কেউ বলে হাদিয়া গ্রহণ করা জায়িয, কেউ বলে না-জায়িয। আমি এর ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চাই। কোরআন ও হাদিসেত আলোকে বলবেন।
শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

* আবদুর রহমান ইবনে শিবল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তোমরা কোরআন পড়ো। তবে তাতে বাড়াবাড়ি করো না। এর প্রতি বিরূপ হয়ো না। কোরআনের বিনিময় ভক্ষণ করো না এবং এর দ্বারা সম্পদ কামনা করো না। (মুসনাদে আহমদ ৩/৪২৮, হাদিস : ১৫৫২৯; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৫/২৪০)

* ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তোমরা কোরআন পড়ো এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করো। তোমাদের পরে এমন জাতি আসবে, যারা কোরআন পড়ে মানুষের কাছে প্রার্থনা করবে। -(মুসনাদে আহমদ ৪/৪৩৭, হাদিস : ১৯৯১৭)

* আবদুল্লাহ ইবনে মা'কাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি এক রমজানে লোকদের নিয়ে তারাবি পড়ালেন। এরপর ঈদের দিন উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ (রা.) তাঁর কাছে একজোড়া কাপড় এবং ৫০০ দিরহাম পাঠালেন। তখন তিনি কাপড় জোড়া এবং দিরহামগুলো এই বলে ফেরত দিলেন, আমরা কোরআনের বিনিময় গ্রহণ করি না। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৫/২৩৭, হাদিস : ৭৮২১)

এরূপ আরো বহু হাদিস ও দলিল প্রমাণের আলোকে উম্মতের ফকিহগণ তারাবিতে পবিত্র কোরআন খতমের বিনিময়ে বা হাদিয়া দেওয়া-নেওয়া সম্পূর্ণরূপে হারাম বলেছেন।

প্রখ্যাত ফকিহদের মতামত : ১. হজরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী বলেন, তারাবিতে যে পবিত্র কোরআন পড়ে এবং শোনে তাদের বিনিময় দেওয়া হারাম। (ফতোয়ায়ে রশীদিয়া ৩৯২)

২. হজরত খলিল আহমদ সাহারানপুরী (রহ.) বলেন, বিনিময় দিয়ে পবিত্র কোরআন শোনা জায়েজ নয়। দানকারী এবং গ্রহণকারী উভয় গোনাহগার হবে। (ফতোয়ায়ে খলিলিয়া ১/৪৮)

৩. হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, বিনিময় লেনদেন হয় এমন খতম তারাবি শরিয়তপরিপন্থী। এরূপ খতমের দ্বারা সাওয়াবের ভাগী হওয়া যাবে না বরং গোনাহের কারণ হবে। (এমদাদুল ফতোয়া ১/৪৮)

৪. মুফতি কেফায়াতুল্লাহ (রহ.) বলেন, তারাবিতে পবিত্র কোরআন শোনানোর বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ নেই। (কেফায়াতুল মুফতি ৩/২৬৫)

৫. হজরত মুফতি আযীযুর রহমান (রহ.) বলেন, বিনিময় গ্রহণ করে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করা জায়েজ নেই। যাদের নিয়তে দেওয়া-নেওয়া আছে, তাও বিনিময়ের হুকুমে হবে। এমতাবস্থায় শুধু তারাবি আদায় করাই ভালো। বিনিময়ের কোরআন শরিফ না শোনা উত্তম। কিয়ামুল লাইলের সাওয়াব শুধু তারাবি পড়লেই অর্জন হয়ে যাবে। (ফতোওয়া দারুল উলুম ৪/২৪৬)

৬. হজরত মাওলানা মুফতি শফী (রহ.) বলেন, ছোট ছোট সুরা দিয়ে তারাবি পড়ে নিন। বিনিময় দিয়ে কোরআন শুনবেন না। কারণ কোরআন শোনানোর মাধ্যমে বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ নেই। (জাওয়াহেরুল ফিকহ ১/৩৮২)

৭. তারাবিতে কোরআন পড়ার বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ নেই। দানকারী এবং গ্রহণকারী উভয়েই গোনাহগার হবে। যদি বিনিময়বিহীন কোরআন শোনানোর মতো হাফেজ পাওয়া না যায়, তবে ছোট ছোট সুরা দিয়ে তারাবি পড়ে নেওয়াই উত্তম। (ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া ৭/১৭১)

৮. খেদমতের নামে নগদ টাকা বা কাপড়চোপড় ইত্যাদি দেওয়াও বিনিময়ের মধ্যে শামিল। বরং তা বিনিময় ধার্য করা থেকেও জঘন্য। কারণ তাতে দুটি গোনাহ একত্রিত হয়। একটি কোরআনের বিনিময় গ্রহণের গোনাহ। দ্বিতীয়টি হলো, যে বিনিময় হচ্ছে তা না জানার গোনাহ। (আহসানুল ফতোওয়া ৩/৫১৪)

এ বিষয়ে বেরলভি সম্প্রদায়ের মতামত : বিশিষ্ট বেরলভি মুফতি আমজাদ আলী কাদেরী আজমী এক ফতোয়ায় লেখেন, বর্তমানে অধিক প্রচলন দেখা যায়, হাফেজ সাহেবকে বিনিময় দিয়ে তারাবি পড়া হয়। যা জায়েজ নেই। দানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ই গোনাহগার হয়। এটুকু নেব বা এটুকু দেবে- এটিই শুধু বিনিময় নয়। বরং যদি জানা থাকে যে এখানে কিছু পাওয়া যায়, যদিও তা নির্দিষ্ট নয়, তা নাজায়েজ। কারণ জানা থাকাও শর্তকৃতের মতো। (বাহারে শরিয়ত ৪/৬৯২)

