৯ জিলহজ, ১০ হিজরি। জুমাবার। আরাফার দিন। আরাফার মরুপ্রান্তরে প্রায় সোয়া লাখ জনতার সমাবেশে দ্বিপ্রহরের খানিক পরে সিক্ত ভক্তদের উদ্দীপ্ত প্রেরণা ও ধীর আগ্রহের প্রহর শেষে হজরত মুহাম্মদ (সা.) যে ভাষণ দেন, ইসলামের ইতিহাসে তা-ই 'হাজ্জাতুল বিদা' বা 'বিদায় হজ' নামে পরিচিত। এ ছাড়া এই ভাষণকে 'হাজ্জাতুল বালাগ' ও 'হাজ্জাতুত তামাম' বা পূর্ণতার হজ নামেও অভিহিত করা হয়। সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত আগত, বিগত পৃথিবীর সব ভাষণের মধ্যে এ ভাষণ শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় বিভূষিত। বিশ্ব মানবতার মুক্তির এমন কোনো দিক নেই, যার ছোঁয়া এই মূল্যবান ভাষণে লাগেনি। মূলত বিদায় হজের ভাষণ মহানবী (সা.)-এর ২৩ বছরের নবুয়তি জীবনের কর্মপন্থা ও প্রজ্ঞার নির্যাস। তা ছাড়া এ ভাষণ ছিল মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর থেকে কিয়ামত অবধি বিপদসংকুল পৃথিবীর উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান। এ ভাষণ ছিল বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার এক পূর্ণাঙ্গ ও বাস্তব কর্মসূচি। ইসলাম ধর্মের ক্রমসম্প্রসারমাণ প্রক্রিয়া ও রূপরেখার যে ধারাবাহিকতা হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু হয়েছিল, তারই পূর্ণ বিকাশ ও পরিসমাপ্তি ঘটেছিল এ ভাষণের মধ্য দিয়ে। এ ভাষণের পর তিন মাস অতিবাহিত হতে না হতেই তিনি এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে অবিনশ্বর জগতে পাড়ি জমান। জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তিনি লাখো জনতার কণ্ঠে নবুয়তি দায়িত্ব যথার্থভাবে পালনের স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন। রাসুল (সা.)-এর মুখে 'আল-বিদা', 'আল-বিদা' ধ্বনি শুনে ভক্তকুলের আকাশ বিদীর্ণ করা আর্তনাদ ও নিঃশব্দ আকুতিতে সেদিন ভারী হয়েছিল আরাফার আকাশ। 'আমি কি পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি?' বারবার ধ্বনিত হওয়া এ বাক্যটি শুনে বিগলিত মন ও সিক্ত নয়নে ভক্তকুলের মুখ থেকে কেবল একটি শব্দই বেরিয়ে এসেছিল, 'নায়াম'- হ্যাঁ। মূলত বিদায় হজে রাসুল (সা.) তিনটি ভাষণ প্রদান করেছিলেন। এক. আরাফার ময়দানে। দুই. কোরবানির দিন, মিনায়। তিন. 'আয়্যাম-ই-তাশরিকে'র মধ্যবর্তী স্থানে, মিনায়। ভাষণগুলোর মানবাধিকারসংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়েই আমরা আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব, ইনশাআল্লাহ।

সাম্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা : ধর্ম, জাতি, বর্ণবৈষম্যের কারণে হারিয়ে যায় মানবিক মূল্যবোধ। শুরু হয় মানুষের মধ্যে হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারি। আজকের বিশ্বে তা কেবলই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এসবের অবসানকল্পে মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেন, 'হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের রব একজন। তোমাদের আদি পিতা একজন। প্রত্যেকেই আদমের সন্তান। আর আদম মাটির তৈরি। আল্লাহ তায়ালা পারস্পরিক পরিচিতির সুবিধার্থে বিভিন্ন সমাজ ও গোত্রে তোমাদের বিভক্ত করেছেন। আরবের ওপর যেমন অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তেমনি অনারবের ওপর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই আরবের। একইভাবে শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের আর কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব বা বৈশিষ্ট্য নেই। শ্রেষ্ঠত্ব, বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার একমাত্র ভিত্তি হলো তাকওয়া তথা আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে।'

দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে পৃথিবীর রাতগুলোকে যতই দিনের আলোর মতো জ্বলজ্বল করে তোলার চেষ্টা চলছে, ততই মানুষের অন্তঃকরণ ক্রমেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর সর্বত্র আজ হত্যা, লুণ্ঠন, ছিনতাই, সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই। ভূলুণ্ঠিত মানবতা নিভৃতে কাঁদছে। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) বলেন, 'হে লোক সকল! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্মান, তোমাদের সম্পদ পরস্পরের জন্য চিরতরে হারাম করা হলো- যেমন আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহরে রক্তপাত করা হারাম বা নিষিদ্ধ।'

ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা : আমাদের সমাজে অপরাধী শক্তিশালী হওয়ার দরুন, ঘুষের বিনিময়ে অথবা স্বজনপ্রীতি করে নিরীহ ব্যক্তির ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। একজনের অপরাধের কারণে তার পরিবার, বংশ, পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের ব্যাপারে ঢালাওভাবে মন্তব্য করার হীন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ মর্মে রাসুল (সা.) বলেন, 'শুনে রাখো, অপরাধীর দায়িত্ব কেবলই তার ওপর বর্তাবে। পিতা তাঁর পুত্রের জন্য আর পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্য দায়ী নয়।'

নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক : এক শ্রেণির লোক বলে বেড়ায়, 'ধর্ম হলো শোষণের হাতিয়ার!' নারীর অধিকার রক্ষার সস্তা স্লোগানধারী কিছু মানুষ বলে থাকে, 'নারী নির্যাতনের জন্য ধর্ম ও ধর্মীয় মতামতই (ফতোয়া) দায়ী!' তারা কি রাসুল (সা.)-এর এ কথাগুলো পড়ে দেখেছে? 'হে মানবমণ্ডলী! নারীদের প্রতি নির্মম ব্যবহার করার সময় তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই তোমরা তাদের আল্লাহর জামিনে গ্রহণ করেছ এবং তাঁরই কালেমার মাধ্যমে তাদের সঙ্গে তোমাদের দাম্পত্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জেনে রেখো, তাদের ওপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের ওপর তাদেরও অধিকার রয়েছে। সুতরাং তাদের সার্বিক কল্যাণ সাধনের বিষয়ে তোমরা আমার অসিয়ত (অন্তিম উপদেশ) গ্রহণ করো।'

শ্রেষ্ঠতম শ্রমনীতি ঘোষণা : বর্তমান বিশ্বে শ্রমিক সমস্যা সবচেয়ে আলোচিত সমস্যা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাসুল (সা.) শ্রমনীতি ঘোষণা করেন। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে- এটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শ্রমনীতি। তিনি বলেছেন, 'তোমরা তোমাদের অধীনদের সম্পর্কে সতর্ক হও। তারা তোমাদের ভাই। তোমরা নিজেরা যা খাও তা তাদের খাওয়াবে। তোমরা নিজেরা যা পরিধান করো তা তাদের পরিধান করাবে। তাদের ওপর সাধ্যাতিরিক্ত শ্রমের বোঝা চাপিয়ে দেবে না। যদি কোনো কারণে চাপিয়ে দিতে হয়, তবে তুমিও তাতে অংশীদার হও।'

নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা যাবে না : মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও ঐক্যের ভিত মজবুত করা ও নিরপরাধ মানুষ হত্যা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে মহানবী (সা.) বলেন, 'হে লোক সকল! শুনে রাখো, মুসলমান জাতি পরস্পর ভাই ভাই। আমার অবর্তমানে তোমরা পরস্পর মারামারি ও হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়ে কাফির হয়ে যেও না। মনে রেখো! শয়তান এ বিষয়ে নিরাশ হয়ে গেছে, যারা নামাজ আদায় করে তারা শয়তানের পূজারি হবে না। তবে হ্যাঁ, সে তোমাদের বিভিন্ন রকমের চক্রান্তের উসকানি দেবে।'

মানব সভ্যতাবিরোধী সব বর্বরতা নিষিদ্ধ : মানব সভ্যতা, নৈতিকতাবিরোধী সব অপকর্ম, রক্তপাত, প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষের আগুন পৃথিবী থেকে চিরতরে নির্বাপিত করার জন্য মহানবী (সা.) ঘোষণা দেন, 'শুনে রাখো, জাহেলি ও বর্বর যুগের সব প্রথা আজ আমার পায়ের নিচে পদদলিত। জাহেলি যুগের রক্তের দাবিও আজ থেকে রহিত করা হলো।'

সুদবিহীন অর্থনীতি প্রণয়ন : পুঁজিবাদী সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার জাঁতাকলে পিষ্ট আজকের মানবসমাজ। সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চিরতরে মূলোৎপাটন করে জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহানবী (সা.) বলেন, 'জাহেলি যুগের সুদব্যবস্থা রহিত করা হলো। এ পর্যায়ে সর্বপ্রথম আমি আমার চাচা হজরত আব্বাসের সুদ মাফ করে দিলাম, আর সেই সঙ্গে গোটা সুদব্যবস্থা আজ থেকে রহিত করা হলো।'

