হযরত ওয়াহেস আল কারনী(রহঃ) এর জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত রেফারেন্স সহ জানতে চাই।
শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

হযরত ওয়ায়েস কারনী(রঃ) যিনি ছিলেন স্বনামধন্য এক তাবেয়ী। তিনি তখন ইয়েমেনে থাকতেন এবং তাঁর সাথে রাসূলপাক(সাঃ) এর কখনো দেখা হয়নি। রাসূলপাক(সাঃ) যখন দ্বীন ইসলাম প্রচারে নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষন-মুহুর্ত অতিবাহিত করছেন তখন এ মহান সাধক তাঁর হৃদয়-মন সর্বস্ব মহানবী(সাঃ) - এর আদর্শে সঁপে দিয়ে গভীর সাধনায় নিমগ্ন। মানুষ তাঁর খবর রাখেনি, কিন্ত রাসূলপাক(সাঃ) ঠিকই জানতেন। এটাইতো মহানবী(সাঃ) -এর মহিমা, তিনি বিশ্বনবী, তাঁর কাছে সবকিছুর খবর থাকাটা স্বাভাবিক। বিশ্বনবী(সাঃ) একদিন তাঁর সাহাবায়ে কেরামদের বলেছিলেন, “তোমরা জেনে রাখ, আমার এমন একজন ভক্ত আছেন, যিনি শেষ বিচারের দিনে রাবী ও মোজার গোত্রে ছাগপালের পশম সংখ্যাতুল্য আমার পাপী উম্মতের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবেন।” সবাই অবাক, কে এই সৌভাগ্যবান পুরুষ ? নবী করিম(সাঃ) জানালেন তিনি আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দা, যাঁর নাম ওয়ায়েস কারনী। তিনি কি আপনাকে দেখেছেন ? - এই ছিল সাহাবায়ে কেরামের প্রশ্ন। না, চর্মচক্ষু দিয়ে দেখেননি; তবে দেখেছেন নয়ন দিয়ে। তিনি যদি আপনার এতই গুণ মুগ্ধ তবে আপনার সমীপে উপস্থিত হন না কেন ? আল্লাহর নবী বললেন, দুটো কারণে। প্রথমত, আল্লাহ ও আল্লাহর নবীর প্রেমে তিনি এমনই বিভোর যে, তাঁর কোথাও যাওয়ার অবস্থা নেই। দ্বিতীয়ত, বাড়ীতে থাকা বৃদ্ধা অন্ধ মায়ের দেখভাল করার জন্য তাঁকে সেখানে থাকতে হয় এবং জীবিকার তাগিদে উটও চরাতে হয়। সাহাবীরা এই মহান ব্যাক্তিকে দেখার ইচ্ছে জানালে মহানবী(সাঃ) জানালেন হযরত উমর (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) ছাড়া আর কারো সঙ্গে তাঁর দেখা হবে না। অতঃপর তিনি ওয়ায়েস কারনী (রঃ) -এর দৈহিক বর্ণনা দিলেন, তাঁর সারা দেহ বড় বড় লোমে ঢাকা এবং দু'হাতের বাম দিকে একটা করে সাদা দাগ আছে যা শ্বেতী নয়। আসন্ন মৃত্যুর প্রাক্কালে রাসূল(সাঃ) তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী হযরত উমর (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) কে বললেন- আমার মৃত্যুর পর আমার খেরকা ওয়ায়েস কারনীকে দেবে। তাঁকে আমার সালাম জানিয়ে বলবে তিনি যেন আমার গুনাহগার উম্মতের জন্য দোয়া করেন। নবীজির এ আদেশ যথাসময়ে পালিত হয়। হযরত ওমর (রাঃ)- এর শাসনকাল, একদিন হযরত আলী (রাঃ) কে সাথে নিয়ে মহানবী (সাঃ) -এর নির্দেশ পালনের জন্য বেরিয়ে পড়লেন কুফার পথে । কুফার মসজিদে খুতবা পাঠকালে হযরত ওমর (রাঃ) উপস্থিত লোকদের কাছে জানতে চাইলেন ওয়ায়েস কারনী সম্পর্কে । লোকজন তেমন তথ্য দিতে পারল না । জানা গেল ওয়ায়েস কারনী লোকালয় ছেড়ে জনবিরল এলাকায় বাস করে, মাঠে উট চরায়, দিনের শেষে শুকনো রুটি খায় । লোকে যখন হাসে, সে তখন কাঁদে । আবার লোক যখন কাঁদে, সে তখন হাসে । খাপছাড়া টাইপের মানুষ । এ সংবাদের উপর ভিত্তি করে দুই খলীফা কারন এলাকায় গেলেন । ওয়ায়েস তখন নামায পড়ছিলেন, মাঠে তাঁর উটের পাল চরছিল যার দেখাশোনা