শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
manik

Call
কিয়াসের আলোকে পর্দার অপরিহার্যতা।
 
     ইসলামি শরিয়ত স্বীকৃত ও ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণের সঠিক চিন্তা-গবেষণা ও চেষ্টা সাধনা হচ্ছে, কল্যাণকর বিষয়াদি ও তদীয় উপায় উপকরণাদি যথাযথ বহাল রাখার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা, অনুরূপভাবে অনিষ্টকর বিষয়াদি ও তার মাধ্যমসমূহের নিন্দা করা এবং তা থেকে বিরত থাকার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা। বলা বাহুল্য যেসব বিষয়ে শুধু খালেছ কল্যাণই নিহিত রয়েছে কিংবা অকল্যাণের তুলনায় কল্যণ প্রবল, সেসব বিষয় ইসলামি শরিয়তে নির্দেশিত, সেটা ওয়াজিব হবে বা মুস্তাহাব হবে। পক্ষান্তরে যেসব বিষয়ে কেবল অনিষ্টই অনিষ্ট বা অকল্যাণ কল্যানের চাইতে অধিক সেসব বিষয় যথাক্রমে প্রথমটি হারাম এবং দ্বিতীয়টি মাকরূহে তানযীহি হয়ে থাকে। আলোচ্য মূলনীতির ভিত্তিতে গভীরভাবে চিন্তা করলে উপলব্ধি করা যায় যে, নারীর জন্যে পরপুরুষের সামনে মুখমন্ডল খোলা রাখাতে (নৈতিকতা বিধ্বংসী) অনেক ফাসাদ ও অনাচার নিহিত রয়েছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, মুখমন্ডল খোলা রাখাতে কিছু কল্যাণ নিহিত রয়েছে তবে তা অকল্যাণ ও ফাসাদের তুলনায় নগণ্য। কাজেই নারীর জন্যে পর পুরুষের সম্মুখে চেহারা খোলা রাখা হারাম এবং আবৃত রাখা ওয়াজিব বলে প্রমাণিত হল।                
পর্দাহীনতার কতিপয় অনিষ্টতা:
 
      (১) ফিৎনা ও অনাচারে পতিত হওয়া।
 
 নারী মুখমন্ডল খোলা রেখে বেপর্দা হলে আপনা আপনি ফিৎনা ও অনাচারে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়। কারণ, মুখমন্ডল খোলা রেখে চলতে হলে নারীকে তার মুখ মন্ডলে এমন কিছু বস্তু ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হয়, যাতে মুখমন্ডল লাবণ্যময়, সুদৃশ্য ও দৃষ্টি আকষর্ণকারী হয়। আর এটি হচ্ছে অনিষ্ট, অনাচার ও ফাসাদ সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
 
     (২) লজ্জাশীলতা বিলীন হয়ে যাওয়া।
 
পর্দাহীনতার ন্যায় অসৎ আচরণের কারণে নারীর অন্তর থেকে ক্রমে ক্রমে লজ্জা-শরম বিলুপ্ত হয়ে যায়, যা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত এবং নারী প্রকৃতির অন্যতম ভূষণ। তাইতো কোন এক সময় নারীকে লজ্জাশীলতার প্রতীক বলা হত। যেমন বলা হত,  অমুক তো গৃহকোনে অবস্থানরত কুমারী রমণীর চাইতেও অধিক লাজুক। নারীর জন্যে লজ্জাহীনতা কেবলমাত্র দ্বীন ও ঈমান বিধ্বংসীই নয় বরং আল্লাহ তাআলা যে প্রকৃতির উপর তাকে সৃষ্টি করেছেন, সেই প্রকৃতির বিরোধিতা বা স্বভাব দ্রোহীতাও বটে।
 
   (৩) পুরুষদের অপ্রীতিকর বিষয়ে জড়িয়ে যাওয়া।
 
বেপর্দা নারীর কারণে পুরুষদের জন্য ফিৎনা ও অশ্লীলতায় লিপ্ত হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। বিশেষত: যদি সেই নারী সুন্দরী ও তাদের সাথে ক্রিড়া কৌতুকে অভ্যস্থ হয়। এরূপ অশোভন আচরণ বেপর্দা নারীর সাথেই বেশি সংঘটিত হয়েছে। যেমন প্রবাদ রয়েছে:
আঁখি মিলন এরপর সালাম অনন্তর কালাম, অতএব অঙ্গীকার, সাক্ষাৎ, সঙ্গম শেষ পরিণাম।
 বস্তুত: মানুষের চিরশত্রু  শয়তান, মানব দেহে রক্তের ন্যায় শিরা-উপশিরায় চলাচল করে। নারীপুরুষের পারস্পরিক হাসি-ঠাট্টা ও কথা-বার্তার মাধ্যমে পুরুষ নারীর প্রতি কিংবা নারী পুরুষের প্রতি আসক্ত হওয়ার কারণে কতইনা অমঙ্গল সাধিত হয়েছে, যা থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ আমাদের সকলকে তা থেকে হেফাজত করুন।
 
