রমজানে সিয়াম সাধনা মুসলিমদের জীবনে ইবাদতের স্বর্ণদুয়ার খুলে দেয়। মাহে রমজান আসে রহমত, নাজাত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে। একটি টেকসই ও আদর্শ জীবন গঠনের শিক্ষা নিয়ে আসে এই রমজান। ইসলাম সাম্য-মৈত্রী, খোদাভীতি, আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি, শৃঙ্খলা, মমত্ববোধ, দান, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের যে মহান শিক্ষা দিয়েছে, তা বাস্তবায়নের সুযোগ এনে দেয় রমজানের সিয়াম সাধনা। রোজা ইবাদতের সুযোগ তৈরি করে এটি সাধনার মাস, পবিত্রতা অর্জন ও ইবাদতের মাস। এ মাসে রোজাদারদের মন নরম ও পবিত্র থাকে। রোজাদার মাত্রই এ মাসে অধিক ফজিলত লাভ করতে চায়। ক্ষুধার যন্ত্রণা ও প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বেঁচে থাকার প্রয়াস রোজাদারের জীবনকে অন্য আঙ্গিকে তৈরি করে। এ সময় রোজাদার বেশি বেশি দৈহিক ও আর্থিক আমল করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ফলে তার প্রতিটি কাজ হয় সুন্দর ও মার্জিত। এ সময় সাওয়াবের নিয়তে রোজাদার বেশি বেশি দান করে, অসহায় ও দরিদ্র মানুষকে অর্থ বা খাবার দিয়ে সাহায্য করে। রোজার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জিত হয়। মাহে রমজানের অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে তাকওয়া অর্জন। সাওম পালনের মাধ্যমে মনের মধ্যে খোদাভীতি বা আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয়। রমজানের রোজা মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে চলার শিক্ষা দেয়। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ও আত্ম-অহংবোধ ভুলে গিয়ে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী সমাজ প্রতিষ্ঠার মাসই হলো মাহে রমজান। উম্মতে মুহাম্মদীর নৈতিক চরিত্র উন্নত করে সাহাবায়ে কিরামের মতো আদর্শ জীবন গঠন করার প্রশিক্ষণ এ মাসেই গ্রহণ করতে হয়। রোজা মানুষকে প্রকৃত ধার্মিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়। রোজাদারদের ইবাদত-বন্দেগির ভেতর দিয়ে সব ধরনের অন্যায়-অত্যাচার, অশোভন- অনাচার, দুরাচার-পাপাচার ও যাবতীয় অকল্যাণকর কাজকর্ম থেকে বিরত হয়ে সংযম সাধনার পথ ধরে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসমর্পণের শিক্ষা দেয়। ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করে একত্রে ইফতার, দীর্ঘ তারাবি নামাজ, সেহির এ সবকিছুর মধ্য দিয়ে একজন রোজাদার ব্যক্তি মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। রোজা ধৈর্য, সংযম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রশিক্ষণ দেয়। রোজা আদব, শিষ্টাচার ও আদর্শ চরিত্র শেখায়।
রোযার আধ্যাতিক শিক্ষা:
রোযার আসল উদ্দেশ্য আল্লাহ বলে দিয়েছেন “তাকওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করা”। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে: যদি তোমরা ধৈর্য্যরে পরিচয় দাও এবং তাকওয়া অবলম্বন করতে থাক তাহলে ইহা হবে এক দৃঢ়সংকল্পের ব্যাপার। (আল-ইমরান-১৮৬)
আমাদের জানা থাকা দরকার, অন্যান্য ইবাদত ও রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো—অন্যান্য ইবাদতে ‘রিয়া’ বা প্রদর্শনেচ্ছা কাজ করার সম্ভাবনা থাকে যেমন—নামাজ, জাকাত, দান-সদকাহ ইত্যাদি; কিন্তু রোজার মধ্যে রিয়া নেই। বান্দা পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে কিংবা লোকচক্ষুর অন্তরালে পানাহারের সুযোগ থাকলেও একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে সকাল-সন্ধ্যা রোজা পালন করে। এ কারণেই রোজার ফজিলত অনেক। আল্লাহ তায়ালা রোজার প্রতিদান নিজেই দান করবেন। রমজান মাসকে সওয়াবের মৌসুমও বলা চলে। ভালো কাজ করলেই অন্য মাসের চেয়ে বেশি গুণ সওয়াব। অন্য মাসের ফরজের সওয়াব মেলে নফলে। দান-সদকায় সওয়াব সত্তর গুণ। রাসুল (সা.) এই মাসে ব্যাপক হারে দান করতেন। কাউকে ইফতার করালে ওই রোজাদারের মতো সওয়াব দেয়া হয়। সওয়াব তথা প্রতিদান কামানোর এ এক মহা সুযোগ।
রোজার মাধ্যমে বান্দা আত্মশুদ্ধি অর্জন করে। এক মাস রোজা রেখে বাকি এগারো মাস নিজেকে গুনাহমুক্ত রাখার সংকল্প গ্রহণ করেন মুসলিমরা। রোজা মানুষকে গরিব-দুঃখীর কষ্ট অনুধাবনে সহায়তা করে। একজন রোজাদার যখন সুবহে সাদিক থেকে মাগরিব তথা সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকেন, তখন তিনি বাস্তবিকই অনুভব করেন অনাহারে থাকা গরিব মানুষের জীবন যন্ত্রণা। তাই একজন রোজাদার রোজার মাধ্যমে সহমর্মিতা ও সহনশীলতার শিক্ষা লাভ করেন। রোজা মানুষকে চরম ধৈর্যের শিক্ষা দেয়। সামনে হালাল খাদ্য ও পানীয় এবং তা গ্রহণ করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিবারণ না করে নির্ধারিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন একজন মুসলমান। এমন ধৈর্যের সুন্দর নিদর্শন আর কী হতে পারে? রোজা মানুষকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতা সাধনের শিক্ষা দেয়। পরিমিত আহার ও নিদ্রার মাধ্যমে সুস্থ জীবনযাপনের শিক্ষা দেয়। শিক্ষা দেয় কঠোর পরিশ্রমের। সারাদিন রোজা আবার রাতে তারাবি ও তাহাজ্জুদ। সিয়াম-কিয়ামের এই কঠিন প্রশিক্ষণে মানুষ হতে পারে ভদ্র ও সুসভ্য। রোজা মানুষকে সুশৃঙ্খল হতে সাহায্য করে। মানবের মধ্যে যত খারাপ চরিত্র আছে তা ধুয়ে-মুছে ফেলে এই রোজা। যে ব্যক্তি রোজা রাখেন তিনি কখনও অন্যকে কষ্ট দিতে পারেন না। তিনি মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। পারেন না কোনো হারাম কাজ করতে। কোরআনের আলোয় আলোকিত হয়ে একজন মুসলিম তার সুবাতাস সমাজে ছড়িয়ে গড়তে পারেন সুন্দর সমাজ।