যার যার প্রাপ্য তাকে দিয়ে দিতে হবে : প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা মানবতাকে ধ্বংস করছে। অন্যের অধিকার হরণ করে যেকোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনের চিন্তা সমাজের সমস্যাগুলোকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে। সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসুল (সা.) বলেন, 'ঋণ অবশ্যই আদায় করতে হবে। প্রত্যেকের আমানত (প্রাপ্য অধিকার) তার হকদারের কাছে অবশ্যই ফেরত দিতে হবে।'

অন্যের অর্থ আত্মসাৎ ও জুলুম-নির্যাতন নিষিদ্ধ : আঁধার-আলো, রৌদ্র-ছায়া, রাত-দিন, সবল-দুর্বল নিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছে বৈচিত্র্যময় এ পৃথিবী। তাই শক্তিমত্তা ও ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে কারো সম্পদ গ্রাস করা ও কারো ওপর নির্যাতনের খৰ চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। রাসুল (সা.) বলেন, 'সাবধান! তোমরা জুলুম করবে না; সাবধান!! তোমরা জুলুম করবে না, সাবধান!!! তোমরা জুলুম করবে না। আর কোনো মুসলমানের ধন-সম্পত্তি থেকে তার সম্মতি ছাড়া কোনো কিছু গ্রহণ করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়।'

আদর্শিক দ্বন্দ্বে পরমতসহিষ্ণু হতে হবে : প্রত্যেক জাতি ও ধর্মাবলম্বীর রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শ। বহুধাবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় বহুদল-উপদল ও নানা মতের মানুষ থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংঘাত ও বাড়াবাড়ির কোনো সুযোগ নেই। মহানবী (সা.) বলেন, 'সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও সংঘাতের পথ বেছে নিও না। এই বাড়াবাড়ির ফলেই অতীতে বহু জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।'

শাসক নিকৃষ্টমানের হলেও রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ করা যাবে না : শাসক যদি কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো কাজ না করে, তাহলে রাষ্ট্রের যেকোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া নাগরিকের কর্তব্য- শাসক যতই নিকৃষ্টমানের হোক না কেন। রাসুল (সা.) বলেন, 'যদি কোনো কর্তিত নাশিকাবিশিষ্ট হাবসি ক্রীতদাসকেও (নীচু প্রকৃতির মানুষ) তোমাদের নেতা বা শাসক বানিয়ে দেওয়া হয় এবং সে যদি কোরআন-সুন্নাহ অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তবে অবনত মস্তকে তার আদেশ মেনে চলবে।'

ভবিষ্যৎ আগত সমস্যার সমাধান : ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। আর রাসুল (সা.) হলেন শেষ নবী। তাই সমস্যাসংকুল পৃথিবীতে ইসলাম নিত্যনতুন যুগজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে পারে। তারই সমাধানকল্পে মহানবী (সা.) বলেন, 'আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যত দিন তোমরা এ দুটো জিনিস আঁকড়ে থাকবে, তত দিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। সে দুটি বস্তু হলো- আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নাহ।' (তবে সুরা নিসার ৫৭ নম্বর আয়াত মতে, 'উলুল আমর' বা রাষ্ট্রপ্রধান ও বিজ্ঞ ফকিহদের মতামতও মান্য করতে হবে।)

ধর্মের মর্মবাণী মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে হবে : পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তোমরা হলে উত্তম জাতি, তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানবতার কল্যাণে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দেবে ও অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে।' (সুরা : আলে ইমরান, ১১০)

তাই ধর্মের মর্মবাণীগুলো বিশেষত বিদায় হজের ভাষণের বার্তা বিশ্ব মানবতার কাছে পেঁৗছে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে লাখ লাখ সাহাবি আপন বাসস্থান ত্যাগ করে ছড়িয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। ঘরে ঘরে আজ পেঁৗছে গেছে ইসলামের শান্তির বাণী। রাসুল (সা.) বলেন, 'তোমরা যারা আজ এখানে উপস্থিত আছ, তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে

যারা আজ উপস্থিত নেই তাদের কাছে আমার এই আদেশ-উপদেশগুলো পেঁৗছে দেওয়া।' সমস্যায় জর্জরিত ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ফিরে যেতে হবে সেই চৌদ্দ শত বছর আগে। জীবনকে ঢেলে সাজাতে হবে বিদায় হজের ভাষণের সুমহান আদর্শে।


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে