শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

গান বাজনার ব্যাপারে ইসলামের বিধান 


আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا(لقمان 6)
আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে। (সূরা লুকমান ৩১: ৬ আয়াত)।
বেশীর ভাগ তাফসীরকারকগণ ‍লাহওয়াল হাদীস বলতে গানকে বুঝিয়েছেন। উবনে মাসউদ রা. বলেন: উহা গান। ইমাম হাসান বছরী র. বলেন: উহা গান ও বাদ্য শানে নাজিল হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা শয়তানকে সম্বোধন করে বলেন:
وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ(الاسراء 64)
তোমার কন্ঠ দিয়ে তাদের মধ্যে যাকে পারো প্ররোচিত কর। (সূরা ইসরা ১৭: ৬৪ আয়াত)।

গান বাজনার ক্ষতিকর দিকসমূহ

ইসলাম কোন জিনিসের মধ্যে ক্ষতিকারক কোন কিছু না থাকলে তাকে হারাম করেনি। গান ও বাজনার মধ্যে নানা ধরনের ক্ষতিকর জিনিস রয়েছে। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. এ সম্বন্ধে বলেন:
বাজনা হচ্ছে নফসের মদ স্বরুপ: মদ যেমন মানুষের ক্ষতি করে, বাদ্যও মানুষের সেই রকম ক্ষতি করে। যখন গান বাজনা তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে, তখনই তারা শিরকে পতিত হয়। আর তখন তারা ফাহেশা কাজ ও জুলুম করতে উদ্যত হয়। তারা শিরক করতে থাকে এবং যাদের কতল করা নিষেধ তাদেরকেও কতল করতে থাকে। যেনা করতে থাকে। যারা গান বাজনা করে তাদের বেশীর ভাগের মধ্যেই এই তিনটি দোশ দেখা যায়। তাদের বেশীর ভাগই মুখ দিয়ে শিস দেয় ও হাততালি দেয়।
শিরকের নিদর্শন: তাদের বেশীর ভাগই তাদের শায়খ (পীর) অথবা গায়কদের আল্লাহরই মতই ভালবাসে অথবা আরো অধিক।
ফাহেশার মধ্যে আছে: গান হল যেনার রাস্তা স্বরূপ। এর কারণেই বেশীর ভাগ ফাহেশা কাজ অনুষ্ঠিত হয় গানের মজলিসে। ষেখানে পুরুষ, বালক, বালিকা ও মহিলা চরম স্বধীন ও লজ্জাহীন হয়ে পড়ে। এভাবে গান শ্রবন করতে করতে নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনে। তখন তাদের জন্য ফাহেশা কাজ করা সহজ হয়ে দাড়ায়, যা মদ্যপানের সমতুল্য কিংবা আরও অধিক।
কতল বা হত্যা: অনেক সময় গান শ্রবণ করতে করতে উত্তেজিত হয়ে একে অপরকে কতল করে ফেলে। তখন বলে: তার মধ্যে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল যে জন্য হত্যা করা ছাড়া উপায় ছিল না। উহা হতে বিরত থাকা তার ক্ষমতার বাইরে ছিল। আসলে এই সময়ে মজলিসে শয়তান উপস্থিত হয়। আর যাদের উপর শয়তান বেশী শক্তিশালী, তারা অন্যদের কতল করে ফেলে।
গান বাজনা শ্রবণে অন্তরের কোন লাভ হয় না, তাতে কোন উপকারও নেইঅ বরঞ্চ ওতে আছে গোমরাহী এবং ক্ষতি, যা লাভের থেকেও বেশী ক্ষতিকর। উহা রুহের জন্য ঐ রকম ক্ষতিকর যেমন মদ শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ফলে যারা সঙ্গীত শ্রবণ করে, তাদের নেশা মদ্যপায়ীর নেশা থেকেও অনেক বেশী হয়। তারা ওতে যে মজা পায়, তা মদ্যপায়ীর থেকেও অনেক বেশী।
শয়তানও তাদের নিয়ে খেলা করে। তখন এই অবস্থায় তারা আগুনে প্রবেশ করে, কেউ গরম লোহা শরীরের মধ্যে কিংবা জিহবায় প্রবেশ করায় অথবা এ জাতীয় কাজ করে। তারা সালাত আদায়ের সময় অথবা কোরআন তেলাওয়াতের সময় এই রকম অবস্থা প্রাপ্ত হয় না। কারণ এগুলি শরীয়ত সম্মত ইবাদত, ঈমানী কাজ, রাসূলের সা. কাজ, যা শয়তানকে দুরে সরিয়ে দেয়। আর অন্যগুলো ইবাদতের নামে বিদআত। এতে আছে শিরক ও শয়তানী কাজ, দার্শনিকের কাজ, যাতে শয়তানরা সহজেই আকৃষ্ট হয়।
শরীরে লোহা প্রবেশ করানোর হাকীকত