লা-মাজহাবি সম্প্রদায়ের ফতোয়া : লা-মাজহাবিদের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুর রহমান মোবারকপুরী লেখেন, ইমাম আহদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর কাছে বিনিময় নিয়ে তারাবি নামাজে ইমামতকারী ইমামের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, সেরূপ ইমামের পেছনে কে বা কারা নামাজ আদায় করবে? আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক বলেন, আমি বিনিময় নিয়ে নামাজ পড়ানোকে মাকরূহ মনে করি এবং আমার ভয় হয়, ওই সব লোকের নামাজ আবার পড়তে হবে কি না, যারা এমন ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করে। এরপর তিনি বলেন, আমার মত হলো, বিনিময় গ্রহণ করা যাবে না। (ফতোয়ায়ে নজিরিয়া ১/৬৪২)

* মাওলানা আব্দুল্লাহ আমরতসরী লেখেন, বিনিময়ের মাধ্যমে তারাবিতে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করা বা বিনিময় নির্ধারণ করা সম্পূর্ণ হারাম। বরং এরূপ লোকের পেছনে তারাবিও হয় না। (ফতোয়ায়ে আহলে হাদিস ২/৩০২)

এ আলোচনার পর স্পষ্ট হয়ে গেল, খতম তারাবি পড়িয়ে কোনো প্রকার বিনিময়-হাদিয়া লেনদেনের কোনো অবকাশ দ্বীন ইসলামে নেই। এটি পুরো উম্মতের দল-মত নির্বিশেষে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত। সুতরাং এ ব্যাপারে অপরিণামদর্শী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন হীলা-বাহানার অবতারণা করে বিষয়টিকে জটিল করার কোনো সুযোগ আর বাকি থাকে না। আল্লাহ আমাদের সত্য বোঝা ও মানার তাওফিক দান করুন আমিন।

হাফেজদের প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা ও তাদের খেদমত করার পদ্ধতি : তার পরও একটি বিষয় থেকে যায়, তাহলো মুসলমানগণের আবেগ, হাফেজদের মূল্যায়ন করা তাদের খেদমত করা, তা কিভাবে সম্ভব? মুসলমানদের এরূপ আবেগ, ভক্তি-ভালোবাসা থাকা স্বাভাবিক। কারণ পবিত্র কোরআনের হাফিজের অগণিত ফজিলত হাদিস শরিফে এসেছে। তাই হাফেজদের মূল্যায়ন করা, মুহাব্বত করা, তাদের যথাসম্ভব খেদমত করা সব মুসলমানের জন্য জরুরি বিষয়। শরিয়তে এরও পদ্ধতি ভিন্নভাবে আছে। রমজানসহ সারা বছর তাদের খিদমত করার সুযোগ আছে। যেমন ১. এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের সর্বপ্রথম দ্বীনি দায়িত্ব হলো পবিত্র কোরআনের হাফিজকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসা ও ভক্তি করা। এই ভালোবাসা ও ভক্তি সব সময়ের জন্য, সারা বছরের জন্য। শুধু রমজানের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। ২. পবিত্র কোরআন ও হাফেজে কোরআনের মুহাব্বত তখনই প্রকাশ পাবে, যদি অন্তরে নিজের সন্তানকে হাফেজে কোরআন বানানোর ইচ্ছা করা হয় এবং চেষ্টা করা হয়। ৩. রমজান মাসে যে হাফেজের পেছনে তারাবি পড়া হবে, তার খানাপিনার ক্ষেত্রে সর্বোন্নত ব্যবস্থা করা যায়। ৪. তাদের যাতায়াতের জন্য সবচেয়ে উন্নত গাড়ি ব্যবহার করা যায়। ৫. সারা বছর যারা পবিত্র কোরআন হিফজ করার কাজে নিয়োজিত, এরূপ ছাত্র-শিক্ষকদের যেকোনো খেদমত যেকোনো সময় আঞ্জাম দেওয়া যায়। নিজের সাধ্যমতো হাফেজদের খোঁজখবর রাখা, তাদের জরুরত পূরণ করা। তাদের খানাপিনার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।

এভাবে হাফেজদের যথাযথ খিদমত আঞ্জাম দেওয়া ও আন্তরিক ভালোবাসা দিয়ে তাদের অভিভাবকত্ব করার ফজিলত অপরিসীম। আল্লাহ আমাদের বৈধ পদ্ধতিতে হাফেজদের যথাযথ মূল্যায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ

কোরআন তেলাওয়াত করে তার বিনিময় গ্রহণ করা না জায়েজ। ইসালে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে খতমে কোরআন করে হাদিয়া দেওয়া/নেওয়া না জায়েজ।কোরআন শিক্ষাদান করে বেতন নেওয়া জায়েজ। বিস্তারিত জানতে তাফসিরে মাঅারিফুল ক্বোরআন থেকে সুরা আল-বাকারার ৪১নং আয়াতের তাফসির পড়ুন। সৌদি প্রিন্ট ৩৫ পৃ:।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