    (৪) নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা।
 
নারী যখন অনুধাবন করে যে, সেও পুরুষের মত চেহারা খোলা রেখে স্বাধীনভাবে চলতে পারে। তখন সে পুরুষের সাথে ঘেষাঘেষি করে চলাফেরা করতে লজ্জাবোধ করে না। আর এ ধরনের লজ্জাবিহীন ঘেষাঘেষি ও মেলামেশাই হচ্ছে ফিৎনা, ফাসাদ, অনাচার, ব্যাভিচারের সবচে বড় কারণ।
         একদা মানব জাতির অনন্য নৈতিক মুয়াল্লিম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আইহি ওয়াসাল্লাস) মসজিদ থেকে বের হয়ে রাস্তায় মহিলাদেরকে পুরুষদের সাথে মিলে মিশে চলতে দেখে, মহিলা সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বক্তব্য পেশ করেন:
استأخرن فإنه ليس لكن أن تحتضن الطريق عليكن بحافات الطريق
তোমরা পেছনে সরে যাও, রাস্তার মধ্যাংশে চলার অধিকার তোমাদের নেই। তোমরা রাস্তার কিনারায় চলাচল করবে।
রাসূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আইহি ওয়াসাল্লাস)-এর এই ঘোষণার পর মহিলাগণ রাস্তার পার্শ্ব দিয়ে এমনভাবে চলা ফেরা করতেন অনেক সময় তাদের পরিহিত চাদর পাশ্ববর্তী দেয়ালের সাথে লেগে যেত।
উক্ত হাদীসকে আল্লামা উবনে কাসীর রহ. (হে রাসূল! মুমিন নারীগণকে বলে দিন তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে, (সূরা নূর-৩১) আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন।
শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়াহ রহ. সর্বশেষ মুদ্রিত ফতওয়া গ্রন্থে (২য় খন্ডের ১১০ পৃষ্ঠায় ফেকাহ ও মাজমুউল ফতওয়ায় ২২তম খন্ডে) মহিলাদের জন্যে পর পুরুষের সামনে পর্দার অপরিহার্যতা সম্পর্কে সুস্পস্ট বক্তব্য পেশ করে বলেন: প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তাআলা নারীর সৌন্দর্যকে দুইভাগে বিভক্ত করেছেন:
   (কা) প্রকাশ্য সাজ-সজ্জা
  (খ) অপ্রকাশ্য সাজ-সজ্জা।
       মহিলাদের জন্যে তাদের স্বামী ও মাহরাম পুরুষ -যাদের পারস্পপরিক সাক্ষাতে যৌন কামনা জাগ্রত হয় না এবং বিবাহ বন্ধন ইসলামি শরিয়ত অবৈধ ঘোষণা করেছে- তারা ব্যতীত পরপুরুষের সামনে প্রকাশমান সাজ-পোষাক প্রকাশ করা জায়েয আছে।
পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে তৎকালীন মহিলারা চাদর পরিধান করা ব্যতীত বের হত এবং মহিলাদের হাত ও মুখমন্ডল পুরুষের দৃষ্টিগোচর হত। সে যুগে মহিলাদের জন্যে হাত ও মুখমন্ডল খোলা রাখা জায়েয হওয়ার কারণে পুরুষদের জন্যে মহিলার হাত ও মুখমন্ডলের প্রতি দৃষ্টিপাত করা বৈধ ছিল। পরবর্তীতে যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পর্দার আয়াত অবতীর্ণ করে নির্দেশ প্রদান করলেন:
 قل َيا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ
 হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বল, ‘তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, (সূরা আহযাব-৫৯)
    তখনই মহিলা সম্প্রদায় পুরুপুরী পর্দা অবলম্বন করতে লাগল। অত:পর শায়খূল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়াহ (রহ:) জিলবাব শব্দের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন: জিলবাব বলতে চাদরকে বুঝায়। সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা:) জিলবাবের আকার আকৃতি সম্পর্কে বলেন। জিলবাব মানে চাদর এবং সাধারণ লোক জিলবাব বলতে ইজার বুঝে থাকে অর্থাৎ বিশেষ ধরনের বড় চাদর যা দ্বারা মস্তকসহ গোটা শরীর আবৃত করা যায়। অত:পর তিনি বলেন নারী জাতীকে জিলবাব তথা বড় চাদর পরিধান করার নির্দেশ এ জন্যেই দেয়া হল যে, যাতে কেউ তাদেরকে চিনতে না পারে। তাহলে এ উদ্দেশ্য তখনই সফল হবে, যখন নারী মুখমন্ডল আবৃত রাখবে। সুতরাং, চেহারা এবং হাত সেই সাজ-পোষাকের অন্তর্ভুক্ত যা গাইরে মাহরাম পুরুষের সামনে প্রকাশ না করার জন্যে মহিলা সম্প্রদায়কে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হল যে, মহিলার পরিহিত কাপড় বা চাদরের উপরিভাগ ছাড়া হাত, মুখমন্ডল এবং শরীরের কোনো অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ পরপুরুষের দৃষ্টিগোচর হওয়া কস্মিনকালেও বৈধ হবে না।
