Call

কবি ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত পাঞ্জেরী কবিতাটি তার লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। কবিতাটিতে কিছু সাধারণ প্রতীকি শব্দ ব্যবহার করে কবি তাকে অসাধারণ বক্তব্য ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতার শিরোনাম পাঞ্জেরী। ফারসি এ শব্দটির বাংলা অর্থ হচ্ছে জাহাজের অগ্রভাগে রক্ষিত পথনির্দেশক আলোকবর্তিকা কিংবা আলোকবর্তিকাধারী ব্যক্তি। যার মাধ্যমে নাবিকগণ সমুদ্রের দুর্গম পথ অতিক্রম করে। তবে কবি এখানে একজন সাধারণ চালক নয় এ প্রতীক শব্দটি ব্যবহার করেছেন স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী কোটি কোটি মানুষের সুযোগ্য নেতাকে। সাধারণ যে ব্যাখ্যা, তাহলো বন্দরে অপেক্ষমান জাহাজের হাজার হাজার যাত্রী মনজিলে মকসুদে পৌঁছার জন্য সমুদ্র বন্দরে অপেক্ষা করছে। আবাল-বৃদ্ধ- বণিতা যে মানব সন্তানদের নানা বিড়ম্বনার মধ্যে সময় কাটছে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ব্যাধি-বিপদ তাদের প্রতি মুহূর্তে গ্রাস করছে। কবি এর অর্থ প্রকাশ করেছেন রূপকভাবেঃ এভাবে ভারতের পরাধীন কোটি কোটি মানুষ অবৈধ ইংরেজ শাসনের যাঁতাকলে নিষণ সহ্য করে অপেক্ষা করছে স্বাধীনতা লাভের আশায়। কিন্তু তাদের সে স্বপ্নের স্বাধীনতা সূর্য কবে উদিত হবে? \ দুই \ রোমান্টিক কবি ফররুখ আহমদ স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন দেশের স্বাধীনতার। নেতৃত্ব দানকারী পাঞ্জেরীকে তাই বার বার তাগিদ দিচ্ছেন সচেতনতার সাথে। জিজ্ঞেস করছেনঃ রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে? সেতারা হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে সাতশত বৎসর সুখ-সমৃদ্ধশালী ছিল যে জাতি তারা আজ দুর্ভাগ্যের কারণে দু'শ বছর ধরে ইংরেজদের গোলামির জিঞ্জির পরে আছে। কবি মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর পরাজয় এবং পরবর্তীকালে শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের ভুল-ভ্রান্তির কারণে জাতির পরাধীনতা স্থায়ী হয়েছে মনে করেন। নেতার ভুল ও গাফলতির কারণে কষ্ট- জুলুম নেমে এসেছে এ জাতির ভাগ্যাকাশে। ১৭৫৭ সালে পলাশী প্রান্তরে ইংরেজদের হাতে এ দেশের স্বাধীনতা চলে যাওয়ার পেছনে এ দেশের অনেক নেতৃবৃন্দের বেঈমানী ও ভ্রান্তি রয়েছে বলে কবি মনে করেন। পরবর্তীতে প্রায় দু'শ বছরের আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদেরও অনেকের রয়েছে ভুল আর অলসতা। আর সে ভুলের কারণে কোটি কোটি মানুষের জীবনে নেমে এসেছে দুঃখ আর দুর্ভোগ। \ তিন\ ইসলামী আদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য এ জাতি আজ বিপদাপন্ন। কবির বিশ্বাস, মুসলমানগণের নেতৃত্ব সচেতন হলে ইসলামের নতুন চাঁদ আর কাঙ্ক্ষিত পতাকা সগৌরবে উড্ডীন হবে। দেশ থেকে দূর করতে হবে বিদেশী হায়েনাদের। জাতি পাবে পুনর্বার স্বাধীনতার সুখ। কবি ফররুখ স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে নেতাকে সচেতন করার উদ্দেশে বলছেন- আমাদেরই ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়েছে তাদের সেতারা শমী। কবি নেতার ভুল ভ্রান্তির সমালোচনা করেছেন। পুনরায় নেতার ভুল নেতৃত্বের কারণে দুর্ভাগ্যের রাত যেন নেমে না আসে জনগণের জীবনে। আজ জনগণের মধ্যে আর্তনাদ আর ক্ষুধার্ত মানুষের কান্না-হতাশা। আমরা জানি যে কোন বৃহৎ সংগ্রামে নেতৃবৃন্দ জাতিকে দেন নেতৃত্ব কিন্তু কর্মীবাহিনী থাকেন জনগণের পাশাপাশি, দুঃখ- কষ্টে