শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

শীতের সকালঃ-

ভূমিকা:

শীতকাল অন্যসব ঋতু থেকে আলাদা গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বাংলার রূপ বৈচিত্র্যের অনেকখানি জায়গা জুড়ে শীতের অবস্থান। হেমন্তের সোনালি ডানায় ভর করে হিমেল হাওয়া সাথে নিয়ে কুয়াশার রহস্যময় চাদর জড়িয়ে আসে শীত। শীত বাঙালির প্রিয় ঋতু। যেকোনো ঋতুই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল, এদেশের মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও মহিমাময়। এসব কিছুর পরেও মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে শীত যেন বিশেষ আদরের, দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে প্রাপ্তির আনন্দে উজ্জ্বল হলুদ পাতার ঝরা খামে চিঠি আসে শীতের। হিম-শীতল বাতাসে উত্তরের পথ ধরে ঘন কুয়াশার উত্তরীয় গায়ে প্রকৃতিতে শীতের আগমন। পিঠা পুলি আর খেজুর রসের মিষ্টি ঘ্রাণে বাংলার ঘরে ঘরে শীত বরণ হয়।

 

প্রকৃতিতে শীতের সকাল:

পৌষ-মাঘ এই দুই মাস মিলে শীতকাল। যদিও শীতের আমেজ শুরু হয়ে যায় হেমন্তের শেষে অর্থাৎ অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি থেকে। প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা ঘোষণা হয় বহু আগেই। শীতের সকালের রূপ অন্যসব ঋতু থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। হেমন্তের দিনগুলো শেষ হতে না হতেই শীতবুড়ি এসে প্রকৃতিতে হাজির। কুয়াশা কন্যারাও নির্জন বন-মাঠ আর নদীর কূলজুড়ে ছাউনি ফেলে। উত্তর দিগন্তে হিমালয়ের বরফচূড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে হিমশীতল নিঃশ্বাস। পৃথিবী কেমন যেন জড়সড় হয়ে যায় শীতে। বিবর্ণ হলুদ পাতারা চুপিসারে খসে পড়ে পথের ধুলোয়। শীতের দীর্ঘ রাতে কুয়াশার আবরণ গায়ে মেখে সুবহে সাদিকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি। গাছে গাছে তখন পাখিদের মুখরিত কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে জনমানবের। বাংলার শীতের সকাল সত্যিই বড় বৈচিত্র্যময়। গাছিরা খেজুর রস কাঁধে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে চলে পল্লী গাঁয়ে। পুবাকাশে কুয়াশা ঢাকা ম্লান রোদে উঠোনে পাটি বিছিয়ে ছেলেমেয়েরা কাঁচা রসে চুমুক দিয়ে শীতের আনন্দে ভাগ বসায়। বাড়ির আঙিনায় মাচার ওপর, খড়ের চালে শিশিরভেজা শিম, বরবটি, লাউ আর কুমড়ার গাছগুলো অপরূপ দেখায় শীতের সকালে। মাঠভরা সরিষার হলুদ ফুল মন কেড়ে নেয় প্রতিটি বাঙালির। মটরশুঁটি আর সবুজ ঘাসের ডগায় ঝুলে থাকে শিশির বিন্দু। কুয়াশার ঘন জাল সরিয়ে মিষ্টি রোদের সূর্য এসে নতুন মাত্রা যোগ করে শীতের সকালে। কবিমন তাই খুশিতে গেয়ে উঠে-“মেঘ ছিঁড়ে ধীরে ধীরে সূর্যের মুখরোদে রোদে ভরে দেয় জীবনের সুখ।”

 

শীত সকালে গ্রাম-বাংলা:

চারদিকে কুয়াশার বিস্তীর্ণ চাদর, বাংলাদেশের সবুজ গাঁয়ে কুয়াশার দৃশ্য আশ্চর্যজনক দেখায়। ঘন কুয়াশায় ডুবে থাকে সারা গ্রাম। কোথাও কিছু দেখার উপায় নেই। ঘরবাড়ি গ্রাম, জলাশয়, বাঁশঝাড় এবং বিশাল প্রান্তর জুড়ে কুয়াশা আর কুয়াশা। গাছের পাতা থেকে ঝরে পড়া কুয়াশার শব্দ মনকে বিমোহিত করে তোলে। শিশিরের ক্ষীণ শব্দ পেছনে ফেলে মন তখন ছুটে যায় তেপান্তরের কলাই ফুলের মাঠে। মাঠে মাঠে কাটা ধানের নাড়ায় জমে থাকে কুয়াশারা। খেজুর গাছের মাথায় ঝুলে থাকা মিষ্টি রসের হাড়িটি শীতের সকালকে করে তোলে কল্পনার রাজ্যের স্বর্গপূরীর মত। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির শেষ আঁচড় এটি। সকালের প্রথম রোদে জ্বলন্ত উনুনের পাশে বসে গরম ধোঁয়া উঠা ভাপা পিঠা আর খেজুরের রস শীতের সকালকে এনে দেয় এক অন্য রকম মাত্রা। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে তখন নতুন ধানের চালে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু সব শীতের পিঠা। অফুরন্ত অবসর তাই গ্রাম বাংলার প্রকৃতিতে শীত যেন এক অকৃপণ দাতা। হিমশীতল স্পর্শে কাঁপিয়ে দিয়ে যায় বাংলার গ্রাম। তখন দল বেঁধে আগুন জ্বেলে তাপ নেয়া বা সকালের রোদ গায়ে মেখে দুপুর গড়িয়ে দেয়া যেন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। কবির কণ্ঠেও তাই সূর্যের বন্দনা-

হে সূর্য! শীতের সূর্য!

হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতিক্ষায় আমরা থাকি।’