করছিল আল্লাহর ফেরেশতারা । নামায শেষে তিনি অতিথিদের সালাম দিলেন । হযরত ওমর (রাঃ) তাঁর নাম জানতে চাইলে তিনি জানালেন আব্দুল্লাহ । আসল নাম জানতে চাইলে তিনি জানালেন ওয়ায়েস । হযরত ওমর (রাঃ) তাঁর হাত পরীক্ষা করে রাসূলপাক (সাঃ) - এর বর্ণনার সাথে মিল খুঁজে পেলেন । তিনি ওয়ায়েস কারনী (রঃ) - এর হাতে চুমো খেলেন । তারপর তাঁর হাতে তুলে দেয়া হল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) - এ পবিত্র খেরকা । আর তিনি যেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) - এর উম্মতের জন্য দোয়া করেন সে কথাও তাঁর কাছে নিবেদন করা হল । কিন্তু ওয়ায়েস (রঃ) বললেন, আপনারা ভাল করে খোঁজ নিন । সম্ভবতঃ তিনি অন্য কারো কথা বলেছেন । তখন ওমর (রাঃ) জানালেন তাঁরা ভালো করে খবর নিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তিনিই রাসূলপাক (সাঃ) -এর পরম প্রিয় ওয়ায়েস কারনী (রঃ) । এতক্ষণে ওয়ায়েস আগন্তুকদের পরিচয় জানতে চাইলেন । পরিচয় পেয়ে তাঁদের হাতে চুমো খেলেন, বললেন নবীজির গুনাহগার উম্মতের মুক্তির জন্য দোয়া করার যোগ্যতা তাঁদেরই বেশী । ওমর (রাঃ) বললেন, আমরা তা করছি । আপনিও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) - এর নির্দেশ পালন করুন । মহানবী (সাঃ) - এর পবিত্র খেরকাটি নিয়ে ওয়ায়েস কারনী (রঃ) সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন । তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালেন, প্রভূ গো ! রাসূলুল্লাহর উম্মতদের গুনাহ মাফ না করলে আমি খেরকা পরব না । নবী মুস্তফা (সাঃ) হযরত ওমর ও হযরত আলীর প্রতি যে দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন তা তাঁরা পালন করেছেন, এখন আপনার কাজ বাকী । আপনি আপনার প্রিয় বন্ধুর উম্মতের পাপ মাফ করে দিন । দৈববাণী হল, হে ওয়ায়েস ! তোমার দোয়ার কারণে কিছু সংখ্যক উম্মতকে মাফ করা হল । কিন্তু তিনি শুনলেন না । বললেন, যতক্ষণ না সমস্ত উম্মতকে মাফ করা না হয় ততক্ষণ আমি নবীজির দেওয়া খেরকা পরব না । ইলহাম এল- তোমার দোয়ার জন্য কয়েক হাজার মানুষকে মার্জনা করা হবে । তখন সেখানে হযরত ওমর (রাঃ) উপস্থিত হলেন । তাঁকে দেখে তিনি বললেন যতক্ষণ পর্যন্ত সকল উম্মতকে মাফ করাতে না পারছি সে পর্যন্ত আমি রাসূলপাক (সাঃ) - এর খেরকা গায়ে তুলব না । ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত এ মানুষটির অন্তর্জোতি দেখে হযরত ওমর (রাঃ) অভিভূত হয়ে পড়লেন । তাঁর কাছে খিলাফত তুচ্ছ মনে হল । তিনি বললেন, এমন কেউ আছ যে, একখানি রুটির বিনিময়ে খেলাফতের দায়িত্ব নিতে পার ? তাঁর এই স্বগতোক্তি শুনে ওয়ায়েস (রঃ) বললেন, যে বোকা সেই তা নেবে । মন না চাইলে ছুঁড়ে ফেলুন, যার মন চায় সে কুড়িয়ে নেবে । এই কথা বলে তিনি রাসূলপাক (সাঃ) -এর প্রদত্ত পোশাক পরম ভক্তিভরে পরলেন । তারপর বললেন, আল্লাহ এ অধমের প্রার্থনায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, রাবী ও মোজার কবিলার ছাগ লোমের তুল্য নবীজীর উম্মতকে মার্জনা করবেন । হযরত ওমর (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) এ কথা শুনে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন । কিছুক্ষণ পরে ওমর (রাঃ) জানতে