উল্লেখিত বর্ণনা হতে প্রমাণিত হল যে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) সর্বশেষ নির্দেশের বর্ণনা দিয়েছেন (তা হচ্ছে নারীর সাজ-পোষাকের বাহ্যিক দিক ছাড়া নারী দেহের অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দর্শন প্রদর্শন অবৈধ) আর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) ইসলামের প্রাথমিক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। (তা হচ্ছে হাত, পা, মুখমন্ডল খোলা রাখা বৈধ) উল্লেখিত মতদ্বয়ের বিশুদ্ধ মতে নসখ‍‌‌‌‌‍ তথা রহিত হওয়ার পূর্বেকার বিধানের পরিপন্থী। বর্তমানে নারীর জন্যে পরপুরুষ সমীপে মুখমন্ডল, হাত, পা, প্রকাশ করা বৈধ নয়। বরং কাপড়ের উপরিভাগ ছাড়া কোনো কিছুই প্রকাশ করার অনুমতি নেই। অত:পর শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ (র:) বণির্ত গ্রন্থের ২য় খন্ডের ১১৭ ও১১৮ পৃষ্ঠায় পর্দা সম্পর্কিত মাসআলাটিকে আরো সুস্পষ্ট করে বলেন যে, মহিলার জন্যে হাত, পা ও মুখমন্ডল শুধুমাত্র মাহরাম পুরুষ ও নারীদের সামনে খোলা রাখা ইসলামি শরিয়ত সম্মত।
মূলত: ইসলামি শরিয়তে পর্দা সম্পর্কিত মাসআলায় দুটি উদ্দেশ্য প্রণিধানযোগ্য,
      (ক) পুরুষ ও নারীর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারিত হওয়া।
      (খ) নারী জাতি পর্দার অন্তরালে থাকা।
 এটাই হল পর্দা সম্পর্কে শাইখুল ইসলাম ইবেন তাইমিয়াহ (রহ:) এর বক্তব্য।
হাম্বলী মাজহাব অবলম্বনকারী পরবর্তী ফেকাহ শাস্ত্রবিদগণের দৃষ্টিতে পর্দার অপরিহার্যতা:
 আল-মুন্তাহা নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে,পুরুষত্বহীন (যার অন্ডকোষ ফেলে দেয়া হয়েছে) ও লিঙ্গবিহীন পুরুষের জন্য পর নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করা হারাম।
    আল-ইক্বনা নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, পুরুষত্বহীন, নপুংসক পুরুষের জন্যে নারী দর্শন হারাম। এই কিতাবের অন্যত্র উল্লেখ আছে, স্বাধীন পর নারীর প্রতি ইচ্ছাকৃত দৃষ্টিপাত করা এমনকি তার চুলের প্রতি নজর করাও হারাম।
আদ-দলীল গ্রন্থের মূল পাঠে উল্লেখ আছে,
দৃষ্টিপাত আট প্রকার। প্রথম প্রকার হল: সাবালক যুবকের পক্ষে (যদিও সে লিঙ্গ কর্তিত হয়) স্বাধীন প্রাপ্তবয়স্কা নারীর প্রতি (বিনা প্রয়োজনে) তাকানো হারাম। এমনকি রমনীর মাথার কৃত্রিম চুলের প্রতিও তাকানো জায়েয নয়।
শাফেয়ী মতাবলম্বী ফেকাহ শাস্ত্রবিদগণের পর্দা সম্পর্কিত অভিমত।
      নারীর প্রতি কামুক দৃষ্টিতে তাকানো হারাম অনুরূপভাবে যে দৃষ্টিতে ফেতনার আশঙ্কা আছে সেটিও হারাম।
আর দৃষ্টি যদি কামোভাব সহকারে না হয় এবং এতে ফেৎনা সৃষ্টির আশংকাও না থাকে এ ক্ষেত্রে তারা দুইটি অভিমত পেশ করেন। শারহুল ইক্বনা গ্রন্থকার অভিমতদ্বয় উল্লেখ করে বলেন, ত্রুটিমুক্ত ও বিশুদ্ধ মতটি হল: এ ধরনের দৃষ্টিপাত হারাম। তাদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল মিনহাজে উল্লেখ আছে যে, রমণীর পক্ষে মুখমন্ডল খোলা রেখে বের হওয়া মুসলিমদের ঐক্যমতে নিষিদ্ধ। তাতে আরও বলা হয়েছে, মুসলিম শাসকবৃন্দের ইসলামি ও ঈমানি দায়িত্ব হচ্ছে, মহিলা সম্প্রদায়ের প্রতি মুখমন্ডল খোলা রেখে বের হওয়ার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। কারণ, ফেৎনা সৃষ্টি ও যৌন উত্তেজনার মূলে দর্শনই দায়ী। যেমন, আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন:
وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ
আর তুমি মুমিনদেরকে বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে। (সূরা নূর-৩০)
     প্রজ্ঞাভিত্তিক ইসলামি শরিয়তের বিধি-বিধানের লক্ষ্য হচ্ছে ফিৎনা-ফাসাদ, অনাচার, ব্যভিচারসহ যাবতীয় অবাধ্যতার ছিদ্রপথ চিরতরে বন্ধ করে দেয়া।
    মুনতাকাল আখবার গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ নাইলুল আওতারে উল্লেখ আছে, নারীর জন্যে মুখমন্ডল খোলা রেখে বেপর্দা হয়ে বের হওয়া বিশেষত: দুষ্ট-দুরাচার-পাপীলোকদের সম্মুখে ইসলামপন্থীদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে হারাম।
 
