“ঐকতান” হলো অশীতিপর স্থিতপ্রজ্ঞ কবির আত্ম-সমালােচনা; কবি হিসেবে নিজের অপূর্ণতার স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকারােক্তি।
দীর্ঘ জীবন-পরিক্রমণের শেষপ্রান্তে পৌছে স্থিতপ্রজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ পেছন ফিরে
তাকিয়ে সমগ্র জীবনের সাহিত্যসাধনার সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসাব খুঁজেছেন
“ঐকতান” কবিতায়। তিনি অকপটে নিজের সীমাবদ্ধতা ও অপূর্ণতার কথা
ব্যক্ত করেছেন এখানে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কবি অনুভব
করেছেন নিজের অকিঞ্চিৎকরতা ও ব্যর্থতার স্বরূপ। কবি বুঝতে পেরেছেন,
এই পৃথিবীর অনেক কিছুই তার অজানা ও অদেখা রয়ে গেছে। বিশ্বের
বিশাল আয়ােজনে তাঁর মন জুড়ে ছিল কেবল ছােট একটি কোণ। জ্ঞানের
দীনতার কারণেই নানা দেশের বিত্রি অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন গ্রন্থের চিত্রময়
বর্ণনার বাণী কৰি ভিক্ষালব্ধ ধনের মতাে সযত্নে আহরণ করে নিজের
কাব্যভাণ্ডার পূর্ণ করেছেন। তবু বিপুল এ পৃথিবীর সর্বত্র তিনি প্রবেশের দ্বার
খুঁজে পাননি। চাষি ক্ষেতে হাল চাষ, তাঁতি তাঁত বােনে, জেলে জাল ফেলেএসব শ্রমজীবী মানুষের ওপর ভর করেই জীবনসংসার এগিয়ে চলে। কিন্তু কবি এসব হতদরিদ্র অপাঙ্ক্তেয় মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে সমাজের উচ্চমাঞ্চ আসন গ্রহণ করেছিলেন। সেখানকার সংকীর্ণ জানালা দিয়ে যে জীবন ও জগৎকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, তা ছিল খণ্ডিত তথা অপূর্ণ। ক্ষুদ্র জীবনের সঙ্গে বৃহত্তম মানব-জীবনধারা ঐকতান সৃষ্টি না করতে পারলে শিল্পীর গানের পসরা তথা সৃষ্টি সম্ভার যে কৃত্রিমতায় পর্যবসিত হয়ে ব্যর্থ হয়ে
, কবিতায় এই আত্মােপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে কবির। বলেছেন তিনি, তার
কবিতা বিচিত্র পথে অগ্রসর হলেও জীবনের সকল স্তরে পৌঁছাতে পারেনি।
ফলে, জীবন-সায়াহ্নে কবি অনাগত ভবিষ্যতের সেই মৃত্তিকা-সংলগ্ন মহৎ
কবিরই আবির্ভার প্রত্যাশা করছেন, যিনি শ্রমজীবী মানুষের অংশীদার হয়ে
সত্য কর্মের মধ্যে সৃষ্টি করবেন আত্মীয়তার বন্ধন। “ঐকতান” কবিতায়
যুগপৎ কবির নিজের এবং তাঁর সমকালীন বাংলা কবিতার বিষয়গত
সীমাবদ্ধতার দিক উন্মােচিত হয়েছে।