চাইলেন কেন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) - এর সাথে সাক্ষাত করেননি । তিনি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উলটো প্রশ্ন করলেন, আপনারা তো তাঁকে দেখেছেন; বলুন তো তাঁর পবিত্র ভুরু দুটো জোড়া ছিল, না আলাদা ? প্রশ্ন শুনে তাঁরা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন । আশ্চর্যের কথা , তাঁরা কেউই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না । ওয়ায়েস কারনী (রঃ) জানালেন ওহোদের যুদ্ধে রাসূলপাক (সাঃ) -এর পবিত্র দাঁত শহীদের খবর শুনে তিনি নিজের সকল দাঁত ভেঙে ফেলেছেন । কারন তিনি জানতেন না রাসূলুল্লাহ (সাঃ)- এর কোন দাঁত শহীদ হয়েছে । হযরত ওমর (রাঃ) তাঁকে কিছু দিতে চাইলেন । তখন ওয়ায়েস কারনী (রঃ) জামার পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে বললেন, আমি উট চরিয়ে এ পয়সা রোজগার করেছি । আপনি যদি বলতে পারেন এ পয়সা খরচ করার পরেও আমি বেঁচে থাকব তাহলে আমার কিছু জিনিষের প্রয়োজন হবে । তারমানে, জীবন কখন ফুরায় কেউ জানে না । সুতরাং কোন কিছু সঞ্চয়ের প্রশ্ন আসে না । এরপর তিনি অতিথিদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন এবং বললেন কিয়ামতের দিন তাঁদের সাথে আবার দেখা হবে । তাঁদের বিদায় জানিয়ে তিনি নিজেও সেখান থেকে চলে গেলেন । এরপর ওয়ায়েস কারনী (রঃ) - এর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে । এরপর তিনি ঐ এলাকা ছেড়ে কুফায় চলে যান । শোনা যায় হারম ইবনে জামান ছাড়া আর কারো সাথে তাঁর দেখা হয়নি ।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ

৩৭ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ তার হয়নি। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা ছিল। তার বৃদ্ধা মা ছিলেন। মায়ের সাথে তিনি সদাচরণ করতেন। মায়ের সেবাযত্ন করতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চিনতেন। হাদীস শরীফে এসেছে, ওমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইয়ামান থেকে উয়াইস নামে এক ব্যক্তি তোমাদের কাছে আসবে। ইয়ামানে মা ছাড়া তার আর কেউ নেই। তার শ্বেত রোগ ছিল । সে আল্লাহর কাছে দুআ করলে আল্লাহ তার রোগ ভাল করে দেন, কিন্তু তার শরীরের একটি স্থানে এক দিনার অথবা এক দিরহাম পরিমাণ স্থান সাদাই থেকে যায়। তোমাদের কেউ যদি তার সাক্ষাৎ পায় সে যেন তাকে নিজের জন্য ইস্তেগফার করতে বলে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৪২

ওয়ায়েস করনীর সাথে সাহাবীদের সাক্ষাতের ঘটনাও হাদীস শরীফে এসেছে। সহীহ মুসলিমে এসেছে, ওমর রা.-এর সাথে ওয়ায়েস করনীর সাক্ষাত হলে তাকে সনাক্ত করার জন্য তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  বলে দেয়া সব আলামত জিজ্ঞাসা করেন। এ বর্ণনায় আছে ওমর রা. নবীজীর কথা অনুযায়ী তাকে নিজের জন্য ইস্তিগফার করতে বলেন, তিনি ওমর রা.-এর জন্য ইস্তিগফার করেন। পরবর্তী বছর হজ্বের মৌসুমে ওয়ায়েস করনী যে এলাকায় বসবাস করছিলেন সেখান থেকে এক ব্যক্তি এলে ওমর রা. তার (ওয়ায়েস করনীর) খোঁজ খবর নেন। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৪২)

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