মুখমন্ডল খোলা রাখার মতাবলম্বীদের কতিপয় যুক্তি:
 
      আমার জানামতে যারা নারীর হাত ও মুখমন্ডলকে ইসলামি পর্দা বহিভূর্ত মনে করে, এবং তা অনাবৃত রাখা এবং তার প্রতি পরপুরুষের দৃষ্টিপাত করা জায়েয বলে মত পোষণ করেন, পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক তাদের কোনো দলীল নেই। হ্যাঁ কোরআন ও সুন্নাহ থেকে নিম্নোক্ত প্র্রমাণাদি পেশ করতে পারেন।
 
(১) আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا
আর তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না।  (সূরা নূর: ৩১)
 কারণ, সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা:) ‌‍‍‌মা জাহারা মিনহা (যা সাধারণত: প্রকাশ হয়ে পড়ে) আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, এখানে নারীর হাত, আংটি এবং মুখমন্ডল বুঝানো হয়েছে। (কেননা কোনো নারী প্রয়োজন বশত: বাইরে যেতে বাধ্য হলে চলা ফেরা ও লেন-দেনের সময় মুখমন্ডল ও হাত আবৃত রাখা খুবই কষ্টকর হয়)। এ তাফসীর ইমাম আমাশ সাঈদ বিন যুবাইরের মধ্যস্থতায় আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. হতে বর্ণনা করেছেন। আর সাহাবির তাফসীর শরিয়তের বিধান সাব্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে দলীল হিসাবে গৃহীত।

    (২) ইমাম আবু-দাউদ তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সুনানে আবু-দাউদ-এ উম্মত জননী আয়েশা (রা.) এর বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, একদা আবু-বকর (রা.) তনয়া আসমা রা: পাতলা কাপড় পরিধান করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সমীপে উপস্থিত হলে নবীজী চেহারা মুবারক অপর দিকে ফিরিয়ে হাত ও মুখমন্ডলের প্রতি ইংগিত করে আসমাকে বললেন, হে আসমা! মেয়ে মানুষের প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর তার মুখমন্ডল ও হাত ছাড়া শরীরের অন্য কোনো অংশই দৃষ্টি গোচর হওয়া উচিত নয়।

     (৩) বুখারি শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন, বিদায় হজের সময় তার ভ্রাতা ফজল বিন আব্বাস রা: রাসূলের সাথে সওয়ারীর পিছনে উপবিষ্ট ছিলেন, ইতিমধ্যে খুসআম গোত্রের জনৈকা মহিলা রাসূলের সমীপে উপস্থিত হলে ফজল মহিলার প্রতি তাকাচ্ছিলেন এবং মহিলাও ফজলের প্রতি দৃষ্টি প্রদান করছিল, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজল ইবনে আব্বাসের চেহারা অন্য দিকে ফিরিয়ে দেন। এতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, মহিলাটির মূখমন্ডল খোলা ছিল।

     (৪) সহীহ বুখারি ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে জাবের (রা:) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কর্তৃক লোকদের নিয়ে ঈদের নামাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামাজ শেষ করে লোকদেরকে আখেরাত সংক্রান্ত উপদেশ প্রদান করে বললেন,
     মহিলাদের কাছে গিয়ে হৃদয়গ্রাহী কিছু উপদেশ পেশ করেন আর বলেন: হে নারী সম্প্রদায় !  তোমরা আল্লাহর পথে তারই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে দান-দক্ষিণা কর, কেননা তোমরা অধিক হারে জাহান্নামের জ্বালানী হবে। তখন তাদের কালো বর্ণের চেহারা বিশিষ্ট জনৈকা মহিলা দাঁড়িয়ে বললেন,...........( আল হাদিস)
      এতে বুঝা গেল, মহিলাটির চেহারা খোলা ছিল, আবৃত ছিল না। নতুবা জাবের রা. কিভাবে জানতে পারলেন যে, মহিলাটির চেহারা কালো বর্ণের ছিল। আমার জানা মতে এই আয়াত ও হাদিস কয়টিই মহিলাদের জন্যে পরপুরুষের সামনে চেহারা খোলা রাখার বৈধতার দলীল হিসেবে পেশ করা যেতে পারে।

       উল্লেখিত দলীলগুলোর জওয়াব

     নারীর হাত ও মুখমন্ডল খোলা রাখার বৈধতা প্রমাণকারী এই দলীল চতুষ্টয় পূর্বে বর্ণিত হাত ও মুখমন্ডল পর্দার অন্তর্ভুক্ত করে তা আবৃত রাখা অপরিহার্যতার প্রমাণপঞ্জীর পরিপন্থী নয়, আর তা দুই কারণে,

      (ক) নারীর চেহারা আবৃত রাখার প্রমাণাদিতে একটি স্বতন্ত্র ও নতুন নির্দেশ নিহিত আছে পক্ষান্তরে চেহারা অনাবৃত রাখার দলীল পেশ করার মৌলিক নির্দেশ রয়েছে, তা হচ্ছে পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বেকার ব্যাপক প্রচলন।
       উসূল শাস্ত্রবিদগণের প্রসিদ্ধ মূলনীতি হচ্ছে, সাধারণ অবস্থার বিপরীত নতুন দলীলকে প্রাধান্য দেয়া। কেননা, দলীল না পেলে তা বহাল রাখা যাবে। আর যখন সাধারণ অবস্থার অতিরিক্ত কোনো নতুন নির্দেশের দলীল উপস্থিত হবে, তখনই সাধারণ অবস্থাকে বহাল না রেখে নতুন নির্দেশের মাধ্যমে হুকুম পরিবর্তন করা হবে।
      যেহেতু প্রত্যেক বস্তু তার স্বস্থানে বহাল থাকাকে আসল বলা হয়, সেহেতু যখনই আসলের পরিবর্তনকারী কোনো প্রমান পাওয়া যাবে, তখনই প্রতীয়মান হবে যে, বস্তুর আসলের উপর অন্য আরেকটি হুকুম আরোপিত হয়েছে এবং তার পূর্বেকার হুকুমের পুরবতর্ন ঘটেছে। এ জন্যই আমরা বলি, নতুন হুকুমের দলীল উপস্থাপনের অতিরিক্ত জ্ঞান যোগ হয়।
অর্থাৎ প্রাথমিক এবং সাধারণ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে এবং নারীর চেহারা আবৃত রাখা ফরজ সাব্যস্ত হয়েছে। কাজেই নেতিবাচক হুকুমটির উপর ইতিবাচক হুকুমটির প্রাধান্য অর্জিত হবে।
     এটি উল্লেখিত দলীলাদির সংক্ষিপ্ত জওয়াব। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, উভয় পক্ষের প্রমাণপঞ্জী মাসআলা সাব্যস্ত করার দিক দিয়ে পরস্পর সমপর্যায় সম্পন্ন তাহলেও ইতিবাচককে নেতিবাচকের উপর পাধান্য দেওয়া হয়। এই মূলনীতির দৃষ্টিতে নারীর মুখমন্ডল আবৃত রাখা অপরিহার্যতার প্রমাণপঞ্জী অগ্রাধিকার লাভ করবে।