শরীরের মধ্যে লোহার শলাকা, না রাসূল সা., আর না সাহাবীরা প্রবেশ করাতেন। যদি এ কাজ উত্তমই হত তবে অবশ্যই তারা এতে অগ্রগামী হতেন। বরঞ্চ উহা সূফী পীর ও বিদআতীদের কাজ। আমি তাদেরকে মসজিদে একত্রিত হতে দেখেছি, তাদের সাথে তবলা জাতীয় যন্ত্র দফ ছিল। তারা গান করছিল: আমাদের মদের গ্লাস এনে দাও এবং তা আমাদের পান করাও। আল্লাহর ঘরে বসে মদ জাতীয় দ্রব্যের উচ্চারণ করতে তাদের লজ্জাও হয় না। তারপর উচ্চ আওয়াজে দফ বাজাচ্ছিল এবং উচ্চ আওয়াজে গাইরুল্লাহর নিকট বিপদে উদ্ধার চাচ্ছিল। আর বলছিল: হে দাদা! এভাবে শয়তান তাদের ধোকায় নিপতিত করছিল। তারপর আর একজন তার জামা খুলে একটি লোহার শিক হাতে নিয়ে তার পাঁজরের মধ্যে প্রবেশ করাল। তারপর আর একজন উঠে দাড়িয়েঁ কাচেঁর একটি গ্লাস ভেঙ্গে তা দাঁত দিয়ে চুর্ণ বিচুর্ণ করছিল। তখন আমি মনে মনে বললাম, এরা যা বলছে তা যদি সত্যিই সহীহ হয় তবে যেন তারা ঐ ইয়াহুদীদের সাথে সাথে যুদ্ধ করে যারা আমাদের ভূমি জবর দখল করে রেখেছে, আর আমাদের সন্তানদের হত্যা করেছে। এসব কাজ যে সব শয়তানরা সেখানে উপস্থিত হয় তারা তাদের সাহায্য করে। কারণ, ঐ লোকেরা আল্লাহর স্বরণ হতে দূরে রয়েছে। আর যখন তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের নিকট বিপদে উদ্ধার চায়, তখন তারা শিরকের মধ্যে লিপ্ত হয়। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمَنْ يَعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمَنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ ﴿36﴾ وَإِنَّهُمْ لَيَصُدُّونَهُمْ عَنِ السَّبِيلِ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ مُهْتَدُونَ ﴿37﴾ الزخرف
আর যে পরম করুণাময়ের জিকির থেকে বিমুখ থাকে আমি তার জন্য এক শয়তানকে নিয়োজিত করি, ফলে সে এক শয়তানের সঙ্গী হয়ে যায়।
আর নিশ্চয়ই তারাই (শয়তান) মানুষদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয়। অথচ মানুষ মনে করে তারা হিদায়েত প্রাপ্ত। (সূরা জুখরুফ ৩৬ ৩৭ আয়াত)
আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য শয়তানকে নির্দিষ্ট করে দেন, যাতে তারা আরও গোমরাহ হতে পারে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
قُلْ مَنْ كَانَ فِي الضَّلَالَةِ فَلْيَمْدُدْ لَهُ الرَّحْمَنُ مَدًّا(مريم75)
বল, যে বিভ্রান্তিতে রয়েছে তাকে পরম করূণাময় প্রচুর অবকাশ দেবেন, (সূরা মারইয়াম ৭৫ আয়াত)
শয়তান যে তাদের সাহায্য করে, এতে আবাক হওয়ার কিছুই নেই। কারণ, সুলাইমান আ: এক জিনের নিকট সাহায্য চেয়েছিলেন, রাণী বিলকিসের সিংহাসন উঠিয়ে আনার জন্য। এ সম্বন্ধে কোরআনে আছে:
قَالَ عِفْريتٌ مِنَ الْجِنِّ أَنَا آَتِيكَ بِهِ قَبْلَ أَنْ تَقُومَ مِنْ مَقَامِكَ وَإِنِّي عَلَيْهِ لَقَوِيٌّ أَمِينٌ ﴿النمل : 39﴾
এক শক্তিশালী জিন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার পূর্বেই আমি তা এনে দিব। আমি নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে । (সূরা নামল ৩৯ আয়াত)।
যারা হিন্দুস্তানে গিয়েছেন, যেমন ভ্রমনবিদ ইবনে বতুতা কিংবা অন্যান্যরা, তারা অগ্নি উপাসকদের লোহার শিক শরীরে প্রবেশ করানো হতেও বেশী ভযংকর ঘটনা দেখেছে, যদিও তারা ছিল কাফের। তাই এই ঘটনা কোন কারামত বা অলৌকিক ঘটনা নয়। বরঞ্চ ইহা ঐ সমস্ত শয়তানদের ঘটনা যারা এভাবে একত্রিত হয় গান বাজনার আশরে। দেখা যায়, বেশীর ভাগ লোক, যারা শরীরে শিক প্রবেশ করায়, তারা নানা ধরনের পাপে লিপ্ত। এমনকি প্রকাশ্যভাবে তারা আল্লাহর সাথে শিরকে লিপ্ত থাকে। কারণ তারা তাদের মৃত পুর্বপুরুষদের নিকট সাহায্য ভিক্ষা করে। তাহলে কিভাবে কারামতের অধিকারী অলী আল্লাহ হতে পারে?
