শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

বাংলাদেশ বিগত দশকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়সমূহে প্রতিবেশী ও বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই আমরা ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’ বা এমডিজি-৪ অর্জন করেছি এবং সীমিতস্বাস্থ্য বাজেট ও সেই সাথে অন্যান্য আরো অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এমডিজি-৫ এর সীমারেখার কাছে রয়েছি। আমরা এখন এসডিজি যুগে রয়েছি। বাংলাদেশে ৪র্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা এবং পুষ্টি (এইচপিএন) সেক্টর প্রোগ্রাম জানুয়ারি ২০১৭ থেকে জুন ২০২২ এর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চালু রয়েছে। এসডিজি এর প্রথম সাড়ে পাঁচ বছরের জন্য, এমডিজি হিসাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে কমিউনিটি বেইজড হেলথকেয়ার (সিবিএইচসি) উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির অর্জন অব্যাহত থাকবে। ৪র্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা এবং পুষ্টি (এইচপিএন) সেক্টর প্রোগ্রামের অধীনে কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি)’র মাত্রা আরো বাড়ানো হয়েছে। সংক্ষেপে, এটি কমিউনিটি ক্লিনিক যা বর্তমান সরকারের ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প এবং ইএসডি (এশেনশিয়াল হেলথ সার্ভিস সিসি ব্যতীত ইউএইচসি থেকে উপজেলা এর মধ্যে বিদ্যমান সমস্ত প্রতিষ্ঠান) এর কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। স্বাস্থ্যসম্মত জীবন নিশ্চিত করতে ও সব বয়সের সবার কল্যাণ বৃদ্ধির জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গুণগত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাসমূহের প্রবেশাধিকার, সামর্থ্য ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যসমূহ নিয়ে ১৯৯৮ সালে ৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের যাত্রা শুরু। ১. বাংলাদেশের সমগ্র এলাকার জনসংখ্যার স্বাস্থ্য (জনসংখ্যা ও পুষ্টি) সুনিশ্চিত করার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহ পরিচালিত হচ্ছে। ২. বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সেবাসমূহ সমভাবে গ্রাম পর্যায়ে পৌছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহ কাজ করে যাচ্ছে। ৩. জনগণের উন্নত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করণের জন্য গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম বিস্তৃত করা। ৪. কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়াসগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ভাবে বজায় রাখা। ৫. গ্রাম পর্যায়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শক্তিশালী করা। ৬. গ্রাম পর্যায়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিতরে ও বাইরে কার্যকর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ৭. গ্রাম স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যথাযথ কার্যক্রমের জন্য সরকার কর্তৃক চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। ৮. উন্নত কর্মক্ষমতা ও কর্মদক্ষতার জন্য গ্রাম পর্যায়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন করা। ৯. সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাগুলোর ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে নাগরিকদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো। ১০. উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। সারা দেশে এখন ১৩ হাজার ৪৪২টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে। এসব ক্লিনিক থেকে মাসে গড়ে ৯৫ লাখ মানুষ বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নেয়। কমিউনিটি ক্লিনিক চালু হওয়ার পর থেকে উপজেলা হাসপাতালে রোগীর চাপ কমেছে। আমাদের দেশে অন্য অনেক কিছুর মতো কমিউনিটি ক্লিনিকের এই উদ্যোগও রাজনীতির রোষানলে পড়েছিল। তবে মানুষের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই উদ্যোগ কতটা কাজে লেগেছে, তার একটা চিত্র পাওয়া যায় ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: হেলথ রেভল্যুশন ইন বাংলাদেশ’ (কমিউনিটি ক্লিনিক: বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব) শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে। সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই যৌথ প্রতিবেদেন ২০১৩ সালের ১২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের কিছু ছাপা হয়েছিল। সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে তিনি তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধারণা ও চিন্তার সম্প্রসারণ করেছেন। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমি তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তাঁর চিন্তা ও পরিকল্পনাগুলো আমি তাঁর কাছ থেকে শুনতাম। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কীভাবে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া যায়, এ নিয়ে তাঁর ভাবনাগুলো তিনি আমাকে বলতেন। পরে ওই চিন্তাভাবনাগুলোই আমি আরও বিস্তৃত করেছি।’ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কাজটি কঠিন। বিভিন্ন সময় নানা দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এ নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আলমাআটাতে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ‘২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য’—এই বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়। এরপর থেকে অনেক দেশে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার নানা উদ্যোগ নেওয়া হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম কমিউনিটি ক্লিনিক বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। প্রতি ৬ হাজার গ্রামীণ মানুষের জন্য একটি করে মোট ১৩ হাজার ৫০০ ক্লিনিক তৈরির পরিকল্পনা ছিল। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার ক্লিনিকের নির্মাণকাজ শেষ হয় এবং ৮ হাজার ক্লিনিক চালু হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। শত শত কমিউনিটি ক্লিনিক পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। এরপরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-০৮) কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো কীভাবে চালু করা যায়, তার একটি উদ্যোগ নেয়। এনজিওগুলোকে দিয়ে ক্লিনিকগুলো চালানো যায় কি না, এমনও ভাবা হয়েছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার স্বাস্থ্য খাতের অগ্রাধিকার বিবেচনায় কমিউনিটি ক্লিনিক পুনরায় চালু করে। ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ’ নামের প্রকল্পের আওতায় ক্লিনিকগুলো মেরামত, নতুন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ এবং ওষুধ সরবরাহ করার মাধ্যমে ক্লিনিকগুলো চালু করা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিক হচ্ছে সরকারের সর্বনিম্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো। এখান থেকে স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টিসেবা দেওয়া হয়। এখান থেকে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ পায় মানুষ। শুক্রবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহে ছয় দিন সকাল নয়টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত ক্লিনিক খোলা থাকে। ক্লিনিক পরিচালনা করেন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি)। এই পদে স্থানীয় নারী কর্মীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তাকে সহায়তা করেন স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারী। কমিউনিটি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সর্বেশষ তথ্যে বলা হচ্ছে, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবাগ্রহীতার ভিজিট সংখ্যা ৬১ কোটি ৫০ লাখ, ক্লিনিক থেকে জরুরি ও জটিল রোগী রেফারের সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ ৪৮ হাজার, স্বাভাবিক প্রসবের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩০৯টি, গর্ভবতী মায়ের প্রসব পূর্ববর্তী সেবা (এএনসি) ২৩ লাখ ৮৬ হাজার ২০৪টি, প্রসব-পরবর্তী সেবা (পিএনসি) ৮ লাখ ১১ হাজার ৬৬৩টি। এই বিপুল সেবা গ্রামের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ পেয়েছে বিনা মূল্যে। দেশব্যাপী সরকারের এই উদ্যোগ কতটুকু কার্যকর, যাদের জন্য এই উদ্যোগ তারা সন্তুষ্ট কি না, তা নিয়ে একাধিক মূল্যায়ন হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ ২০১৩ সালে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছে, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ৮২ শতাংশ এলাকাবাসী সেবা নেয়। ক্লিনিকগুলো বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় এবং বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়া যায় বলে মানুষ এখানে সেবা নিতে আগ্রহী। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা যায়, বাড়ির পাশের ক্লিনিক থেকে বিনা মূল্যে ওষুধ ও পরামর্শ পেয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) জরিপ বলছে, সেবা নিয়ে ৯৮ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। সিংহভাগ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থানীয় কোনো ব্যক্তির জমিতে গড়ে উঠেছে। এর পরিচালনায় স্থানীয় মানুষ ও জনপ্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত। সরকারি বেতনভুক যে তিনজন এখানে সেবা দেন, তাদের অধিকাংশ সংশ্লিষ্ট এলাকার। তাই কমিউনিটি ক্লিনিককে সাধারণ মানুষ নিজেদের প্রতিষ্ঠান বলে মনে করে। সাধারণ অসুখে আগে যারা চিকিৎসকের কাছে যেতেন না, এখন তারা কমিউনিটি ক্লিনিকে আসেন। ইউনিয়ন সাবসেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জেলা/সদর হাসপাতাল-এ রকম একটি প্রতিষ্ঠিত স্বাস্থ্যকাঠামোর মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। এতে মাঠপর্যায়ে কিছু টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। আবার ক্লিনিক কার্যক্রম চলছে প্রকল্পের আওতায় ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার পরিকল্পনা সহকারীর বেতন হয় রাজস্ব খাত থেকে, কিন্তু কমিউনিটি বেইজড হেলথ (সিএইচসিপি)’র বেতন হয় প্রকল্প থেকে। এ নিয়ে সিএইচসিপিদের মধ্যে অসন্তোষ আছে। ২০১৭ সালের শুরু থেকে ‘কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার’ নামের কর্মপরিকল্পনার আওতায় কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম চলছে। কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক আবুল হাসেম খান ব্যাখ্যা করে বললেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজের পরিধি বাড়ছে। এখন প্রায় ১ হাজার ২০০ ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসব হচ্ছে, প্রতিটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবের আয়োজন করা হচ্ছে। এ ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগ এখান থেকে শনাক্ত করা হবে। স্বাস্থ্যসম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্য তুলে ধরা হয়। 


বিশ্বসম্প্রদায়েরও কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যাপারে আগ্রহ আছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক বাংলাদেশ সফরের সময় গ্রামে গিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক ঘুরে দেখেছিলেন। বিনামূল্যে সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা বা ৩০ ধরনের ওষুধ পাওয়া গ্রামের মানুষের জন্য কম পাওয়া নয়। গ্রামের মানুষদের নিয়ে গঠিত কমিটি চালায় কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় গ্রাম পর্যায়ে স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণের এই ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে একটি মডেল এবং বড় সাফল্যের দৃষ্টান্ত যা বাংলাদেশকে বিশ্ব স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সেবায় ভারত ও পাকিস্তান থেকে এগিয়ে রয়েছে। এ পরিসংখ্যান দেশের স্বাস্থ্য সেবায় অগ্রসরমান চিত্রের স্মারক বহন করছে।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