   (খ) আমরা যখন নারীর চেহারা খোলা রাখার বৈধতার দলীলাদি নিয়ে গভীর গবেষণা করি তখন এই বাস্তবতা ফুটে উঠে যে, এই বৈধতার দলীলাদির সমতুল্য নয়। বিস্তারিত বিবরণ প্রতিটি দলীলের পৃথক পৃথক জওয়াবের মাধ্যমে জানা যাবে ইনশাআল্লাহ।
  (১) সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা:) বর্ণিত তাফসীরের তিনটি জওয়াব।

 (১) আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা:) পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বের অবস্থা বণর্না করেছেন। যেমন শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়ার উক্তি বর্ণনার স্থলে উল্লেখ হয়েছে।

 (২) হতে পারে তার উদ্দেশ্য হল, ঐ সৌন্দর্য বর্ণনা করা যা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। যেমন- আল্লামা ইবনে কাসীর (র:) উক্ত আয়াতের তাফসীর সম্পর্কিত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা:) যেই তাফসীর উল্লেখ করেছেন তাতেও আমাদের পক্ষ হতে উপরোক্ত জওয়াবদ্বয়ের সমর্থন পাওয়া যায়, যা কোরআন ভিত্তিক তৃতীয় প্রমাণের পূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

 (৩) যদি আমাদের উল্লেখিত দুই জবাব মানতে তাদের আপত্তি থাকে। তাহলে তৃতীয় জওয়াব হচ্ছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের তাফসীর কেবলমাত্র তখনই দলীল হতে পারে যখন তার তাফসীরের প্রতিকূলে অন্য সাহাবির কোন বক্তব্য বিদ্যমান না থাকে। নতুবা পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী দলীলাদির যেটি অন্য দলীলের সমর্থনে প্রবল এবং প্রাধান্যযোগ্য সাব্যস্থ হবে, সে দলীল দ্বারা প্রমাণিত উক্তির উপরই আমল করা হবে। আমাদের বিতর্কিত মাসআলায় আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের তাফসীরের প্রতিকূলে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের তাফসীর ও বিদ্যমান। তিনি বলেন: (ততটুকু ভিন্ন যতটুকু এমনিই প্রকাশ পায়) বাক্যে উপরের কাপড় যেমন- বোরকা, চাদর ইত্যাদিকে পর্দার বিধানের ব্যতিক্রমের অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে যা সর্বাবস্থায় প্রকাশিত হয়ে যায়, যা আবৃত করা সম্ভবপর নয়।
     এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কর্তব্য হচ্ছে। রাসূলের বিশিষ্ট সাহাবিদ্বয়ের তাফসীরের মধ্যে কোন তাফসীরটি প্রবল এবং প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য তা দলীল ভিত্তিক যাচাই করা এবং প্রবল এ প্রধান্য পাওয়ার যোগ্য তাফসীর অনুসারে আমল করা।

(২) উম্মত জননী আয়েশা (রা:) এর বর্ণিত হাদীসটি দুই কারণে দুর্বল।

  (ক) খালেদ বিন দুরাই যে হাদীস বণর্নাকারীর মধ্যস্থতায় আয়েশা (রা:)-এর হাদিসটি বর্ণনা করেছেন , খালেদ সেই বর্ণনাকরীর নাম উল্লেখ করেননি, কাজেই হাদীসটি মুনকাতে প্রমাণিত হল। তাছাড়া ইমাম আবু দাউদ (র:) হাদীসটিকে দুর্বল বলে চিহ্নিত করে বলেন যে, খালেদ ইবনে দুরাই আয়েশা (রা:) হতে সরাসরি হাদীসটি শুনেছেন বলে এরূপ কোনো প্রমাণ নেই। হাদীসটি দুর্বল হওয়ার এ কারণটি আবু হাতেম রাজী (রহ.)ও বর্ণনা করেছেন।

  (খ) এই হাদীসের সনদ তথা হাদীস বর্ণনা কারীদের ধারাবাহিক তালিকায় সাঈদ বিন বশীর আল-বসরী (পরবর্তীতে সিরিয়ার রাজধানী দামেশকের অধিবাসী।) নামের এক ব্যক্তি পাওয়া যায়। ইবনে মাহদী তাকে অনুপযুক্ত মনে করে পরিত্যাগ করেছেন। ইমাম আহমাদ ইবনে মাঈন ইবনে মাদীনী এবং ইমাম নাসায়ী প্রমুখ অনুসরণযোগ্য মুহাদ্দেসীনে কেরাম তাকে দুর্বল বর্ণনাকারী সাব্যস্ত করেছেন। কাজেই হাদীসটি দূর্বল এবং তা আমাদের বর্ণিত পর্দার অপরিহার্যতা সম্পর্কিত বিশুদ্ধ হাদীসের মোকাবেলা করতে পারবে না। তাছাড়া আসমা বিনতে আবু-বকর (রা:)-এর বয়স হিজরতের সময় সাতাশ বৎসর ছিল, এই বয়স্কা নারী রাসূলের সমীপে এমন পাতলা বস্ত্র পরিধান করে যাবেন, যাতে তার হাত ও চেহারা ব্যতীত অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকৃতিও প্রকাশ পাবে এটা সুস্থ্ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, হাদীসটি বিশুদ্ধ, তাহলে বলা যাবে আসমা সম্পর্কিত ঘটনাটি পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বেই ঘটেছে। আর পর্দার বিধান অবতীর্ণ হয়ে পূর্বের অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কাজেই পরবর্তী বিধান তথা পর্দার অপরিহার্যতার বিধান অগ্রগণ্য ও পালনীয় হবে।  