আল্লাহ তায়ালা আউলিয়াদের সম্বন্ধে বলেন:
أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ﴿يونس : 62﴾
শুনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই, আর তারা পেরেশানও হবে না। (সূরা ইউনুস ৬২ আয়াত)।
অলী হচ্ছেন ঐ মুমিন বান্দা, যিনি সর্বদা এক আল্লাহর নিকট সাহায্য ভিক্ষা করেন। আর মুত্তাকি হচ্ছেন ঐ ব্যক্তি  যিনি আল্লাহর সাথে পাপ ও শিরক করা হতে বিরত থাকেন। এই সমস্ত অলীদের জীবনে হঠাৎ করে কোন কারামত ঘটে যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে কোন মানুষের দাবী বা লোক দেখএনার জন্য এটা ঘটে না।
বর্তমান জামানায় গান বাজনা
বর্তমান জামানায় বেশীর ভাগ গান হয় বিয়ের মজলিসে অথবা অন্য কোন উৎসবে, রেডিও ও টেলিভিশনে। এগুলোর বেশীর ভাগই ভালবাসা, শাহওয়াত, চুমু দেখা সাক্ষাৎ ইত্যাদির উপরে ভিত্তি করে রচিত। তাতে থাকে মুখের, কপালের এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রতঙ্গের বর্ণনা, যা যুবকদের মনে শাহওয়াত জাগিয়ে তোলে, আর তাদের ফাহেশা কাজ ও যেনা করতে উদ্বুদ্ধ করে। আর তাদের চরিত্র নষ্ট করে।
যখন গায়ক গায়িকারা গান বাজনার নামে একত্রিত হয়, তখন ঐ সমস্ত ধন দৌলত ব্যয় হয়, যা সংস্কৃতির নামে জাতীয় তহবিল হতে চুরি করা হয়। তারপর ঐ ধন দৌলত নিয়ে ইউরোপ আমেরিকা যেয়ে বাড়ী গাড়ী ইত্যাদি খরিদ করে। তারা তাদের অশ্লীল গান বাজনা দিয়ে জাতীয় চরিত্র নষ্ট করে দেয়। তাদের অশ্লীল ও নগ্ন ছবি দিয়ে যুবকদের চরিত্র নষ্ট করে। ফলে, আল্লাহকে ছেড়ে তারা তাদেরকে ভালবাসতে থাকে। এমনকি ১৯৬৭ সালে ইয়াহুদীদের সাথে যুদ্ধের সময় রেডিও হতে বলা হচ্ছিল, তোমরা যুদ্ধে অগ্রসর হতে থাক; কারণ তোমাদের সাথে অমুক অমুক গায়িকা আছে। ফলে, তারা পাপিষ্ট ইয়াহুদীদের সাথে চরমভাবে বিপর্যস্ত ও পরাজিত হয়। বরঞ্চ তাদের বলা উচিৎ ছিল: তোমরা সম্মুখে অগ্রসর হতে থাক তোমাদের সাথে আল্লাহ আছেন, তাঁর সাহায্য নিয়ে। এমনকি এক গায়িকা এই ঘোষণা দিয়েছিল যে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পূর্বে তার প্রতি মাসে কায়রোয় যে মাসিক উৎসব হতো, এ বৎসর তা সে তেলআবিবে করবে, যদি তারা জয়যুক্ত হয়। অন্যদিকে ইয়াহুদিরা যুদ্ধের পর বায়তুল মুকাদ্দাসের গোনাহ মোচনের দেয়ালের সামনে দাড়িয়েঁ আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিল, আল্লাহ তাদের সাহায্য করার জন্য। এমনকি দ্বীনি গ্ন বাজনার মধ্যে নানা ধরনের গর্হিত কথা থাকে। যেমন বলা হল, প্রতি নবীরই একটা নির্দিষ্ট অবস্থান আছে, আর হে মুহাম্মাদ! এই সেই আরশ! একে গ্রহণ কর। এই বাক্যের শেষ কথা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে মিথ্যা বানান হয়েছে, যার মূল ঠিক নয়। কারণ রাসূল সা. কক্ষনই আরশ গ্রহণ করবেন না, আর তাঁর রবও এ কথা বলবেন না।
শ্রুতিমধুর কন্ঠস্বরের দ্বারা মেয়েদের ফিৎনা
সাহাবী বারাহ ইবনে সালেকের রা. কন্ঠস্বর ছিল মধুর। কোন কোন সফরে রাসূলের সা. সাথেচলার সময় ধর্মীয় গান গাইতেন। একদা যখন তিনি গান গাচ্ছিলেন, আর মহিলারা নিকটে এসে পড়ল, তখন রাসূল সা. তাকে বললেন:মেয়েদের থেকে সাবধান! ফলে তিনি নিশ্চুপ হয়ে পড়লেন। তার স্বর মেয়েরা শ্রবণ করুক তা রাসূল সা. পছন্দ করেন নি। (হাকেম)।
যদি রাসূল সা. এই ভয় পেয়ে থাকেন যে বাগানে গিয়ে সুর করে কবিতা পড়লে মেয়েদের মধ্যে ফিৎনা হবে, তাহলে বর্তমান জামানায় মহিলারা রেডিও টেলিভিশনে যে ধরণের গান বাজনা করে, তাদের গান বাজনা শুনলে কি বলতেন? এই ধরনের গায়িকারা বেশীর ভাগই নানা ধরনের ফাসেক ও নগ্ন কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে, আর শরীরের নানাবিধ বর্ণনা দিয়ে যে কবিতা পাঠ করে তাতে বিবিধ ধরনের অব্স্থার ও নফসিয়াতের উদ্রেক করে। ফলে অন্তরে এমন রোগের সৃষ্টি হয় যাতোদের উৎসাহিত করে তাদের লজ্জা শরম বির্সজন দিতে ও বেহায়াপনায় লিপ্ত হতে। যদি এই গানের সাথে মাতার করা সুরের মিশ্রন হয়, তবে তো তাদের বুত্থির বিভ্রম ঘটায়। যারা ই গানের নেশায় পড়ে, তাদের তা ঐ রকমই ক্ষতি করে যা মদ পান করার পর হয়ে থাকে।
গান অন্তরে নিফাকী সৃষ্টি করে
ইবনে মাসউদ রা. বলেন: গান অন্তরে মুনাফেকী সৃষ্টি করে, যেমন ভাবে পানি ঘাস সৃষ্টি করে। যিকর অন্তরে ঈমান সৃষ্টি করে, যেমন পানি ফসল উৎপন্ন করে।
ইবনুল কাইয়িম র. বলেন: যে ব্যক্তি সব সময় গান বাজনায় ব্যস্ত থাকে, তার অন্তরে মুনাফেকীও সৃষ্টি হবে, যদিও তার মধ্যে এর অনুভুতি আসবে না। যদি সে মুনাফেকীর হাকিকত বুঝতে পারত, তবে অব্শ্যই অন্তরে তার প্রতিফলন দেখতে পেত। কারণ কোন বান্দার অন্তরে কোন অবস্থাতেই গানের মহব্বত ও কোরআনের মহব্বত একত্রে সন্নিবেশিত হতে পারে না। তাদের একটি অন্যটিকে অবশ্যই দুর করে দিবে। কারণ আমরা দেখতে পাই যে, কোরআন তেলাওয়াত শ্রবণ করা, গান ও কাওয়ালী শ্রবণকারীদের কাছে খুবই শক্ত ঠেকে। আর কারি যে আয়াত তেলাওয়াত করে, তা দ্বারা তারা মো্টেই উপকৃত হয় না। ফলে শরীরে কোন নাড়াচড়া ও অন্তরে কোন উদ্দীপনা আসে না। আর যখনই তারা গান শ্রবণ করে, তখনই তাদের কন্ঠস্বরে ভয়ের এক প্রভাব সৃষ্টি হয়, অন্তরে এক ভাবের সৃষ্টি হয়, রাত্রি জাগরণ করা মধুর হয়। ফলে দেখতে পাই তারা গান বাদ্য শ্রবণ করাকে কোরআনে তেলাওয়াত শ্রবণ অপেক্ষা বেশী প্রধান্য দেয়। বেশীর ভাগ লোকই যারা গান ও বাদ্যের ফিৎনায় লিপ্ত আছে, তারা সালাত আদায়ে খুব অলসতা দেখায়। বিশেষ করে জামাতে সালাত আদায়ের ব্যাপারে।
ইবনে আকীল র. যিনি হাম্বলি মাযহাবের একজন বড় আলেম, তিনি বলেন: যদি কোন গায়িকা (নিজের স্ত্রী ব্যতিত) গান গায় তবে তা শ্রবণ করা হারাম। এ ব্যপারে হাম্বলি মাজহাবে কোন মতবিরোধ নেই।
ইবনে হাযম র. বলেন: মুসলিমদের জন্য কোন অপরিচিতা মহিলার গান শ্রবণ করে আনন্দ লাভ করা হারাম।
গান বাজনা শ্রবণের প্রতিকার
রেডিও টেলিভিশন, ভিডিও কিংবা অন্য কোন স্থানে যে গান হয়, তা শ্রবণ করা হতে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে অশ্লিল গান হতে, যাতে বাদ্যও বাজান হয়।
গান বাজনা থেকে বিপরিত কাজ হল আল্লাহর যিকর করা ও কোরআন তেলাওয়াত করা। বিশেষ করে সূরা বাকারা তেলাওয়াত করা।
রাসূল সা. বলেছেন:
إنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الذِيْ يَقْرَأُ فِيْهِ الْبَقَرَةَ (رواه مسلم)
যে বাড়িতে সূরা বাকারা তেলাওয়াত করা হয় সে বড়ী হতে শয়তান পালায়ন করে (মুসলিম)
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
يا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ ﴿57يونس﴾
হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাতের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তর সমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়েত ও রহমত। (সূরা ইউনুস ৫৭ আয়াত)
রাসূলের সা. জীবনী ও শামায়েল (আখলাক)পাঠ করা এবং সাথে সাথে সাহবায়ে কেরামগণের জীবনীও অধ্যায়ন করা।
যে সমস্ত গান শ্রবণ করা জায়েয
ঈদের গান শ্রবণ করা: এ হাদীসটি আয়েশা রা. হতে বর্ণিত:
دَخَلَ رَسُولُ اللهِ صَلي الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَيْهَا وَعِنْدَهَا جَارِيَتَانِ تَضْرِبَانِ بِدَفَّيْنِ (وَفِي رِوَايَةٍ عِنْدِي جَارِيَتَانِ تُغَنِّيَانِ) فَانْتَهَرَهُمَا ابُوْبَكرٍ فَقالَ صَلي الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دَعْهُنَّ فَانَّ لِكُلِّ قَوْمٍ عِيْدًا وَإنَّ عِيْدَنَا هَذا الْيَوْم (رواه البخاري)
একদা রাসূল সা. তাঁর ঘরে প্রবেশ করেন। তখন তার ঘরে দুই বালিকা দফ বাজাচ্ছিল। অন্য রেওয়ায়েতে আছে গান করছিল। আবু বকর রা. তাদের ধমক দেন। তখন রাসূল সা. বললেন: তাদের গাইতে দাও। কারণ প্রত্যেক জাতিরই ঈদের দিন আছে। আর আমাদের ঈদ হল আজকের দিন। (বুখারী)
দফ বাজিয়ে বিয়ে প্রচারের জন্য গান গাওয়া আর তাতে মানুষদের উদ্ধুদ্ধ করা। দলিল: রাসূল সা. বলেছেন:
فَصْلُ ما بَيْنَ الْحَلَالِ وَالْحَرَمِ ضَرْبُ الدَّفِ وَالصَّوْتُ فِي النِّكَاحِ (رواه أحمد)
