়াম করা যেতে পারে, কিন্তু মুদ্রা অভ্যাস একেবারে করা উচিত নয়। সন্তান প্রসবের তিন মাস পর আবার ধীরে ধীরে সব আসনাদি অভ্যাস করা বাঞ্ছনীয়। গর্ভাবস্থায় সকাল ও সন্ধ্যায় খোলা জায়গায় পায়চারি করা বিশেষ উপকারী।


১২. আসনাদি অভ্যাসকালে এমন কোন পোশাক পরা উচিত নয় যাতে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।


১৩. যোগ-ব্যায়াম অভ্যাসকালে কথা বলা বা অন্যমনস্ক হওয়া ঠিক নয়। কারণ মনের সঙ্গে দেহের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যোগ-ব্যায়ামের মূলমন্ত্র। একাগ্রতাই অভীষ্ট ফল এনে দিতে পারে।


১৪. যোগ-ব্যায়ামে তাড়াতাড়ি ফল পাবার আশা করা ঠিক নয়। এতে বিশ্বাস ও ধৈর্য্যের একান্ত প্রয়োজন। নিয়মিত ও নিয়মমতো যোগ-ব্যায়াম অভ্যাসে সুফল আসবেই।


১৫. যদি তামাকের অভ্যাস বা মাদসাক্তি থাকে, বর্জন করুন।


১৬. যতটা সম্ভব মন প্রফুল্ল রাখা বাঞ্ছনীয়। কুচিন্তা বা দুশ্চিন্তা যেন মনে না আসে।


তাহলে এবার যোগব্যায়াম শুরু করে দিন আর নিজের উপর আস্থা রেখে এগিয়ে যান। সফলতা আপনার হাতের মুঠোয়।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ
Call
যোগ সম্পর্কিত যে ধারণা (বিভিন্ন শারীরিক ভঙ্গিমা ও আসন) বর্তমানে সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছে তা সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই প্রচলিত ছিল। তখন থেকেই এটা অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে এবং এখন আমরা যাকে যোগাভ্যাস বলে জানি তা প্রকৃত যোগাভ্যাসের থেকে অনেকটাই আলাদা। এখানে যোগ-এর এই বিবর্তনের বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলঃ

বেদের আগের যুগ (৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বের আগে)


কিছুদিন আগেও পশ্চিমের শিক্ষিতরা এটাই বিশ্বাস করতেন যে যোগ আবিষ্কৃত হয় ৫০০ খ্রীষ্টপুর্বাব্দে যখন বৌদ্ধ ধর্মের সূত্রপাত হয়। যদিও, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়োর সর্বশেষ খনন কার্যের ফলে যে সব নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে যোগের বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবিও আছে। এর থেকেই বোঝা যায় যে খ্রীষ্টের জন্মের ৫০০০ বছর আগেও যোগাভ্যাসের প্রচলন ছিল। যদিও, এই বক্তব্যের লিখিত কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।


বৈদিক যুগ (খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০)

বৈদিক যুগে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসাবে যোগাভ্যাস করা হত, মনঃসংযোগ বাড়ানোর জন্য এবং দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য। এখনকার যুগের যোগাভ্যাসের থেকে তখনকার ধর্মীয় আচারের যোগাভ্যাস অনেকটাই আলাদা ছিল। বৈদিক যুগের ধর্মীয় আচারগুলোই ছিল যোগের সংঞ্জা - আত্মার সাথে পরমাত্মার যোগ।


প্রি-ক্ল্যাসিকাল বা ঊপনিষদের যুগ (খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০)


ঊপনিষদ, মহাভারত ও গীতাতে যোগের উল্লেখ দেখা যায়। ভগবৎগীতাতে ঞ্জান যোগ, ভক্তি যোগ, রাজ যোগ ও কর্ম যোগ এই চার প্রকারের যোগেরই উল্লেখ পাওয়া যায়। গীতার উপদেশে শ্রীকৃষ্ণ বলেন যে যদি কোন ব্যক্তি নম্রতা ও নিষ্ঠার সাথে বাস্তবতাকে খোঁজে তাহলে তিনি উচ্চ মার্গের চেতনা লাভ করেন। সেই সময়, যোগ শুধুমাত্র শ্বাস বা ভঙ্গিমা সংক্রান্ত অভ্যাস ছিল না, তা ছিল প্রাত্যহিক জীবনের একটা অঙ্গ।



ক্ল্যাসিকাল যুগ (খ্রীষ্টপূর্ব ১৮৪ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ১৪৮)



ক্ল্যাসিকাল যুগে পতঞ্জলি ১৯৫টা সূত্রকে একত্রিত করে যোগকে একটা সংক্ষিপ্ত আকার দেন। পতঞ্জলির যোগ দর্শন রাজ যোগ নামেই পরিচিত। এর মোট আটটা শাখা আছে - ইয়ম্ (সামাজিক বিধি), নিয়ম (ব্যক্তিগত বিধি), আসন (শারীরিক ভঙ্গিমা), প্রাণায়াম (শ্বাস-প্রশ্বাসের বিধি), প্রত্যাহার (চেতনা কে সরিয়ে রাখা), ধারণ (মনঃসংযোগ), ধ্যান ও সমাধি। যদিও, আগেকার যোগাভ্যাসে পতঞ্জলি বেশ কিছু শারীরিক ভঙ্গিমা ও শ্বাস বিধির সংযোগ করেছিলেন সেগুলো ব্যবহার করা হত শুধুমাত্র ধ্যান ও সমাধির আনুষঙ্গিক হিসাবে। পতঞ্জলির সূত্রে কোন আসন বা প্রাণায়ামের নাম পাওয়া যায় না।



পোস্ট ক্ল্যাসিকাল যুগ (৮০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দ)



এই সময়ে পতঞ্জলিযোগের অনুগামীরা আসন, ক্রিয়া ও প্রাণায়ামের দ্বারা শরীর ও মনের শুদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়ে যোগাভ্যাসকে একটা নতুন মাত্রা দেন। এই শরীর ও মনের শুদ্ধি এই যোগাভ্যাসকারীদের সমাধির মত উচ্চ মার্গের সাধনাতে সাহায্য করত। এই ধরণের যোগ কে বলা হয় হট্ যোগ।



আধুনিক যুগ (খ্রীষ্টাব্দ ১৮৬৩ পরবর্তী)



শিকাগোর ধর্ম মহাসম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতার মাধ্যমে সারা পৃথিবীর কাছে যোগকে পৌঁছে দেন। অনেক যোগী পুরুষ যেমন মহর্ষি মহেশ যোগী, পরমহংস যোগানন্দ, রামন মহর্ষি ও আরও অনেকে পশ্চিম বিশ্বকে তাঁদের আধ্যাত্মিক ঞ্জানে এতটাই অনুপ্রাণিত করেন যে সারা বিশ্বই যোগকে ধর্ম নির্বিশেষে আধ্যাত্মিকতার এক অন্যতম অঙ্গ হিসাবে গ্রহন করেছে, কোন বিশেষ ধর্মের আচার হসাবে নয়।
ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