 (৩) আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা:) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের জওয়াব, এই হাদীসে পরনারীর মুখমন্ডলের প্রতি দৃষ্টিপাত করা জায়েয হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজল ইবনে আব্বাসের এই কর্ম অর্থাৎ তার নিকট আগমন কারী নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করার উপর সম্মতি প্রকাশ করেননি বরং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজলের চেহারা অন্য দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ কারণেই ইমাম নববী (র:) সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন যে, এ হাদীস থেকে প্রমাণিত মাসআলা সমূহের মধ্যে এটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা যে, পর নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করা হারাম।
     হাফেজ ইবনে হাজার আসক্বালানী (র:) সহীহ বুখারীর শ্রেষ্ঠতম ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুলবারীতে এই হাদীসের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন, এই হাদীস দ্বারা এটাও জানা হল যে, পরনারীর দর্শন ইসলামি শরিয়তে নিষিদ্ধ এবং এমতাবস্থায় দৃষ্টি নত রাখা ওয়াজিব।
কাজী আয়াজ (রহ:) বলেন, কতক লোকের ধারণা, যখন পরনারী দর্শনে ফেৎনা ও অনচারে লিপ্ত হওয়ার আশংকা থাকে তখনই (পুরুষের জন্যে) দৃষ্টি নত রাখা ওয়াজিব। (এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আব্বাস তনয় ফজলের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি। আর ফেৎনায় পতিত হওয়ার আশংকা না থাকলে পরনারী দর্শন জায়েয। কিন্তু আমার মতে কোনো কোনো বর্ণনামতে রাসূল যে ফজলের চেহারা ঘুরিয়ে দিয়েছেন, তার এই কাজটি মৌখিক নিষেধাজ্ঞার চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। (কাজেই পরনারী র্দশনে ফেৎনায় লিপ্ত হওয়ার আশংকা থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থাতে হারাম এবং দৃষ্টি নত রাখা ওয়াজিব)  
                                  
      এখন প্রশ্ন হল, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অনাবৃত চেহারায় আগমন কারী মহিলাটিকে পর্দাবলম্বন করার নির্দেশ দেননি কেন?
    এর উত্তর হচ্ছে,
·                       মহিলাটি এহরাম অবস্থায় ছিলেন, আর এহরামরত নারীর প্রতি ইসলামের বিধান হল পরপুরুষের দৃষ্টির আওতায় না থাকলে চেহারা খোলা রাখা ওয়াজিব।
·                      এমন সম্ভাবনাও আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পরবর্তীতে তাকে চেহারা ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা, হাদীস বর্ণনাকারীর পর্দার নির্দেশ উল্লেখ না করার দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না যে, রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে মুখমন্ডল ঢেকে রাখার নির্দেশ দেননি। কারণ, কোনো বিধান উল্লেখ না হওয়াতে এমনটি জরুরি নয় যে বিধানটিই অস্তিত্বশূন্য।
 সহীহ মুসলিম ও আবু দাউদে সাহাবি জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ বাজালী (রা:) থেকে রাসূলুল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি বর্ণিত আছে যে, অনিচ্ছকৃতভাবে (আকম্মাৎ) পর নারীর উপর দৃষ্টি পতিত হলে সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নাও। (বর্ণনাকারী সন্দেহ পোষণ করে বলেন) অথবা ইবনে আব্দুল্লাহ বাজলী (রা:) বলেন: রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে পর নারী দর্শন থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন।

