মহাবিশ্ব সৃষ্টির আদি অবস্থা
و هو الذى خلق السموات و الارض فى ستة ايام و كان عرشه على الماء ......
“আর তিনিই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন, তখন তাঁহার আরশ ছিল পানির উপর, তোমাদের মধ্যে কে কার্যে শ্রেষ্ঠ তাহা পরীক্ষা করিবার জন্য।”...........। (সূরা হুদঃ ৭)


অত্র আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সব জিনিসের উপর তাঁর একচ্ছত্র কুদরতের কথা বর্ণনা করেছেন এভাবে যে, তিনি ছয় দিনে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন। আর এগুলো সৃষ্টি করার পূর্বে তাঁর আরশ পানির উপর অবস্থিত ছিল। হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন- ‘হে বনী তামীম! তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। তারা বললÑ আপনি আমাদেরকে যে জিনিসের সুসংবাদ দান করছেনÑ তা আমাদেরকে প্রদান করুন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পূণরায় ঘোষণা করলেনÑ হে ইয়ামানবাসী! তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। তারা বললÑ আমরা গ্রহণ করলাম। অতঃপর আপনি আমাদেরকে বলুনÑ এই মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হল? পূর্বে কেমন ছিল? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উত্তর করলেনÑ সবকিছুর আগে আল্লাহ তায়ালা ছিলেন এবং তাঁর আরশ পানির উপর বিদ্যমান ছিল এবং তিনি লাওহে মাহফূজের মধ্যে সবকিছুর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। (বুখারী, মুসলিম)
অপর এক রেওয়ায়েত মতে ইয়ামন বাসীরা এসে বলেÑ ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! আমরা আপনার কাছে এসেছি এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য। জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনÑ সর্বপ্রথম শুধু আল্লাহ তায়ালাই ছিলেন। তাঁর আগে আর কিছুই ছিল না এবং তাঁর আরশ ছিল পানির উপর। সবকিছু সম্পর্কে তিনি যিক্র তথা লাওহে মাহফুজের মধ্যে লিপিবদ্ধ করেন। অতঃপর তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেন।


মুসলিম শরীফের হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছেÑরাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেনÑ নিশ্চই আল্লাহ তায়ালা নভোমন্ডল-ভূমন্ডল সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগেই সমস্ত মাখলূকের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেলেন। সে সময় তাঁর আরশ পানির উপর ছিল।
উপরে বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম বুখারী (রহঃ) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে হাদীস বর্ণনা করেনÑ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনÑ আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেনÑ “হে বান্দা! তুমি আমার রাস্তায় অম্লান বদনে খরচ কর, আমি তোমাকে অবলীলায় দান করব।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেনÑ আল্লাহ তায়ালার হাত ভরপুর রয়েছে। বান্দার জন্য বেহিসাব খরচ করা উহাকে নিঃশেষ করতে পারে না। তিনি রাত-দিন অবিরাম দাতা। এরপর বলেনÑ তোমরা কি মনে কর? তিনি নভোমন্ডল ও ভুমন্ডল সৃষ্টির আদিকাল থেকে অদ্যাবধি সৃষ্টিকূলের উপর অবিরাম দানের ধারা বর্ষণ করে চলেছেন অথচ তাঁর হাতে যা রয়েছে তার বিন্দুমাত্র নিঃশেষ হয়নি এবং তাঁর আরশ রয়েছে পানির উপর। আর তাঁরই হাতে রয়েছে নিক্তি বা মিযান। এর দ্বারা তিনি কাউকে অপদস্ত করেন। আবার কাউকে উচ্চাসন দান করেন।


ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) আবু রযীন থেকে বর্ণনা করে বলেনÑ আমি আরজ করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ)! মাখলুক সৃষ্টি করার পূর্বে আল্লাহ তায়ালা কোথায় ছিলেন? উত্তর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনÑ উঁচু মেঘমালার মধ্যে। যার নিচেও ছিল মহাশূন্য এবং উপরিভাগেরও ছিল মহাশূন্য। অতঃপর তিনি আরশ সৃষ্টি করেন।
ইমাম মুজাহিদ (রহঃ) বলেনÑ কোন কিছু সৃষ্টি করার পূর্বেও আল্লাহর আরশ পানির উপর অবস্থিত ছিল। এ প্রসঙ্গে ইমাম কাতাদাহ (রহঃ) বলেনÑ নভোমন্ডল-ভূমন্ডল সৃষ্টির পূর্বে সৃষ্টির আদি অবস্থা কেমন ছিলÑ তা বুঝা যায় আল্লাহ তায়ালার এই ভাষ্য থেকে যে, “আল্লাহর আরশ পানির উপর ছিল।” রবী ইবনে আনাস (রাঃ) বলেনÑ আল্লাহর আরশ পানির উপর ছিল। অতঃপর যখন তিনি নভোমন্ডল-ভূমন্ডল সৃষ্টি করেনÑ তখন তিনি ঐ পানিকে দুই ভাগে ভাগ করেন। সেটাকেই কুরআনের ভাষায় ‘আল্ বাহরুল মাসজূর’ বলা হয়েছে।


হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনÑ আল্লাহর আরশ সর্বোচ্চ মাখলুক হওয়ার কারণেই উহাকে ‘আরশ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইসমাঈল ইবনে আবু খালেদ (রহঃ) বলেনÑ আমি সাদ আত্-তায়ী (রাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, আরশ লাল বর্ণের ইয়াকূত পাথর দ্বারা তৈরী। মুহাম্মাদ বিন ইসহাক (রহঃ) বলেনÑ আল্লাহ তায়ালা উপরোল্লেখিত আয়াতে নিজকে যেভাবে বর্ণনা করেছেনÑ তিনি তেমনি। কেননা সে সময় পানি ব্যতীত কিছুই ছিল না। আর পানির উপরে ছিল তাঁর আরশ............।


“আল্লাহ তায়ালার আরশ পানির উপর অবস্থিত ছিল।” এই আয়াত প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয় যে, তাহলে পানি কার উপর অবস্থিত ছিল? উত্তরে তিনি বলেনÑ বাতাসের (পিঠের) উপর। (তাফঃ ইবনে কাসীর, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৪৩৭)


তাফসীরে কুরতূবীতে বর্ণিত রয়েছে “আল্লাহর আরশ পানির উপর অবস্থিত ছিল”Ñএকথা বলে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, নভোমন্ডল-ভূমন্ডল সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা পানি এবং আরশকে সৃষ্টি করেছেন। হযরত কা’ব আহবার (রাঃ) বলেনÑ এক সময় আল্লাহ তায়ালা সবুজ রং এর ইয়াকূত পাথর তৈরী করেন। অতঃপর উহার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিপাত করেন। এতে উহা গলে তরল পানিতে পরিণত হয়। তখন আল্লাহর ভয়ে পানি কাঁপতে আরম্ভ করে। অর্থাৎ পানির উপর তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এজন্যই অদ্যাবধি পানি সর্বদাই কাঁপে। যদিওবা পানিকে স্থির রাখার চেষ্টা করা হয় তারপরও কাঁপে। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা বাতাস সৃষ্টি করেন এবং পানি রাশিকে বাতাসের (পিঠের) উপর স্থাপন করেন। এরপর পানি রাশির উপর আরশ স্থাপন করেন। (তাফঃ কুরতূবী, খন্ড-৯, পৃষ্ঠা-৮)
তাফঃ রুহুল বয়ান, খন্ড-১২, পৃষ্ঠা-৯৯ এবং তাফঃ কাবীর, খন্ড-১৭, পৃষ্ঠা-১৮৭ তে বলা হয়েছে এর অর্থ এই নয় যে, পানির উপর যেমন পানির সংস্পর্শে থেকে নৌকা ভাসে তেমনি আরশও পানির সাথে লেগে থেকে পানির উপর ভাসছে: বরং আল্লাহ তায়ালা এদের একটিকে আরেকটির উপর স্থাপন করে উভয়ের মধ্যখানে ফাঁকা রেখে স্বীয় কুদরতের দ্বারা এগুলোকে ধরে রেখেছেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং আরো কতিপয় সাহাবী থেকে বর্ণিত রয়েছেÑ আল্লাহর আরশ পানির উপর অবস্থিত ছিল। তখনও পর্যন্ত তিনি পানি ছাড়া অন্য কিছুই সৃষ্টি করেননি। এরপর যখন তিনি মাখলুক সৃষ্টি করার মনস্থ করলেনÑ তখন পানি থেকে ধূঁয়া উদ্গীরণ করলেন এবং সেই ধূঁয়াকে উপরের দিকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে উহা দ্বারাই আকাশ সৃষ্টি করলেন। পানি বাষ্পাকারে উপরের দিকে উঠিয়ে নেয়ার ফলে নিচে কিছুটা শুকিয়ে যায় এবং যমীন সৃষ্টি হয়ে যায়। পৃথক পৃথক ভাবে সাতটি যমীন সৃষ্টি করা হয়। রবি ও সোমবার এই দুই দিনে সাত যমীন তৈরী করা হয়।