বা মিছিলে। কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন সেই মিছিলের সৈনিক। তার কবিতায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে মজলুম মানুষের কথা। তিনি সচক্ষে দেখেছেন ১৩৫০ সালের দুর্ভিক্ষের চিত্র যা ছিল ভারতবাসী জনগণের উপর ইংরেজদের চাপিয়ে দেয়া দুর্ভিক্ষ। লাশ কবিতায় বাস্তবভাবে তুলে ধরেছেন সে ভয়াবহ ছবি। \ চার \ ‘পাঞ্জেরী বা নেতার কাছে কৈফিয়ত চাচ্ছেন কবি। এ কৈফিয়ত ক্ষুধার্ত নিপীড়িত লাখো মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে দিতে হবে। নেতা কোন ভুল-ভ্রান্তি করবেন বলে মেনে নেবেন না জনগণ ক্ষমা করবেন না তাকে। কবি চান পাঞ্জেরি বা নেতা কর্তৃক স্পষ্ট স্বাধীনতার আহবান। পাঞ্জেরী! জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রূকুটি হেরি দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ রোমান্টিক কবি হিসেবে পরিচিত। তাই বলে তিনি বাস্তবতার ধরাছোঁয়ার বাইরে আলাদা এক জগতে বাস করেননি। রোমান্টিক তার সাগরে অবগাহন করেও এক বাস্তব জগতের প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীকে এদেশ থেকে তাড়িয়ে এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ গড়ার স্বপ্ন কোন রোমান্টিক কল্পনা বিলাস নয়। প্রবন্ধকার মোহম্মদ মাহফুজউল্লাহ লিখেছেন : ‘ফররুখ ইসলামী আদর্শ ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ আর মুসলিম রেনেসাঁর রূপকার হলেও তার রচনার শোষিত বঞ্চিত ও ক্ষুধাতুর মানুষের বেদনা মূর্ত হয়েছে।' কবির অধিকাংশ কবিতায় দুঃখ-দুর্দশার বাস্তব চিত্র থাকলেও তার মধ্যে আছে আশার বাণী। কবি ছিলেন স্বপ্নচারী, তার স্বপ্নচারিত রোমান্টিকতা থাকলেও তাতে স্বপ্নবিলাসিতা প্রকাশ পায়নি। কবি বিশ্বাস করতেন এমন একটি সুন্দর রাষ্ট্র কায়েম হবে যেখানে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য থাকবে না। সুশৃক্মখল ক্ষুধামুক্ত ভালোবাসাবাসির এক সুন্দর দেশের স্বপ্ন কবি দেখেছিলেন। তার ‘পাঞ্জেরী' হলেন সেই সুন্দর দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের যোগ্য নেতা। ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘পাঞ্জেরী'তে ক্লান্তি ও জিজ্ঞাসার সুর ধ্বণিত প্রতিধ্বণিত হয় ধুয়ার মতো বারবার ঘুরে আসা একটি চরণে : রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী! অতল ক্লান্তির অনবদ্য পোরিক প্রতিমূর্তি এই কবিতা সম্ভবত গীতি কবিতাবলীর মধ্যে ফররুখের শ্রেষ্ঠ রচনা।’’ ফররুখ আহমদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তার লেখায় জাতীয় জাগরণের রূপ ফুটে উঠেছে। জাতীয় জীবনের অংশ আকাঙ্ক্ষা, মানবতার রূপ, আদর্শ সমাজের বাণী ফুটে উঠেছে। তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষতার নামাবলী পড়ে কবি ময়ূর পুচ্ছ পরে ময়ূর সাজতে চাননি। ঘৃণা করতেন পাশ্চাত্যের জড় মেকী সভ্যতাকে। কখনো বিচ্যুত হননি তার পথচলার আদর্শ থেকে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল ও নজরুলের মতো ফররুখ আহমদও তার লেখা কবিতাগুলোতে যথার্থভাবে আরবী- ফারসি শব্দের ব্যবহার করেছেন। এতে তার লেখার ভাবগাম্ভীর্য ও পরিবেশকে আরো বেশি সুন্দর ও সাবলীল করেছে। ‘পাঞ্জেরী' কবিতায় এ জাতীয় শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ফররুখ আহমদের ‘পাঞ্জেরী' কবিতাটি একটি সার্থক দেশাত্মবোধক কবিতা। সুত্র: দৈনিক সংগ্রাম সাহিত্য

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