   (৪) জাবের (রা:) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের জওয়াব হল,
·                   উল্লেখিত হাদীসে সুস্পষ্ট বর্ণনা নেই যে, রাসূলের ঈদের নামাজ শেষে মহিলাদেরকে উপদেশ দান করা সম্পকির্ত ঘটনাটি কত সালে সংঘটিত হয়েছিল।
·                   হয়ত কালোবর্ণের মুখমন্ডল বিশিষ্ট মহিলাটি সেসব বৃদ্ধ নারীদের অন্তভুর্ক্ত ছিলেন (বাধ্যর্কের কারণে) যাদের সাথে বিবাহ বন্ধনের আশা করা যায় না। এমন নারীদের চেহারা খোলা রাখা জায়েয। এসব বৃদ্ধ মহিলাদের উপর থেকে পর্দার বিধান উঠিয়ে নেয়ার দ্বারা অন্যান্য মহিলাদের উপর থেকেও পর্দার অপরিহার্যতা বিয়োগ হয় না। (বৃদ্ধ নারী ছাড়া অন্য সব নারীদের উপর পর্দার অপরিহার্যতা বহাল থাকবে।)
·                   হয়ত এই ঘটনাটি পর্দার আয়াত অবতরণের পূর্বেকার ঘটনা। কেননা,পর্দার বিধানাবলী বর্ণিত সূরা আল-আহযাব ৫ম অথবা ৬ষ্ঠ হিজরী সনে অবতীর্ণ হয়েছে। আর ঈদের নামাজ প্রবর্তিত ২য় হিজরী সনে । এখন যেহেতু ঘটনাটি কত সনে ঘটেছে হাদীসে উল্লেখ নেই। তাই ঘটনাটি পর্দার আয়াত নাযিল হবার পূর্বেকার হলে তার দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, মহিলার জন্যে পর পুরুষের সম্মুখে চেহারা খোলা রাখা বৈধ। কাজেই মহিলার জন্যে চেহারা আবৃত রেখে পরিপূর্ণ পর্দা পালন করা অপরিহার্য।
স্মর্তব্য, পর্দা সম্পর্কিত এই মাসআলা বিস্তারিত আলোচনা করার কারণ হল,
   * অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সামাজিক মাসআলাটি সম্পর্কে ইসলামি শরিয়তের বিধান কি?  সাধারণ মানুষের এটি জানা খুবই জরুরি।
   * হালকা জ্ঞানের অধিকারী কিছু লোক পর্দা বিষয়ে কলম ধরে বহু প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করেছে। এবং এসব লেখনির মাধ্যমে তারা পর্দাহীনতা ও নগ্নতাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। (যার কারণে পর্দাহীনতা বেড়ে গেছে, ফলশ্রুতিতে যেনা-ব্যভিচার, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি নিত্য-নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল আজ যৌন অপরাধের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে কিশোরী, তরুণী ও যুবতী যথেচ্ছভাবে। ব্যভিচারের এ নগ্ন থাবায় আক্রান্ত হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে হাজার হাজার তরুণী প্রতিদিন হাসপাতালে। তাদের আর্ত চিৎকারে আকাশ পাতাল ভারী হচ্ছে । পত্রিকার পাতা খুললে এমন বিভৎস চেহারা নিত্য ব্যাপার। পর্দাহীনতাই যে এসবের মূল কারণ তা আর ব্যাখ্যা করে বুঝানোর প্রয়োজন নেই।)
       পর্দাহীনতার পক্ষাবলম্বী ব্যক্তিবর্গ পর্দা সম্পর্কিত বিষয়ে গভীর চিন্তা গবেষনা ও যথাযথ তাহক্বীক করেbনি। অথচ চিন্তাবিদ গবেষক ও তদন্তকারীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে,
ইনসাফ ও সমতা ভিত্তিক আচরণ করা এবং প্রয়োজনীয় জ্ঞাতব্য বিষয়াদি অবগত হয়ে বিষয়ের গভীরে পৌঁছা ব্যতীত  এ ধরনের উক্তি ও যুক্তি পেশ করা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকা।
   অভীজ্ঞ ও পারদর্শী ব্যক্তিবর্গের করণীয় হচ্ছে, প্রমাণাদি ন্যায়পরায়ণ বিচারপতির মত ইনসাফ ও সমতা ভিত্তিক যাচাই করা। এবং গ্রহণযোগ্য প্রমাণাদি ব্যতিরেকে কোনো এক পক্ষকে প্রাধান্য না দেওয়া। বরং প্রতিটি দৃষ্টিকোণ থেকে গভীর চিন্তা-গবেষণা করে প্রকৃত তথ্য অবগত হওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করা। এমনটি কোনোভাবেই সমীচীন হবে না যে, নিজের মনোপুত মতবাদকে (যদিও নিভুর্ল প্রমাণাদির দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য না হয়) সাব্যস্ত করার জন্যে ভিত্তিহীন যুক্তি দিয়ে সেই মতবাদের পক্ষে উপস্থাপিত দলীলাদিকে প্রবল করার চেষ্টা করা আর বিপক্ষের দলীলাদিকে অকারণে দূর্বল এবং অগ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করা। এ জন্যেই প্রাজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম বলেন, ইসলামি আক্বীদার প্রতি ঈমান আনার পূর্বে তার প্রমাণপঞ্জী সম্বন্ধে গভীর গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়ে চুলচেরা যাচাই করে নিতে হবে যে, সে গুলো গ্রহণযোগ্য কি না। যাতে দলীলটি বিশ্বাসের অনুগত না হয়ে বিশ্বাসটি দলীলের অনুগত হয়। অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য দলীলাদির ভিত্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, বিশ্বাস স্থাপন করে তা টিকিয়ে রাখার জন্য দলীল অনুসন্ধান করবে না। কেননা, যারা প্রমাণাদির তোয়াক্কা না করে বিশ্বাস স্থাপন করে নেয়, তারা স্বীয় বিশ্বাস পরিপন্থী দলীলাদীর অর্থ বিকৃত করে তার অপব্যাখ্যা দিতে দ্বিধাবোধ করে না।
     বিশ্বাস স্থাপন করার পর তা টিকিয়ে রাখার জন্যে দলীলাদির অনুসন্ধান করার অনিষ্টসমূহ,