যমীন মাছের পিঠের উপর রয়েছে। এটা ঐ মাছ যার বর্ণনা কুরআন মাজিদের সূরায়ে “নূন” এর মধ্যে রয়েছে। “নূন” অর্থ মাছ। মাছটি রয়েছে পানির মধ্যে একটি বিশালকায় পাথরের উপর। পাথর রয়েছে ফেরেস্তার উপর। আর ফেরেস্তা দাঁড়িয়ে রয়েছে অপর একটি পাথরের উপরে। এটা ঐ পাথর (ছাখরা) যার বর্ণনা রয়েছে সূরা লুকমানের মধ্যে স্বয়ং লুকমান (আঃ) এর ভাষ্যে। উক্ত পাথর বাতাসের উপর শূন্যে ভাসমান রয়েছে। মাছের নড়াচড়ার কারণে যমীন কাঁপতে শুরু করে। তখন আল্লাহ তায়ালা যমীনে পর্বতমালার পেরেক গেঁড়ে দেন। এতে উহা স্থির হয়ে যায়। এটাকেই তিনি এভাবে বর্ণনা করেনÑ “এবং আমি যমীনের মধ্যে পর্বতমালার পেরেক ঢুকিয়ে দিলাম। যাতে উহা তাদেরকে নিয়ে স্থির হয়ে থাকে। পাহাড় গর্বভরে যমীনের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে।”
পাহাড়-পর্বত, গাছ-পালা ইত্যাদি যমীনের সমূদয় বস্তুকে মঙ্গল, বুধ দুই দিনে সৃষ্টি করেন। অতঃপর তিনি আসমান সৃষ্টিতে মনসংযোগ করেন। ইহা প্রথমে ধুম্রকুঞ্জ তথা বাষ্পাকারে ছিল। পানির শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ প্রক্রিয়াতে এই বাষ্প তৈরী হয়। এই বাষ্প দিয়ে প্রথমে একটি আসমান তৈরী করেন। অতঃপর উহাকে ফাঁড়িয়ে খন্ড খন্ড করে সাত আসমানে পরিণত করেন দুই দিনে। অর্থাৎ বৃহস্পতি ও শুক্রবার দিনে। ধূঁয়া থেকে সাত আসমান সৃষ্টি করেন বৃহস্পতি ও শুক্রবার দুই দিনে। শুক্রবার আসমান-যমীনের সৃষ্টিকর্ম সমাপ্ত হয়ে যায় বলেই উহাকে জুমআর দিন বলা হয়।
আসমানে বসবাসের জন্য তিনি ফিরিশতা পয়দা করেন। আরও এমন সব মাখলূক সৃষ্টি করেন, যেগুলোর খবর আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কেহ জানেনা। যেমনঃ সাগর, বরফের পাহাড় ইত্যাদি। পৃথিবীর নিকটতম আকাশকে তিনি নক্ষত্র মন্ডলী দ্বারা সুশোভিত করেছেন। শয়তানের অবাধ বিচরণ থেকে নভোমন্ডলকে সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে তারকারাজীকে শয়তান বিতাড়নের হাতিয়ার বানিয়েছেন। এই সমস্ত বস্তুকে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ্ তায়ালা আরশে আজীমের উপরে অধিষ্ঠিত হন।
এটাকেই আল্লাহ তায়ালা এভাবে বর্ণনা করেন “তিনি আসমান-যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেন। অতঃপর আরশের উপর অধিষ্ঠিত হন।” তিনি অন্যত্র বলেন- “এই দুইটি অর্থাৎ, নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডল সৃষ্টির পূর্বে জমাট ধুম্রকুঞ্জ ছিল। আমি উহাদেরকে পাহাড়, পানি ইত্যাদির মাধ্যমে সজীব করে তুলি। আল্লাহই ভাল জানেন (ুুুুতাফঃ সুদ্দি,তাফঃ ইবনে কাসীর, খন্ড-১, উর্দূ সংস্করণ, পৃষ্ঠা- ৩৪)

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