বেশি বেশি কীটনাশক ব্যবহারে ফসল নষ্টকারী পােকামাকড়, ছত্রাক ইত্যাদি কীটনাশকসহনশীল হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলাে যে করেই হােক খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানাে। এরই সমাধানে নতুন অভিনব প্রযুক্তি ক্রিসপার (CRISPR) হতে পারে। দারুণ এক হাতিয়ার, যাকে টার্গেট করে পৃথিবীর সব অণুজীববিজ্ঞানী, জীবপ্রযুক্তিবিদেরা খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং লবণ-সহনশীল, খরাতাপমাত্রা-সহনশীল, রােগ-সহনশীল শস্য (যেমন : ধান, আলু, টমেটো, শসা, সয়াবিন, ক্যানােলা, যব, জোয়ার, বাজরা ইত্যাদি) উৎপাদন করার জন্য ক্রিসপার প্রযুক্তির ব্যবহার করে যাচ্ছেন। ডিএনএ (DNA) সম্পর্কে কমবেশি আমরা সবাই জানি। ডিএনএ হচ্ছে সব জীবের গঠন ও কাজের একক। আর জীবদেহের সমস্ত ডিএনএ মিলে তৈরি করে জিনােম। 

জিনােমের মধ্যে বিভিন্ন অংশে থাকে হাজারােজিন। এসব জিনের ডিএনএ থেকে আরএনএ আর আরএনএ থেকে প্রােটিন তৈরি হয়। জীবদেহের (হােক সে মানুষ, গাছ, শৈবাল, ছত্রাক কিংবা ব্যাকটেরিয়া) সব কাজ এসব প্রােটিনই নিয়ন্ত্রণ করে। ধানের কথাই ধরা যাক, ধানের হাজারাে প্রােটিন আছে, যেগুলাের নানা কাজ করে। আবার বিভিন্ন জাতের ধানের প্রােটিন তৈরি করার ক্ষমতা ভিন্ন হতে পারে। কখনাে দেখা যায় কিছু প্রােটিনের উপস্থিতির জন্য ধানের উৎপাদন কমে যাচ্ছে অথবা ধান আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন পােকামাকড় বা রােগ দ্বারা। তখন দরকার হয় এসব প্রােটিন যাতে কম তৈরি হয় অথবা প্রােটিন তৈরিকারী জিনটি একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় সেই ব্যবস্থা করা। আবার দেখা গেল, হয়তাে ধানের কোনাে একটি জাতে এমন প্রােটিন আছে, যেটির জন্য প্রচণ্ড খরায় গাছটি বেঁচে আছে, কিন্তু এর ফলন কম। 


অথচ বেশি ফলনের অন্য একটি জাত আবার খায় টিকতে পারছে না। তখন আমরা যদি প্রথম জাতের ধান থেকে খরায় বাঁচতে সাহায্য করে এমন প্রােটিন তৈরিকারী জিনটিকে পরের জাতের ধানে এনে প্রকাশ করতে পারি, তবে একটি অসাধারণ কাজ হবে। তাতে খরা বা পানিশূন্যতা সহনশীল ধানের জাত আমরা পাব, যা কি না উচ্চফলন দেবে। একইভাবে আমরা লবণাক্ত পানি সহনশীল ধানের জাতও পেতে পারি আবার শুধু ধানের ফলন বাড়াতে ও কোনাে জিনকে নিষ্ক্রিয় করা বা অন্য জিনের প্রকাশ ঘটানাে যায় এই ক্রিসপার-এর মাধ্যমেই। ক্রিসপার-ক্যাস হলাে ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়ার আত্মরক্ষার কৌশল । ব্যাকটেরিয়ার জিনােমে এমন কিছু অংশ আছে, যা কোনাে প্রােটিন তৈরি করতে পারে না। কিন্তু এর সঙ্গে ভাইরাসের জিনােমের মিল আছে । যখন ব্যাকটেরিয়াকে ভাইরাস আক্রমণ করবে, তখন ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএর বা ক্রিসপার নামের অংশ থেকে আরএনএ তৈরি হবে, যা ভাইরাসের আরএনএ বা ডিএনএর সঙ্গে যুক্ত হয়ে

যাবে। তখন ক্যাস৯ প্রােটিন এসে কাঁচির কাজ করবে! এটি ভাইরাস এর আরএনএ বা ডিএনএকে চিনে ফেলে একে কেটে ফেলবে কয়েক টুকরােয়। এভাবেই ব্যাকটেরিয়া শতাব্দী ধরে আত্মরক্ষাকৌশল অবলম্বন করছে। 