আমরা সকলই প্রত্যক্ষ করে থাকি যে, কিভাবে তারা দুর্বল হাদীসকে সহীহ হাদীস বলে আখ্যায়িত করে থাকে। অথবা দলীলাদির মূল পাঠের এমন অর্থ করার চেষ্টা করে যা দলীলাদি থেকে মোটেও বুঝে আসে না। কিন্তু তারা তাদের (ভ্রান্ত) মতবাদকে প্রমাণ করার জন্যে এ সব করে থাকে। (সম্মনিত গ্রন্থকার বলেন) সম্প্রতি আমি পর্দা ওয়াজিব না হওয়ার উপর লিখিত একটি প্রবন্ধ পড়েছি। তাতে প্রবন্ধকার সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত আয়েশা (রা:) কর্তৃক বর্ণনাকৃত হাদীসে উল্লেখিত সাহাবি আবু বকর (রা:) তনয়া আসমা (রা:) পাতলা বস্ত্র পরিধাণ করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়াসাল্লাম) সমীপে আগমন করা এবং রাসূল তাকে লক্ষ্য করে এ নির্দেশ প্রদান করা যে, হে আসমা নারী প্রপ্তবয়স্ক হবার পর মুখমন্ডল ও হাত ব্যতীত তার শরীরের কোনো অংশই অনাবৃত হওয়া উটিত নয়।
    এ হাদীসটি উল্লেখ করার পর সে প্রবন্ধকার লিখেছেন, উল্লেখিত হাদীসটি সর্বসম্মত। অর্থাৎ ইমাম বুখারী ও মুসলিম প্রমূখ হাদীস শাস্ত্রবিদগণ এ গাদীসটি বিশুদ্ধ বলে একমত হয়েছেন। অথচ বাস্তবে হাদীসটি সর্বসম্মত হাদীস নয়, তা কিভাবে স্বয়ঙ হাদীসটি বর্ণনাকারী ইমাম আবু-দাউদ (র:) হাদীসটিকে মুরসাল হওয়ার কারণে দুর্বল হাদীস বলে আখ্যায়িত করেছেন, এবং এ হাদীসটির বর্ণনা সনদ বর্ণনাকারঅদের ধারাবাহিক তালিকায় এমন একজন গাদীস বর্ননা কারীর নাম উল্লেখ রয়েছে, যাকে ইমাম আহমদ এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসীনে কেরামগণ দূর্বল বর্ণনাকারী সাব্যস্ত করেছেন। (বিস্তারিত বিবরণ সে হাদীস সংক্রান্ত জওয়াবে উল্লেখিত হয়েছে।) কিন্তু অজ্ঞতা, মুর্খতা ও অন্ধভাবে স্বীয় মতামত পক্ষপাতিত্ব করার দ্বারা মানুষ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বিপদগ্রস্ত হয়। (সেই পক্ষপাতিত্ব ও মূর্খতার পতন ঘটুক এটাই কামনা করি)
শায়খুল ইসলাম ইবনুল কাইয়িম কতই না সুন্দর বলেছেন:
و تعر من ثوبين من يلبسهما    يلقى الردى بمذلة وهوان
ثوب من الجهل المركب فوقه    ثوب التعصب بئست الثوبان
و تحل بالإنصاف أفخر حلة   زينت بها الأعطاف والكتفان
দু ধরনের কাপড় পরিধান করা হতে নিজেকে মুক্ত করে নাও সেই দুই কাপড় পরিধান করে যে সে লাঞ্চিত, অপমানিত ও ধ্বংস প্রাপ্ত হবে।
সেই বস্ত্রদ্বয়ের একটি হলো চরম মুর্খতা ও অজ্ঞতা, ২য়টি হলো অন্ধভাবে স্বীয় পক্ষে কঠোর হওয়া, কতই না নিকৃষ্ট এ বস্ত্রদ্বয়।
ইনসাফ ও ন্যায় পরায়ণতার মত গৌরবান্বিত সাজ-সজ্জার মাধ্যমে নিজেকে সজ্জিত করে নাও। যদ্বারা  কাধ ও তৎপার্শ্বস্থও সজ্জিত হয়ে যায়। (সারকথা নিরেট মূর্খতা ও অজ্ঞতা এবং অন্ধভাবে পক্ষপাতিত্বের ন্যায় দুটি কুস্বভাব পরিহার করে ইনসাফ ও ন্যায় পরায়ণতা অবলম্বন করে নিজেকে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য করে নাও)
    কোনো গ্রন্থকার ও প্রবন্ধকারকেই প্রমাণাদির চুলচেরা তাহক্বীক ও অনুসন্ধান করতে গিয়ে অলসতার জালে আবদ্ধ হওয়া উচিত নয়। বরং নিগুঢ় তত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া ছাড়া তাড়াহুড়ার মাধ্যমে কোনো উক্তি ও যুক্তি পেশ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। নতুবা তারা ঐ সমস্ত লোকদের দলভুক্ত হবে যাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কঠোর সতর্ক উচ্চারণ করা হয়েছে:
فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا لِيُضِلَّ النَّاسَ بِغَيْرِ عِلْمٍ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
 সুতরাং তার চেয়ে অধিক যালিম কে, যে না জেনে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়? নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়াত করেন না।
( সূরা আন্‌আম-১৪৪)
আর এমনও উচিত হবে না যে, প্রমাণাদির অনুসন্ধান ও চুলচেরা তাহক্বীক করতে গিয়ে অলসতার জালে আবদ্ব হবে এবং গ্রহণযোগ্য ও প্রমাণিত দলীলাদিকে হঠকারীতা সূলভ মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে। তারা ঐ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন,
 فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَذَبَ عَلَى اللَّهِ وَكَذَّبَ بِالصِّدْقِ إِذْ جَاءَهُ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِلْكَافِرِينَ
সুতরাং তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে এবং তার কাছে সত্য আসার পর তা অস্বীকার করে? জাহান্নামেই কি কাফিরদের আবাসস্থল নয়? (সূরা জুমার: ৩২)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে বিনীত প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে হক কে হক বুঝে মেনে চলার এবং বাতিলকে বুঝে শুনে তা হতে সম্পূর্ণভাবে দূরে থাকার তাওফীক দান করেন এবং তারই মনোনীত সরল সঠিক পথে পরিচালিত করেন, তিনিই হচ্ছেন ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহ পরায়ণ।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