হারাম ও হলালের মধ্যে পার্থক্য হল দফের বাজনা। এই শব্দে বুঝা যায় যে, সেখানে বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। (আহমাদ)
কাজ করার সময় ইসলামী গান শ্রবণ করা, যাতে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে ঐ গানে যদি দুয়া থাকে। এমনকি রাসূল সা. পর্যন্ত ইবনে রাওয়াহা রা. নামক সাহবীর কবিতা আবৃত্তি করতেন। আর সাথীদেরকে খন্দকের যুদ্ধের সময় পরিখা খনন করতে উদ্ধুদ্ধ করতেন এই বলে যে, হে আল্লাহ কোনই জীবন নেই আখেরাতের জীবন ব্যতীত। তাই আনছার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করনি। তখন আনছার ও মুহাজিনগণ উত্তর দিলেন: আমরাই হচ্ছি ঐ ব্যক্তিবর্গ যারা রাসূলের নিকট বাইআত করেছি জিহাদির জন্য যতদিনই আমরা জীবিত থাকিনা কেন।
আর রাসূল সা. সাহাবীদের নিয়ে যখন খন্দক (গর্ত) খনন করছিলেন, তখন ইবনে রাওয়াহা রা. এই কবিতা আবৃত্তি করছিলেন:
আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহ না থাকতেন তাহলে আমরা হেদায়েত পেতাম না। আর সিয়ামও পালন করতাম না, আর সালাতও আদায় করতাম না। তাই আমাদের উপর সাকিনা (শান্তি) নাযিল করুন। আর যখন শত্রুদের মুকাবিলা করব তখন আমাদের মজবুত রাখুন। মুশরিকরা আমাদের উপর আক্রমণ করেছে, আর যদি তারা কোন ফিৎনা সৃষ্টি করে, তবে আমরা তা ঠেকাবই। বারে বারে আবাইনা শব্দটি তারা উচ্চ স্বরে উচ্চারণ করছিলেন।
ঐ সমস্ত গান, যাতে আল্লাহর তাওহীদের কথা আছে অথবা রাসূলের সা. মহব্বত ও তার শামায়েল আছে অথবা যাতে জিহাদে উৎসাহিত করা হয় তাতে দৃঢ় থাকতে অথবা চরিত্রকে দৃঢ় করতে উদ্ধুদ্ধ করা হয়। অথবা এমন দাওয়াত দেয়া হয় যাতে মুসলিমদের একে অন্যের প্রতি মহব্বত ও সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। অথবা যাতে ইসলামের মৌলিক নীতি বা সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়। অথবা এই জাতীয় অন্যান্য কথা যা সমাজকে উপকুত করে দ্বীনি আমলের দিকে কিংবা চরিত্র গঠনের জন্য।
ঈদের সময় ও বিয়ের সময় কেবল মাত্র মহিলাদের জন্য তাদের নিজেদের মধ্যে দফ বাজানোর অনুমতি ইসলাম দিয়েছে। যিকরের সময় এটার ব্যবহার ইসলাম কখনই দেয়নি। রাসূল সা. যিকরের সময় কখনই উহা ব্যবহার করেননি। তাঁর পরে তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু  আনহুমগণ কখনই তা করেন নি। বরঞ্চ, ভণ্ড সুফি পীররা তা মুবাহ করেছে নিজেদের জন্য। আর জিকরের দফ বাজানকে তারা সুন্নত বানিয়ে নিয়েছে। বরঞ্চ উহা বিদআত। রাসূল সা. বলেছেন:
ايَّاكُمْ وَمُحْدَثاتِ الْاُمُوْرِ فاِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بدْعَةٍ وكُلُّ بِدْعًةٍ ضَلالَةٍ (رواه  الترمذي)
তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন কোন সংযোজন করা হতে বিরত থেক। কারণ, প্রতিটি নতুন সংযোজনই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী। (তিরমিযী)

আশাকরি বুঝতে পারছেন ।

সোর্স



ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ

আল্লাহ তাআলা সূরা লুকমানে আখেরাত-প্রত্যাশী মুমিনদের প্রশংসা করার পর দুনিয়া-প্রত্যাশীদের ব্যাপারে বলছেন, আর একশ্রেণীর লোক আছে, যারা অজ্ঞতাবশত খেল-তামাশার বস্তু ক্রয় করে বান্দাকে আল্লাহর পথ থেকে গাফেল করার জন্য।-সূরা লুকমান : ৬। উক্ত আয়াতের শানে নুযূলে বলা হয়েছে যে, নযর ইবনে হারিস বিদেশ থেকে একটি গায়িকা বাঁদী খরিদ করে এনে তাকে গান-বাজনায় নিয়োজিত করল। কেউ কুরআন শ্রবণের ইচ্ছা করলে তাকে গান শোনানোর জন্য সে গায়িকাকে আদেশ করত এবং বলত মুহাম্মদ তোমাদেরকে কুরআন শুনিয়ে নামায, রোযা এবং ধর্মের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার কথা বলে। এতে শুধু কষ্টই কষ্ট। তার চেয়ে বরং গান শোন এবং জীবনকে উপভোগ কর।-মাআরিফুল কুরআন ৭/৪ এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াত নাযিল করেন। সাহাবী ও তাবেয়ীদের ব্যাখ্যা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কে উক্ত আয়াতের ‘লাহওয়াল হাদীস’-এর ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘তা হল গান।’ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. একই কথা বলেন। তাবেয়ী সায়ীদ ইবনে যুবাইর থেকেও অনুরূপ মত বর্ণিত হয়েছে। বিখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী রাহ. বলেন, উক্ত আয়াত গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, যা বান্দাকে কুরআন থেকে গাফেল করে দেয়।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/৪৪১। কুরআন মজীদের অন্য আয়াতে আছে, ইবলিস-শয়তান আদম সন্তানকে ধোঁকা দেওয়ার আরজী পেশ করলে আল্লাহ তাআলা ইবলিসকে বললেন, তোর আওয়াজ দ্বারা তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস পদস্খলিত কর।-সূরা ইসরা : ৬৪। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যে সকল বস্তু পাপাচারের দিকে আহ্বান করে তাই ইবলিসের আওয়াজ। বিখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ রাহ. বলেন, ইবলিসের আওয়াজ বলতে এখানে গান ও বাদ্যযন্ত্রকে বোঝানো হয়েছে। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. বলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যেসব বস্তু পাপাচারের দিকে আহ্বান করে তার মধ্যে গান-বাদ্যই সেরা। এজন্যই একে ইবলিসের আওয়াজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।-ইগাছাতুল লাহফান ১/১৯৯। সাহাবী ও তাবেয়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী বহু গুনাহর সমষ্টি হল গান ও বাদ্যযন্ত্র। যথা : ক) নিফাক এর উৎস খ) ব্যভিচারের প্রেরণা জাগ্রতকারী গ) মস্তিষ্কের উপর আবরণ ঘ) কুরআনের প্রতি অনিহা সৃষ্টিকারী ঙ) আখিরাতের চিন্তা নির্মূলকারী চ) গুনাহের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিকারী ও ছ) জিহাদী চেতনা বিনষ্টকারী।-ইগাছাতুল লাহফান ১/১৮৭। বস্তুত গান বাজনার ক্ষতিকর প্রভাব এত বেশি যে, তা নাজায়েয হওয়ার জন্য আলাদা কোনো দলীল খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না। এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বহু হাদীসের মাধ্যমে তা প্রমাণিত। হাদীসের ভাষ্য গান-গায়িকা এবং এর ব্যবসা ও চর্চাকে হারাম আখ্যায়িত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- তোমরা গায়িকা (দাসী) ক্রয়-বিক্রয় কর না এবং তাদেরকে গান শিক্ষা দিও না। আর এসবের ব্যবসায় কোনো কল্যাণ নেই। জেনে রেখ, এর প্রাপ্ত মূল্য হারাম।-জামে তিরমিযী হাদীস : ১২৮২; ইবনে মাজাহ হাদীস : ২১৬৮। বর্তমানে গান ও বাদ্যযন্ত্রের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে যাতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এর সকল উপার্জন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস অনুযায়ী সম্পূর্ণ হারাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার উপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা রমনীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে যমীনে ধ্বসিয়ে দিবেন।-সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস : ৪০২০; সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস : ৬৭৫৮। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি গান মানুষের অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে।-ইগাছাতুল লাহফান ১/১৯৩; তাফসীরে কুরতুবী ১৪/৫২। উপরোক্ত বাণীর সত্যতা এখন দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার। গান-বাজনার ব্যাপক বিস্তারের ফলে মানুষের অন্তরে এই পরিমাণ নিফাক সৃষ্টি হয়েছে যে, সাহাবীদের ইসলামকে এ যুগে অচল মনে করা হচ্ছে এবং গান-বাদ্য, নারী-পুরুষের মেলামেশা ইত্যাদিকে হালাল মনে করা হচ্ছে। সহীহ বুখারীতে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল সাব্যস্ত করবে।