বস্তুত হানাফী ঈদের নামায এবং আহলে হাদীস ঈদের নামাযের মাঝে মূলগত দিক থেকে কোনো বিবেধ বা বিরোধ নেই। আর বিবেধটাও উত্তম অনুত্তম পর্যায়ের। উভয় দর্শন মতেই উভয়ের ঈদের নামায আদায় হয়ে যায় কোন দর্শনের ঈদের নামায বেশি শুদ্ধ বা বেশি সুন্দর এটি একটি আপেক্ষিক বিষয়। কেউ হানাফী দর্শনের ঈদের নামাযকে বেশি শুদ্ধ বলবেন কেউ আবার আহলে হাদীস দর্শনের ঈদের নামাযকে বেশি শুদ্ধ বলবেন। আপনি যদি হানাফী দর্শন বা ব্যাখ্যা মতে ঈদের নামায আদায় করে থাকেন তবে তাতে টেনশন ফিল করার কিছু নেই। কারণ হানাফী অভিমতের অনুসারীগণ যে পদ্ধতিতে ঈদের নামায আদায় করেন তা হাদীস এবং আসার এবং অন্যান্য দলীর সমৃদ্ধ।

মূলত ঈদের নামায বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন হাদীস ও আসার বর্ণিত হয়েছে। তবে ইমাম আবূ হানীফা রহ. ও উলামায়ে আহনাফের গবেষণা ও বিশ্লেষণ মতে ঈদের নামাযে অতিরিক্ত ছয় তাকবীর অর্থাৎ প্রত্যেক রাকাআতে তিন তিন তাকবীর করে। হাদীসের গ্রন্থসমূহে এ সম্বন্ধে অসংখ্য হাদীস, আসার, সাহাবী, তাবেয়ীদের আমল ও ফাতাওয়া বর্ণিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, দাঁড়ানো অবস্থায় উভয় রাকাআতে মোট তাকবীর হল মোট নয়টি। প্রথম রাকাআতে পাঁচটি ও দ্বিতীয় রাকাআতে চারটি। প্রথম রাকাআতে তাকবীরে তাহরীমা, তিনটি অতিরিক্ত তাকবীর এবং রুকুর তাকবীর এই মোট পাঁচ তাকবীর। দ্বিতীয় রাকাআতে তিনটি অতিরিক্ত ও রুকুর তাকবীর এই মোট চার তাকবীর। নিম্নোল্লিখিত হাদীসগুলোর কোনটিতে মোট সংখ্যা ধরে নয়টি তাকবীরের কথা বলা হয়েছে, আবার কোনটিতে পাশাপাশি তাকবীর হিসেবে চারটি করে আটটি তাকবীরের কথা বলা হয়েছে। এ সবের মধ্যে কোন বৈপরিত্ব নেই। সর্বাবস্থায় অতিরিক্ত তাকবীর তিনটি করে ছয়টিই থাকছে। এসব বিষয় সামনে রেখেই হাদীসগুলো বুঝতে হবে।

১.    প্রসিদ্ধ তাবেয়ী আবূ আব্দুর রহমান কাসিম রহ. বলেন, আমাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন সাহাবী হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন আমাদেরকে নিয়ে নামায পড়ালেন এবং চারটি করে তাকবীর দিলেন। নামায শেষ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভুলে যেয়ো না, ঈদের নামাযের তাকবীর জানাযার তাকবীরে মত। এই বলে তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি গুটিয়ে বাকী চার আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলেন। (শরহু মাআনিল আসার ২/৪০০) ইমাম ত্বহাবী রহ. এ হাদীসকে হাসান বলেছেন।

২.    মাকহুল রহ. বলেন, হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. এর একজন সঙ্গী আবূ আয়িশা রাযি. আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, সাঈদ ইবনুল আস রাযি. (কুফার গভর্ণর) এসে আবূ মূসা আশআরী রাযি. ও হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রাযি. কে জিজ্ঞাসা করলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহায় কিভাবে তাকবীর দিতেন? আবূ মূসা রাযি. বললেন, তিনি জানাযার মত চার তাকবীর দিতেন। তখন হুযাইফা রাযি. বললেন, আবূ মূসা সঠিক বলেছেন। আবূ মূসা রাযি. বললেন, আমি যখন বসরার গভর্ণর ছিলাম তখন এভাবেই তাকবীর দিতাম। আবূ আয়িশা রাযি. বলেন, এ সময় আমি সাঈদ ইবনুল আসের কাছে উপস্থিত ছিলাম। (সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ১১৫৩, মুসনাদে আহমাদ ৪/৪১৬, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হা.নং ৫৭৪৪)