ক্রিসপারের এই বিভিন্ন ডিএনএর অংশকে চিনে ফেলার দারুণ ক্ষমতাকে ব্যবহার করে আজ বিভিন্ন অভূতপূর্ব কাজের পরিকল্পনা সম্ভব হচ্ছ।এই ক্রিসপার-ক্যাস৯ দ্বারা আমরা কোনাে শস্যে, যখন কোনাে পরিবর্তন ঘটাতে চাই, তখন আমাদের দুইটি জিনিস লাগে—ক্যাস৯ প্রােটিন, যা আমাদের

কাঁচি! আর আরেকটি গাইড আরএনএ, যা ক্যাস৯-কে গাইডের মতােই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে ডিএনএর যে জায়গায় পরিবর্তন আনতে চাই সে জায়গায় । যখন গাইড আরএনএ-ক্যাস৯-কে গাছের কোষে ঢুকানাে।

হয়, সে পথ চিনে ঠিক চলে যাবে তার গন্তব্যে, সেখানে ক্যাস৯ প্রােটিনের কাটা অংশে আমাদের সরবরাহকৃত নতুন কোনাে ডিএনএর অংশ, কোষ নিজে ঢুকাতে পারে। ফলে নতুন কোনাে প্রােটিন পাওয়া যাবে, অথবা 

ডিএনএর কোনাে অংশকে কেটে ফেলে সেই জিনের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেবে। ২০১২-১৩ সালে এই ক্রিসপার আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই রােগ-কীট-কঠিন জলবায়ু সহনশীল খাদ্যশস্য উৎপাদনের কথা ভেবে


আসছেন বিজ্ঞানীরা। আর এ নিয়ে কাজও হয়েছে বেশ। Magnaporthe নামের এক ছত্রাকের জন্য ধানের ব্লাস্ট রােগ হয়ে থাকে। আর এ সময় ERF922 নামের প্রােটিনের কাজ বেড়ে যায়। আবার লবণাক্ত পানি, খরা বা প্রচুর ঠান্ডায়ও এই প্রােটিনের কাজ বাড়ে। চীনের বিজ্ঞানীরা ক্রিসপার-ক্যাস দিয়ে এই প্রােটিনের কিছু অংশ বাদ দিয়ে দেখলেন, যে নতুন ধানের যে জাতটি পাওয়া গেল, তা আসল ধান জাতের চেয়ে অনেকগুণ বেশি ব্লাস্ট রােগ প্রতিরােধ করতে পারছে। অন্যদিকে, ধানের ফলনও আগের মতােই পাওয়া গেল, যা প্রমাণ করে, ক্রিসপার দ্বারা পরিবর্তিত ধানের উন্নত বৈশিষ্ট্য

পাওয়া যাবে, কিন্তু ফলন কমবে না। আবার, IPA1 নামের জিনটি ধানের অধিক বীজ আর বেশি ফলনের জন্য দায়ী। 

কিন্তু miR156 নামক ম্যাক্রো-আরএনএ এই জিনের কাজে বাধা দান করে। যখন IPA1 এ ক্রিসপার-ক্যাস৯ দ্বারা একটি ছােট্ট পরিবর্তনের জন্য miR156 যুক্ত হতে পারে না। দেখা গেল, ধানের ফলন, বীজের সংখ্যা ও মান বহুগুণে

বেড়ে গেছে। ক্রিসপার-ক্যাস৯ পদ্ধতি দ্বারা এভাবে আদর্শ খাদ্যশস্যের জাত তৈরি সম্ভব, যা উচ্চতায়, ফলনে, মানে অনন্য। ক্রিসপার-ক্যাস দ্বারা যে

শুধু ধানের গুণাগুণ বাড়ানাে হয়েছে তা কিন্তু নয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের DuPont Pioneer নামক একটি কোম্পানি ভুট্টার ARGOS8 নামক প্রােটিনের উৎপাদন বাড়িয়ে খরা-সহনশীল করতে সক্ষম হয়েছে। এভাবেই লবণাক্ততা-সহনশীল, উচ্চতাপমাত্রা-খরাবন্যাসহনশীল, ভালাে মানের অধিক ফলন দেয় এমন ধান, গম, আলু ইত্যাদি উৎপাদন সম্ভব, যা আমাদের নিকট ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ খাদ্যসংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারে। তা ছাড়া পােকামাকড় প্রতিরােধী ধান ও গম যেমন কীটনাশক ব্যবহার কমাবে, তেমনি পরিবেশের ওপর এসব রাসায়নিক কৃত্রিম পদার্থের প্রকোপও কমবে। 

সূত্র: PLOS ONE, Plant Biotechnology Journal


Talk Doctor Online in Bissoy App