-সহীহ বুখারী হাদীস : ৫৫৯০। মুসনাদে আহমদের হাদীসে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন এবং বাদ্যযন্ত্র, ক্রুশ ও জাহেলি প্রথা বিলোপসাধনের নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীসের আলোয় সাহাবীদের জীবন দু’একটি ক্ষেত্রে শুধু দফ বাজানোর বিষয়টি ব্যতিক্রম থাকলেও যে কোনো বাদ্যযন্ত্রই হারাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস এবং সাহাবীদের বাস্তব আমল তা প্রমাণ করে। বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত নাফে’ রাহ. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার চলার পথে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বাঁশির আওয়াজ শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুই কানে আঙ্গুল দিলেন। কিছু দূর গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হে নাফে’! এখনো কি আওয়াজ শুনছ? আমি বললাম হ্যাঁ। অতঃপর আমি যখন বললাম, এখন আর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না তখন তিনি কান থেকে আঙ্গুল সরালেন এবং বললেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলার পথে বাঁশির আওয়াজ শুনে এমনই করেছিলেন। -মুসনাদে আহমদ হাদীস : ৪৫৩৫; সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ৪৯২৪। বিখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ রাহ. থেকেও এমন একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।-ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৯০১। এখন একটু ভেবে দেখুন তো, যে আওয়াজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম মুহূর্তের জন্যও কানে তুলতে রাজি ছিলেন না সেই ইবলিসী আওয়াজের অনুকূলে কথা বলার দুঃসাহস আমরা দেখাতে পারি কি না? বাজনাদার নুপুর ও ঘুঙুরের আওয়াজও সাহাবায়ে কেরাম বরদাশত করতেন না। তাহলে গান ও বাদ্যযন্ত্রের প্রশ্নই কি অবান্তর নয়? নাসাঈ ও সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত আছে, একদিন হযরত আয়েশা রা.-এর নিকট বাজনাদার নুপুর পরে কোনো বালিকা আসলে আয়েশা রা. বললেন, খবরদার, তা কেটে না ফেলা পর্যন্ত আমার ঘরে প্রবেশ করবে না। অতঃপর তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ঘরে ঘণ্টি থাকে সেই ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।-সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ৪২৩১; সুনানে নাসাঈ হাদীস : ৫২৩৭। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ঘণ্টি, বাজা, ঘুঙুর হল শয়তানের বাদ্যযন্ত্র।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ২১১৪। মৃদু আওয়াজের ঘণ্টি-ঘুঙুরের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আধুনিক সুরেলা বাদ্যযন্ত্রের বিধান কী হবে তা খুব সহজেই বুঝা যায়। চার ইমামের ভাষ্য গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-অভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। সকলেই গান-বাদ্যকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইমাম মালেক রাহ. কে গান-বাদ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কেবল ফাসিকরাই তা করতে পারে।-কুরতুবী ১৪/৫৫। ইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেছেন যে, গান-বাদ্যে লিপ্ত ব্যক্তি হল আহমক। তিনি আরো বলেন, সর্বপ্রকার বীণা, তন্ত্রী, ঢাকঢোল, তবলা, সারেঙ্গী সবই হারাম এবং এর শ্রোতা ফাসেক। তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না।-ইগাছাতুল লাহফান ১/১৭৯; কুরতুবী ১৪/৫৫। হাম্বলী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ আল্লামা আলী মারদভী লেখেন, বাদ্য ছাড়া গান মাকরূহে তাহরীমী। আর যদি বাদ্য থাকে তবে তা হারাম।-আহসানুল ফাতাওয়া ৮/৩৮৮। ইমাম শাফেয়ী রাহ. শর্তসাপেক্ষে শুধু ওলীমা অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশ আছে বলে মত দিয়েছেন। কেননা বিয়ের ঘোষণার উদ্দেশ্যে ওলীমার অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর অবকাশের বর্ণনা হাদীসে রয়েছে।