৩.    বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত কুরদুস রহ. বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের নামাযে নয়টি করে তাকবীর দিতেন। নামায শুরু করে চারটি তাকবীর দিতেন (তিনটি অতিরিক্ত আর একটি তাহরীমার) তারপর কিরাআত পড়তেন। অতঃপর এক তাকবীর বলে রুকু করতেন। এরপর দ্বিতীয় রাকাআতে দাঁড়িয়ে কিরাআত পড়ে মোট চারটি তাকবীর দিতেন যার একটি দিয়ে রুকু করতেন। (মুজামুত ত্বাবারানী; হা.নং ৯৫১৩, ৯৫১৮, মাজমাউয যাওয়ায়িদ; হা.নং ৩২৪৯) এই হাদীস সম্পর্কে হাফেযে হাদীস আল্লামা হাইসামী রহ. বলেন, এই হাদীসের সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। (মাজমাউয যাওয়ায়িদ ২/৩৬৭)

৪.    আব্দুল্লাহ ইবনে হারেস ইবনে নওফেল বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. ঈদের দিন প্রথম রাকাআতে চারটি তাকবীর দেন। অতঃপর কিরাআত পড়েন। এরপর রুকু করেন। দ্বিতীয় রাকাআতে দাঁড়িয়ে প্রথমে কিরাআত পড়লেন। এরপর নামাযের অন্যান্য তাকবীর ছাড়া অতিরিক্ত তিনটি তাকবীর দিলেন। [ইবনে হাযাম রহ. এই হাদীসটি এবং পূর্বে বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে বলেন, এই উভয় হাদীসের সনদ খুব সহীহ] (আল-মুহাল্লা বিল-আসার ৩/২৯৫)

৫.    আব্দুর রায্যাক রহ. ইবনে জুরাইজ থেকে বর্ণনা করেছেন, ইউসুফ ইবনে মাহাক রহ. আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাযি. প্রত্যেক রাকাআতে চার তাকবীরই বলতেন, এর বেশি বলতেন না। এভাবে উভয় রাকাআতেই তিনি তাকবীর বলতেন। আমরা তার কাছ থেকেই এটা শুনেছি। (মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক; হা.নং ৫৬৭৬) এই হাদীসের সনদ সহীহ।

৬.    ইবরাহীম নাখায়ী রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি আসওয়াদ রহ. ও মাসরূক রহ. সম্পর্কে বলেছেন, তারা দুজনই ঈদের নামাযে নয় তাকবীর বলতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হা.নং ৫৭৫৯) এর সনদ সহীহ।

৭.    হিশাম রহ. বলেন, হাসান বসরী রহ. ও মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রহ. নয় তাকবীর বলতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হা.নং ৫৭৬৫) সনদ সহীহ।

এছাড়া আরো বহু হাদীস, আসার এবং সাহাবী-তাবেয়ীদের আমল ও ফাতাওয়া রয়েছে।

উল্লেখ্য, উপরোক্ত বিষয়ে যে মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে (অর্থাৎ অতিরিক্ত ছয় তাকবীর ও নয় তাকবীরের ক্ষেত্রে) তা মূলত উত্তম অনুত্তম বিষয়ক। সুতরাং এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা ও প্রান্তিকতার আশ্রয় নেয়া কোন ক্রমেই কাম্য নয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সব ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি মূলক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।

(সূত্র: শরহু মাআনিল আসার ২/৪০০, সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ১১৫৩, মুজামুত তাবারানী; হা.নং ৯৫১৩, ৯৫১৮, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/৩৬৭, আল-মুহাল্লা বিল-আসার ৩/২৯৫, মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক; হা.নং ৫৬৮৭, ফাতাওয়া শামী ২/১৭১, ১৭২, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১১, ফাতাওয়া হাক্কানিয়া ৩/৪১৬)

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