-জামে তিরমিযী হাদীস : ১০৮৯; সহীহ বুখারী হাদীস : ৫১৪৭, ৫১৬২। মনে রাখতে হবে, এখানে দফ বাজানোর উদ্দেশ্য হল বিবাহের ঘোষণা, অন্য কিছু নয়।-ফাতহুল বারী ৯/২২৬। দফ-এর পরিচয় যারা সরাসরি আরবে দফ দেখেছেন, তাদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, দফ-এর এক পাশ খোলা। বাজালে ঢ্যাব ঢ্যাব আওয়াজ হয়। প্লাস্টিকের গামলা বাজালে যেমন আওয়াজ হবে তেমন। আসলে দফ কোনো বাদ্যযন্ত্রের পর্যায়ে পড়ে না। আওনুল বারী গ্রন্থে দফ-এর পরিচয় দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে যে, এর আওয়াজ স্পষ্ট ও চিকন নয় এবং সুরেলা ও আনন্দদায়কও নয়। কোনো দফ-এর আওয়াজ যদি চিকন ও আকর্ষণীয় হয় তখন তা আর দফ থাকবে না; বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হবে।-আওনুল বারী ২/৩৫৭। আর দফ-এর মধ্যে যখন বাদ্যযন্ত্রের বৈশিষ্ট্য এসে যাবে তখন তা সর্বসম্মতিক্রমে নাজায়েয বলে পরিগণিত হবে।-মিরকাত ৬/২১০। এখন কেউ যদি বলেন, তৎকালীন যুগে দফ ছিল আরবের সর্বোচ্চ বাদ্যযন্ত্র, বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় তা-ই উন্নত হয়েছে। তাহলে একে অজ্ঞতাপ্রসূত অবাস্তব কথা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারি না। কেননা একাধিক হাদীসে ঢোল, তবলাসহ অনেক বাদ্যযন্ত্রের নাম এসেছে। বাস্তবে না থাকলে এসব বাদ্যযন্ত্রের নাম আসবে কোত্থেকে? তাছাড়া মুহাদ্দিসদের ভাষ্য অনুযায়ী দফ বাদ্যযন্ত্রের পর্যায়ে পড়ে না, যা ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি। আরবে এখনো দফ বিদ্যমান আছে। দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সুদানী উস্তাদকে ছাত্ররা এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, দফ তো বাচ্চাদের জন্য, আর বড়দের জন্য হল কুরআন। পরিণত ব্যক্তিদের জন্য কুরআন ছেড়ে এসবের মধ্যে লিপ্ত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এরপরও যদি মেনে নেওয়া হয় যে, তৎকালীন যুগে দফ সর্বোচ্চ বাদ্যযন্ত্র ছিল তবে তাতেই বা লাভ কী? বাদ্যযন্ত্রকে তো আর জায়েয বানানো যাচ্ছে না। হাদীসে রাসূলই তাকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছে। সুফী সাধকের নাম ব্যবহারকারী একটি জগতেও আজ আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। তাই আধুনিক কিছু সুফী বলে থাকে, বাদ্যসহ যিকির ও কাওয়ালি জায়েয। দলীল হিসেবে তারা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম এ বর্ণিত দুটি বালিকার দফ বাজিয়ে কবিতা গাওয়ার হাদীসটি উপস্থাপন করে। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. লেখেন, উক্ত হাদীসে আয়েশা রা.-এর বর্ণনাই তাদের অবাস্তব দাবির বিরুদ্ধে উৎকৃষ্ট জবাব। গান-বাদ্য যে নাজায়েয এই বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য হাদীসের রাবী হযরত আয়েশা রা. বলছেন, উক্ত বালিকাদ্বয় কোনো গায়িকা ছিল না। তারা কোনো গান গায়নি।-ফাতহুল বারী ২/৪৪২। ইমাম কুরতুবী রাহ. বলেন, গান বলতে যা বুঝায়, বালিকাদ্বয় তা গায়নি। পাছে কেউ ভুল বুঝতে পারে তাই আয়েশা রা. বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ইমাম কুরতুবী আরো বলেন, বর্তমানে একশ্রেণীর সুফীরা যে ধরনের গান ও বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ঘটিয়েছে তা সম্পূর্ণ হারাম।-তাফসীরে কুরতুবী ১৪/৫৪। বিখ্যাত সাধক হযরত জুনাইদ বাগদাদী রাহ. তার যুগে কাওয়ালি শোনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, বর্তমানে কাওয়ালি শোনার শর্তগুলো পালন করা হয় না। তাই আমি এর থেকে তওবা করছি।-আহসানুল ফাতাওয়া ৮/৩৯২। জুনাইদ বাগদাদী রাহ.-এর যুগেরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আমাদের যুগের অবস্থা কেমন হবে তা ভাববার বিষয়। এক বিদ্যান ব্যক্তি একটি শিক্ষণীয় উক্তি করেছিলেন যে, তোমরা আধুনিক হও ভালো কথা, কিন্তু আধুনিক হতে গিয়ে মনুষ্যত্বের সীমানা অতিক্রম করো না এবং শয়তানের দোসর বনে যেও না।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